বাইতুল্লাহর মুসাফির-১২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হযরত ধীরে ধীরে নেমে এলেন তাওয়াফের চত্বরে। হযরতের এই নেমে আসার দৃশ্যটি আমার আজীবন মনে থাকবে। জীবনে বহুবার নছীব হয়েছে আমার বাইতুল্লাহর মাতাফে নেমে আসার। হযরত উম্মেহানির যে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিলেন আমি সেখান দিয়েই নামি। এটা জরুরি নয়, তবু আমার মনে হয়, কিছুটা আশ্বাস যেন হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়। আল্লাহর অলীকে ভালোবাসলে আল্লাহ কি খুশী হবেন না! ভালো না বাসলে যখন অখুশী হন!
হযরতকে অনুসরণ করে আমরাও নেমে এলাম মাতাফে। পুরো মাতাফ তখন তরঙ্গময় এক জনসমুদ্র! বাইতুল্লাহর কাছে গিয়ে হাজরে আসওয়াদ চুমু দিয়ে তাওয়াফ শুরু করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। হযরত তাই হাজরে আসওয়াদের বরাবর হয়ে সেদিকে মুখ করে দাঁড়ালেন।
তারপর দু’হাত তুলে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে তালু দ্বারা হজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করলেন এবং হাতের তালুতে চুমু খেলেন। তারপর তাওয়াফ শুরু করলেন। ‘হযরত কী করেছেন’ তা আমরা দেখেছি, কীভাবে করছেন তা দেখার দৃষ্টি আমাদের ছিলো না! তবু এটাকেই আজ বড় সৌভাগ্যের মনে হয় যে, তাঁকে দেখেছিলাম ঘরের সামনে ঘরের মাতাফে। আহ! হযরতের সেই ঝিলমিল চেহারা, যা আমার অন্তরে এখনো সমুজ্জ্বল, যদি আজকের মানুষকে দেখাতে পারতাম! মসজিদ থেকে সিঁড়ির অল্প ক’টি ধাপ পার হয়ে তিনি যখন মাতাফে নামলেন এবং ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হলেন, প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর লেবাসের শুভ্রতা এবং চেহারার উজ্জ্বলতা আরো যেন প্রখরতা লাভ করছিলো। কেউ যদি ভাবে, এটা ভক্তির আতিশয্য, ভাবতে দাও; আমি শুধু বলবো, আমার তো তাতে লাভই হয়েছিলো! সেই ভক্তিটুকু আমাকে তো শক্তি যুগিয়েছিলো! এবং আশ্চর্য কী, আজ এত বছর পর তুমি যদি সেই ভক্তিতে একাত্ম হতে পারো তাহলে তুমিও হয়ত অর্জন করতে পারো সেই হৃদয়ের কিছুটা সান্নিধ্য পরশ! যুগে যুগে এ পথে যে যা পেয়েছে, ভক্তিগুণেই তো পেয়েছে! যুক্তিগুণে কে কবে কী পেয়েছে বলো! হযরতকে অনুসরণ করে আমরাও তাওয়াফ শুরু করলাম। বাইতুল্লাহর দিকে না তাকিয়ে নযর নীচে রাখা হলো তাওয়াফের আদব। এ বিষয়ে হযরত আগেই আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তাই আমাদের তাওয়াফ ছিলো নীচের দিকে। মন কিন্তু বারবার বলছিলো, দেখি না একটু কেমন সুন্দর কালো গিলাফে ঢাকা আমার আল্লাহর ঘর!
তবে প্রেমের তত্ত্বজ্ঞানী আজমের এক কবি বলেছেন অন্য কথা-
না দেখে পেতে চাই তোমার দেখা হে প্রিয়তম!/ হে চিরসুন্দর, চিরউজ্জ্বল, চিরউত্তম/ প্রিয়ার তনু দেখা যায় শুধু কি চোখের তারায়!/ নেই কি তার আলোকছবি দিলের পর্দায়!
তাওয়াফ চলছে। হযরতের পিছনে পিছনে আমরা এগিয়ে চলেছি, কিংবা কোন ঢেউ, কোন জোয়ার, কোন স্রোত যেন আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
জীবনের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন অবস্থায় হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে আমি দেখেছি। নামাযে ও তিলাওয়াতে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি দরসে হাদীছের মসনদে এবং মুরীদানের সামনে মসজিদের মিম্বরে, তেমনি দেখেছি লক্ষ মানুষের উত্তাল জনসভায়। সর্বত্রই তিনি ছিলেন আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। তাঁর তুলনা ছিলেন শুধু তিনি।
আজ তাঁকে দেখলাম আল্লাহর ঘরে তাওয়াফের হালাতে। তাঁর তাওয়াফ আমি দেখছিলাম। কারণ তাঁর তাওয়াফ থেকে আমাকে শিখতে হবে আমার নিজের তাওয়াফ। কিতাবের পাতা থেকে অবশ্য আমরা জেনেছি, কেমন ছিলো ছাহাবা কেরামের তাওয়াফ, তাবে‘ঈন, তাবয়ে তাবে‘ঈন এবং
পরবর্তীদের তাওয়াফ কিন্তু নামায বলো, তাওয়াফ বলো, দ্বীনের কোন আমল শুধু পড়ে শেখার বিষয় নয়, দেখেও শেখার বিষয়। ছাহাবা কেরাম শিখেছেন আল্লাহর নবীকে দেখে, তাবেঈন শিখেছেন ছাহাবা কেরামকে দেখে, তাবয়ে তাবে‘ঈন শিখেছেন তাবে‘ঈনকে দেখে। এভাবে প্রত্যেক পরবর্তী শিখেছেন পূর্ববর্তীকে দেখে। আমাদের সামনে এখন আছেন আল্লাহর এই নেক বান্দা! তাই আমি মদীনা শরীফ থেকে শুরু করে হজ্বের শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি বিষয় দেখার, শেখার এবং অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। এটা অবশ্য ঠিক যে, আমার দৃষ্টি যেমন দেখা তো তেমনই হবে! আমার যোগ্যতা যেমন শেখা তো সেভাবেই হবে! সর্বোপরি আমার সাধ্য যেমন অনুসরণ তো সে পরিমাণেই হবে! তবু আমি চেষ্টা করেছি দেখার, শেখার এবং অনুসরণ করার।
আল্লাহর ঘরের তাওয়াফে দেখা হযরত হাফেজ্জী হুযূর ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। তাঁর হৃদয় ও আত্মার ব্যাকুলতা এবং তাঁর কলব ও রূহের অস্থিরতা, এগুলো তো ভিতরের বিষয়! তা বোঝার সাধ্য আমাদের কোথায়?! বাইরে থেকে যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে তিনি আল্লাহর আশিক বান্দা ও প্রেমিক দাস! ইশক ও আবদিয়াত এবং প্রেম ও দাসত্ব, এ দুইয়ের অপূর্ব এক মিলন ঘটেছে তাঁর মাঝে। হাসান বছরীর তাওয়াফ কেমন ছিলো; জিলানী ও জোনায়দ বোগদাদীর তাওয়াফ কেমন ছিলো; মারূফ কারখী ও বিশরে হাফী এবং রূমী ও তাবরেযীর তাওয়াফ কেমন ছিলো জানি না; আমি জানি না কেমন ছিলো যুগে যুগে আল্লাহর আশিক বান্দাদের তাওয়াফ! তবে হযরতের তাওয়াফ দেখে বারবার আমি ভেবেছি, তাঁদের তাওয়াফ কি আরো সুন্দর, আরো সজীব ছিলো! আরো বেশী ছিলো সেই তাওয়াফের শানে ইশক ও শানে বন্দেগি! আমার শুধু মনে হয়েছে, হযরতের এই যে তাওয়াফ, এর হাজার ভাগের একভাগ যদি কারো নছীব হয় তাহলে অবশ্যই সে খোশনছীব!
হযরত ইফরাদ হজ্বের ইহরাম করেছেন, আমরাও। সে হিসাবে এটা ছিলো শুধু তাওয়াফে কুদূম, যার পরে সা‘ঈ নেই। সুতরাং এর শুরুতে রামাল ও ইযতিবা নেই। তবে তাওয়াফে যিয়ারাতের পরবর্তী সা‘ঈ যদি এখন করে নেয়া হয় তাহলে এখানে রামাল ও ইযতিবা করতে হবে। আমরা তাওয়াফে যিয়ারাতের পরবর্তী সা‘ঈ এখনই করে ফেলবো, তাই তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রামাল ও ইযতিবা করলাম। তাওয়াফে যিয়ারাতের সময় যে প্রচন্ড ভিড় হয় সেদিক থেকে এখন সা‘ঈ করে নেয়া তুলনামূলক সহজ, বিশেষত মাযূর ও দুর্বলদের জন্য।
আমরা চিন্তিত ছিলাম, মাতাফের এই জনসমুদ্রে হযরত কীভাবে কী করবেন, যেখানে জোয়ানদেরও হিমশিম অবস্থা! কিন্তু হযরতকে মনে হলো, তিনি এসব চিন্তার ঊর্ধ্বে! তিনি শান্ত, নিশ্চিন্ত! তিনি শুধু কালো গিলাফের হাতছানিতে আকুল ও ব্যাকুল!
তাওয়াফ শুরু হতেই বোঝা গেলো, হযরতের বিষয় আসলেই অন্যকিছু! তাঁর উপর রয়েছে রহমতের ছায়া এবং রহমানের মায়া! তিনি একটু একটু অগ্রসর হন, আর কোন এক অদৃশ্য ব্যবস্থায় সামনের জনতরঙ্গ একটু একটু সরে যায়! এমনকি প্রথম তিনচক্করে হযরত রামালও করলেন পূর্ণ শানের সাথে এবং একেবারে নির্বিঘ্নে। ইযতিবার হালাতে হযরতের রামাল ছিলো দেখার মত দৃশ্য! সেদিনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যারা তাঁর বার্ধক্যের কথা বলেছেন, তাদের প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। তারা তো তাদের মত করেই ভাববেন, বলবেন! কিন্তু তারা যদি আজ এখানে থাকতেন, অবশ্যই অনুতপ্ত হতেন নিজেদের ‘মূর্খতার’ জন্য!
