সোসাইটি নামে দালালিভিত্তিক কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান : অর্থনীতি ও ফিকহে ইসলামীর আলোকে বিশ্লেষণ ও শরয়ী সমাধান
ভূমিকা : দীর্ঘদিন যাবৎ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মারকাযুদ দাওয়াহ ঢাকা-এর দারুল ইফতা ও মাসিক আলকাউসারের প্রশ্নোত্তর বিভাগে অনেক প্রশ্ন আসছে, যেগুলো সোসাইটির নামে আত্মপ্রকাশ করলেও তাদের মূল কাজ হল বীমা পলিসির মতো দালালী পন্থা অনুসরণ করে মুদারাবাহ অর্থ সংগ্রহ করা এবং দালালদেরকে পার্সেন্টেজের হিসাবে কিংবা নির্ধারিত বেতন আকারে কমিশন প্রদান করা। যেমন এহসান এস, সেবক সোসাইটি, তামাদ্দুন, সৌরভ, শাবাব, সাউথ এশিয়া, বি.সি.আই, সিলভার ইত্যাদি।
যেহেতু মুফতী বোর্ড, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেও এ বিষয়ে ইস্তেফতা এসেছিল এবং ওই সব প্রতিষ্ঠানের শরয়ী হুকুমের বিষয়টি মুফতী বোর্ডে আলোচনাধীন ছিল এজন্য এতদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ফতোয়া প্রচার করা হয়নি এবং আলকাউসারে কোনো প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়নি।
এক বছরেরও অধিক সময় সম্মিলিত আলোচনা ও পর্যালোচনার পর কিছু দিন পূর্বে মুফতী বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত লিখিত আকারে সামনে এসে গেছে। এ অবস্থায় স্বতন্ত্র কোনো প্রবন্ধের পরিবর্তে মুফতী বোর্ড ঢাকার ওই সম্মিলিত সিদ্ধান্তই আলকাউসারে প্রকাশ করা মুনাসিব বলে মনে হয়েছে। তাই মুফতী বোর্ড ঢাকা-এর অনুমতিক্রমে ফতোয়াটি প্রকাশ করা হচ্ছে।
মুফতী বোর্ডের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল মূলত সেবক সোসাইটি ও তামাদ্দুন সম্পর্কে। এজন্য এই ফতোয়ার সকল আলোচনা এ দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেই প্রযোজ্য হবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই ফতোয়ার মৌলিক কথাগুলো এ ধরনের সকল সোসাইটির জন্যই প্রযোজ্য। কেননা, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেকটির কর্মপদ্ধতি হল, তারা মালে মুদারাবা সংগ্রহ করার জন্য দালালী পন্থা অনুসরণ করে থাকে এবং দালালদেরকে পার্সেন্টেজ হিসেবে কিংবা নির্ধারিত বেতন আকারে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে, যা সরাসারি বা প্রকারান্তে মুদারাবার ব্যয় হিসেবে পরিগণিত। বলাবাহুল্য যে, এই একটি বিষয়ই এ ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোর কারবার ফাসিদ, নাজায়েয ও ওয়াজিবুল ফসখ (আবশ্যকীয়ভাবে প্রত্যাহারযোগ্য) হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এরপর যেসব সোসাইটিতে আরো অতিরিক্ত সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোর অবস্থা তো আরও মারাত্মক।
মুফতী বোর্ড একটি ভালো কাজ এই করেছে যে, ফতোয়ার শুরুতে একটি বিশদ ভূমিকা সংযুক্ত করেছে। এই ভূমিকাটি যদি মনোযোগ সহকারে পড়া হয় তাহলে এমন অনেক প্রশ্ন খুব সহজেই দূর হবে, যা আলোচিত বিষয়ের শরয়ী সমাধান বুঝতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
আল্লাহ তাআলা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঠিক কথা বোঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন
-তত্ত্বাবধায়ক
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين وعلى آله وأصحابه أجمعين، أما بعد!
[মূল উত্তরের আগে ইসলামী অর্থনীতির আলোকে চলমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর কিছুটা আলোকপাত করা হচ্ছে।]
ভূমিকা : ভোগ-বিলাসমুখী এ দুনিয়ায় মানুষ অন্যের টাকা হাতিয়ে নেয়ার বহু পন্থা আবিষ্কার করেছে এবং আবিষ্কার করেই চলেছে। এর মধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মিথ্যা দাবী, চাঁদাবাজির মতো সর্বজন ঘৃণিত রাস্তাগুলো অবলম্বন করে থাকে কেউ কেউ। কিন্তু অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে সুকৌশলে এবং বিভিন্ন চুক্তি ও কারবারের নামে। জনসেবা, আর্তমানবতার কল্যাণ, স্বনির্ভর করা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, রাতারাতি বড়লোক বানিয়ে দেওয়া, অল্প পরিশ্রমেই প্রতিমাসে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা রোজগারের ব্যবস্থা প্রভৃতি শ্লোগানকে সামনে নিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা।
উদাহরণস্বরূপ জুয়া, বীমা, কমোডেটি এক্সচেঞ্জের ফিউচার সেল, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং, শেয়ার বাজারের জুয়া সদৃশ বিভিন্ন লেনদেন, কতিপয় এনজিও ও সোসাইটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। মুসলমানদেরকে হারাম উপার্জন থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এবং তাদের কষ্টার্জিত অর্থ ঝুঁকিতে ফেলার ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য নিম্নে এগুলোর কয়েকটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা হচ্ছে
জুয়া ও লটারি : অবৈধভাবে অর্থোপার্জনের এ পদ্ধতি সনাতনী হলেও এ যুগে লটারি এবং স্ক্র্যাচ কার্ডের নামে চালু হয়েছে বহুবিধ রমরমা ব্যবসা। বিভিন্ন পুরস্কার প্রাপ্তির প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয় সাধারণ জনগণের কোটি কোটি টাকা।
কমোডেটি এক্সচেঞ্জ/ফিউচার সেল : ভবিষ্যতে কোনো পণ্য খরিদের বাহানা করে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে (পণ্য বা মূল্য কিছুই আদান-প্রদান না করে) টাকা কামাবার একটি আধুনিক পুঁজিবাদী সংস্করণ।
এনজিও : সেবা ও সহযোগিতার শ্লোগান নিয়ে সুদের আবিষ্কারকদের মদদপুষ্ট এ দেশী এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আটকে ফেলছে ‘সুদ’ নামক ভয়াবহ অভিশাপের বেড়াজালে। একদিক থেকে গরিব জনগণের কষ্টার্জিত রোজগারের সঞ্চয়গুলো নিজেদের ব্যবসার জন্য এনে হারাম মিশ্রিত করছে, অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণের নামে লেখাপড়া না জানা সাধারণ লোকদের কাছ থেকে উঠিয়ে আনছে বিপুল পরিমাণ সুদ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে বানানো জিনিসগুলো শহরের হাই-ফাই শো রুমগুলোতে এসে চড়া দামে বিক্রয় করলেও উৎপাদনকারীদের মজুরি দেয়া হচ্ছে নামমাত্র। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সেবা কার্যক্রম চালিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তারা খুলে ফেলতে পারছে বড় বড় ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়, অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং নির্মাণ করছে বিশাল বিশাল টাওয়ার।
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং : ব্যবসার নামে সাধারণ লোকজনের টাকা হাতিয়ে নেয়ার এটি আধুনিক আবিষ্কার। এ পদ্ধতিতে মূলত ব্যবসার পরিবর্তে একটি বহুমাত্রিক দালালি কার্যক্রম এবং তার বিনিময় ও বোনাস নিয়ে গবেষণা হয়ে থাকে অনেক বেশি। একজন ক্রেতা সদস্য কতজনকে ক্রেতা বানালে কী কী সুবিধা পাবে আবার তারা অন্যদেরকে বানালে কার কী লাভ হবে, কোন পর্যায়ের ব্রোকারি করতে পারলে লাখপতি হওয়া যাবে আবার কোন স্তরের দালালির জন্য বিদেশ সফর করা যাবে, সিলভার, গোল্ড, প্লাটিনাম স্তর অতিক্রম করে প্রেসিডেন্ট হওয়া যাবে এসব প্রশিক্ষণই এ কোম্পানিগুলো বেশি দিয়ে থাকে। এ কারবারে প্রথম দিকের দালাল সদস্যগণ উপকৃত হলেও পরের দিকের লোকেরা তেমন সুবিধা করতে পারে না। এজন্য এ পর্যন্ত বহু এম.এল.এম কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।
