Shaban-Ramadan 1429   ||   August 2008

তাসাওউফ সম্পর্কে প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতা

মাওলানা মুহাম্মদ মনযুর নুমানী

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সেই বুযুর্গ এ সম্পর্কে তিনি আরো বললেন- আল্লাহই জানেন, লোকেরা তাসাওউফকে কী মনে করে। তাসাওউফ তো শুধু ইখলাস ও ইশক পয়দা করার মাধ্যম। আর যে কাজ ইশকের শক্তি দ্বারা এবং ইখলাসের বরকতে সম্পন্ন হয় তা ইশক ও ইখলাস ব্যতীত হতেই পারে না। তাহলে বোঝা গেল, তাসাওউফ মূল বিষয় নয়, ইশক ও ইখলাস হল মূল বিষয়। আর এ বিষয়গুলো অর্জন করার পথে যেহেতু তাসাওউফ সহায়ক তাই এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সুতরাং যদি কারো ইশক ও ইখলাস অর্জনের জন্য এর চেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত অন্য কোনো পন্থা জানা থাকে তাহলে সেটা তার জন্য মুবারক। তিনি সেই পন্থাতেই এটা অর্জন করতে পারেন এবং আমাদেরকেও সে পন্থা বাতলে দিতে পারেন। আমরা তো এ প্রসঙ্গে যিকর-শোগল-এর পন্থাই জানি, যে পন্থা আল্লাহ পাকের হাজার হাজার সত্যিকারের বান্দা শত বছর ধরে পরীক্ষা করেছেন। যাদের মধ্যে এমন শত শত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যারা এ বিষয়ে মুজতাহিদ ইমাম ছিলেন এবং ইলহামেরও অধিকারী ছিলেন।

 

আমি বললাম- যে ব্যক্তি পূর্ব হতেই কোনো দ্বীনী কাজে মশগুল রয়েছে, কিন্তু সে অনুভব করে যে, আল্লাহ পাকের ইশক ও ইখলাস তাঁর নসীব হয়নি তাহলে কি সে কিছু দিনের জন্য ঐ কাজ ছেড়ে প্রথমে এই ইশক ও ইখলাস অর্জন করবে? না কি এটাও সম্ভব যে, সে যে কাজ করছে সেটাও করতে থাকবে এবং সাথে সাথে ইশক ও ইখলাস অর্জন করার সাধনাও করবে? সেই বুযুর্গ বললেন- হ্যাঁ, হতে পারে। অবশ্য কারো কারো অবস্থা এমন হয় যে, তাদের জন্য (সবকিছু ছেড়ে) কিছু দিন একাগ্রতার সাথে এ কাজে লিপ্ত হওয়া আবশ্যক হয়।

 

আমি বললাম, এ জন্য বাইআত হওয়া কি জরুরি? তিনি বললেন, না, কখনো নয়। আগ্রহ ও আস্থার সাথে মুহাববত ও সোহবত আবশ্যক। বাইআত তো শুধু সম্পর্ক ও আস্থা প্রকাশের জন্য করা হয়। তা না হলে আসল উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বাইআতের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।

আমি বললাম, তাহলে আমাকেও কিছু শিখিয়ে দিন। সেই বুযুর্গ বললেন, মৌলবী ছাহেব! হাদীস শরীফে এসেছে- যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয় তাকে আমানতদার হতে হয় এবং  পূর্ণ বিশ্বস্ততার সাথে পরামর্শ দিতে হয়। তাই আমি আপনার জন্য উত্তম মনে করি, আপনি এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য অমুক অথবা অমুক বুযুর্গের নিকট যান। তাদের উপর আল্লাহ পাকের খাস রহমত আছে। আপনার মতো আলেমের জন্য আমি তাঁদেরকেই যোগ্য মনে করি। আমি বললাম, ঐ দুই বুযুর্গের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পূর্ব হতেই আমার    অন্তরে ছিল। এখন হযরতের বলার কারণে আরো বেড়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু আমার মধ্যে এখনো তেমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি তাই আমি এ পথে হযরতের রাহনুমায়ীই উত্তম মনে করছি।

 

সেই মহান বুযুর্গ স্বীয় মুহাববত ও স্নেহ প্রকাশের সাথে সাথে একবার অথবা দুইবার ঐ বুযুর্গের কথাই বললেন। কিন্তু যখন আমি আদবের সঙ্গে নিজের মতের ব্যাপারে চাপাচাপি করলাম, তখন তিনি আমার আবেদন কবুল করলেন এবং আমার কর্মব্যস্ততার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রেখে যিকর ও অন্যান্য আমলের অতি সংক্ষিপ্ত কর্মসূচী আমার জন্য নির্বাচন করলেন। আমিও সেগুলো পালন করতে শুরু করলাম।

 

এরপর সম্ভবত আমি আরো চার-পাঁচ দিন সেখানে অবস্থান করলাম। পরে যখন অনুমতি নিয়ে বিদায় নিচ্ছিলাম তখন বিশেষ গুরুত্বের সাথে তিনি বললেন- হযরত দেহলবী (অর্থাৎ হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রাহ.)-এর খেদমতে আপনি অবশ্যই উপস্থিত হবেন এবং সেখানে কিছু দিন থাকবেন।