আমার শ্রদ্ধেয় জনাব আখতার ফারূক ছাহেব এখন দুনিয়াতে নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, তাওয়াফের সময় হযরতকে বেষ্টনীতে রাখার, কিন্তু শেষে অবস্থা এমন হলো যে, আমরা যুবকেরা হযরতের ‘বেষ্টনীতে’ নির্বিঘ্নে তাওয়াফ সমাপ্ত করলাম! এই সফরে যতবার হযরতের সঙ্গে তাওয়াফ করেছি ততবার আমরা এ অভিনব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আর প্রতিদিন তিনি তাওয়াফও করেছেন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী!
হযরত পাহাড়পুরী হুযূর জীবনের প্রথম বাইতুল্লাহর সফর করেছেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহ)-এর সঙ্গে। তখন একদিন হযরত নাকি আমার হুযূরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আজ কয় তাওয়াফ হয়েছে? হুযূর ভেবেছিলেন, উত্তর শুনে হযরত খুশী হবেন, কিন্তু তিনি বললেন, মিয়াঁ তোমরা তো জোয়ান মানুষ, আরো বেশী তাওয়াফ করতে পারো না!
হুযূর বলেন, আমার কৌতুহল হলো, তাই জিজ্ঞাসা করলাম, হযরত আজ কয়টি তাওয়াফ করেছেন?
তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে আফসোসের সাথে বললেন, এখন তো বুড়া হয়ে গেছি, আগের মত আর পারি না, আজ মাত্র পনের তাওয়াফ করেছি।
এটা আসলে শুনে বোঝার বিষয় নয়, দেখে অনুভব করার বিষয়। পুরো সফরে হযরতের যে অবস্থা দেখেছি, আল্লাহর গায়বি মদদ ছাড়া এর অন্য কোন ব্যাখ্যা আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। আমি শুধু বুঝেছি, যা কিছু তিনি করেছেন আত্মার শক্তিতে করেছেন, দেহের শক্তিতে নয়। রূহানিয়াতের শক্তি যখন সাহায্য করে, জিসমানিয়াতের শক্তি তখন গৌণ হয়ে যায়।
গায়বের সঙ্গে যখন বন্ধন স্থাপিত হয় তখন মানুষ অন্য মানুষ হয়ে যায়। আমাদের হযরতকে পুরো হজ্বের সফরে আমার মনে হয়েছে তেমনি অন্য এক মানুষ।
তাওয়াফের সাত চক্কর শেষ হলো। আমি ভাবছি, হযরত এখন মাকামে ইবরাহীমের দু’রাকাতের জন্য অগ্রসর হবেন। কিন্তু না, তিনি ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হাজরে আসওয়াদ ও মুলতাযামের দিকে! দৃষ্টির ব্যাকুলতার অর্থ হয়ত বুঝতে পারছি। আমাদের মত প্রেমহীন হৃদয়েও তো আছে কিছু ব্যাকুলতা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করার! আমাদের উত্তাপহীন বুকেও তো আছে কিছু তৃষ্ণা মুলতাযামের স্পর্শ লাভ করার! কিন্তু মজবূর অবস্থায় দূর থেকে শুধু দেখা ছাড়া উপায় কী! আশিক ও প্রেমিকদের ভাষায় যার নাম দৃষ্টির চুম্বন এবং দৃষ্টির স্পর্শ। এটাও তো সৌভাগ্যের বিষয়! দূর থেকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে হযরত হয়ত এখন সে সৌভাগ্যই অর্জন করছেন।
কিন্তু না, আমাদেরকে অবাক করে তিনি বললেন, হাজরে আসওয়াদ না হোক, অন্তত মুলতাযামে পৌঁছার চেষ্টা করি; আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট না দিয়ে যদি সম্ভব হয়ে যায়!
অবাক হওয়ার পর একসঙ্গে আমরা সবাক হলাম, হযরত! যে সঙ্গীন অবস্থা, তাতে ...!
হযরত শান্ত কণ্ঠে বললেন, কোশিশ তো করতে পারি! বান্দার শাওক দেখে আল্লাহর যদি দয়া হয়ে যায়!
একজন বৃদ্ধের সামনে একজন যুবকের এরপর আর কিছু বলার থাকে না। বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু ‘আলাল্লাহি বলে হযরত অগ্রসর হলেন; আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম। হযরত বললেন-
اَللّهُمَّ وَاقِيَةً كَوَاقِيَةِ الْوَلِيْدِ
এই দু‘আটি পড়ো, আর আগে বাড়ো, তবে দেখো, আল্লাহর কোন বান্দার যেন কষ্ট না হয়। কারণ মুসলমানকে কষ্ট দেয়া হারাম!
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে বাইতুল্লাহর মাতাফে মুলতাযামের পথে হযরত এ দু‘আটি শিখিয়েছেন এবং আল্লাহর রহমতে আমি এর উপর আমল করছি। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করছেন এবং রক্ষা করছেন। এ রক্ষাকবচ মৃত্যুর সময় শয়তানের হামলা থেকেও যেন আমাকে রক্ষা করে, তখনো যেন আল্লাহ সাহায্য করেন; যারা আমীন বলবে তাদেরও।
হযরত অগ্রসর হলেন এবং .. এবং আল্লাহ তাঁকে মদদ করলেন। সামনের যে-ই দেখে এই নূরানী ছুরতের মানুষটিকে সে-ই সসম্ভ্রমে পথ করে দেয়। এভাবে হযরত কাউকে কোন কষ্ট না দিয়ে সত্যি সত্যি মুলতাযামের কাছে পৌঁছে গেলেন। আর আমরা! হযরতের পিছনে থেকে আমরাও নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলাম। ‘পিছনে’ থাকার লাভ জীবনের সর্বক্ষেত্রে, কিমুত আমরা এগিয়ে যেতে চাই এবং পিছিয়ে পড়ি, কিংবা পথ হারিয়ে ফেলি!
প্রিয় বন্ধু! তোমাকে আমি দেখেছি, কিংবা দেখিনি; তবে আমাদের মাঝে তো রয়েছে (ইলমের এবং) ঈমানের বন্ধন! তোমাকে আমি ভালোবাসি এবং তোমার কল্যাণ কামনা করি। একজন কল্যাণকামী বন্ধুর কাছ থেকে এই ‘সন্দেশ’টুকু তুমি গ্রহণ করো; জীবনের বন্ধুর পথে আলোকিত কোন মানুষের পিছনে পথ চলার চেষ্টা করো।
আরেকটি কথা, চাঁদের ‘দাগ’ দেখে ভুলে যেয়ো না চাঁদের সৌন্দর্য।
হযরত কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং সতৃষ্ণ নয়নে মুলতাযামের পানে তাকিয়ে
থাকলেন। সামনে আল্লাহর যে বান্দা মুলতাযামে বুক লাগিয়ে রেখেছিলেন তিনি হয়ত তৃপ্ত হলেন, কিংবা অন্য বান্দাকে সুযোগ দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এবং অতৃপ্তির মাঝে আরো গভীর তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করলেন। তিনি হযরতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা‘আলা ইয়া শায়খ! (হে শায়খ, আপনি আসুন)
তিনি সরে আসামাত্র হযরত ফাঁক পেলেন এবং দু’হাত উপরে তুলে মুলতাযামে বুক লাগিয়ে দিলেন। আমি হযরতের পিঠের সাথে বুক লাগিয়ে রাখলাম এবং .. এবং আমার মনে হলো, মুলতাযামের শীতলতা আমাকেও যেন স্পর্শ করলো! অনুভব যদি করা যায় তাহলে এক স্পর্শ থেকে অন্য স্পর্শের শীতলতা অবশ্যই লাভ করা যায় এবং এভাবে স্পর্শপরম্পরায় পরম স্পর্শের সান্নিধ্যে উপনীত হওয়া যায়। মুলতাযামে বুক লাগিয়ে আমরা কি শুধু মুলতাযামের স্পর্শ লাভ করি! এখানে কি নেই অতীতের এবং দূর অতীতের স্পর্শ!
হে আল্লাহ! তোমার আশিক বান্দার বুক লেগে আছে তোমার মুলতাযামে, আর তোমার অধম বান্দার বুক লেগে আছে তাঁর পিঠের সঙ্গে। হে আল্লাহ! শরীর থেকে শরীরে তো বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়; তাহলে আমার বুকেও কি আসবে না তোমার মুলতাযাম থেকে তোমার রহমতের কিছু প্রবাহ!
হে আল্লাহ! তোমার পেয়ারা বান্দা তোমার কাছে কী ‘চাইছেন’ আমি জানি না; আমার শুধু মিনতি, তাঁর সমস্ত চাওয়া থেকে আমারও যেন হয় কিছু পাওয়া!
