স্বা গ ত ম : রমযানের প্রশাসনিক প্রস্ত্ততির কথা
আসন্ন রমযান মাসে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওএমএসের মাধ্যমে খোলা বাজারে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ২২শে জুলাইয়ের সংবাদপত্রে খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাতে যে সংবাদ ছাপা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, এ কার্যক্রম আগস্টের শেষ সপ্তাহ অর্থাৎ রমযানের ১০ দিন আগে থেকেই শুরু হবে। শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রধান এলাকা থেকে নিয়ে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এ কার্যক্রম সপ্তাহে ৬ দিন চলবে এবং একাজে ৫০টি ট্রাক ব্যবহৃত হবে।
অস্থিতিশীল ও ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূলের এই সংকটকালে এ ধরনের সিদ্ধামত্ম কেবল রমযান মাসের জন্য নির্ধারিত না করে সারা বছরের জন্য করা উচিত। তবুও রমযান উপলক্ষে বিশেষভাবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিঃন্দেহে প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ। তবে এর সংগে এটিও সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রাখা দরকার যে, চাল প্রধান খাদ্য হলেও নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের তালিকায় রয়েছে ভোজ্যতেল, ডাল, লবণ, চিনি এবং কাঁচা বাজার। সেজন্য মূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রোগ্রামে কেবল চালকে গুরুত্ব দিয়ে অন্য সব পণ্যের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে গেলে চলবে না। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র ও হতদরিদ্র শ্রেণীর সবাই এ সব পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে প্রায় প্রতি রমযানেই হিমশিম খেয়ে থাকেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এখনই খাচ্ছেন। সে জন্য অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্য চেক দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখন থেকেই নেয়া উচিত। কয়েকদিন আগে এ লক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সংগে মিটিংয়ে বসার সংবাদ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। আমদানী, উৎপাদন, সবরাহের প্রতিটি পর্যায়ে জটিলতা চিহ্নিত করে সহজীকরণের আগাম পদক্ষেপ যেমন এখন থেকেই নেয়া যেতে পারে তেমনি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজি প্রতিরোধে কৌশলী ও দৃষ্টান্তমূলক মনিটারিংয়ের প্রোগ্রাম গ্রহণ করা যেতে পারে। তাহলে এর সুফল রমযানে কিছু না কিছু অবশ্যই পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
রমযান মাস উপলক্ষে রোযাদার মুসলিম নাগরিক সাধারণের জন্য সরকারের অন্যতম করণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও প্রকাশ্য খাদ্যখানার আয়োজন বন্ধ করা। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর নীতি ও প্রোগ্রামে কিছু জরুরী ‘পালনীয় পরামর্শ’ প্রদান, সিনেমা হল, সিনেমার পোষ্টার ও বিলবোর্ডগুলোর চিত্র বিষয়ে কিছু সেন্সর আরোপ করা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ ও আচ্ছাদিত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রকাশ্যে চা পান, ধূমপান বন্ধ রাখার নিয়ম চালু করা যায়। এতে রমযানের পবিত্রতা যেমন রক্ষিত হবে তেমনি রোযাদার মানুষেরা বিড়ম্বনার কবল থেকে বাঁচতে পারবেন। দলমত নির্বিশেষে দেশের বেশীর ভাগ মুসলিমই রোযা রাখেন। তার মানে দেশের অধিকাংশ রোযাদার- সংযমী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশের একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আয়োজন এভাবে গড়ে তোলা যায়। এতে ভালো কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি না হলেও বহু মানুষ স্বস্তি ও উপকৃত বোধ করার সুযোগ পাবেন।
একই রকম আরেকটি বিষয়ের প্রতি অনেক সময় প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়া হয় না। সেটি হচ্ছে লোডশেডিংয়ের শিডিউল। বিগত কোনো কোনো রমযানে দেখা গেছে, ঠিক ইফতারীর সময়ের আধাঘন্টা, সেহরীর সময়ের আগে-পরে এক আধ ঘন্টা এবং এশা ও তারাবির নামাযের সময়ের ঘন্টাখানেক সময়কেই ঢাকাসহ দেশের বহু এলাকায় লোডশেডিংয়ের আওতায় রাখা হয়। অথচ সারা দিনের অন্য সময় দেখা যায় লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা নেই। রোযাদারের জন্য লোডশেডিংয়ের এ শিডিউলটা যে কত মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী সেটা সহজেই
অনুমানযোগ্য। দেশে চরম বিদ্যুতের ঘাটতি আছে এটি তো সত্য। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার মতো নয় এবং এ কারণে লোডশেডিং-ও অনিবার্য ।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিটি এলাকায় গড়ে দুই থেকে তিন ঘন্টা লোডশেডিংয়ের আওতাভুক্ত হলে তার জন্য দিনের বেলার কিছু সময় এবং রাত এগারটার পরের কিছু সময় নির্ধারিত করা যায়। কোনো অবস্থাতেই যেন ইফতার, সেহরী, তারাবির সময়ে দেশের কোনো এলাকাতেই লোডশেডিং না হয়- এব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগকে আগাম সতর্ক করা হলে রোযাদার মানুষের জন্য সরকার তার করণীয় কাজটি করতে পারবেন। রমযানে ব্যাপকভাবে করণীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ব্যাপক যানজটের দুর্ভোগকে কমিয়ে আনা। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ট্রাফিক-মতামত নিয়ে একটি সুবিন্যস্ত প্রোগ্রাম গ্রহণ করা যায়। বিশেষত রমযানের বিকেল-সন্ধ্যায় রাজপথ অনেকটাই স্থবির ও জমাটবদ্ধ হয়ে যায়।
ঘরমুখো বহু মানুষ দেড়-দু’ঘন্টা পথে থেকেও ইফতার করতে বাধ্য হন বাসের রড ধরে ঝুলে থেকে। রমযানে ব্যাপক যানজটের প্রধান প্রধান কারণ ও বিশেষ বিশেষ সময়ের চাপ চিহ্নিত করে ট্রাফিকিংয়ের বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারলে রমযানকেন্দ্রিক বিশেষ সুব্যবস্থাপনার একটি নজির স্থাপন করার দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারে সরকার। খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অশ্লীলতা বন্ধ, লোডশেডিংয়ের সুচিন্তিত শিডিউল নির্ধারণ এবং দুর্বিষহ যানজট কমিয়ে আনার বিষয়গুলো নাগরিকদের সব সময়েরই দাবি। তবুও যদি রমযানকে উপলক্ষ করেও এ দাবির কিছুটা পূরণ করার একটি ট্রায়াল হয়ে যায় তাহলে বছরের বাকী সময়েও ইতিবাচক দাবিগুলো পূরণ হওয়ার পথ রচিত হতে পারে।