সে সময় হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. সম্পর্কে তিনি অনেক উচ্চ   মন্তব্য করলেন। আর সত্যি কথা  এই  যে,  তাঁর ঐ  উচ্চ  মন্তব্যই আমাকে তাঁর নির্দেশ পালনে উৎসাহিত করেছিল। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর মালফুযাতের ভূমিকায় লিখেছি যে, এই নির্দেশ পালনের পরই আমি মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা অবগত হয়েছি এবং এর কিছু দিন পরে আমি এটাও বুঝতে পেরেছি যে, ঐ বুযুর্গ আমাকে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর খেদমতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ এত গুরুত্বের সাথে কেন দিয়েছিলেন।

 

বাস্তব কথা এই যে, খানকাহর ব্যবস্থাপনা, খানকাহর কার্যকলাপ এবং খানকাহসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আমার যে দূরত্ব ছিল, এ বিষয়ে আমার ঐ ধারণারও বিশেষ দখল ছিল যে, খানকাহর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বীনের ফিকির এবং দ্বীনের খেদমতের আগ্রহ কম। অথচ এটাকে আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ উত্তরাধিকার মনে করি। আমার ধারণা, ঐ বুযুর্গ আমার ঐ অনুভূতি বুঝতে পেরেই আমার সংশোধনের উদ্দেশ্যে ও আমার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্যই এত গুরুত্ব দিয়ে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর খেদমতে হাজির হওয়ার এবং সেখানে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেন আমাকে আল্লাহ পাকের প্রেমে মত্ত একজন মুখলেস বুযুর্গের দ্বীনের দরদ, এ পথে তাঁর ব্যাকুলতা ও আত্মনিবেদন প্রত্যক্ষ করানো এবং এটা দেখানো উদ্দেশ্য ছিল যে, দ্বীনের খেদমতে যারা (সত্যিকার অর্থে) আত্মনিয়োগ করেন তারা এমনই হন। এক উর্দূ কবি বলেছেন- অর্থ : হে প্রেমিক, প্রেমের শিক্ষা গ্রহণ কর মোমের আলোতে ঝাঁপ দেওয়া পতঙ্গের কাছে। হৃদয় দগ্ধ হবে তবু আহ শব্দ হবে না।

এগুলো আট-নয় বছর পূর্বের ঘটনা। স্মরণশক্তি যতটুকু সংরক্ষণ করে রেখেছে তা লিখে দিলাম। ঐ বুযুর্গের সাথে আমার আলোচনার যে অংশটুকু উদ্ধৃত করা হয়েছে জানা কথা যে, এত দীর্ঘ সময় পর তা হুবহু উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। এজন্যে সকল আলোচনাকে রেওয়ায়েত বিল মানা (ভাব বর্ণনা) মনে করতে হবে। বরং প্রবল সম্ভাবনা আছে যে, কিছু কথা বাদ পড়েছে এবং এমন কিছু কথা লিখে দেওয়া হয়েছে যা সে সময় নয়, পরের কোনো বৈঠকে ঐ বুযুর্গ থেকে শুনেছিলাম। মোটকথা, যে সকল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ঐ বুযুর্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে লেখা হয়েছে সেগুলো তাঁর কাছ থেকেই শোনা।

তাসাওউফের যে সকল কর্ম-কান্ড সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ইচ্ছে করেছিলাম, আফসোস! নিজের মানসিক দুর্বলতা এবং এসকল বিষয়ে অমনোযোগিতা এবং অন্যান্য কিছু ব্যস্ততার কারণে যথাযথভাবে এ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারিনি। তবে সামান্য যা কিছু সম্পর্ক তাসাওউফ ও তার কর্মকান্ডের সাথে ছিল ঐ কয় বছরই ছিল। ফলে এ পথের মুরুববীদের সাথে যে নৈকট্য অর্জন হয়েছিল এবং সে সময়ে তাদের অবস্থা ও পরিবেশ নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করার যে সুযোগ পেয়েছিলাম, সে সুযোগ থেকে কয়েকটি বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। যার মধ্যে কয়েকটি বিষয় তাসাওউফের বিরুদ্ধাচরণ-কারীদের খেদমতে পেশ করার মতো, আর কিছু         বিষয় এমনও আছে যা তাসাওউফপন্থীদের খেদমতে পেশ করা আবশ্যক মনে করছি। আসল কথা হল, অসহায় তাসাওউফ স্বীয় শত্রু ও বিরুদ্ধবাদীদের অত্যাচারের শিকার তো হয়েছেই, উপরন্তু যারা তার পক্ষের এবং তাসাওউফের পতাকাধারী তাদেরও কিছু কিছু লোক তাসাওউফের উপর অত্যাচারের কারণ হয়েছে। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

অনুবাদ : মাওলানা হাবীবুর রহমান খান 

 

advertisement