গাছ সমাচার : কোনো কোনো মাল্টিলেভেল গ্রুপের সদ্য আবিষ্কার এটি। বর্তমানে কারবারটি নাকি জমজমাটভাবে চলছে। সামান্য মূল্যের কয়েকটি গাছের চারা ১২ বছর পর হস্তান্তরের কথা বলে বিক্রয় করা হচ্ছে ৫ হাজার টাকায়। আর এক শ্রেণীর ক্রেতার জন্য ৫ হাজার টাকা মূল্য সামান্যই। কারণ এর মাধ্যমে সে ব্রোকার হয়ে আরো ক্রেতা সংগ্রহ করে পাবে লাখ লাখ টাকা বোনাস। তাই ক্রয়-বিক্রয়ের পরিবর্তে এখানে ৫ হাজার টাকার ক্রেতা সংগ্রহের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে থাকে। যেখানে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপক্ক গাছের অপরিপক্ক ফলও বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন সেখানে কেউ কেউ নাকি ১২ বছর পরে গাছ বা মূল্য সরবরাহ করার শর্তে গাছকেন্দ্রিক উক্ত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (সঠিক অর্থে মাল্টিলেভেল ব্রোকারেজ) কে জায়েয বলারও ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকেন।
শেয়ার বাজার : কৌশলে রাতারাতি সাধারণ লোকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার আরেকটি কেন্দ্র শেয়ার বাজার। এখানে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল মাঝে মাঝেই বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে এবং প্রতারণা ও চালাকি করে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের নামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
বীমা : বীমা পদ্ধতি বেশ পুরনো হলেও বর্তমানে এ ব্যবসাটি খুব জমজমাট। ব্রোকার/প্রতিনিধিদের লেকচারে আতঙ্কিত/অভিভূত হয়ে অনেকেই তাদের হাতে অন্তত প্রথম কিস্তির টাকা দিয়ে পলিসি গ্রহণ করে থাকে। আর এতেই এজেন্ট/ব্রোকারদের পোয়া বারো অবস্থা হয়ে যায়। কারণ প্রথম কিস্তির টাকার প্রায় ৮০%ই চলে যায় বিভিন্ন স্তরের ব্রোকারদের হাতে। পরবর্তীতে গ্রাহকদের কিস্তি চালু থাকলে তো তাদের কমিশন চালু থাকছেই, না হয় প্রথম কিস্তির পুরো টাকাই তারা পেয়ে যাচ্ছে। বীমা সম্পর্কে আরো কিছু কথা এ লেখার শেষের দিকে বলা হবে ইনশাআল্লাহ।
নিজের টাকা নিজের একাউন্টে রেখেই মাসে মাসে বিশাল কামাই : দৈনিক পত্রিকাগুলোর ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনের পাতায় এ শিরোনামের বিজ্ঞাপন প্রায়ই নজরে পড়ে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে আপনার টাকা আপনার নামেই আপনার একাউন্টে থাকবে। তবুও সে টাকার কারণে আপনি ভিন্ন সূত্র থেকে মাসে ২০/৩০ হাজার টাকা অর্জন করতে পারবেন। কিছু দুষ্ট চক্র এভাবেই সাধারণ মুসলিম জনগণকে হারাম খেতে উৎসাহিত করে থাকে এবং তাদের টাকা বিশাল ঝুঁকিতে ফেলে পরোক্ষভাবে সু-কৌশলে তা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করে থাকে। টাকাওয়ালা ব্যক্তিকে অন্যের ঋণের গ্রান্টার (জামিন) বানিয়ে এর বিনিময়ে দেয়া হয় সুদ। কিন্তু যদি ঋণ গ্রহিতা ঐ ঋণ পরিশোধ না করে পালিয়ে যায় তবে গ্রান্টারের টাকার কী হবে? উপরোক্ত চক্রটির দ্বীন-শরীয়ত সম্পর্কে অনবগত মুসলিম সমাজকে শুধু হারাম পথেই নামাচ্ছে না; বরং তাদের কষ্টার্জিত টাকাগুলোকেও ফেলছে মারাত্মক ঝুঁকিতে।
সোসাইটি প্রসঙ্গ : ঢাকাকে এক সময় বলা হত মসজিদের শহর। শহরের আয়তন ও আবাদীর তুলনায় সে সময়ে ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা ছিল অনেক। সেটি এখন অতীতের ইতিহাস। এরপর ঢাকা আরো অনেক কিছুর শহরে পরিণত হয়েছে। এক সময়ে হয়ে উঠেছিল ভিডিও গেমসের শহর। অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল এর দোকান। কিন্তু বর্তমানে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ঢাকা কীসের শহর বা ঢাকা শহরের অলি-গলিতে কীসের সাইনবোর্ড বেশি বেশি নজরে পড়ে? তাহলে অনেকেই এর জবাবে সহজে বলে দিবেন যে, বর্তমানে ঢাকা হল মাল্টি পারপাস সোসাইটির শহর। শুধু রাজধানী কেন বিভাগীয় এবং মফস্বল শহরগুলোতেও এখন এসব সোসাইটির ব্যাপক ছড়াছড়ি। কেউ উদ্যোগী হয়ে এমন একটি সোসাইটি করে অফিস খুলে বসতে পারলেই হল। অর্থ জোগানের কাজ আঞ্জাম দিবে মিডিয়া তথা দালালগণ। ২০-৩০% কমিশনের বিনিময়ে এ সকল ব্রোকার বড় বড় মুনাফা দেয়ার কথা বলে নিম্ন আয়ের মানুষের জমানো অর্থকড়ি এনে সোসাইটিকে দিয়ে থাকে। দেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত ও স্বল্প আয়ের হওয়ার সুবাদে তাদেরকে বিনিয়োগকারী পেতে বেগ পেতে হয় না। যে ফতোয়ার জন্য এ ভূমিকা লেখা হচ্ছে তা মূলত এ ধরনের সোসাইটিগুলো সম্পর্কিত। নিম্নে আলোচিত সোসাইটিগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য সামান্য ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরা হল।
প্রচলিত সোসাইটিগুলোর বৈশিষ্ট্য
১) নামে সেবা কামে ব্যবসা
আলোচিত সোসাইটিগুলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও তারা সরকারী রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করে থাকে অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসাবে তারা নিবন্ধিত হয় না।
২) সদস্যগণ অংশিদার নয় বরং বিনিয়োগকারী
এ সংস্থাগুলোতে যারা বিনিয়োগ করে থাকে এবং যাদেরকে তারা সদস্য বলে থাকে তারা মূলত আইনগতভাবে সোসাইটির কোনো অংশিদার নয়। সোসাইটির সম্পদে তাদের কোনো অধিকার নেই। সোসাইটি পরিচালনায় তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রাখার আইনগত সুযোগ নেই। বরং তারা হল শুধুমাত্র অর্থ জমাদানকারী তথা বিনিয়োগকারী।
৩) কমিশন বাণিজ্য
আলোচিত সোসাইটিগুলোর কার্যক্রমের মূল আকর্ষণ হচ্ছে কমিশন। মাঠকর্মী/কামেল-মোকাম্মেল/উন্নয়নকর্মী বা এ ধরনের অন্যান্য খেতাবধারী অসংখ্য লোক রাতদিন ব্যস্ত থাকে এদের জন্য অর্থসংগ্রহের কাজে। তারা মানুষকে এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে টাকা খাটাতে উদ্বুদ্ধ করতে থাকে এবং বিনিময়ে হাসিল করে থাকে মোটা অংকের কমিশন ২০-২৯% পর্যন্ত। আর লাখ টাকার বিনিয়োগ এনে দিতে পারলে প্রতিমাসে ১,০০০/- করে এদের জন্য বরাদ্দ থাকে।
৪) সিকিউরিটি মানি
কোনো কোনো সোসাইটি কর্মীদের থেকে ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা করে সিকিউরিটি মানির নামে নিয়ে তা নিজেদের ব্যবসায় খাটিয়ে থাকে।
৫) মূলধন ফেরত ও লাভ প্রদানে শর্তারোপ
টাকা দাতাদেরকে সোসাইটির অংশিদারিত্ব না দিলেও এ সোসাইটিগুলো জনগণের টাকা ফেরত দানে গড়িমসির আশ্রয় নিয়ে থাকে। বহুল আলোচিত একটি সোসাইটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বারবার নির্দেশ প্রদান সত্ত্বেও মানুষের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার কারো কারো এমন বিধান রয়েছে যে, জমাকারী ১ বছর আগে তার মূলধন ফেরত নিতে পারবে না এবং ২ বছর পূর্বে টাকা নিলে কোনো লভ্যাংশ পাবে না। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে মানুষের টাকা থেকে অর্জিত লাভ সোসাইটি এককভাবে ভোগ করবে।
৬) প্রশিক্ষণের নামে টাকা গ্রহণ
কেউ কেউ কর্মী প্রশিক্ষণের নামেও হাজার হাজার টাকা গ্রহণ করে নিজেদের তহবিল ভারি করে থাকে।
উপরোক্ত বৈশিষ্টের অসংখ্য সোসাইটি রয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশে। এর মধ্যে আবার কিছু সোসাইটি তাদের কারবারকে শরীয়া নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার দাবি করে থাকে। এ দ্বিতীয় শ্রেণীর সংস্থা বর্তমানে ছেয়ে যাচ্ছে ব্যঙ্গের ছাতার মতো। কিছুদিন পরপরই সুন্দর সুন্দর নাম নিয়ে একেকটি সোসাইটি গড়ে উঠছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এ ধরনের একটি সোসাইটি গড়ে উঠে কয়েক বছর আগে কৃষি ব্যাংকের একজন অফিসারের হাত ধরে। ভদ্রলোক শুরুতেই কয়েকজন মাওলানা সাহেবকে এর সাথে জড়িয়ে নেন। এরপর বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক এবং ইমাম-মুয়াজ্জিনদের মাধ্যমে তা ঐ এলাকার জেলাগুলোতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে দেশব্যাপী তার কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। সোসাইটির জন্য মানুষ থেকে টাকা জমা করে ২০% কমিশন পান কামেল-মোকাম্মেল খেতাবধারী ব্যক্তিগণ। অর্থাৎ মাসে ১ লাখ টাকা উসুল করলে তার থাকবে ২০ হাজার টাকা। এভাবে ব্রোকার ব্যক্তিগণ যেমনিভাবে টাকা কামিয়ে থাকে তেমনিভাবে সোসাইটির উদ্যোক্তারাও ঘরে বসে কোটি কোটি টাকার ডিপোজিট পেয়ে যান। সম্ভবত অর্থপ্রাপ্তির উক্ত দু’টি সহজ পন্থাই অনেক লোকজনকে এ ধরনের সোসাইটি গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে। আর শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত হওয়ার শ্লোগান যোগ হওয়ায় সাধারণ মুসলমানগণও ব্যাপকভাবে তাতে অংশগ্রহণ করছে।
