বইয়ের গল্প
আরবী ভাষার একজন প্রসিদ্ধ কবি হলেন আবুত তাইয়্যেব মুতানাববী (৯১৫-৯৬৫)। দিওয়ানে মুতানাববী নামে তার কাব্য-গ্রন্থ আরবী সাহিত্যের অঙ্গনে সুপরিচিত। গ্রন্থ সম্পর্কে মুতানাববীর একটি প্রসিদ্ধ পংক্তি আছে।
أعز مكان في الدنيا سرج سابح + وخير جليس في الزمان كتاب
‘অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানের স্থান হল দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠ। আর সময়ের সর্বোত্তম সঙ্গী হল গ্রন্থের পাতা।’ এই গ্রন্থ ও গ্রন্থ-পাঠ প্রসঙ্গে কিছু গল্প।
এক খলীফার একজন জ্ঞানী সহচর ছিল। তার সঙ্গে খলীফা বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন, আবার অবসর সময়ে গল্প-সল্পও করতেন। এক রাতে খলীফা তাকে ডেকে পাঠালেন। দূত এসে দেখল, তিনি অধ্যয়নে মগ্ন। আর তাঁর চারপাশে অনেক বইপত্র। দূত আদবের সঙ্গে খলীফার তলব জানাল। জ্ঞানী লোকটি বললেন, তাঁকে গিয়ে বলবে, এখানে অনেক পন্ডিত-মনীষী সমবেত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে আমি আসছি। দূত ফিরে গেল এবং খলীফাকে কথাটা বলল। খলীফা কিছুটা রাগতস্বরে বললেন, কারা এমন জ্ঞানী-গুণী ওখানে সমবেত হয়েছেন যে, তিনি আমার ডাকেও সাড়া দিতে বিলম্ব করছেন? দূত বলল, আমীরুল মু’মিনীন, আমি কিন্তু তাঁর ওখানে কাউকে দেখিনি। খলীফা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, আচ্ছা! তিনি কি তাহলে অসত্যও বলেন? যাও, এখনি তাকে উপস্থিত হতে বল। দূত দ্বিতীয়বার এলে জ্ঞানী লোকটি খলীফার দরবারে উপস্থিত হলেন। খলীফা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ওখানে কে কে এসেছেন? তিনি তখন কয়েকটি পংক্তি পড়লেন, যার তরজমা এই-
তাঁরা সুজন সুহৃদ কাছে হোক কিবা দূরে/তাদের সুদীর্ঘ আলাপচারিতা আনে না/ক্লান্তি, কিংবা বিরক্তি; এনে দেয় প্রশান্তির ছোঁয়া/চিন্তার বলিরেখা দূর হয়ে যায়/তাঁদের অমর বাক্যসূধায়/আসে বল, আসে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আর/অতীতের ছবি আঁকা হয়ে যায়/তাঁরা সরল-হৃদয়, সংশয়হীন তাই/নেই কোনো ভয়, নেই শঙ্কা/হাতে ও জিভে বিষ ছড়াবে-নেই এমন কোনো আশঙ্কা/যদি বল, তারা নির্বাক, নির্জীব তবে মিথ্যা বলনি/আর যদি বল, সবাক-সজীব তবেও নির্বোধ নও। খলীফা বুঝলেন, তিনি জ্ঞানী-গুণী বলে বইদের বোঝাচ্ছেন। তাই তার বিলম্বে আগমনে দোষ নিলেন না।
কিন্তু সুহৃদ যতই অন্তরঙ্গ হোক, তার উপর সর্বদা নির্ভরশীল হয়ে থাকা কি ভালো? মানে বই থেকে ভালো ভালো বিষয়গুলো আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো মুখস্থ করে ফেলতে হবে। তা না হলে কিন্তু পরিহাস হবে ললাট-লিখন। যেমন শায়খ ছাওলীর হয়েছিল।
আবু সায়ীদ উকায়লী একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি দেখলেন, শায়খ ছাওলীর ঘরভর্তি বই। তাকে তাকে সাজানো। নানা রংয়ের বাঁধাই। এমন নয় যে, ছাওলী আলেম বা জ্ঞানী ছিলেন না। তবে বই-নির্ভরতা তার মধ্যে ছিল বেশি। কোনো বিষয়ে প্রয়োজন হওয়া মাত্রই বলতেন, বৎস, ওই বইটা আন তো দেখি! তার এই সার্বক্ষণিক বই নির্ভরতা লক্ষ করে আবু সায়ীদ উকায়লী বললেন, মনে হচ্ছে আপনি নন, আপনার এই বইগুলোই আলেম। ছাওলীকে লক্ষ করে উকায়লীর পরিহাসমূলক কয়েকটি পংক্তির তরজমা :
ছাওলী এক শায়খ/তাঁর আছে জ্ঞানী জ্ঞানী বই/যখনই তার কাছে যাই/জানতে কোনো বিষয়/বলেন তিনি, ওহে ছেলেরা/আন দেখি বইয়ের বোঝাটা।