হযরত দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন বিশ বছরের বেশী হলো। যখনই আমি হযরতের কবর যিয়ারত করি, কবরের বুক বরাবর দাঁড়াই, মুলতাযামের সেই দৃশ্য আমার সামনে ভেসে ওঠে এবং .. থাক, এবং-এর পরেরটুকু আমার বুকের ভিতরেই থাক। কিছু কথা বুকের ভিতরে থেকে যাওয়াই ভালো।
ধীরে ধীরে হযরত মুলতাযাম থেকে সরে এলেন এমনভাবে যেন তাঁর পিছনে যে আছে সে জায়গা পেয়ে যায়। পিছনে ছিলাম আমি, কিন্তু আল্লাহর অন্য বান্দার পিপাসা হয়ত ছিলো আরো বেশী, কিংবা আল্লাহর ডাক তিনি হয়ত শুনেছেন আরো বেশী! তিনি সুযোগ পেলেন, আমি পেলাম না, তবে আমার আফসোস হলো না। কারণ তিনি যে দেশের, যে গোত্রের, যে বর্ণের এবং যে ভাষারই হোন তিনি তো আমারই ভাই! তার প্রাপ্তি তো আমারও প্রাপ্তি! তাই বিনা আফসোসে শুধু ‘গিবতার’ নযরে একবার তার দিকে তাকিয়ে পিছনে সরে এলাম এবং তাওয়াফের তরঙ্গপ্রবাহে ভাসতে ভাসতে মাকামে ইবরাহীমী থেকে কিছুটা দূরে এসে থামলাম।
হযরত দু’রাকাত আদায় করে সংক্ষিপ্ত মুনাজাত করলেন। আমরাও কোনরকম তাঁকে অনুসরণ করে গেলাম।
হে বন্ধু! এবার আমি একটি শব্দ উচ্চারণ করবো, যা শুধু কানেই নয়, হৃদয়েরও গভীরে রিমঝিম সুর সৃষ্টি করে, ‘যমযম’! আহ, কী মধুর উচ্চারণ! মাতৃমমতার সুধা যেন ঝরে ঝরে পড়ে! আবার বলি, ‘যমযম’! আহ, শুধু উচ্চারণেই হৃদয়ের তৃষ্ণা যেন নিবারিত হলো! আবার, ‘যমযম’! আহ, হৃদয়ের তৃষ্ণা যেন আরো তীব্র হলো!
ঐ যে যমযমের সিঁড়ি! হযরত এগিয়ে গেলেন, আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম। যমযমের
অন্তহীন ফোয়ারা যেন পরম মমতায় আমাদের টেনে নিয়ে এলো! যমযমের এ মমতা সবার জন্য! তুমি পাপী, গোনাহগার? যমযমের মমতা তোমারও জন্য, যদি তুমি অনুতপ্ত হও!
আমি মুজরিম, অপরাধী! যমযমের মমতা আমারও জন্য, যদি হৃদয় আমার অনুশোচনায় দগ্ধ হয়!
মুমিনের মাঝে এবং মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য কী? আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন, ‘যমযমের পানি’! মুনাফিক যমযম তৃপ্তিভরে পান করে না, করতে পারে না। মুমিন যত পান করে, তার তৃপ্তি হয় না। আকণ্ঠ পান না করে তার তৃষ্ণা যেন নিবারিত হয় না।
এই সিঁড়ি দিয়ে জীবনে প্রথম নেমেছিলাম একা একা; আজ আবার নামলাম হজ্বের মৌসুমে আল্লাহর নেক বান্দার পিছনে পিছনে। আমার মত স্থূল হৃদয়েও অনুভূত হলো দুয়ের পার্থক্য! তখন ছিলো কিছু কিছু, এখন হলো অনেক কিছু!
প্রাণভরে পান করলাম যমযমের সুশীতল পানি। আমি তৃপ্ত হলাম, আমি কৃতার্থ হলাম এবং অন্তরের গভীর থেকে আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। আমার আরেকটি সৌভাগ্য; হযরত আমাকে গ্লাস ভরে যমযমের পানি পান করালেন। আবার, আবার আমি সময়ের রাজপথ ধরে দূর অতীতে চলে গেলাম! আমি যেন সেই পবিত্র হাত থেকে যমযম পান করলাম, যে পবিত্র হাত থেকে ইনশাআল্লাহ একদিন আলকাউছার পান করবো! হে আল্লাহ, তোমার রহমতের কাছে এটা তো অসম্ভব কোন চাওয়া নয়! হে আল্লাহ, যারা আমীন বলবে তারাও যেন আলকাউছারের হাযিরান হয়, আমীন।
প্রিয় পাঠক! বারবার ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে এই যে, দু‘আ উশুল করে নেয়া, তুমি কি বিরক্ত হও?! আমি কিন্তু জানতাম না, আল্লাহর এক বান্দা আমাকে এ কৌশল শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘লেখকদের বিরাট সুযোগ যুগ যুগ ধরে হাজার হাজার মানুষের দু‘আ হাছিল করে যাওয়ার।’ তাছাড়া আমীন বলে দু‘আ করে তুমি তো আর বঞ্চিত হবে না!
এরপর ছাফা ও মারওয়া! মা হাজেরার ছাফা ও মারওয়া! ইবরাহীম খলীল ও ইসমাঈল যাবীহ (আ)-এর ছাফা ও মারওয়া! এবং সাইয়েদুল মুরসালীন ও রাহমাতুল-লিল আলামীনের ছাফা ও মারওয়া! হযরত রওয়ানা হলেন ছাফা- মারওয়ার উদ্দেশ্যে। তাঁর সবকিছু অন্যরকম! আমরা তাওয়াফ করে ক্লান্ত, তাওয়াফের পর তিনি আরো প্রাণবন্ত! আমরা কিছুটা নির্জীব, তিনি যেন আরো সজীব! দেহনির্ভর আত্মা এবং আত্মানির্ভর দেহ- এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য আছে বন্ধু, বিরাট পার্থক্য আছে! সজীব আত্মা ধারণ করেন যারা তাদের উত্তসূরী কিয়ামত পর্যন্ত অবশ্যই থাকবে এবং এবং তাদের সান্নিধ্য হবে আমাদের মত মানুষের জন্য কল্যাণকর।
হযরত ছাফা ও মারওয়ার মাঝে সা‘ঈ করার হাকীকত ও ফযীলত বয়ান করে আমাদের বোঝালেন এবং সা‘ঈর বিভিন্ন আদব স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি আমাদের সতর্ক করে বললেন, দেখো; সাইয়েদেনা হযরত ইবরাহীম (আ) এখানে সা‘ঈ করেছেন, তারপর দোজাহানের সরদার হুযূরে আকদাস ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে সা‘ঈ করেছেন। ছাহাবা কেরাম সা‘ঈ করেছেন। যুগে যুগে আল্লাহর বেশুমার আশেকান সা‘ঈ করেছেন। আজ আল্লাহ আমাদেরও নছীব বুলন্দ করেছেন এখানে সা‘ঈর মাকামে হাযির করে। জানি না আর কখনো নছীব হবে কি না! সুতরাং এটাকেই শেষ সুযোগ মনে করে কাজে লাগাতে চেষ্টা করো। হুযূরে কলব যেন থাকে, আদবের যেন কমি না হয়।
এ কথাগুলো কি নতুন কিছু! কিন্তু হযরতের যবানে যখন শুনলাম, মনে হলো নতুন শুনলাম।
হযরত সা‘ঈর নিয়ত করে ছাফা পর্বতে আরোহণ করলেন এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন বলেছেন, তাঁকে অনুসরণ করে বললেন-
...
আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমিও তা দিয়ে শুরু করছি। নিঃসন্দেহে ছাফা ও মারওয়া হচ্ছে আল্লাহর শা‘আইর (ও বিশেষ নিদর্শনাবলী) থেকে গণ্য।
হযরত বাইতুল্লাহ-অভিমুখী হয়ে হাত তুলে হামদ-ছানা করলেন, দু‘আ করলেন, তারপর তাকবীর বলে অবতরণ করলেন। আমরা তাঁকে অনুকরণ করে গেলাম এ আশায় যে, এভাবে আমাদেরও আমল সুন্নাতের অনুগামী হবে। কারণ আমরা নিজেরা তো জানি না কিছু! অথচ তিনি হলেন ইশকের পথের পুরোনো পথিক! কবি যে বলেছেন-
পানের জলসায় তুমি তো আনাড়ী আগন্তুক/ দেখো আমি সুরায় কত পানি মেশাই কেমনে ঠোঁট লাগাই!/ আমার চুমুক দেখে দাও চুমুক, দোলাও মাথা/ জমবে নেশা, পাবে ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন মজা।
ক’দিন আগে রামাযানে দু’বার সাফা-মারওয়ার সা‘ঈ করেছি। তাতে আল্লাহ যে আত্মিক শান্তি ও রূহানি সুকূন দান করেছেন তাতে আমি কৃতার্থ, কিন্তু হযরতকে অনুসরণ করে আজকের যে সা‘ঈ, সত্যি তা অতুলনীয়! অজানা রহস্যের নতুন দিগন্ত যেন উন্মোচিত হলো! ইশক ও মুহাববাত এবং প্রেম ও ভালোবাসার নতুন ঝরণাধারা যেন হৃদয় থেকে উৎসারিত হলো। বর্তমানের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে অতীতের মাঝে সমর্পিত হওয়া যেন আরো সহজ হলো।
ছাফা পাহাড় থেকে হযরত যখন নেমে আসতেন, মনে হতো, আসমান থেকে নূরের ফিরেশতা নেমে আসছেন! তাঁর পিছনে পিছনে আমরা যেন রহমতের দরিয়ায় অবগাহন করার জন্য নেমে আসছি!
হযরত যখন মারওয়ায় আরোহণ করতেন, মনে হতো, নূরের ফিরেশতা যেন ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ করছেন! তাঁর পিছনে আমরা যেন আলোর রজ্জু ধারণ করে আছি!
দুই সবুজের মাঝে আশি বছরের বৃদ্ধ যখন দৌড়তেন, মনে হতো, তিনি যেন তিনি নন, অন্য কেউ! এ যুগের জন্য তিনি যেন সে যুগের প্রতিনিধি! তিনি যেন তাঁদের প্রতিচ্ছবি! তাঁর পিছনে পিছনে আমরা যেন ছুটছি এ যুগের সীমানা ছেড়ে সে যুগের সীমানায় প্রবেশ করার জন্য এবং সে যুগের পবিত্রতাকে একটু হলেও স্পর্শ করার জন্য!
হায়, কী দিন, রাত পার হলো! কেমন সৌভাগ্যের মুহূর্তগুলো চলে গেলো! এই পঁচিশটি বছরের বিনিময়ে হে আল্লাহ, তুমি যদি ফিরিয়ে দিতে সেই শুভ্র-সমুজ্জ্বল দিনগুলো! তুমি কবুল করো হে আল্লাহ, আমার সব ভালোকে আরো ভালো বানিয়ে এবং সব মন্দকে ভালোতে বদল করে! তুমি কী না পারো হে আল্লাহ!