নিম্নে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক এবং শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে উপরোক্ত সোসাইটিগুলোর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পেশ করা হচ্ছে।
বাণিজ্যিক বিশ্লেষণ
অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে এ সকল সোসাইটির দুর্বলতা ও চরম ঝুঁকির বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠে। কারণ যে প্রতিষ্ঠান ব্যবসার নামে মানুষ থেকে টাকা উঠিয়ে তা কারবারে লাগাবার আগেই এর ৩০-৪০% (কমিশন ও সংস্থা পরিচালনা খরচ) ব্যয় করে ফেলে তার ভিত্তি যে কত দুর্বল একথা দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের খোঁজখবর রাখে এমন যে কেউ সহজেই অনুধাবন করতে পারবে। উদাহরণ স্বরূপ ধরে নেয়া যাক, একটি সোসাইটি ২০ জন লোক থেকে ২০,০০০/- টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করল। এর থেকে (২৯%) ৫,৮০০/- টাকা কমিশন দিল টাকা উঠিয়ে আনা কর্মীদেরকে, আর নিজেদের অফিস ভাড়া, অফিস পরিচালনা খরচ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিছনে খরচ করল আরো কম পক্ষে (১১%) ২,২০০/- টাকা, তাহলে ব্যবসায় লাগার আগেই এ টাকা থেকে বিয়োগ হয়ে গেল ৮০০০/- টাকা। বাকি থাকল ১২,০০০/-টাকা। এখন এ ১২,০০০/- টাকাকে মূলধন ২০,০০০/- এর সমান করার জন্য প্রয়োজন আরো ৮,০০০/- টাকা। যদি প্রথম বছরের লাভ আট হাজার এর কম হয় তাহলে দেখা যাবে মূলধনেই ঘাটতি থেকে গেছে। এবং ব্যবসা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। আর যদি ১ বছরে ৪০% মুনাফা অর্জিত হয় তবে মূলধন সমান হবে এবং লাভ দেয়া-নেয়ার জন্য কিছুই থাকবে না।
এখন দেখার বিষয় হল, ইসলামী তরীকায় পরিচালিত হওয়ার দাবিদার সোসাইটিগুলো সাধারণত শতকরা কত ভাগ মুনাফা করে থাকে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, এরা সাধারণত মুরাবাহা বিনিয়োগ করে থাকে। আর জানা কথা যে, এ বিনিয়োগে লাভের হার আগেই ঠিক হয়ে যায়। সোসাইটিগুলো সাধারণত বার্ষিক ২০% মুনাফায় মুরাবাহা করে থাকে। এখন ১২,০০০/- টাকা বিনিয়োগ করলে মুনাফা হয় ২৪,০০/- (চবিবশ শত) টাকা। আর যদি কিস্তি আদায়ের পর তা রুলিং হয়ে পুনবিনিয়োগ হয় তবে তা অনুর্ধ্ব ৩০% হলে অংকটি হবে ৩,৬০০/- (ছত্রিশ শত টাকা) টাকা। এ হিসাবে ১২,০০০+৩,৬০০=১৫,৬০০/-। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত টাকার সকল কিস্তি যথাসময়ে আদায় হলে এবং তা পুনঃবিনিয়োগ হলেও ২০,০০০/- টাকার মূলধন বছরান্তে ১৫,৬০০/-টাকায় গিয়ে পৌঁছবে? যার অর্থ হল, মূলধনের ঘাটতি এখনো ৪,৪০০/-টাকা। উপরোক্ত হিসাবে ২ বছর যদি ঠিকমত ব্যবসা হয় এবং লাভ ও মূল ফেরত পাওয়া যায় তাহলে হয়ত মূলধন সমান হতে পারে। লাভের বিষয়টি তখনো থাকবে অনেক দূরের ব্যাপার।
উপরোক্ত উদাহরণ দ্বারা একথাই শুধু বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, এ সকল সোসাইটির আর্থিক ভিত্তি খুবই দুর্বল ও নাজুক। বরং ব্যবসা বহির্ভূত খাতে মূলধনের একটি বড় অংশ খরচ করে ফেলায় জমাকারীদের টাকা পড়ে যায় বিপদজনক স্তরের ঝুঁকিতে। এবং পূর্ববর্তী জমাকারীদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই মুনাফা পরিশোধ করতে হয় পরবর্তী জমাকারীদের টাকা থেকে। অর্থাৎ ব্যবসায় লাভ না হলেও যেহেতু মাঠকর্মী তথা ব্রোকারদের কল্যাণে তারা নতুন নতুন সদস্য পেয়ে থাকে তাই এদের জমাকৃত টাকা দিয়েই আপাতত পূববর্তীদেরকে বুঝ দেওয়া যায়। এ কারণেই দেখা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নোটিশ পাওয়া একটি সোসাইটি ৬০% পর্যন্ত লভ্যাংশ (!) বন্টন করার প্রতারণাও করেছে। বর্তমানে কোনো কোনো সোসাইটি এমন রয়েছে যাতে কেউ ১ লক্ষ টাকার ডিপোজিট এনে দিলে সে ব্রোকার প্রতিমাসে ১০০০/-টাকা করে বোনাস পেতে থাকে এবং টাকা দাতার জন্য ঘোষিত রয়েছে মাসিক ২,০০০/- টাকা করে। অর্থাৎ প্রতিমাসে (১,০০০+২,০০০) ৩,০০০/- করে বার্ষিক ৩৬০০০/- (ছত্রিশ হাজার) টাকা তারা শুধু ডিপোজিটার ও ব্রোকারের পিছনে খরচ করেছে। এরপর রয়েছে সংস্থা ও ব্যবসা পরিচালনার বিশাল খরচ। অথচ মুরাবাহা বিনিয়োগ করে যদি মূল ও লভ্যাংশের সকল টাকা হাতেও এসে যায় (ব্যবসা ক্ষেত্রে যা বিরল) এবং কিস্তির টাকাগুলো বারবার রুলিংও হয় তবুও মুনাফা ৩০% অতিক্রম করার কথা নয়। সুতরাং আলোচিত সোসাইটিগুলোকে বীমা কোম্পানি ও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর মতো অনেক ক্ষেত্রেই এক জমাকারীর টাকা দিয়ে অন্য জমাকারীকে বুঝ দিতে হয় তা বলাই বাহুল্য। কোনো কোনো সোসাইটির বাস্তবভিত্তিক হিসাব সামনে এনে তাদের এসেট ও লায়বিলিটি (সম্পদ ও দায়) এর পুঙ্খানুপঙ্খু বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। প্রসঙ্গত একটি সোসাই&&টর উদাহরণ টানা যেতে পারে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ঐ সোসাইটির কর্ণধার ব্যক্তিটি (বাস্তবে প্রতিষ্ঠাতা বা এম.ডি হলেও তিনি কিন্তু কাগজে-কলমে সংস্থার কেউ নন, বরং খাতাপত্রে তার স্ত্রী হচ্ছেন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কারণ প্রতিষ্ঠাতা সাহেব একজন সরকারী কর্মকর্তা) যিনি এখনো একটি সুদী ব্যাংকে কর্মরত আছেন। অথচ তিনি কিনা লক্ষ লোককে সুদ থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঐ সোসাইটির একজন উচ্চ পদস্থ আলেমকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, এম.ডি সাহেব কেন এখনো কৃষি ব্যাংকে কর্মরত? তিনি তখন জবাবে বলেন যে, ‘অনেক আগেই তো সরে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সোসাইটির জন্য ব্যাংক থেকে লোন নেয়া হয়েছে। তাই তা পরিশোধের আগে তিনি ঐ ব্যাংক ছাড়তে পারছেন না।’ এ তথ্য যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে তা খুবই ভয়ঙ্কর। এমন একটি সোসাইটি, যে সুদের মোকাবেলায় ইসলামী পন্থায় অর্থগ্রহণ ও বিনিয়োগের কথা বলে লক্ষ লোককে তাদের সাথে জড়াচ্ছে, অনেক বুযুর্গ সরলমনা আলেমের সমর্থন নিচ্ছে তার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ব্যক্তিটি বহু বছর পার হওয়ার পরও সুদী ব্যাংকের সামান্য একটি চাকুরী ছাড়তে পারছেন না, আবার সেখানে নাকি ঐ সোসাইটির নামে লোনও আছে। জানা কথা যে, ঐ ব্যাংক সুদের ভিত্তিতেই লোন প্রদান করে থাকে।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ সোসাইটিগুলোর আরেকটি বড় সমস্যা হল, এগুলো প্রচার-প্রচারণার দিক থেকে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান হলেও রেজিস্ট্রেশনের দিক থেকে সম্পূর্ণ সেবামূলক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান (এ লেখার শুরুর দিকেও কথাটা বলা হয়েছে)। ফলে, মানুষের অর্থকড়ির আইনগত নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। বিষয়টি আরো বেশি উদ্বেগজনক এজন্য যে, ব্রোকারী পদ্ধতির কারণে মসজিদ-মাদরাসার সাথে জড়িত অসংখ্য লোক বর্তমানে এসব সোসাইটির জন্য মানুষের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করছে। এখন যদি (আল্লাহ না করুন) কখনো কোনো বিপদ ঘটে তবে পুরো বদনামটাই হবে সাদা পোশাকের লোকদের।
শরঈ বিশ্লেষণ