তাই বই পড়তে হবে এবং বইয়ের জ্ঞান আত্মস্থ করতে হবে। কিন্তু সব বই কি পড়ার মতো। সব বই কি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করে? করে না। কিছু বই আছে যা মানুষকে জ্ঞানের বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে যায়, যেমন দূরে নিয়ে গিয়েছিল এক। তাহলে বলি ঘটনাটা।
এক রাজা সম্পর্কে কথিত আছে যে, তিনি একদিন তার উজীরকে বললেন, আমাকে কিছু বই এনে দাও তো। উজীর তার লোকদেরকে বলল, যাও, রাজার জন্য ভালো কিছু বই সংগ্রহ কর। তবে বইগুলো এনে আগে আমাকে দেখাবে। যাকে পাঠানো হল তিনি জ্ঞানী লোক ছিলেন। তিনি ভালো ভালো কিছু বই সংগ্রহ করলেন যেগুলো একজন রাজার পড়া উচিত। যেমন পূর্ববর্তী রাষ্ট্রনায়কদের রাজ্যশাসনের ইতিহাস, মন্ত্রী-উজীরদের সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতা, কর-খাজনা ইত্যাদি সংগ্রহের কলাকৌশল ইত্যাদি। উজীর যখন বইগুলো দেখল বলল, সেরেছে! তুমি দেখছি আমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। উজীর-নাজিরের কার্যকলাপ আর রাজ্য শাসনের কলাকৌশল-এত কিছু রাজার জানার দরকার কী। যাও দেখি বাপু, কিছু গল্প-উপন্যাস আর কবিতার বই এনে দাও। এগুলোতেই তাঁর সময় কাটবে ভালো।
আমার কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না? মনে মনে ভাবা হচ্ছে, গল্প-উপন্যাস কি আর সে যুগে ছিল? কেন থাকবে না, অবশ্যই ছিল। ধরন-ধারনে পার্থক্য ছিল, কিন্তু মূল বিষয়টা ছিল। ইতিহাসের এ গল্পটা যিনি বলেছেন তার মূল আরবী বাক্যটা লক্ষ কর-
‘হিকায়াতুন তুলহীহ ওয়া আশআরুন তুতরিবুহ্’। ‘গল্প-উপন্যাস ও কবিতার বই’ ছাড়া এ শব্দগুলোর আর কী তরজমা হতে পারে শুনি?
আমাদের চারপাশে যদি তাকাই তো এমন ‘সময়-কাটানো রাজার’ মুখ অনেক দেখতে পাই। আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে কিন্তু চালবাজ ‘উজীর’রা আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে।
হয়ত বলবে, ভালো বই না পড়লে কি সর্বনাশ হয়? হয়, একেবারে চরম সর্বনাশ হয়। যে বিষয়ে আমি বড় হতে চাই, বড় হয়ে কাজ করতে চাই সে বিষয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য আমাকে প্রচুর পড়তে হবে। না পড়লেই সর্বনাশ। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে বলছি সর্বনাশের গল্পটা। বলেছেন আহমাদ দীদাত। তার রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ হয়ে এসেছে। ওখান থেকেই তুলে দিচ্ছি :
‘ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও ইসরায়েল সম্মিলিতভাবে তাদের অপারেশন থ্রি মাসকেটিয়ার্স পরিচালনা করে ১৯৫৬ সালে। সাকতাই তেভিত রচিত মোসে দায়ানের জীবনীগ্রন্থে লিখেছেন যে, ১৯৫৬ সালের সিনাই অভিযানের পরিকল্পনা সৈন্যবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে তিনিই তৈরি করেছিলেন, আর বাস্তবায়নও তিনি করেছিলেন। ঐ বইয়ের ২৬৭ পৃষ্ঠায় দায়ান ইসরাইল বাহিনীর অভিযানের পরিকল্পিত মানচিত্র প্রকাশ করেছেন।
এই অভিযানের সফলতায় তিনি এতখানি গর্বিত যে, বলেছেন, প্রয়োজন হলে পুনরায় তিনি সেই পরিকল্পনা অনুসারেই আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। সত্য কথা বলতে কি ১৯৬৭ সালে পাঠ্যপুস্তকের ছকমত তিনি মিসরীয় বাহিনীকে একইভাবে পর্যুদস্ত পরাভূত করেছিলেন। দায়ান নিশ্চিত জানতেন, কোনো আরব তার জীবনীগ্রন্থ পাঠ করবে না। অথচ এই বই পড়লে তারা জানতে পারত তাদের চাচাতো ভাইয়েরা তাদের সর্বনাশ করার জন্য কী পরিকল্পনা করেছে।’
আমরা সব সময় মনে রাখব, বড় হতে হলে আমাদেরকে তিনটি কাজ করতে হবে। পড়া, পড়া এবং পড়া। তবে অবশ্যই সে পড়া বড়দের মাধ্যমে নির্বাচিত ও নির্দেশিত হতে হবে।