প্র তি বে শী : বিএসএফের বর্বরতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে
১৭ জুলাই রাত থেকে নিয়ে ২০ জুলাই সকাল পর্যন্ত সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক চলেছে নির্বিকার বাংলাদেশী হত্যাযজ্ঞ। ১৭ জুলাই রাতে চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ব্রাশফায়ার করে দু’জন বিডিআর জওয়ানকে হত্যা করা হয়। এদেশের সংবাদপত্রে এ নির্মম আগ্রাসী হত্যাযজ্ঞের খবর ছাপা হয় ১৯ জুলাই তারিখে। সংবাদ মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি ওইদিন যখন দেশের দেশপ্রেমিক সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ও প্রকাশিত হয় তখন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ওই দিনই আবারো দু’জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করে যশোরের চৌগাছা সীমান্ত এলাকায়। আর গত ২০ জুলাই ভোরে বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্ত অঞ্চলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে আরো একজন বাংলাদেশী যুবককে। এই ৫টি হত্যাকান্ডসহ গত ৬ মাসে বিএসএফ মোট ৭৮জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। তাদের এই বেপরোয়া বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিরতি কোথায় গিয়ে ঘটবে- এখনো সে সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
গত ১৭ জুলাই ছিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। এ বৈঠকের লক্ষই ছিল দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানো ও সহযোগিতা বৃদ্ধি, কিন্তু প্রথম দিনের বৈঠক সমাপ্তির রাতেই বিএসএফ কর্তৃক দু’জন বিডিআর জওয়ানকে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে ভারতের মুখোশপরা বন্ধুত্বের স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে গেছে। এরও পর আবারো দু’জন কৃষক ও একজন বাংলাদেশী যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, এ হত্যাকান্ডগুলো কেবল সীমান্তে পড়ে থাকা বিএসএফের নিজস্ব ‘অসংযমী আচরণ’ নয়, বরং আক্রোশমূলক রাষ্ট্রীয় পলিসির অংশ হিসেবেই ঘটনাগুলো একের পর এক তোয়াক্কাহীনভাবে ঘটানো হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, এবারের দিল্লী বৈঠকে ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশের মিডিয়ার ‘অতি প্রচারণা’ এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ্য বহিঃপ্রকাশের ফলে ভারতের তীব্র অসন্তুষ্টির একটি ‘নিদর্শন’ স্থাপন করা হল এ কয়েকটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে। যদিও প্রথম পর্যায়ে বিডিআর হত্যার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পরপর আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এটিকে ‘মারাত্মক ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং বিএসএফের হত্যাযজ্ঞকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে আখ্যায়িতও করা হয়েছে, তথাপি দেখা গেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব প্রতিবাদ ও মন্তব্যের কোনো পাত্তাই দেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে পরের দু’দিন আরো ৩টি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তারা।
ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট চায়-এ নিয়ে এবারের দিল্লী বৈঠকের আগে ভারতীয় হাই-কমিশনার ঢাকায় খোলাখুলি প্রেশার দিয়ে কথা বলেছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ ভারতের কাছে চায় বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, পানি বণ্টনের পূর্ব চুক্তি রক্ষার অঙ্গীকার এবং দু'দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মতো কিছু ন্যায্য বিষয়। দিল্লী বৈঠকের প্রথম দিন (১৭ জুলাই) উভয় পক্ষের এজেন্ডা নিয়েই কথাবার্তা হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ট্রানজিট প্রশ্নে এদেশের প্রতিনিধিরা ভারতকে কোনো কথা না দেয়ায় ভারতীয় পক্ষে নীরব রুষ্টতা ছড়িয়ে পড়ে। বিএসএফের আচরণে লাগাতার সেই রুষ্টতার আলামত ঝরে পড়েছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ভারতীয় এজেন্ডাগুলোর চেয়ে বাংলাদেশী এজেন্ডাগুলো ছিল অধিক যুক্তিসঙ্গত এবং পূর্ব ধারাবাহিকতা সম্পন্ন। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আলোচনা ও বার্গেনিঙে আর আগে না বাড়তে দেয়ার কৌশল হিসেবেও বিএসএফ দিয়ে একের পর এক বর্বরতাগুলো ঘটিয়ে সেগুলো নিয়ে এদেশের মানুষ ও সরকারকে ব্যস্ত রাখার পথটি ভারত সরকার বেছে নিয়েছে।