আলোচিত সোসাইটিগুলোর শরঈ বিশ্লেষণ করতে গেলে বিষয়টি খুবই করুণ ও বিব্রতকর হয়ে উঠে। এক শ্রেণীর তরুণ-যুবক আলেম-ওলামাদের দ্বারা পরিচালিত এবং সরলমনা কিছু বড় ব্যক্তিদের দ্বারা সমর্থিত ইসলামী তরীকায় পরিচালিত হওয়ার দাবিদার এ সংস্থাগুলোতে এত মারাত্মক ধরনের এবং বিভিন্ন প্রকারের শরঈ ত্রুটি থাকতে পারে তা বাহ্যিক দিক দেখে অনেকে বিশ্বাসই করতে চাবে না।
লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কারবারের ক্ষেত্রে শরীয়তে যে বিষয়গুলো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ তার মধ্যে الغرر، الغصب، الخيانة، الغش، الرشوة এ পরিভাষাগুলোরসংক্ষিপ্ত সারমর্ম নিম্নরূপ :
‘আলখিয়ানাহ’ এটি الأمانة (আলআমানাহ)এর বিপরীত পরিভাষা। যার শাব্দিক অর্থ হল বিশ্বাস ভঙ্গ করা।
‘আলগাছাব’এর শাব্দিক অর্থ হল ছিনতাই করা, লুট করা।
‘আলগারার’এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ধোকা, অস্পষ্টতা, অস্বচ্ছতা
‘আলগাশ্’এর শাব্দিক অর্থ হল প্রতারণা, ভেজাল মিশ্রণ।
الرشوة (আররিশওয়াহ) এর শাব্দিক অর্থ হল উৎকোচ, ঘুষ, বিনিময়হীন উপার্জন।
উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত পরিভাষাগুলো বহু হাদীসে বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে তাদের লেনদেন ও কারবারে এগুলো থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর এ নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর সবই কুরআনুল কারীমে নিষিদ্ধ (আকলু মালিল গাইরে বিল বাতিল) অবৈধ পন্থায় অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া’-এর অন্তর্ভুক্ত।
আলোচিত সোসাইটিগুলোতে উপরোক্ত নিষিদ্ধ বিষয়গুলো কীভাবে উপস্থিত আছে তা অত্র উত্তরপত্রে সুস্পষ্টভাবে দলীল-প্রমাণসহ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, মুফতী বোর্ড ঢাকা অত্র সমাধান তৈরি ও প্রকাশে কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো করেনি; বরং দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তাহকীক ও গবেষণা করে, অনেকগুলো দীর্ঘ সময়ের মিটিংয়ে পর্যালোচনা করে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা-বার্তা বলে ও তাদের থেকে পাওয়া কাগজ-পত্র আর তাদের বাস্তব কর্মগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণের পর সব দিক নিশ্চিত হয়ে জবাবটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মুফতী বোর্ডের ৩ সফর ১৪২৯ হিজরী মোতাবেক ১১/০২/০৮ঈ. তারিখের সভায় সোসাইটিগুলোর কারবার নাজায়েয হওয়া সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এরপর উত্তরটি যখন বিন্যাস ও প্রকাশের পর্যায়ে ছিল সে সময় পুরানা পল্টন কেন্দ্রিক একটি সোসাইটির পক্ষ থেকে ‘প্রশ্ন ও তার জবাব’ শিরোনামে ৮ পৃষ্ঠার একটি লেখা বিভিন্ন দারুল ইফতায় দেওয়া হয়। এতে ঐ সোসাইটির বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর আকারে মতামত পেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই মুফতী বোর্ডের এই সমাধানটি প্রকাশের পূর্বে ঐ প্রশ্নোত্তর ভালোভাবে পড়ে শরীয়তের নিরিখে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। যদিও তাদের ঐ ‘প্রশ্ন ও তার জবাব’-এ অনেক অসঙ্গতি, স্ববিরোধিতা, ভুল তাকয়ীফ (تكييف) এবং অস্পষ্টতা রয়েছে তবে আশার কথা হল, তাতে স্বীকার করা হয়েছে যে, এ ধরনের সোসাইটির কারবার (فاسد) ফাসেদ। যেহেতু মূল বিষয়ে অর্থাৎ কারবারটি (فاسد) ফাসেদ তথা বাতিলযোগ্য ও শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়েছেন তাই বিষয়টির স্পর্শকাতর হওয়া এবং হালাল-হারাম সংক্রান্ত হওয়ার কথা মাথায় নিয়ে অনতিবিলম্বে এ সকল কারবার ও নাজায়েয চুক্তিগুলো বন্ধ ও বাতিল করা দরকার।
প্রকাশ থাকে যে, এ সমাধানটি শুধু এজন্য তৈরী হয়েছে যে, বেশ কিছু দিন থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছিল যে-
১.হক-হালালের উপর পরিচালিত তাবকার (গোষ্ঠির) অনেক তালাবা, ওলামা, ইমাম-মুয়াজ্জিন এবং দ্বীনদার শ্রেণীর লোক এ কারবারে জড়িয়ে পড়েছে এবং দৈনন্দিন এ সকল সংস্থা ও এতে জড়িতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২.ইসলমী তরীকায় পরিচালিত হওয়ার দাবির প্রেক্ষিতে বহু পরহেজগার লোক এ সংস্থাগুলোতে টাকা জমা রাখা শুরু করেছে।
৩.মাসআলার তাহকীক না থাকায় অনেক তরুণ-যুবক আলেম এ ধরনের নতুন নতুন সোসাইটি বানানোর ব্যাপারে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছে।
৪.মুফতী বোর্ড ঢাকাসহ প্রায় সকল দারুল ইফতা ও মুফতী সাহেবদের নিকট এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।
৫.এবং দুঃখজনক ভাবে তালেবে ইলম ও আসাতিযায়ে কিরামের একটি অংশ নিজেদের পেশাগত মূল দায়িত্বকে দু’নম্বরে রেখে এ সকল সংস্থার মাঠকর্মী, সমন্বয়কারী, কামেল, মোকাম্মেল ও উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনে উঠে পড়ে লেগেছে। এবং এ বিষয়ে বহু প্রতিষ্ঠান ও মাদারেসের জেলা সমিতি থেকে দুঃখজনক অভিযোগও এসেছে।
তাই মুফতী বোর্ড ঢাকা দেশের ও ইসলামের ভবিষ্যত তালাবা সমাজ এবং জাতির রাহবার ওলামায়ে কেরাম এবং সুদ, ঘুষ, জুয়া ও প্রতারণা সমৃদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থনীতির এ যুগেও যে সকল মুসলমান হালাল-হারাম বেছে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের স্বার্থে এ সমাধান প্রকাশ করছে এবং উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে যে-
* যেহেতু অভিশপ্ত ইয়াহুদীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া এবং গোমরাহ নাসারাগণ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া পুঁজিবাদী অর্থনীতি বর্তমানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল দেশের লোকদের অর্থসম্পদ গ্রাস করে নিচ্ছে এবং তাদের প্রায় সকল কারবারে শরীয়ত নিষিদ্ধ বিষয়গুলো উপস্থিত থাকছে তাই যে কোনো ব্যবসায়ী চুক্তি করার পূর্বে এবং যে কোনো অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক, একক বা যৌথ মূলধনী কারবার শুরু করার আগেই তার শরঈ দিকগুলো সম্পর্কে অভিজ্ঞ মুফতীগণ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিন।
* ব্যবসা করা মুবাহ, কিন্তু হারাম-নাজায়েয থেকে বেঁচে থাকা ফরয-একথা সর্বদা খেয়াল রাখুন।
* ধন-সম্পদ জীবন চলার জন্য জরুরি এবং আখেরী যামানায় এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি, কিন্তু সেই অর্থ সম্পদ অর্জিত হতে হবে অবশ্যই হালাল পন্থায়। এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হারাম ও নাজায়েয উপার্জনের চেয়ে দারিদ্র ভালো।
* দ্বীনি খেদমতের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের জন্য মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে ধরনা দেয়ার মতো দালালি কর্মে নিয়োজিত হওয়া খুবই বেমানান।
প্রয়োজনীয় এ ভূমিকাটির পর এবার মূল উত্তর উপস্থাপিত হচ্ছে। উত্তরটি মুফতী বোর্ড ঢাকার সভায় সর্বসম্মতিক্রমে স্বাক্ষরিত ও গৃহিত হয়েছে।
মূল উত্তর :