সপ্তম চক্কর শেষ হলো মারওয়ায়। হযরত বাইতুল্লাহর অভিমুখী হয়ে অনেক্ষণ দু‘আ করলেন হৃদয়কে বিগলিত করে এবং চোখের অশ্রুতে স্নাত হয়ে। সেই মুনাজাতে হযরতের বিগলিত রূপ দেখে আমরা অন্তত বুঝতে পারলাম, এমন করে মুনাজাত করা হয়! পিছনের যুগে এমন করে মুনাজাত করা হতো! এবং এমন মুনাজাতই ধারণ করতে পারে ‘সেই মুনাজাতের’ সামান্য কিছু ফায়য ও ফায়যান! আমাদের জন্য তো এতটুকু সৌভাগ্যই যথেষ্ট যে, আমরা এমন মুনাজাত দেখেছি এবং আমীন, আমীন বলেছি।
মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ এখন দুনিয়াতে নেই; তার কবর হোক জান্নাতের বাগিচা! ফেরদাউস হোক তার ‘আবাদী’ ঠিকানা! তাকে সেদিন দেখেছিলাম হযরতের পিছনে দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে। চোখের পানিতে ধোয়া তাঁর চেহারা যেন ছিলো শাবনামে ধোয়া তাজা ফুল! তার অাঁসু-ভেজা আওয়াযের সেই কথাটি আমার মনে পড়ে; তিনি বলেছিলেন, আমাদের হযরতকে কবে আমরা চিনতে পারবো! কবে চিনতে পারবে আমাদের দেশের মানুষ! তাঁর ডাকেই যদি দেশ সাড়া না দিলো তাহলে তাঁর পরে কী হবে?!
আমি বলেছিলাম, আগে ‘আমরা’ তো চিনতে চেষ্টা করি! আগে ‘আমরা’ তো মানতে চেষ্টা করি! তারপর না হয় ভাববো দেশের মানুষের কথা।
হযরতকে নিয়ে আমরা ফিরে এলাম হাজী মীযানের ঘরে। আমার থাকা খাওয়ার ইনতিযাম ছিলো আলাদা। কিন্তু হাজী মীযান বললেন, আজকের খানা আমার পক্ষ হতে দাওয়াত। হযরত বললেন, দাওয়াতের খানা খেয়ে যাও।
দাওয়াত ছিলো হযরতের, খাবার ছিলো আমাদের। তিনি খেলেন দু’তিন লোকমা, আমরা সাবাড় করে ফেললাম পুরো দস্তরখান! একজন অর্জন করেন, আর বহুজন কাছে থেকে তার ফল ভোগ করে; শুধু দুনিয়ার ফল, কিংবা আখেরাতেরও ফল। দুর্ভাগা তারা যারা শুধু দুনিয়র ফলে তৃপ্ত থাকে, আর বদনছীব তারা, দু'টো থেকেই বঞ্চিত থাকে যারা।
আজকের দস্তরখানে মোলাকাত হলো ‘মুশাক্কাল’-এর সঙ্গে এবং প্রথম মোলাকাতেই মুহববত হয়ে গেলো। কারণ, জানলাম, মুশাক্কাল হযরতের খুব প্রিয়। হাজী মীযানের জানা ছিলো, তাই হযরতের জন্য মুশাক্কালের ইনতিযাম রেখেছেন। মুশাক্কাল মানে টিনের কৌটায় কলার সঙ্গে অন্যান্য ফলের মিশ্র জুস। খেলাম। নাহ, ঠিক মত বলা হলো না, বলা উচিৎ, পান করলাম, একটু একটু করে, স্বাদ বুঝে বুঝে! এমন সুস্বাদু যে, বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা যায়,‘একটি কৌটায় একত্রে সকল ফলের স্বাদ!’
সফরের শেষ পর্যন্ত হযরত আমাকে বহুবার মুশাক্কাল পান করিয়েছেন, আমিও মাঝে মাঝে হযরতের খিদমতে পেশ করেছি। হযরত যে স্নেহমাখা হাসি উপহার দিয়ে মুশাক্কালের কৌটা হাতে নিতেন, তা মনে হলে এখনো আমি আনন্দে আপ্লুত হই। কবি মোটেই অতিশয়োক্তি করেননি-
‘তোমার চিবুকের তিলক, তোমার অধরের মধুর হাসি/একটির জন্য দেবো হৃদয়, একটির জন্য প্রাণ!
আমার বুড়ো হযরতের চিবুকে তিলক ছিলো, শুধু হাসিটুকুর জন্যই আমি বিলিয়ে দেবো আমার হৃদয় ও প্রাণ!
হারাম শরীফ দিন-রাত খোলা থাকে। তাই নিয়ত করেছি, ব্রিফকেসটা কামরায় রাখার ব্যবস্থা করে হারাম শরীফেই রাত যাপন করবো। হারাম শরীফে হযরতের প্রিয় স্থান হলো উম্মেহানি। হযরত থেকে বিদায় নিয়ে আমি হারাম শরীফে উম্মেহানিতে চলে এলাম। তাহাজ্জুদের তখনো কিছু সময় বাকি। ই‘তিকাফের নিয়তে সেখানেই শুয়ে পড়লাম। চোখের সামনে আল্লাহর ঘর! দু'চোখ ভরে দেখছি কালো গিলাফের সৌন্দর্য! এরই মাঝে দু'চোখভরে আল্লাহ দান করলেন প্রশান্তির ঘুম! আল্লাহ যখন জেগে থাকার শান্তি দান করেন তখনো তাঁর শোকর! আল্লাহ যখন নিদ্রার প্রশান্তি দান করেন তখনো তাঁর শোকর। তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নেয়ামত তোমরা অস্বীকার করবে!
ফজরের পূর্বে হযরত উম্মেহানিতে এলেন এবং সেখানেই ফজর আদায় করলেন। ইশরাকের পর তিনি তাওয়াফ করলেন, আমরাও তাঁর অনুগমন করলাম।
প্রিয় পাঠক! হযরতের সঙ্গে এই দ্বিতীয় তাওয়াফেরও আছে এমন কিছু কথা যা শুনতে তোমার ভালো লাগার কথা, কিন্তু আমাকেও তো কিছু সংযম শিখতে হবে! সুতরাং থাক সে প্রসঙ্গ। শুধু বলি, হযরতের সঙ্গে এই সফরের যা কিছু ভালো, আল্লাহ যেন তোমাকেও দান করেন। সফরনামার সেতুবন্ধনের মাধ্যমে তুমিও তো আমার হযরতের সফরসঙ্গী! ছোট্ট করে শুধু একবার আমীন বলো, আমার জন্য এবং তোমার জন্য। নিয়ত করে দেখো না, আল্লাহর রহমতের খাযানা কত অফুরন্ত! আমাদের রব তো বলেছেন, ‘লা-উবালী!’ (আমি দিতেই থাকবো,) কোন পরোয়া করবো না। রহমতের আশা করো রহীমের শান হিসাবে, বান্দার ক্ষুদ্রতা হিসাবে নয়!
তাওয়াফের পর হযরত বাসায় চলে গেলেন, আমি উম্মেহানিতে ঘুমিয়ে থাকলাম। ফারূক ভাইও আমার সঙ্গে থেকে গেলেন এবং আমার প্রতি অন্তরঙ্গতা প্রকাশ করলেন। শাওয়াল থেকে এ পর্যন্ত মাদরাসার কাজ কীভাবে করেছেন! কত প্রতিকূলতার মাঝে কেটেছে তার দিন রাত, শোনালেন। অনুযোগ করে বললেন, অন্তত আপনার চলে যাওয়া উচিত হয়নি আমাকে একা রেখে। এই ভালো মানুষটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। সর্ব কল্যাণ আল্লাহ তাকে দান করুন। পরে তিনি কয়েকবার হজ্ব করেছেন। গত বছর ২৮ হিজরীতে হজ্বের এক সপ্তাহ আগে দেশের বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে আসার পথে এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, পথিমধ্য হতেই তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিলো এবং শাব্দিক অর্থেই তার জীবনাশংকা দেখা দিয়েছিলো। চিকিৎসক এবং আপন-পর কারো কথাই তিনি শুনেননি। হাসপাতাল ছেড়ে সোজা গিয়ে উঠেছেন বিমানে। তার এককথা, মৃত্যু যদি আসে, আল্লাহর ঘরের সফরেই আসুক! আমি বলবো না, এটা ঠিক ছিলো, শুধু বলবো কবির ভাষায়-
আমি বুঝি না জ্ঞানীদের ভাষা, যুক্তির শব্দমালা!/ আমাকে শোনাও মজনুর কাহিনী, দেখাও পানশালা/ আমি হতে চাই প্রেমের ‘শহীদ’ লায়লার দুয়ারে/ কিংবা তার গলিতে, কিংবা মরুপথের অভিসারে!
তিনি সুস্থ হলেন আল্লাহর ঘরে গিয়ে যমযমে আকণ্ঠ হয়ে। হজ্ব করেছেন এবং ফিরেও এসেছেন। আল্লাহ তাকে দীর্ঘায়ু করুন। হয়ত প্রসঙ্গ থেকে সরে গেলাম, কিন্তু প্রিয় পাঠক, ভালো লাগেনি তোমার!
নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠে হারাম শরীফ থেকে বের হলাম কিছু সময়ের জন্য। প্রথমে গেলাম আবুজেহেলের বাড়ী।
না, পাঠক! অাঁতকে ওঠার কিছু নেই; আবু জেহেলের বাড়ী এখন পাবলিক টয়লেট, বাংলায় যাকে বলে গণসৌচাগার। হারাম থেকে খুব দূরে নয়। ভাবতে সত্যি অবাক লাগে, এত কাছে ছিলো লোকটা হারামের! হযরত ওমর তো ছিলেন অনেক দূরে! আর আল্লাহর পেয়ারা হাবীব দু‘আ তো করেছিলেন দু’জনেরই জন্য! দূরের ওমর পেয়ে গেলেন, পেলো না কাছের আবুজেহেল! অথচ ওমর ছুটে এসেছিলেন তালোয়ার হাতে মাথা নিতে, কিন্তু কাছে এসে দিলেন মাথা পেতে! হযরতকে একসময় আমি বলেছিলাম কথাটা, তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘আবুজেহেলের পথে তাকাববুর ছিলো বাধা, আর হযরত ওমর (রা)-এর পথে ‘খুলূছ’ ছিলো ওয়াছিলা! (অর্থাৎ তাঁর অন্তরে যখন হকের পরিচয় ছিলো না, হকের প্রতি তখনো তাঁর খুলূছ বা
আন্তরিকতা ছিলো।)’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘হযরত ওমর আল্লাহর নবীর জান নিতে এসেছিলেন, কিন্তু তাতে শারাফত ছিলো, বাহাদুরি ছিলো, আর আবু-জেহেলের প্রতিটি আচরণে ছিলো ইতরতা ও কামিনাপন। শরীফ ও কামিনা তো সমান হতে পারে না!’
টুকরো টুকরো এরকম অনেক কথা হযরত বলেছেন পুরো সফরে। দু’একটি মনে আছে, আর সব হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। কত ভালো হতো, যদি লিখে রাখতাম তখন!
বলছিলাম আবুজেহেলের বাড়ীর কথা; পরিষ্কার, তবু ঢোকামাত্র নাকে দুর্গন্ধ লাগলো। বুঝতে পারলাম না, সউদী হুকুমত আবুজেহেলের বাড়ীকে এতটা ইজ্জত দিলো কোন্ বুঝে? আবুজেহেলের বাড়ী কি হতে পারে হাজী ছাহেবানদের ‘বাইতুলখালা’! তারা তো আল্লাহর ঘরের মেহমান!
যাক, এটা গুরুতর কিছু নয়, নিছক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য।
আবুজেহেলের বাড়ীতে যতক্ষণ ছিলাম, অস্বস্তিতেই ছিলাম, কিন্তু উপায় ছিলো না। আমার জানা মতে এর চেয়ে কাছে আর কোন বাইতুলখালা
ছিলো না।
হায় আবুজেহেল, তোমার বাড়ীতে ‘বর্জ্য’ ত্যাগ করতে এসেছি সে দোষ কিন্তু আমার নয়; নিজের কপাল নিজেই তুমি পুড়িয়েছো আল্লাহর নবীর শানে গোস্তাখি করে!
তোমার কি মনে পড়ে, আল্লাহর নবী বাইতুল্লাহর ছায়ায় নামায পড়ছিলেন! তিনি যখন আপন প্রতিপালকের সামনে সিজদায়, তুমি তখন হে ‘মূর্খতার পিতা’, তাঁর দেহের উপর উটের আবর্জনা ফেলেছিলে! সুতরাং আজ তুমি সানন্দে গ্রহণ করো লক্ষ লক্ষ হাজী ছাহেবানের ঘন ও তরল উভয় প্রকার আবর্জনা!
তোমার তো বড় খাহেশ ছিলো সরদারি জাহির করার, তাই হে মূর্খতার পিতা, মউতের সময় আবদার করেছিলে তোমার মুন্ডুটা যেন গর্দানসহ লম্বা করে কাটা হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, এটা কোরায়শসরদারের মুন্ডু! সাধে কি আর তোমাকে বলা হয় মূর্খতার পিতা! কার হাতে যেন তুমি কতল হয়েছিলে! হাঁ, মদীনার দুই ‘বাচ্চা’ আনছারীর হাতে! হায়, তোমার এ যুগের বন্ধুরা যদি তোমার পরিণতি থেকে কিছুমাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতো!
হারাম শরীফে ফেরার পথে সেই দোকানে গেলাম যেখানে রামাযানে আমার সামান আমানত রেখেছিলাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম দোকানের মালিককে। বড় ভালো লাগলো। কাছে গিয়ে সালাম দিলাম, বললাম, আমাকে চিনতে পেরেছেন? রামাযানে আমার সামান আমানাত রেখে আপনি বড় উপকার করেছিলেন!
তিনি চিনলেন এবং
আন্তরিকভাবে মুছাফাহা করে বললেন, হাঁ, তোমার কথা আমার খুব মনে আছে।
আমি বললাম, আপনি দু‘আ করেছিলেন, আল্লাহ যেন আবার আমাকে আল্লাহর ঘরে ফিরিয়ে আনেন; দেখুন, আল্লাহ মেহেরবানি করে আপনার দু‘আ কবুল করেছেন!
তিনি খুশী হয়ে বললেন, আল্লাহ আমাদের সবার আমল কবুল করুন। তোমার সামান কোথায়?
বললাম, এবার আমি আমার শায়খের সঙ্গে এসেছি, সামান সেখানে আছে।
তিনি আমাকে ঠান্ডা শরবত দ্বারা আপ্যায়ন করলেন। কিছুক্ষণ পর তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হারাম শরীফে ফিরে এলাম।
যোহরের পর হযরত উম্মেহানিতে বসলেন, হয়ত তাঁর ইচ্ছে ছিলো তিলাওয়াত করবেন, আল্লাহর ঘরের সৌন্দর্য অবলোকন করবেন এবং মোরাকাবায় নিমগ্ন থাকবেন, কিন্তু আল্লাহর বান্দাদের হুজুমের কারণে পুরো সফরে সে সুযোগ তাঁর কমই হয়েছে। কেউ মুছাফাহা করে, দু‘আ চায়, কেউ হজ্বের মাসআলা জিজ্ঞাসা করে, কিংবা অন্য কোন সমস্যার কথা বলে। অনেকে এমন অপ্রয়োজনীয় কথাও বলতো যে, আমরা অসংযম প্রকাশ করতাম। কিন্তু হযরত ছিলেন হযরতের মত! কখনো কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখিনি তাঁকে। একবার শুধু কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মানুষও কী সব বেহুদা কথা নিয়ে চলে আসে!’
একদিন তো এক ভালো মানুষ হযরতকে বটগাছে ভোট দেয়ার খোশখবর দিয়ে রাজনীতির প্রসঙ্গ জুড়ে বসলো। হযরত তাকে তাঁর সেই বিখ্যাত তওবা-দর্শন বোঝালেন এবং হারাম শরীফে সময়ের কদর করার নছীহত করলেন।
কেউ বুঝতেই চাইতো না যে, এভাবে তারা আল্লাহর নেক বান্দার আধ্যাত্মিক নিমগ্নতায় কত বড় বিঘ্ন সৃষ্টি করে!
উম্মেহানিতে দেখা হয়ে গেলো আল্লাহর সেই বান্দার সঙ্গে, রামাযানে যিনি আমাদেরকে তার গাড়ীতে করে জিদ্দা বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি এসেছেন হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ছোহবত গ্রহণ করতে। আমার আসার খবর তার জানার কথা নয়, এমনকি আমাকে চেনারও কথা নয়। কিন্তু আমি যেমন দেখামাত্র তাকে চিনলাম, তিনিও আমাকে চিনলেন এবং খুশী হলেন। আমি কৌতুক করে বললাম, আপনার এবং আপনার গাড়ীর বুজুর্গি ভোলার মত নয়! শেষ পর্যন্ত আপনারা দু’জনে মিলে আমাদেরকে বিমানের উদরে চালান করেই ছাড়লেন! আমি কিন্তু মনে মনে আপনার গাড়ীকে সাধুবাদ জানাচ্ছিলাম যে, হয়ত ওর ওছিলায় বিমান ‘ফেল’ করা সম্ভব হবে!
তিনি বললেন, বিশ্বাস করুন, এরপর একদিনের জন্যও গাড়ীর ইন্জিন কোন গড়বড় করেনি। সেদিন কেন যে এমন হলো তা আলেমুল গায়বই ভালো জানেন। তবে বাংলাদেশ বিমানও কিছুৃ কম যায়নি! যেন পণ করে বসেছিলো, আপনাদের না নিয়ে ওড়াল দেবেই না!
