দৃ ষ্টা ন্ত : সৎ দুই বাসশ্রমিক এবং সাদা মনের ইতিবৃত্ত
ধন ও জ্ঞানের বড়াই মানুষের কম নয়। এ বড়াই সব যুগেই অল্পবিস্তর ছিল, এখনও আছে। কিন্তু প্রকৃত মনুষ্যত্ব ও সততার দীক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ইসলাম মানুষকে যে মরুওয়্যত ও সাদাকাতের শিক্ষা দিয়েছে সে শিক্ষার জ্যোতি প্রকাশের জন্য একজন নিম্ন আয়ের অতি সাধারণ ভালো মানুষই যথেষ্ট। বরং দেখা যায়, ধন-জ্ঞানের গম্যি নিয়ে সমাজের ওপরতলায় যারা বাস করেন তাদের জীবনের বহু ভেজাল ও দূষণ থেকে মুক্ত থাকার নীরব গৌরব পোষণ করেন এসব অতি সাধারণ ভালো মানুষেরাই।
গত ২২ জুনের একটি দৈনিকে এরকম একটি খবরই ছাপা হয়েছে। গাড়িতে ফেলে যাওয়া নগদ দুই লাখ টাকা প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় কুমিল্লার পুলিশ সুপার তাদের পুরস্কৃত করেছেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার বলেছেন, জাতি গঠনে সৎ মানুষের বড়ই অভাব। কঠিন দারিদ্রসীমায় বসবাস করেও বাসশ্রমিক দুলাল ও ইউসুফ খান বড় অংকের নগদ টাকা হাতে পেয়ে নির্লোভ ও সততার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আজকের সমাজে তাদের এ সততা সত্যিকার অর্থেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। আর এ গুণী মানুষদের সম্মানিত করে পরোক্ষভাবে পুলিশ বিভাগই সম্মানিত হয়েছে।’
কুমিল্লার পুলিশ সুপারের এই উপলব্ধি, অভিব্যক্তি ও অভিনন্দন নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে। আমানত ও সততার প্রকৃত পুরস্কার তো আল্লাহ তাআলাই দিবেন। কিন্তু সততার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ একটি সুস্থ সমাজের পরিচয়। এ পরিচয় যে সমাজের নেই সে সমাজে সততার প্রাণ বড়ই নিভু নিভু হয়ে জ্বলতে বাধ্য হয়। বিশেষত এ দেশে ‘তেলাল মাথায় তেল’ দেওয়ার একটি বহু চর্চিত নিয়ম রয়েছে। পয়সা কড়ির মালিক কিংবা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো জনকে অনেক সময় ‘নাই’ কাজের জন্যও বাহবা দেওয়া হয় মুখ ভরে। কিন্তু দু’জন নিম্নবিত্ত বাসশ্রমিকের সততার জন্য তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরষ্কার দিয়ে দেশের তেলতেলা নিয়মটাও ভাঙ্গা হয়েছে এ ঘটনায়। এটিও প্রশংসনীয় ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যবাহী।
এ সমাজে বিরাজমান হাজারো চোর-বাটপার ও অসৎ লোকের ভিড়েও এরকম নির্লোভ দুলাল ও ইউসুফ খানের সংখ্যা নিঃসন্দেহে কম নয়। কিন্তু তাদের ইতিবাচক কাজ ও পদক্ষেপকে পুরস্কৃত করা হয় না, প্রচার দেওয়া হয় না এবং সুন্দর দৃষ্টান্তগুলোকে সামনে আনা হয় না। বরং এসব ক্ষেত্রে কোনো পুরস্কারমূলক আয়োজন থাকলেই ধান্ধার দুর্গন্ধ নাকে আসে। একটি বহুজাতিক কোম্পানি কিছুদিন যাবৎ ‘সাদামনের মানুষ’ খোঁজার নামে দেশে এরকম একটি পক্ষপাতমূলক, ধান্ধাকাতর উদাহরণ সামনে নিয়ে এসেছে। সারা দেশে খুঁজে তারা যে ক’জন ‘সাদা মনের মানুষ’ চিহ্নিত করেছে সেখানে বেশি সংখ্যকই হচ্ছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। তার চেয়ে বড় কথা ইসলামী অনুশাসন পালনকারী কোনো মানুষই যেন ‘সাদা মনের অধিকারী’ হতে পারে না, এমন একটি আবহ তারা প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন। পয়সা তাদের, বিচারক তারাই, সুতরাং কার মন সাদা আর কার মন ময়লা এ সিদ্ধান্ত তারাই নিতে পারেন। এজন্য টাকাকড়িরও বিলি-বিতরণ করতে পারেন। বাঁধা দিবে কে? কিন্তু তারা যখন এ বিষয়টি নিয়ে মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার চালান তখন তাদের অন্তর্নিহিত মতলব নিয়ে সন্দেহ জেগে উঠাই স্বাভাবিক। একটি শ্রেণী বা এক রকম কিছু মানুষকে হাই লাইট করে দেশের বহু সৎ ও সাদাকে কালো বানানোর একটি গায়ে পড়া কসরৎ তাদের কৌশলে ফুটে ওঠে। ধান্দার দুর্গন্ধ এখান থেকেই পাওয়া যায়।
এ কারণেই কুমিল্লার দুই বাসশ্রমিকের সততার ঘটনা এবং সেজন্য তাদের পুরস্কৃত ও অভিনন্দিত করার ঘটনাকে আমরা ইতিবাচক ও সরল দৃষ্টিতে দেখতে চাই। ‘সাদা মন’ নিয়ে ব্যবসাবাজির এই যুগেও সততার প্রকৃত কোনো ঘটনা, সত্যিকারের কোনো সৎ লোককে মূল্যায়নে আমাদের সমাজ যেন পিছপা না হয়-আমরা সচেতন দেশবাসীর প্রতি সে আহবান রাখতে পারি।