প্রশ্নোক্ত সোসাইটিগুলোর কারবার শরীয়ত সম্মত কি না-এ বিষয়ে মুফতী বোর্ড ঢাকা এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। পাশাপাশি সোসাইটিগুলোর কর্মকর্তাগণও তাদের কারবারের শরয়ী অবস্থান জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং বিভিন্ন তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন। ফাতাওয়া বিভাগগুলোতে উক্ত সোসাইটিগুলো ছাড়াও এই নিয়মে পরিচালিত অন্যান্য সোসাইটি সম্পর্কে অহরহ ইস্তেফতা আসছে। মাদরাসার তালাবা, আসাতিযাসহ বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন সাহেবানও এগুলোর বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। এ ছাড়া সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানও এ ধারার সোসাইটিগুলোর শরয়ী অবস্থান জানতে চান। এ ধরনের সোসাইটির ব্যাপকতা এবং দ্রুত বিস্তৃতির কারণে এ বিষয়ের সবিস্তরে সুস্পষ্ট হুকুম প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল প্রকট। তথাপি এ বিষয়ে কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো না করে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করার কাজ অব্যহত ছিল। সোসাইটিগুলোর কর্মকর্তা এবং তাদের শরীয়াহ বোর্ডের বিভিন্ন সদস্যের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। সোসাইটি কর্তৃক প্রদত্ত কাগজ-পত্র থেকেও এ সংক্রান্ত তথ্যাদি একত্রিত করা হয়েছে। এছাড়াও তাদের সদস্য, কর্মীদের থেকেও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। অতঃপর মুফতী বোর্ডের অনেকগুলো সভায় বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনার পর উত্তরটি তৈরি হয়েছে। সহজে বোঝানোর লক্ষে উত্তরটিকে তিন স্তরে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
১. প্রচলিত ধারার সোসাইটিগুলোর ধরন ও মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ।
২. সোসাইটিগুলোর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ।
৩. সোসাইটিগুলোতে বিদ্যমান আপত্তিকর বিষয়সমূহ এবং ফিকহে ইসলামীর দৃষ্টিতে এসকল সোসাইটির শরয়ী হুকুম।
১. প্রচলিত ধারার সোসাইটিগুলোর ধরন ও মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ
ক) এ সোসাইটিগুলো কার্যক্ষেত্রে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান হলেও তারা নিবন্ধিত হয়ে থাকে অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে। আইনের দিক থেকে যে সংস্থার কোনো ব্যক্তি মালিকানা নেই।
খ) এরপর এই রেজিস্ট্রেশনকে ভিত্তি করে মানুষ থেকে বাণিজ্যিকভাবে টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
গ) সদস্যদের থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জমাগ্রহণ ও তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা হলেও সকল কার্যক্রমই পরিচালিত হয় ঐ দাতব্য সোসাইটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসাবেই।
ঘ) এ ধারায় গঠিত সোসাইটিগুলো নামে সেবা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হলেও কার্যক্ষেত্রে তারা সেবা বা দানের তেমন ধার ধারে না।
ঙ) এ সকল সোসাইটির একটি বড় স্বাতন্ত্র হল, সদস্য (অর্থজমাকারী) সংগ্রহের পলিসি। এরা সদস্য সংগ্রহের জন্য বীমা পলিসির মত দালালি নীতি গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সদস্য সংগ্রহ করে দিবে সে একটা মোটা অংকের টাকা পাবে। এবং এ সকল মধ্যস্বত্তভোগী লোকদেরকে তারা বিভিন্ন পদবী দিয়ে থাকে। যেমন উন্নয়ন কর্মী, সমন্বয়কারী ও উর্ধ্বতন সমন্বয়কারী। এ তিন ধাপে যথাক্রমে ২০%, ৭%, ও ২% মোট ২৯% কমিশন দেয়া হয়। আবার কেউ কেউ এসব ব্রোকারদেরকে খেতাব দিয়েছে ‘কামেল’, ‘মুকাম্মেল’।
এসকল সোসাইটিতে এই ব্রোকার বা দালালি পদ্ধতিটিই হল প্রধান আকর্ষণ। দালালির পারিশ্রমিক কেউ কমিশন হিসাবে দেয় আর কেউ নির্দিষ্ট অংকে দিয়ে থাকে। ব্যবসার লাভের চেয়ে সদস্য হয়ে কর্মী হওয়ার আশাই বেশি থাকে। এমনকি এই কমিশনের কথা বলে বলেই লোকদের ভিড়ানো হয়ে থাকে।
এছাড়া এ ধারার সোসাইটিগুলোর কোনো কোনোটিতে আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা নিম্নে তুলে ধরা হল-
১. একটি সোসাইটির নিয়ম হল যে, সদস্যদের থেকে জমা টাকার ৩% অফিস খরচের জন্য কেন্দ্রীয় অফিসে জমা হবে।
২. প্রকল্পে সদস্যদের ভর্তি ফি, বাতিল সদস্যপদ পুনর্বহালের জন্য পুনঃভর্তি ফি ১০০ বা ২০০ টাকা গ্রহণ করা হয়।
৩. সদস্য ভর্তি ফি, বাতিল সদস্যপদ পুনর্বহাল ফি, বিনিয়োগ আবেদন ফরমের মূল্য দাতব্য সোসাইটির আয় গণ্য করা হয়।
৪. একটি সোসাইটির নিয়ম হল, ‘জমার মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলে জমাকারীকে কোনো লাভ দেয়া হবে না।’ আর আরেকটির নিয়ম হল যে, ‘১ বছর বা এর কম সময়ে প্রত্যাহার করলে কোনো লাভ দেয়া হয় না।
৫. উন্নয়ন কর্মী থেকে ১,০০০ টাকা ফি গ্রহণ।
৬. কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স এ জমার নির্ধারিত মেয়াদের আগে জমা প্রত্যাহার করতে চাইলে তাকে পূর্বের চুক্তিকৃত হারে লাভ দেয়া হয় না। বরং সীমিত মেয়াদের জন্য জমার হারে লাভ দেয়া হয়।
৭. কেউ কেউ স্টাফদের থেকে ৫০,০০০ টাকা করে সিকিউরিটি মানি নিয়ে থাকে, যা দ্বারা দাতব্য সোসাইটি ব্যবসা করে।
(২) সোসাইটিগুলোর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ
ক) একথা স্পষ্ট যে, সোসাইটিগুলোর মূলভিত্তিই হল পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণা প্রসূত মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালি নির্ভর, যা বীমা কোম্পানিগুলোর কারবারের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়। বীমা কোম্পানিতে যেমন পলিসি হোল্ডারের প্রিমিয়ামের মোটা অংশ বরং সিংহভাগই ব্রোকারদের কাছে কমিশন হিসাবে থেকে যায়, জমাকারীদের টাকার অতি সামান্য অংশই অফিসে জমা হয়; তদ্রূপ সোসাইটিগুলোর পলিসিও দালালিনির্ভর। ব্যবসার নামে টাকা সংগ্রহ করা হলেও সে টাকা ব্যবসা বা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হওয়ার আগেই ২০% থেকে ২৯% পর্যন্ত মিডিয়া তথা দালালদেরকে দিয়ে দেওয়া হয়। ইসলামী শরীয়তের কোনো ব্যবসা, বিনিয়োগ বা কোনো ন্ঠপ্টদ্দ এর মধ্যে এর দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং এটি পুঁজিবাদীদের কারবারের বিভিন্ন পদ্ধতির মতই একটি পদ্ধতি। আর বলাইবাহুল্য যে, বর্তমান সোসাইটিগুলোতে দালালি নিয়ম বাদ দিলে এগুলোর আকর্ষণ শেষ হয়ে যাবে। এখন যেভাবে মনভোলা মানুষ এগুলোর পিছনে ছুটছে, সদস্য সংগ্রহকারীদের কমিশন দেয়া বন্ধ করে দিলে এগুলোর পিছনে লোকজন আর এভাবে ছুটবে না।
খ) সোসাইটিগুলোর ব্যবসানীতি পুঁজিবাদীদের দালালিপদ্ধতি নির্ভর হওয়ায় এতে ব্যবসা বহির্ভুত অতিরিক্ত ব্যয়ের দরুন লাভ তো দূরের কথা; বরং মূল পুঁজিই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ, মূল ব্যবসার বাইরেই (সোসাইটি ভেদে) ৪০% এর মতো ব্যয় হয়ে যায়। তাহলে জমার ৬০% দিয়ে ব্যবসা করে পুঁজির ঘাটতি পূরণ হতে প্রায় ৬৫% নীট মুনাফা হতে হবে। এই ৬৫% মুনাফা হলে শুধু মূল পুঁজির ঘাটতি পূরণ হবে, লাভ কিছুই থাকবে না। এরপর ব্যবসা-খরচ বাদ দিয়ে অন্তত ১০% লাভ দিতে হলেও ৮৫% মুনাফা হতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন লাভজনক ব্যবসা আছে কি? সম্ভবত এ বাস্তবতার কারণেই তারা এ নীতি প্রণয়ন করেছে যে, ‘এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে টাকা প্রত্যাহার করা যাবে না।’ অর্থাৎ এ সময়ের ভিতর লাভ তো দিবেই না, মূলও দিবে না। দিবে কোথা থেকে মূলের ৪০% তো নেইই। তা তো খরচ হয়ে গেছে কমিশন ও বেতন-ভাতার পিছনে। তাদের আরেকটি ধারা হল, ‘এক বছর বা দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সদস্যপদ প্রত্যাহার করলে কোনো লাভ দেওয়া হয় না।’ অর্থাৎ এ ধারা বানিয়ে তারা পরোক্ষভাবে স্বীকার করছে যে, কমিশনের কারণে কমে যাওয়া মূলধন লাভের উপযোগী হতেই এক বা দুই বছর চলে যায়। এখন ১ বছরের মাথায় আশানুরুপ অর্থাৎ প্রায় ৬৫% লাভ করতে না পারলে যেহেতু মূল পুঁজিরই ঘাটতি থেকে যায় তাই প্রত্যাহারকারীকে অন্যের টাকা থেকে দিতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়ে থাকে বীমাপ্রতিষ্ঠানে। মূল পুঁজির বড় অংশ যেহেতু ব্রোকারদের পিছনে চলে যায় তাই কোনো সদস্য প্রত্যাহার করতে চাইলে তাকে অন্যের টাকা থেকেই দিতে হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে মূল পুঁজি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং এ নিয়ম যে আত্মসাৎ ও অপরের হকে তসরুফনির্ভর তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।