গত কয়েকদিনে আমাদের সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যার পেছনে মূল কারণ যাই থাকুক, সত্য হচ্ছে এই যে, বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যা প্রায় নৈমিত্তিক একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যন্ত ২০০৮ সনেই কেবল বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে ৭৮ জন বাংলাদেশী। ‘অধিকার’ নামক সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে গত সাড়ে ৮ বছরে বিএসএফ ৭০৭ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সুতরাং একটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অবস্থান ও আচরণকে নিরপেক্ষভাবে যে কেউ আগ্রাসী বললে তাকে দায়ী করা যায় না। একইভাবে এ ধরনের চরিত্রের প্রতিবেশীর সঙ্গে সতর্কতাপূর্ণ সম্পর্কের বাইরে নিরাপত্তা ঝুঁকিসম্পন্ন কিংবা দীর্ঘ অর্থনৈতিক লাভালাভের হিসাব সম্বলিত কোনো চুক্তি কিংবা বোঝাপড়ায় যাওয়ার আগে এদেশের কর্তৃপক্ষকে অন্তত সাতবার চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। এ পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক আরেকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখ্য। সেটি হচ্ছে, এ ঘটনায় ইতোমধ্যে দেশের ছোট-বড় প্রায় সব মহলই ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করলেও কথায় কথায় যারা এদেশের স্বাধীনতার কৃতিত্ব বগলদাবা করতে অভ্যস্ত সেই চিহ্নিত মহলটির কাউকেই আজ পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি। না রাজনৈতিক শক্তিকে, না তাদের সুশীল, সাংস্কৃতিক কিংবা বুদ্ধিজীবী সমাজকে। এটিকে একটি চূড়ান্ত রহস্যময় ঘটনা বললেও কম বলা হবে।
২০ তারিখের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় ছিল বিএসএফের বর্বর হত্যাকান্ডের নিন্দা এবং নিন্দাসূচক নিউজ ও সম্পাদকীয়। কিন্তু একই সঙ্গে আরো দু’টি ঘটনার নিউজ এ প্রজন্মের দেশবাসীকে ব্যাপকভাবে হতাশ করেছে। এক. ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবীকারী ’৭১-এর সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ১৯ জুলাই (যেদিন
বিএসএফ কর্তৃক নিহত বিডিআর ২ জওয়ানের ছবি পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে) ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে ‘৭১ -এর যুদ্ধাপরাধীদেরকে আসন্ন স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠনের সভায় লাঞ্ছিত এক মুক্তিযোদ্ধার
লাঞ্ছনার বিচার চেয়েছেন। কিন্তু ওই সম্মেলনে উপস্থিত সেক্টর কমান্ডারদের কেউই ১দিন আগে আগ্রাসী ভারতের ব্রাশফায়ারে দু’জন দেশপ্রেমিক বিডিআর জওয়ান নিহত হওয়া এবং দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত করা নিয়ে টু শব্দটি করেননি। দেশপ্রেমের কথা বলে ৩৭ বছর আগের ইস্যু নিয়ে দেশ গরম করার কর্মসূচী যখন-তখন
বিতরণ করলেও এই সব মুক্তিযোদ্ধা নেতা এবং এদের মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এখন দেখা যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী বৃহৎ দেশটি আমাদের সার্বভৌমত্বের গলা টিপে ধরলেও কোনো কথা বলতে তারা লজ্জা পান। মুখ ও মাথা গুটিয়ে রাখেন। এ বাস্তবতা সামনে থাকায় প্রশ্ন জাগতেই পারে- এরা কি তাহলে এখনও দেশপ্রেমিক? নাকি দেশপ্রেমের দাবিতে যত তুবড়িই এখন ছুটান আসলে তারা বাইরের কোনো প্রভাবশালী শক্তির তল্পিবাহী? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। ভারতীয় সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ মারা গেলে এদেশে যারা বেদনায় অশ্রু ঝরান এবং স্মরণসভা করেন তাদের কাছে কি এদেশের সীমান্তরক্ষী দুই সাহসী বিডিআর সদস্যের
জীবন একদম মূল্যহীন? দেশরক্ষায় তাদের জীবনদানের কি কোনোই তাৎপর্য নেই? হতাশা সৃষ্টিকারী দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে, বিএসএফ কর্তৃক বিডিআর হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ মিছিল করায় ‘ছাত্রমুক্তি’ নামক একটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে এদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও স্বাধীনতার কান্ডারী হিসেবে দাবীদার রাজনৈতিক দলটির ছাত্র সংগঠন। বিডিআর হত্যার প্রতিবাদে যারাই কথা বলুক, তাদেরকে যারা হামলা করে তারা কি এদেশীয় শক্তি? তারা কি এদেশে বসবাসকারী অথচ অন্য রাষ্ট্রের প্রকাশ্য এজেন্ট? প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা এখন কম জরুরি নয়।
ভারতের সঙ্গে যে কোনো সমঝোতার ভালো-মন্দ, দেশের নিরাপত্তার নানা ইস্যু এবং দেশবিরোধী চক্রের ডালপালা সম্পর্কে সজাগ হওয়ার অনেকগুলো আলামত পাওয়া গেল গত ১৭ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত। এসব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের
সুচিন্তিত অথচ দৃঢ় ও দ্রুত সিদ্ধান্ত আমরা কামনা করতেই পারি।