এই মানুষটি আমার মনে থাকার আরেকটি বড় কারণ, তিনি আমাকে একটি কিতাব হাদিয়া দিয়েছিলেন, আর আমাকে যদি কেউ কিতাব হাদিয়া দেয়, সারা জীবন তাকে মনে রাখার চেষ্টা করি।
শায়খ আব্দুল্লাহ বিন বায সৌদী আরবের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলিম। তিনি হযরতের সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায় জানিয়ে লোক পাঠালেন। সম্ভবত ঢাকাস্থ সৌদী রাষ্ট্রদূত জনাব ফুয়াদ আব্দুল হামীদ আলখতীবের মাধ্যমে তিনি হযরতের সফর সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। হযরত আছরের পর তাকে সময় দিলেন।
সউদী আরবের শাসক সম্প্রদায়কে বলা হয় আলে সউদ। আর সউদী শাসকসম্প্রদায়ের ধর্মীয় গুরু শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের বংশধরকে বলা হয় আলে শায়খ।
ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে আলে শায়খের উপদেশ ও নির্দেশনাকে সউদী সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। বিন বায হলেন আলে শায়খ পরিবারের বর্তমান প্রধান ব্যক্তি। প্রথমত বংশীয় পরিচয়ের সূত্রে, দ্বিতীয়ত শায়খের উচ্চ ব্যক্তিত্ব ও ধার্মিকতার কারণে বর্তমান বাদশাহ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন এবং তাঁর মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেন। হক কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি বেশ নির্ভীক ও স্পষ্টভাষী, তবে প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ বলে সর্বমহলে তাঁর বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বহু বছর ধরে তিনি দৃষ্টিহীনতার শিকার, কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি অতিশয় প্রখর, একথা হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী লিখেছেন। মূলত তাঁর লেখার মাধ্যমেই আমি বিন বাযের মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জেনেছি। আমার মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো এই মহান আলিমে দ্বীনকে নিকট থেকে না হোক, অন্তত দূর থেকে একবার দেখার। সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হওয়ার উপলক্ষ এখন তৈরী হলো। তদুপরি হযরত আমাকে আদেশ করেছেন দোভাষীর দায়িত্ব পালন করার।
যথাসময়ে শায়খ বিন বায হযরতের অবস্থানস্থলে তাশরীফ আনলেন। অত্যন্ত সাদাসিধা ও অনাড়ম্বর
জীবনের অধিকারী শায়খ বিন বায পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে হযরতের সঙ্গে মিলিত হলেন। মনে হলো নিজস্ব সূত্রে হযরতের জীবন ও কর্ম এবং মাকাম ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে, বিশেষত বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফাত কায়েমের জিহাদে তাঁর সর্বসাম্প্রতিক তৎপরতা সম্পর্কে আগেই তিনি অবগতি অর্জন করে নিয়েছেন। শায়খের আচরণ ও উচ্চারণে সেটা সুস্পষ্ট ছিলো। সাধারণ সৌজন্য বিনিময়ের পর, আমার ধারণা ছিলো, শায়খ হযরতের ইরান সফর সম্পর্কে জানতে চাইবেন, কিন্তু তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিলো বাংলাদেশে দ্বীনী তালীম ও তারবিয়াতের ক্ষেত্রে আলিম সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে। বোঝা গেলো, সাময়িকতার সীমাবদ্ধতা থেকে তিনি যথেষ্ট মুক্ত, যা অন্যদের ক্ষেত্রে দুঃখজনভাবেই অনুপস্থিত দেখা যায়।
হযরত সংক্ষেপে, কিন্তু সবদিক গুছিয়ে জবাব দিলেন। দ্বীনের খিদমত এবং ইলমের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে, সর্বোপরি বাংলাদেশের মুসলমানদের দ্বীনী তারবিয়াত এবং যাবতীয় বিদআত ও কুসংস্কারের মোকাবেলায় ওলামা-মাশায়েখের বিরাট ত্যাগ ও কোরবানি এবং অবদানের কথা তুলে ধরলেন। আমি অবাক হলাম, হযরত তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রিয় সঙ্গী ছদর ছাহেবের কথা এখানেও বিস্মৃত হলেন না, যিনি বহু আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হযরত খুব মুহববতের সঙ্গে ছদর ছাহেব (রহ)-এর কীর্তি ও কর্ম আলোচনা করলেন, বরং হযরত এমভাবে বললেন, যেন তিনি ছদর ছাহেবের অসমাপ্ত কাজগুলো আঞ্জাম দেয়ার চেষ্টা করছেনমাত্র। হযরতের এ বিনয় ও আত্মবিলোপ শায়খ বিন বাযকে প্রভাবিত করেছিলো। আমি আমার সাধ্যমত হযরতের বক্তব্য আরবীতে তরজমা করলাম।
শায়খ বিন বায বাংলাদেশের দ্বীনী মাদরাসাগুলোর বর্তমান অবস্থা, বিশেষ করে মাদরাসা নূরিয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং বর্তমান কার্যক্রম ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলেন।
হযরত এ বিষয়ে নিজে কিছু না বলে তাঁর পক্ষ হতে আমাকে বলতে বললেন। আমার তাৎক্ষণিক কোন প্রস্ত্ততি ছিলো না। উপস্থিত যতটুকু সম্ভব আলোচনা করলাম। নিজের কাছেই মনে হলো, উপস্থাপন সুন্দর হয়নি। তবু শায়খ বিন বায সন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং মাদরাসার ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। শায়খ নিজের থেকে পরামর্শ দিলেন, এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরী করে হজ্বের পরপর যেন বাদশাহ এবং শায়খের বরাবরে পেশ করা হয়। এরপর বিষয়টি তিনি ব্যক্তিগতভাবে তদারক করবেন। শায়খ আরো বললেন, আফসোস! আপনার পরিচয় আমি অনেক বিলম্বে পেলাম, অন্যথায় বহু আগেই আমি আপনার প্রতি সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করতাম। কারণ বাংলাদেশের মুসলমানদের দ্বীনী তারাক্কী আমার আন্তরিক কামনা।
শায়খের বক্তব্য হযরতের সামনে পেশ করলাম, হযরত খুশী হলেন এবং শায়খকে জাযাকাল্লাহু জানালেন।
এরপর বাংলাদেশের ইসলামী সিয়াসাত এবং ইসলামী হুকুমত সম্পর্কে আলোচনা হলো। ইসলামী আন্দোলনের বিভক্তির কারণ কী? মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের উপায় কী? এ বিষয়ে আপনার কর্মপরিকল্পনা কী? মোটামুটি এগুলো ছিলো হযরতের কাছে শায়খের প্রশ্ন।
হযরত প্রতিটি প্রশ্নের আশ্চর্যরকম যুক্তিনির্ভর ও নির্দ্বিধ জবাব দিলেন। হযরতের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ছিলো এই-
(ক) ঈমান ও আকীদার মৌলিক বিষয় অমীমাংসিত রেখে ইত্তেহাদ বা ঐক্য হয় না এবং এ বিষয়ে অনমনীয় হওয়াকে ইফতেরাক বা বিভেদ সৃষ্টি করা বলে না।
(খ) সমস্ত ‘কালিমাগো’ মানুষকে আমি আমার দ্বীনী ভাই মনে করি। এজন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে তাওবার দাওয়াত দিয়েছি এবং খেলাফত কায়েমের মেহনতে শরীক হওয়ার আহবান জানিয়েছি। (এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বহুল আলোচিত তাওবাদর্শন সংক্ষেপে তুলে ধরেছিলেন।)
(গ) ঐক্যের উপায় হলো ঈমান ও আকীদার মৌলিক প্রশ্নে একমত হওয়া, উম্মতের সর্বসম্মত কোন বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করা এবং প্রকাশ্য শরীয়তবিরোধী না হওয়ার শর্তে আমীরের পূর্ণ আনুগত্য করা।
ইরান সফরের পর ইরানের শিয়া হুকুমত সম্পর্কে হযরতের প্রতিক্রিয়া ও মতামত কী? এটা ছিলো শায়খের শেষ প্রশ্ন।
এ বিষয়ে হযরত মদীনায় যা বলেছেন মোটামুটি তাই বললেন। তবে এখানে হযরত পালটা প্রশ্ন করলেন, ইরানকে আপনি মুসলিম দেশ এবং মুসলিম সরকার মনে করেন কি না?
এমন একটি প্রশ্ন যে হযরতের পক্ষ হতে আসতে পারে তা আমরা যেমন ধারণা করতে পারিনি, সম্ভবত শায়খ বিন বাযেরও ধারণায় ছিলো না। বস্ত্তত এটি ছিলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন, কিন্তু শায়খ বিন বায খুব সম্ভব তাঁর অবস্থানগত সংবেদনশীলতার কারণে এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বললেন, বিষয়টির রাজনৈতিক দিক আলোচনা করা আমাদের কাজ নয়। শুধু শরীয়াতের দৃষ্টিকোণ আলোচনা করাই আমাদের জন্য সঙ্গত হবে।
এ পর্যায়ে হযরতের একজন সম্মানিত সফরসঙ্গী কিছু বলতে উদ্যোগী হলেন। আমি খুব বিচলিত বোধ করলাম এবং নিজের অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা না করেই জোরালোভাবে বললাম, শায়খ এবং হযরতের মাঝেই এ আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। আপনার কিছু বলার থাকলে হযরতকে বাংলায় বলুন; হযরত মুনাসিব মনে করলে তা গ্রহণ করবেন।
যাকে উদ্দেশ্য করে আমার একথা বলা তিনি রুষ্ট হলেন, তবে নিবৃত্ত হলেন।
হযরত তখন শায়খের কথার সূত্র ধরে বললেন, আহলে সুন্নাতের আলিমগণ শিয়াসম্প্রদায়ের যে সকল আকীদাকে কুফুরি সাব্যস্ত করেছেন আমিও সেগুলো কুফুরি মনে করি। তবে ইরানের বর্তমান শিয়ানেতৃত্বের আকীদা ও বিশ্বাস কী তা আমার জানা নেই। এ সম্পর্কে ইসলামী উম্মাহর সর্বসম্মত ফতোয়া আসা দরকার বলে আমি মনে করি এবং সেটা আপনার উদ্যোগেই হতে পারে। বাকি, পর্দাহীনতাকে যে কঠোরতার সাথে সেখানে রোধ করা হয়েছে তার প্রশংসা করতেই হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত সউদী বিমানে বিমানবালা নিয়োগের বিষয়ে শায়খের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