গ) সেবামূলক সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে তাদের সদস্যনির্ভর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তারা দুই শ্রেণীর লোককে অন্ধকারে রেখে নিজেদেরকে সকল প্রকার জবাবদিহিতা থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। এক শ্রেণী হল, সরকার ও প্রশাসন। তাদেরকে এরা বুঝাচ্ছে যে, আমাদের এই প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয় বরং দাতব্য প্রতিষ্ঠান। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক/সরকারের নজরদারিরও প্রয়োজন নেই।
আরেকটি শ্রেণী হচ্ছে, জনগণ। যাদের থেকে মাঠকর্মী তথা ব্রোকারগণ টাকা সংগ্রহ করে থাকে। তারা বুঝছে যে, এ প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক রেজিস্টার্ড। আমাদের জমা টাকা সরকারী নজরদারি ও নিরাপত্তায় রয়েছে। অথচ ঘটনা পুরো উল্টো। আইনগত নিরাপত্তা তো নেই-ই বরং সরকার জানছে এ প্রতিষ্ঠান দাতব্য। এর মালিক কোনো একক ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী নয়। এর সবকিছু জনকল্যাণে ব্যয়িত হবে। এ পদ্ধতিতে যে সমস্যাটি রয়েছে তা হল, প্রতিষ্ঠাতাগণ এ পলিসি অবলম্বন করে আপাতত জমাকারীদের চাপ, ব্যবসায় তাদের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু জমাকারীগণের সব কিছু থেকে গেল ঝুকিপূর্ণ অবস্থায়। পরবর্তীতে যদি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা ডাকাতি হয়ে যায় তখন তারা সদস্যদের জমা ফেরত দেয়ার চাপে থাকছে না; বরং তাদের সকলকে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সদস্য বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ হাতে থাকল। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই হয়ত সদস্য ফরম, পরিচিতি, রশিদ ইত্যাদি সবকিছুতেই দাতব্য সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
(৩) শরীয়তের দৃষ্টিতে সোসাইটিগুলোতে বিদ্যমান আপত্তিকর বিষয়সমূহ এবং ফিকহে ইসলামীর দৃষ্টিতে সোসাইটিগুলোর শরয়ী হুকুম
শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর বিষয়সমূহ
এক : الغصب ও الخيانة (গছব ও খেয়ানত) এর বহুরূপ
ক) উন্নয়নকর্মী, ব্রোকার তথা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কমিশন প্রদান : শরীয়তের হুকুম হল, মুদারাবা কারবারে ব্যবসায়ীর হাতে গচ্ছিত টাকা আমানত। ব্যবসা বহির্ভুত যেকোনো কাজে খরচ করলেই সেটা খেয়ানত ও গছব তথা অন্যের সম্পদ আত্মসাতের শামিল হবে। ফিকহে ইসলামীর নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ তুহফাতুল ফুকাহা-তে আছে-
فإن خالف المضارب صار غاصبا والمال مضمون عليه، لأنه تعدى في ملك غيره
‘ব্যবসায়ী (মুদারেব) যদি নীতি-বহির্ভুত খরচ করে তবে সে গছবকারী সাব্যস্ত হবে। তাকে এ সম্পদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যেহেতু সে অন্যের মালিকানায় তসরুফ করেছে।’ -তুহফাতুল ফুকাহা ৩/২১
وكذا في المبسوط السرخسي 22/19؛ والمحيط البرهاني 18/129؛ ومجمع الأنهر 3/444؛ وشرح المجلة للأتاسي 4/33؛ والنتف في الفتاوى صـ 239.
وفي المغني لابن قدامة (7/162) : إذا تعدى المضارب وفعل ما ليس له فعله ... فهو ضامن للمال، انتهى
وكذا في الشرح الكبير 3/78
وراجع أيضا : المعايير الشرعية 1/248.
وفي عطر الهداية لفتح محمد اللكنوي (118) : مضارب خلاف قرار داد يا عرف كام كرے صمين ہے.
উল্লেখ্য, ব্যবসা বহির্ভুত খরচ মুদারাবার ব্যবসা থেকে করা যাবে না। শুধু তাই নয় বরং যে ব্যয় ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত হওয়া বা না হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে তাও ব্যবসার টাকা থেকে করা নিষিদ্ধ। যেমন ফিকহে হানাফীর অনবদ্য গ্রন্থ ‘আলমুহীতুল বুরহানী’তে রয়েছে-
أما ما ليس بتجارة من كل وجه وهو تجارة من وجه دون وجه وليس ذلك من صنيع التجار فلا يملكه المضارب على رب المال.
(খন্ড ১৮, পৃ ১৫৬)
অতএব সোসাইটি কর্তৃপক্ষ (ব্যবসায়ী) এর হাতে জমা টাকার ১০০%ই আমানত। যার পূর্ণটা একমাত্র ব্যবসার কাজেই ব্যয় করা জরুরি। অথচ তাদের কর্মপন্থা অনুযায়ী ব্যবসার আগে এমনকি ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা পৌছার আগেই ২০% থেকে ২৯% এর অধিকারী হয়ে যাচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। অথচ আলোচিত সোসাইটিগুলোর উন্নয়নকর্মীর প্রধান কাজ হচ্ছে সদস্য বানানো এবং তার মাসিক জমা উসূল করা। জানা কথা, এটা ব্যবসার কোনো কাজ নয়। তাই এ খাতে যা-ই ব্যয় হচ্ছে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে আমানতের খেয়ানত-গছব ও আত্মসাতের অর্ন্তভুক্ত।
مال المضاربة أمانة في يد المضارب. ذكر في تحفة الفقهاء (3/21) : إذا دفع المال إلى المضارب فهو أمانة في يده، في حكم الوديعة، لأنه قبضه بأمر المالك لا على طريق البدل والثيقة.
وفي مجلة الأحكام العدلية، رقم المادة : 1413 : المضارب أمين، فرأس المال في يده في حكم الوديقة، سواء كانت المضاربة صحيحة أو فاسدة. انتهى
وراج أيضا : الهداية 3/258؛ والعناية 7/415؛ والكفاية 7/416؛ والبحر الرائق 7/271؛ والمغني لابن قدامة 7/158-159؛ وشرح المجلة 4/336؛ وعطر الهداية 115؛ والفقه الإسلامي وأدلته 4/853
খ) ব্যবসার সাথে জড়িত সোসাইটির সকল কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন ব্যবসার অবন্টিত টাকা থেকে দেওয়া :
এই সোসাইটিগুলোর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী যারাই ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের বেতন-ভাতা ব্যবসার টাকা থেকে দেওয় হয়। অথচ মুদারিব বা মুদারিবের প্রতিনিধির জন্য ব্যবসার টাকা থেকে বেতন-ভাতাদি নেওয়া জায়েয নেই। এ কথা স্পষ্ট যে, সোসাইটিগুলো জমাকারীদের টাকা মুদারাবার ভিত্তিতে গ্রহণ করেছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে মুদারিব হল সোসাইটি। আর ব্যবসা পরিচালকগণ সোসাইটি (মুদারিব)-এর প্রতিনিধি। আর মুদারিবের প্রতিনিধিদের বেতন-ভাতাদি মুদারিবের জিম্মায়। এটা ব্যবসা থেকে নেয়া সম্পূর্ণ তসরুফ ও ন্ড’ণ্ট এর অর্ন্তভুক্ত। ফিকহে মুকারান এর মৌলিক গ্রন্থ ইমাম ইবনে কুদামা কৃত আল মুগনীতে আছে-
وعلى العامل أن يتولى بنفسه ما جرت العادة أن يتولاه المضارب بنفسه ... ولا أجر له عليه، لأنه مستحق للربح في مقابلة، فإن استجار من يفعل ذلك فالأجر عليه خاصة، لأن العمل عليه ... فإن فعل العامل ما لا يلزمه فعله متبرعا فلا أجر له، وإن فعله ليأخذ عليه أجرا فلا شيء له أيضا. انتهى
‘ব্যবসায়ী মহলের প্রচলন অনুযায়ী মুদারিবকে (ব্যবসায়ী) যে কাজগুলো করতে হয় সেগুলো করা তারই দায়িত্বে ...। এর বিনিময়ে সে কোনো পারিশ্রমিক পাবে না। কেননা সে এর পরিবর্তে লাভের অংশই পাচ্ছে। সুতরাং সে এ ধরনের কাজের জন্য কাউকে নিয়োগ দিলেও তার পারিশ্রমিক মুদারিবের একার জিম্মায় থাকবে। কেননা এ কাজের দায়িত্ব তারই ছিল।’ -আলমুগনী ৭/১৬৩
وكذا في الشرح الكبير 3/79؛ وشرح المهذب 15/163، 183
وفي روضة الطالبين وعمدة المفتين، للأمام النووي (5/134) : على العامل أن يتولى ما جرت العادة به من نشر الثياب وطيها وذرعها وإدراجها في السقط وإخراجها ووزن ما يخف كالذهب والمسك والعود وقبض الثمن وحمله وحفظ المتاع على باب الحانوت وفي السفر بالنوم عليه ونحوه، وليس عليه وزن الأمتعة الثقلية وحملها ولا نقل المتاع من الخان إلى الحانوت والنداء عليه ثم ما عليه أن يتولاه لو استأجر عليهن فالأجرة في ماله وما ليس عليه أن يتولاه، فله أن يستأجر عليه من مال القراض، لو تولاه بنفسه لا أجرة له.
মুদারিবের প্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা কোন খাত থেকে ব্যয় হবে এ সম্পর্কে জিদ্দাহ ফিক্হ একাডেমীর সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত হল :
وبما أن الشخص المعنوي يدير المضاربة من خلال موظفيه وعماله فإنه يتحمل نفقاتهم كما يتحمل جميع النفقات غير المباشرة، لأنها تعطي بجزء من حصته من الربح، ولا يتحمل المضاربة إلا النفقات المباشرة التي تخصها وكذلك نفقات ما لا يجب على المضارب عمله، مثل من يستعين بهم من خارج جهازة الوظيفي.
বেতন-ভাতা সংক্রান্ত উপরোক্ত স্বীকৃত নীতিমালাটি এবং এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সংক্রান্ত নীতিমালা আল্লামা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর ভাষায় নিম্নরূপ :
فإذا تقرر أن المضارب هو المؤسسة أو البنك أو الشركة بصفة كونها شخصا معنويا، فإن جميع التزامات المضاربة وحقوقها ترجع إلى هذا الشخص المعنوي، وبما أن الشخص المعنوي لا يستطيع أن يعمل فإنه من خلال موظفيه وعماله، فنفقات هؤلاء لاموظفين والعمال على الشخص المعنوي وليست على مال المضاربة ولا يتحمل ما المضاربة إلا النفقات التي تخص عمليات الاستثمار.
أما رواتب الموظفين وصيانة المكاتب وتأثيثها ونفقات الكهرباء وما إليها فكلها على الشخص المعنوي وفي عبارة المحاسبة المعصرة : لا يتحمل مال المضاربة إلا النفقات المباشرة (Direct Expenses) للاستثمار.
أما النفقات غير المباشرة (Indirect Expenses) فكلها على الشخص المعنوي المضارب، لأنه هو العمل الذي يقوم به الشخص المعنوي بصفته مضاربا، ولا يستحق حصته من الربح إلا مقابل ذاك. (بحوث في قضايا فقهية معاصرة 2/167-168)
এই উভয় বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো শুধু ডাইরেক্ট এক্সপেনসেসই ব্যবসার অর্থ থেকে নেওয়া যাবে। ইনডাইরেক্ট এক্সপেনসেস এর কোন কিছু ব্যবসার অর্থ থেকে নেওয়া যাবে না এবং কোম্পানি বা সোসাইটির কর্মচারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, অফিসভাড়া, অফিস ফার্নিচার ও বিদ্যুৎবিলসহ এ জাতীয় অন্যান্য খরচ ইনডাইরেক্ট এক্সপেনসেস-এর শামিল, তা ব্যবসার মাল থেকে গণ্য করার কোন অবকাশ নেই।
উপরোক্ত গছব ও খিয়ানতের কারণে সোসাইটিগুলোতে বাতিল শর্তের উপস্থিতি : ব্যবসার অর্থ থেকে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কমিশন বা বেতন দেওয়া এবং মুদারিব বা তার প্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা আদায়ের মধ্যে ‘গছব’ ও ‘খিয়ানত’ ছাড়া আরেকটি আপত্তিকর বিষয় হল, এক্ষেত্রে অঘোষিতভাবে মুদারিবের জন্য লাভের নির্ধারিত হার ছাড়াও প্রতি মাসে অতিরিক্ত একটি অংশ (যে অংশটি কমিশন ও বেতন-ভাতার মধ্যে চলে যাচ্ছে) শর্ত করা হচ্ছে। আর এ শর্ত মুদারাবা চুক্তিকে বাতিল করে দেয়। যেমন ইমাম সারাখসীর ‘আলমাবসূত’ (খ. ২২, পৃ. ১৯) এ আছে-
كل شرط يؤدي إلى قطع الشركة في الربح بينهما مع حصوله وهو مبطل للعقد، لأنه مفوت لموجب العقد.
وفي البحر الرائق (5/177) : (نقلا عن خواهر زاده شيخ الإسلام) : وإذا شرط في المضاربة ربح عشرة أو في الشركة تبطل، لا لأنه شرط فاسد، بل لأنه شرط تنتفي به الشركة.
وفي المعايير الشرعية (1/249) : مستند عدم جواز الجمع بين الربح في المضاربة والأجرة : هو أن الأجر مبلغ مقطوع وقد يحصل من الربح أكثر منها، فتنقطع المشاركة في الأرباح.
সুতরাং ব্যবসা বহির্ভুত এ নাজায়েয খরচ যা সোসাইটিগুলো করে আসছে তা খেয়ানত ও গছব হওয়ার পাশাপাশি বাতিল শর্তেরও অন্তর্ভুক্ত।
গ) সদস্য ফরম, কর্মনির্দেশিকা, সোসাইটির প্রচারপত্র ও বিজ্ঞাপন খরচ
বলাবাহুল্য যে, এ সকল কাজ যেহেতু সোসাইটি তথা মুদারিব এর। তাই এর খরচও তারই হবে, ব্যবসার খরচ নয়। অথচ এ খরচও তারা ব্যবসার টাকা থেকে নিয়ে থাকে, যা সম্পূর্ণ নাজায়েয। সুতরাং এর খরচ মুদারাবা থেকে নেওয়া গছব ও খেয়ানত।
উল্লেখ্য যে, এ সকল ব্যয় যে সোসাইটির খরচেই হওয়া জরুরি তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ হল, এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দাতব্য সোসাইটির। তাই সরাসরি ব্যবসার লাভ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের সকল আয় দাতব্য সোসাইটির একার আয় গণ্য করা হয়। যেমন-সদস্য ফরমের মূল্য, সদস্য-ভর্তি ফি, উন্নয়নকর্মী থেকে গৃহীত ফি ইত্যাদি। এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্টাফদের থেকে গৃহীত সিকিউরিটি টাকার স্বত্তাধিকারী দাতব্য সোসাইটিকেই গণ্য করা হয়।
অতএব এসব কিছুর আয় যেহেতু দাতব্য সোসাইটির, তাই এগুলোর পিছনে যা ব্যয় হবে তাও দাতব্য সোসাইটিরই হওয়া জরুরি। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো এ খরচ ব্যবসার টাকা থেকেই নিয়ে থাকে। অর্থাৎ আয় দাতব্য সোসাইটির আর ব্যয় অন্যের। অথচ এটি ফিকহে ইসলামীর নিম্নোক্তإجماعي قواعد (সর্বসম্মত শরয়ী নীতি) এর খেলাফ-
১. الخراج بالضمان -জামে তিরমিযী ১/২৪১, আলমাদখালুল ফিকহি আলআম ২/১০৩৬
২. الغمن بالغرم -শরহুল মাজাল্লা-খালিদ আতাসী (মাদ্দা ৮৭) ১/২৪, আলমাদখালুল ফিকহি আলআম ২/১০৩৮
দুই : জমাকারীকে পূর্ণ বা আংশিক মুনাফা থেকে বঞ্চিত করা
যৌথ মূলধনী কারবারে লাভ হলে জমাকারী এবং ব্যবসায়ী উভয়ে নির্ধারিত হারে লাভ পাওয়া সুনিশ্চিত। এটা প্রত্যেকের প্রাপ্য হক। কিন্তু সোসাইটিগুলোর সদস্যপদ প্রত্যাহার সংক্রান্ত নীতিমালায় রয়েছে যে, এক বা দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে জমা উঠিয়ে নিলে কোনো লাভ পাবে না। আর একটি সোসাইটির ‘কমার্স এন্ড ফাইন্যান্স’-এ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে আমানত ভাঙলে পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী তার আসল লাভ না দিয়ে কখনোবা সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়। আর কখনো নিজেদের ইচ্ছামতো একটা অংশ দেওয়া হয়ে থাকে। (যার বর্ণনা জমা-ফরমের উল্টো পিঠে রয়েছে)। অথচ পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী আগ থেকেই নির্ধারিত হারে শরীয়তের বিধান অনুসারে সে নির্ধারিত মুনাফার হকদার হয়ে আছে। প্রত্যাহারের কারণে এতে কোনো ধরনের কম-বেশি করার অবকাশ নেই। কারণ তার টাকা উঠিয়ে নেওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে এমন কোনো অন্যায় নয় যার কারণে কারো মুনাফার হক বাতিল করা যেতে পারে। তাই সোসাইটিগুলোর উক্ত নীতি নাজায়েয। সুতরাং এ পন্থায় মূল লাভ থেকে সদস্যদেরকে বঞ্চিত করা أكل مال الغير بالباطل (অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করা)-এর শামিল।
তিন : সোসাইটিগুলোতে নিষিদ্ধ
الغرار (আলগারার)-এর উপস্থিতি
হাদীস শরীফে এসেছে-
نهى عن بيغ الغرر
অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল লেনদেনে সব ধরনের غرر কে নিষিদ্ধ করেছেন। -সহীহ মুসলিম ২/২, জামে তিরমিযী ১/২৩৩, সুনানে আবু দাউদ ২/১২৩
ফিকহবিদগণ বলেছেন, এই হাদীস শরীয়তের মৌলনীতির অন্তর্ভুক্ত। এটি যে কোনো কারবারের ক্ষেত্রে মূলনীতি। নিষিদ্ধ বেচাকেনার অনেক প্রকার এমন রয়েছে, যার ব্যাপারে সরাসরি কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। যেগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে এই ‘গারার।’
আইম্মায়ে ফিকহ উল্লেখিত মৌলিক নীতিমালা এবং এতদসংক্রান্ত অন্যান্য দলিলাদি সামনে রেখে ‘গারার’এর বেশ কিছু সংজ্ঞা পেশ করেছেন। এরপর ‘গারার’এর ক্ষেত্রসমূহ একেকটি করে বর্ণনা করে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ বিষয়গুলো নিষিদ্ধ ‘গারার’এর অন্তর্ভুক্ত।
গারারের কয়েকটি সংজ্ঞা
ইমাম সারাখসী রাহ. বলেন-
ما يكون مستور العاقبة
‘যার পরিণাম অস্পষ্ট তা-ই গারার।’-আলমাবসূত ১২/১৯৪
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন-
الغرر هو مجهول العاقبة، فإن بيعه من الميسر الذي هو القمار
‘গারার হচ্ছে ঐ কারবার যার পরিণাম অনিশ্চিত। কারণ এর দ্বারা সেটা
ميسر (মাইসির)এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় যা জুয়ারই অপর নাম।’- মাজমুআতু ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৯/২২
ইমাম ইবনুল আছীর জাযারী রাহ. বলেন-
الغرر ما له ظاهر تؤثره وباطن تكرهه، فظاهره يغر المشتري وباطنه مجهول.