শায়খ বললেন, এসব বিষয়ে আমি যথাসম্ভব আমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।
শেষ পর্যায়ে হযরত ইরানের কিয়াদাতে ওলামার প্রশংসা করে বললেন, আমি মনে করি, প্রতিটি মুসলিম দেশেই কিয়াদাতে ওলামা (শাসনক্ষেত্রে আলিমনেতৃত্ব) কায়েম হওয়া উচিত।
দীর্ঘ একঘণ্টার আলোচনা বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশেই সম্পন্ন হলো। আলোচনা শেষে শায়খকে হযরত ফলফলাদি দ্বারা আপ্যায়িত করলেন। আরবদের ঐতিহ্যবাহী গাহওয়া অবশ্য পরিবেশন করা সম্ভব হলো না। হজ্বের পর আবার দেখা হবে এ আশাবাদ জানিয়ে শায়খ বিন বায বিদায় নিলেন। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি চোখের দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত, কিন্তু তার চলাফেরা এত সাবলীল যে, অবাক হতে হয়। চোখের দৃষ্টি শক্তি নেই এমন কোন মানুষকে আমি চলাফেরায় এমন সাবলীল দেখিনি।
মজলিসের পর মাওলানা আতাউল্লাহ ছাহেব আমাকে জাযাকাল্লাহু বললেন, সম্ভবত মাদরাসা নুরিয়ার বিষয়টি তুলে ধরার জন্য। তিনি বললেন, মাদরাসার কাজ ফেলে চলে গিয়েছিলেন, এখন আল্লাহ সুযোগ দিয়েছেন। সুতরাং হজ্বের আগেই প্রতিবেদনটি তৈরী করে ফেলুন। আমি বললাম, আগে দেখুন না, হযরত কী বলেন! তাঁর আদেশ ছাড়া তো আমাদের কিছু করা ঠিক হবে না। আমি আরো বললাম, আমাদের পক্ষ হতে হযরতকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া আমার কাছে ভালো মনে হয় না। তিনি যদি মুনাসিব মনে করেন তবে নিজেই আমাদের বলবেন।
আমার এ কথা বলার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিলো। এখানে থাক সে প্রসঙ্গ।
মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিছবাহ হারামে যাওয়ার পথে মজলিসে আমার ভুমিকার প্রশংসা করে বললেন, বিষয়টি হযরতের সামনে তুলে ধরা দরকার। আমি বললাম, আপনি তো হযরতের আস্থাভাজন ব্যক্তি, আপনি বলুন, আপনার কথা ওযনদার হবে। তিনি যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন এবং আমাকেই অনুরোধ জানালেন।
এশার পর উম্মেহানিতে হযরতকে একান্তে পেয়ে বললাম, হযরত! ইজাযত হলে একটি কথা আরয করতে চাই। ইজাযত পেয়ে বললাম, হযরত! ইরান ও তার শিয়া হুকুমতের বিষয়টি এখন খুবই নাযুক। এ সম্পর্কে আপনার কোন মতামত ও মন্তব্য না আসাটাই উত্তম। কেননা এর ভুল ব্যাখ্যা হওয়ার আশংকা রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের যমীনে ইসলামী হুকুমত কায়েমের যে খাব হযরত দেখছেন তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণে। বিশেষ করে ইরানের সফরে হযরতের সফরসঙ্গী যারা এ বিষয়ে তাদের অত্যন্ত সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ তাদের মন্তব্য হযরতের নামেই সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।
হযরত গম্ভীর মনোযোগের সাথে আমার কথা শুনলেন এবং মনে হলো বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করলেন।
আমি যুবক বয়সের সামান্য এক তালিবে ইলম। আমার সবকিছু নূরিয়া মাদরাসার ছোট্ট পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ। হযরতের ইসলামী সিয়াসাতের যে মেহনত, তার সাথে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। তবু বিবেকের দাবী মনে করে হযরতের খিদমতে কথাগুলো আরয করেছিলাম। কেননা বিভিন্ন আলামত দেখে আমার মনে প্রবল আশংকা জেগেছিলো যে, হযরতের মহান ব্যক্তিত্ব, যা এখন বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে বিরাট নেয়ামত, আমাদের অসতর্ক কোন কথা বা কাজের কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়তে পারে। আর সেটা হযরতের জন্য লাভক্ষতির কিছু না হলেও বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য হবে বিরাট দুর্ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু যা হবার শেষ পর্যন্ত তা হয়েই গেলো। একেবারে আপনজনদের হাতে হযরতের যিন্দেগির খাব বড় বে-দরদির সাথে খুন হলো এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর ক্ষতবিক্ষত হৃদয় থেকে শুধু রক্তক্ষরণ হতে থাকলো। এত বিরাট মানুষ এমন অসহায় হতে পারেন তা হযরতকে যারা ভিতর থেকে না দেখেছে তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। হজ্বের সফরনামায় সঙ্গত হবে না, নতুবা এখানে আমার কিছু কথা বলার ছিলো। কে জানে, এ অংশটুকুও মুছে ফেলা ভালো ছিলো কি না। তবে যা লিখেছি, বিবেকের অনুরোধে লিখেছি। ভুল হলে আল্লাহ যেন মাফ করেন।
এ সফরনামার অর্ধেক পাঠক হয়ত সেসময়টুকু দেখেনি যখন হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত কায়েমের সত্যি সত্যি একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো। আমি সে সম্ভাবনা দেখেছি এবং তার করুণ পরিণতিও দেখেছি। সুতরাং আজ কিংবা কাল, জীবন যদি বিশ্বস্ত থাকে, এ বিষয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই, ইতিহাসের আমানত ইতিহাসের হাওয়ালা করার জন্য।
***
আজ আটই যিলহজ্জ, পবিত্র হজ্বের সূচনাদিন। ভোর থেকেই ‘হালচাল’ শুরু হয়ে গেলো। হজ্বের প্রথম তরঙ্গপ্রবাহ যেন সবাইকে দোলা দিয়ে গেলো। কাফেলার পর কাফেলা লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক রবে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
সারা জীবন আমার বুকের কম্পন এবং হৃদয়ের স্পন্দন যে মধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত ছিলো সেই শুভ লগ্ন আজ সমুপস্থিত। সত্যি সত্যি আমি আজ স্বপ্নের প্রথম সৌভাগ্যের সীমানায় প্রবেশ করলাম। শোকর আলহামদু লিল্লাহ!
ইহরামের সাদা লেবাসে নূরানী ফিরেশতার ছুরত ধরে লক্ষ লক্ষ হাজীর একসঙ্গে মক্কা থেকে মিনায় গমনের যে দৃশ্য ও মানযার, সত্যি তা অপূর্ব! কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায় মিনাঅভিমুখী এ শুভ্র শোভাযাত্রাকে! নাহ, এ আসলেই তুলনাহীন! অন্তত আসমানের নীচে এর কোন তুলনা নেই। এ নূরানী কাফেলার নূরানিয়াত যে অবলোকন করবে তার অবশ্যই মনে হবে, না এই উম্মত সম্পর্কে হতাশ হওয়া ঠিক নয়! এখনো আছে! এই উম্মাহর ভবিষ্যত এখনো আছে! প্রয়োজন শুধু বিশ্বপর্যায়ে একটি কিয়াদাতে রাশেদা বা আদর্শ নেতৃত্বের, যা ইনশাআল্লাহ মিনা-আরাফার কাফেলা থেকেই বেরিয়ে আসবে একদিন!
সময় এগিয়ে চলেছে; এশরাক পার হয়ে সূর্য কিছু উপরে উঠেছে। মিনায় রওয়ানা হওয়ার জন্য আমরা সবাই প্রস্ত্তত। এখন শুধু গাড়ীর অপেক্ষা! অপেক্ষা নয়, ব্যাকুল প্রতীক্ষা! কিন্তু গাড়ী আসে না; আসে না তো আসেই না!
ব্যাকুলতা থেকে শুরু হলো অস্থিরতা! আর যেন দেরী সয় না! জীবনের সেই প্রথম অস্থির প্রতীক্ষার মধুর অনুভূতিটুকু আজো বড় মধুর করে মনে পড়ে।
শায়খ বিন বায হযরতের সুবিধার কথা বিবেচনা করে রাবেতা আলমে ইসলামীর পক্ষ হতে একটি আরামদায়ক গাড়ী এবং একজন পথপ্রদর্শকের ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশেষে যথাসময়ের কিছু পরে সেই গাড়ী উপস্থিত হলো। হযরতের সঙ্গে আমরা মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
‘মিনায় রওয়ানা হলাম’, কথাটা কত সহজ! কিন্তু এর ভাব ও মর্ম বড় কঠিন! মিনা তো কোরবানির ময়দান! দুনিয়ার সমস্ত মুহাববাতকে আল্লাহর মুহাববাতের ছুরি দিয়ে কোরবান করার ময়দান! সেই ময়দানে যারা রওয়ানা হবে তাদের তো এখনই প্রতিজ্ঞা করতে হবে আল্লাহর হুকুমের সামনে নফসের সমস্ত খাহেশাতকে বর্জন করার! আল্লাহর মুহাববাতের মোকাবেলায় সমস্ত মুহাববাতকে কোরবান করার! কিন্তু কোথায় আমার দিলের সেই হালাত! আমার দিল তো হে আল্লাহ, তোমারই হাতে! তুমি পয়দা করে দাও দিলের সেই কাইফিয়াত ও অবস্থা যা তোমার পছন্দ! তোমার খলীল ইবরাহীমের, তোমার যাবীহ ইসমাঈলের সেই ত্যাগ ও কোরবানির সামান্য কিছু ছায়া ও ছোঁয়া আমাদেরও কলবে দান করো হে আল্লাহ!
যুলহোলায়ফায় ইহরাম ধারণের পর থেকে হযরতের হিদায়াত মোতাবেক তালবিয়ার আমল তো জারি ছিলো এবং তার স্বাদ ও লয্যত আলহামদু লিল্লাহ অনুভূত হচ্ছিলো, কিন্তু মিনার উদ্দেশ্যে গাড়ীতে আরোহণের সময় হযরতের সঙ্গে যখন উচ্চারণ করলাম-
লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারিকা লাকা লাববাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘ইমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাক।
তখন হৃদয়ের জগতে যে ঝড় উঠলো, যে উথাল-পাতাল ঢেউ জাগলো তা আসলেই শুধু অনুভবের বিষয়। কী যে অদ্ভুত কম্পন ও শিহরণ! কী যে অপূর্ব আবেগ ও উদ্দীপনা! মুহূর্তের মাঝে যেন বদলে গেলো আমার দুনিয়া-জাহান! লক্ষ লক্ষ হাজী ছাহেবানের ‘কোরবানি’ হবে মিনার ময়দানে! সবাই পুলিকত, আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ কোরবানির জামাতে শামিল হতে পেরে! আমি, আমার মত গোনাহগার, কমযোর, মাজবূর বান্দাও তাদের একজন! এ সৌভাগ্যের, এ খোশনছীবির সুন্দর শোকরানা আর কী হতে পারে তালবিয়া ছাড়া!
লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারিকা লাকা লাববাইক ...
গাড়ী চলছে খুব ধীর গতিতে, প্রায় থেমে থেমে। সাধারণভাবে মক্কা থেকে মিনায় যেতে বিশমিনিটের বেশী লাগার কথা নয়। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে যে হাঁটা-পথ তৈরী করা হয়েছে তাতে দূরত্ব একেবারেই কমে গিয়েছে। চল্লিশ মিনিটে চলে যাওয়া যায় সহজেই। হাঁটতে সক্ষম যারা তাদের অনেকে সেভাবে যায়ও। এদিকে গাড়ীর এমন ভয়াবহ যানজট ছিলো যে, মিনার এলাকায় প্রবেশ করতেই তিনঘণ্টা লেগে গেলো। তারপরো ছিলো আমাদের নির্দিষ্ট মুআল্লিমের তাঁবু খুঁজে বের করার সমস্যা। প্রায় দুপুর হয়ে গেলো মুআল্লিমের তাঁবুতে পৌঁছতে।
এ পুরো সময়টা হযরতকে আমরা দেখেছি ধৈর্যের অবিচল নমুনারূপে। গাড়ী আগে বাড়ছে না, চালক পথ খুঁজে পায় না, ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় ফিরে আসে। সবাই পেরেশান এবং কিছুটা ক্ষুব্ধ। কিন্তু হযরত অন্য জগতে! হয়ত হৃদয়-সাগরের বেলাভূমিতে! কিংবা সাগরের তলদেশে! মাঝে মাঝে তাঁর কণ্ঠে জাগে তালবিয়ার সুমধুর ধ্বনি, আমাদেরও বলেন, তালবিয়া পড়ো ভাই, তালবিয়া পড়ো! লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারিকা লাকা লাববাইক ...
তারপরই তিনি আবার আত্মসমাহিত তার ভাবের জগতে।
মিনার সীমানা থেকে তাঁবুর রাজ্য শুরু হয়ে গেলো। সত্যি সত্যি আমি এখন মিনার ময়দানে! আমার হৃদয়জগতে যেন এক বিপ্লব সৃষ্টি হলো। সারা জীবনের মধুর স্বপ্নের পূর্ণতা লাভের পথে আমি আরেক ধাপ এগিয়ে গেলাম। কোথাও দূরে, কোথাও কাছে পাহাড়শ্রেণী অনির্বচনীয় এক ভাবগম্ভীরতা সৃষ্টি করে রেখেছে। সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশ থেকে আমার অন্তর যেন এই বার্তা লাভ করছে, তুমি হে আল্লাহর বান্দা! এখন এক নতুন জগতে প্রবেশ করেছো, যা এত দিনের পরিচিত জীবনের কোলাহল ও শোরগোল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা প্রেমের জগত! এটা আল্লাহর প্রেমিকদের জগত! নিজেকে তাই এ ময়দানের জন্য অন্যভাবে প্রস্ত্তত করে নাও হে আল্লাহর বান্দা!
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা এ সকল পাহাড় সাক্ষী! চারহাজার বছর আগে এখানে এই পবিত্র ভূমিতে রচিত হয়েছিলো আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করার এবং কোরবান হওয়ার সেই অনন্য ইতিহাস! এখানে আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর মুহাববাতকে কবুল করে প্রিয়তম পুত্রের মুহাববাতকে কোরবান করেছিলেন। পুত্রের গলায় নয়, আসলে তিনি তো ছুরি চালিয়েছিলেন দুনিয়ার সমস্ত গায়রুল্লাহর গলায়! ইবরাহীমী কাফেলার প্রত্যেক সৌভাগ্যবান যাত্রীকে তাই এখানে আজ মুহাববাতের কোরবানি করতে হবে। আল্লাহর মুহাববাতের পথে যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায় সবকিছুর গলায় ছুরি চালাতে হবে। আল্লাহ ছাড়া আমার আপন কিছু নেই। আমার যা কিছু প্রিয়, আমার যা কিছু প্রিয়তম সব আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত!
এখানে এই পবিত্র ভূমিতে সৌভাগ্যবান পিতার সৌভাগ্যবান এক সন্তান নিজেকে পেশ করেছিলেন আল্লাহর রাস্তায় কোরবান হওয়ার জন্য। এখানে মরুভূমির বালুকণা এবং পাহাড়শ্রেণী হয়ত সেদিন শুনেছিলো এমন কোন অভিব্যক্তি-
‘হে আল্লাহ! তোমার প্রেমে নিজেকে আমি উৎসর্গ করবো। তুমি যদি চাও তাহলে তোমার সন্তুষ্টির জন্য আমি জান কোরবান করবো। আমার গলায় ছুরি চলুক, তবু আমার কলবে তোমার মুহাববাত যিন্দা থাকুক! তুমি যদি আমাকে কবুল করো হে আল্লাহ, তাহলে তো না যিন্দেগির ফিকির, না মওতের পরোয়া!’
আল্লাহকে ভালোবেসে, আল্লাহর প্রতি ইশক ও মুহাববাতকে অটুট রেখে এই যে অতুলনীয় ত্যাগ ও কুরবানি, এরই জন্যই তো পিতা ইবরাহীম হলেন খালীলুল্লাহ, আর পুত্র ইসমাঈল হলেন যাবীহুল্লাহ! আল্লাহর মুহাববাতকে সর্বোচ্চে রাখার এবং আল্লাহর রাস্তায় সর্বস্ব কোরবান করার আবেগ ও জাযবা এবং শিক্ষা ও দীক্ষাই এ পবিত্র ভূমি থেকে নিয়ে যেতে হবে মিল্লাতে ইবরাহীমীর প্রত্যেক পিতা ও পুত্রকে। আর আল্লাহর কি শান! এতদিন আমি ছিলাম শুধু পুত্র, আল্লাহ আমাকে মিনা ভূমিতে এনেছেন সেই সঙ্গে সন্তানের পিতা বানিয়ে! কাকে বলে সন্তানের মুহাববাত এবং সেই মুহাববাতের কোরবানি তাকি আমি কিছুমাত্র বুঝতে পারতাম, যদি সন্তানের পিতা না হতাম! ছোট্ট মেয়েটির চাঁদমুখ মনে পড়ে মনটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। অদ্ভুত এক কল্পনা জেগে উঠলো মনে! আমি যেন আমার মেয়ের গলায় ছুরি বসিয়ে দিলাম বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে। মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। কোরবানির দিন হযরতকে বলেছিলাম আমার কল্পনার কথা। হযরত মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। আহ! এমন হযরত কোথায় পাবো আমি, আমরা!
জীবনের বিরাট একটা অংশ চলে গিয়েছে গাফলাতের মাঝে। তারপরো আল্লাহ মেহেরবানি করেছেন এবং এখানে এই পবিত্র ভূমিতে ডেকে এনেছেন; খালীলুল্লাহ ও যাবীহুল্লাহর
‘কোরবানগাহে’ দাওয়াত দিয়ে এনেছেন। এখনো কি গাফলাতের ঘোরেই কেটে যাবে আমার সময়! এখানেও কি আমি লিপ্ত থাকবো বেহুদা কথায় ও কাজে! পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে, আত্মস্বার্থের হীন চিন্তায়, কিংবা এ সমস্যা সে সমস্যার সমালোচনায়!
পথ হারিয়ে গাড়ী প্রদক্ষিণ করছিলো বিভিন্ন পথ। আমি দূরের পাহাড় শ্রেণীর দিকে লক্ষ্যহীনভাবে তাকিয়ে ছিলাম, আর এই সব কথা ভাবছিলাম। বিদায় হজ্বে আজকের এ তারিখেই তো এই মিনাভূমিতে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব এসেছিলেন লক্ষ ছাহাবার নূরানি কাফেলা নিয়ে! কেন এসেছিলেন তিনি? কেয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা উম্মতকে কী শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি? কেন এসেছিলেন ছাহাবা কেরাম? কী শিক্ষা নিয়ে যেতে? কিংবা কী শিক্ষা রেখে যেতে?
তারপর যুগে যুগে আল্লাহর কত পেয়ারা বান্দা, কত আশিক ও মজনু-দিওয়ানা এসেছেন এখানে! কত হাসান বাছরী, কত জোনায়দ-জিলানী, কত মুসলিম-বুখারী, কত রাযী-গাযালী এসেছেন এখানে এই পবিত্র ভূমিতে! তারাও এখান থেকে নিয়ে গেছেন কোরবানির শিক্ষা এবং এখানে রেখে গেছেন কোরবানির শিক্ষা! আর আজ! আমার মত পাপী গোনাহগার বান্দা মাওলার দাওয়াতে মেহমান হয়ে এসেছি এখানে! হে আল্লাহ, যে উদ্দেশ্যে আমাকে তুমি এনেছো এখানে তা অর্জন করার তাওফীক দাও আমাকে। তোমার খালীলের এবং তোমার হাবীবের কলবে তোমার প্রতি যে ইশক ও মুহাববাত ছিলো, তোমার পথে কোরবান হওয়ার এবং কোরবান করার যে পাক জাযবা ছিলো তার কিছু হিসসা তুমি ছাহাবা কেরামকে দান করেছো, তাবেঈন ও তাবয়ে তাবেঈনকে দান করেছো, যুগে যুগে তোমার আশিক ও প্রেমিক বান্দাদের দান করেছো, হে আল্লাহ, তার কিছু ছিটেফোঁটা আজ আমাকেও দান করো। হে আল্লাহ, এ পাক যমীনে এসে আবার নিজের কর্মদোষে বঞ্চিত যেন না হই। হে আল্লাহ, এখানে সেই কোরবানির কাহিনী ছাড়া আর সব কিছু যেন ভুলে যাই এবং ভুলে থাকি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)