‘যে কারবারের একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয় কিন্তু এতে অভ্যন্তরীন এমন ত্রুটি রয়েছে যা জানলে মানুষ এ থেকে বিরত থাকবে। ফলে এর প্রকাশ্য রূপ ক্রেতাকে ধোকায় ফেলে দেয়। আর অভ্যন্তরীন রূপ অজানা থেকে যায়।’- জামিউল উসূল ১/৫২৭
ইমাম ক্বারাফী রাহ. বলেন-
وأصل الغرر هو الذي لا يدرى هل يحصل أم لا ... ثم الغرر والجهالة يقعان في سبعة أشياء : في الوجود والحصول، وفي الجنس وفي النوع وفي المقدار وفي التعيين وفي البقاء. الفروق للقرافي 3/432
আলোচিত সোসাইটিগুলোর লেনদেনটি তার ধরন ও প্রকৃতির দিক থেকে ‘মুদারাবা চুক্তি’ (عقد مضاربة)এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু মুদারাবার মৌলিক শরয়ী নীতিমালা বিভিন্নভাবে লংঘনের কারণে তা ফাসিদ ও বাতিল মুদরাবায় পরিণত হয়েছে। যা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। উপরন্তু এতে রয়েছে নিষিদ্ধ (الغرر) আলগারার এর উপস্থিতি। কারণ এটা ফিকহে ইসলামীর স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, মুাদরাবার মধ্যে যদি কোনো এক পক্ষের লাভে অস্পষ্টতা থাকে বা তা (خطرة) অনিশ্চয়তায় উপনীত হয় তাহলে সে মুযারাবা গারারের কারণে নাজায়েয হবে।
সোসাইটিগুলোর লেনদেনে জমাকারীদের (ربح) বা লাভের ক্ষেত্রে তিন ধরনের গারার বিদ্যমান।
১. পূর্বের দীর্ঘ আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সোসাইটিগুলোর কারবারে শরয়ী নীতিমালা লংঘন করে ব্যবসার বাইরে এবং আগে-পরে বিভিন্নমুখী ব্যয়ের দরুন লাভ কতটা অনিশ্চিত। এমনকি মূলও ঝুঁকিপূর্ণ। যৌথ মূলধনী ব্যবসায় এভাবে কৃত্রিম উপায়ে লাভকে ঝুঁকিপূর্ণ করা ‘গারার’এর শামিল।
২. সোসইটিগুলোতে নির্ধারিত মেয়াদের আগে সদস্যপদ প্রত্যাহার করলে জমাকারীকে কখনো লাভ থেকে পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়। আর কখনো আংশিক বঞ্চিত করা হয়। তাহলে কারবার শুরুর সময় একজন সসস্য নিশ্চিত হতে পারছেনা যে, সে কি হারে লাভ পাবে বা আদৌ পাবে কি না। সুতরাং এ ধারা হিসাবে শেষ পরিণাম পূর্ণ অনিশ্চিত ও অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে কারবারটি নিষিদ্ধ ‘গারার’এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
৩. মুদারাবা কারবারে কোনো এক পক্ষের জন্য লাভের হার ছাড়া অতিরিক্ত কোনো কিছু নির্ধারণ করা হলে কিংবা ঘোষিত বা অঘোষিত কোনো শর্তের প্রভাবে লাভের একটি অংশ কারো জন্য নির্ধারিত হয়ে গেলে তা নিষিদ্ধ ‘গারার’এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় এবং কারবারটি নাজায়েয হয়ে যায়।
শায়খ সিদ্দীক মুহাম্মদ আমীন আযযারীর-এর ভাষায়-
لا يجوز أن يشترط أحد المتعاقدين في عقد المضارب لنفسه من الربح شيئا زائدا غير ما انعقدت عليه المضاربة، لأن هذا الشرط يزيد من الغرر في المعقود عليه، لأن أحد المتعاقدين سيأخذ شيئا محققا ويبقى الآخر وحده في الخطر. (الغرر وأثره في العقود صـ 577)
সোসাইটিগুলোতে নিষিদ্ধ গারার-এর এ দিকটিও বিদ্যমান। কেননা এরা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কমিশন ব্যবসার টাকা থেকে দিয়ে থাকে। এছাড়া ব্যবসা পরিচালকগণের বেতন-ভাতাও ব্যবসার টাকা থেকে দিয়ে থাকে। অথচ এরা দাতব্য সোসাইটি মুদারিবের প্রতিনিধি। এদের বেতন-ভাতাও মুদারিবের জিম্মায়। এখন এদের বেতন-ভাতা ব্যবসার টাকা থেকে দেয়ার কারণে মুদারিবের কাছে লাভের নির্ধারিত হার ছাড়াও অতিরিক্ত আরো অংশ চলে যাচ্ছে। তাহলে অঘোষিতভাবেই লাভের কিছু অংশ মুদারিবের পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গেল, যা (رب المال) জমাকারীর অংশ (خطرة) অনিশ্চয়তায় পড়ার নামান্তর। আর এটিই হল নিষিদ্ধ ‘গারার’। সারকথা হলো যেসব কারণে সোসাইটিগুলোতে ‘গছব’ ও ‘খেয়ানত’ বিদ্যমান, ঠিক সেসব কারণে সোসাইটিগুলোতে ‘গারার’ও বিদ্যমান। আর এগুলোর যে কোন একটিই চুক্তি ফাসেদ ও নাজায়েয হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
চার : সোসাইটিগুলোতে শরীয়তের নিষিদ্ধ الغش (ধোঁকা, প্রতারণা)-এর উপস্থিতি
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, তা হল, জনগণ থেকে পূর্ণ শরয়ী তরীকায় ব্যবসা করার অঙ্গীকার করে জমাগ্রহণ করা হচ্ছে। অথচ যে পন্থায় ব্যবসা করা হচ্ছে তা শরীয়তসম্মত নয়। এছাড়া এ ধরনের কারবারের ক্ষেত্রে সরকারী যে নীতিমালা রয়েছে তা-ও গ্রহণ করা হয়নি। দাতব্য ও অলাভজনক সোসাইটি হিসাবে রেজিস্ট্রিকৃত সোসাইটিকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে অর্থলগ্নিকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা প্রকল্পের সকল কাগজপত্রে দাতব্য সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে সাধারণ জনগণ ধোকায় পড়ে যায়। জমাকারীদের সাথে এভাবে ধোকাযুক্ত কারবার করা الغش এর অন্তর্ভুক্ত। আর হাদীস শরীফে আছে-
من غشنا فليس منا
‘যে মুসলমানদেরকে ধোকা দিল সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’- সহীহ মুসলিম ১/৭০, হাদীস নং ১৬৪
পাঁচ : الرشوة (ঘুষ)التعزير بالمال (আর্থিক দন্ড) ও অন্যান্য
সোসাইটিগুলোর কারবার শরীয়ত-পরিপন্থী হওয়ার উপরোক্ত মৌলিক কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু নাজায়েয দিক রয়েছে। নিম্নে সেগুলোর কয়েকটি তুলে ধরা হল।
১) সোসাইটিগুলোতে সদস্য-ভর্তি ফি হিসাবে ১০০ বা ২০০ টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কেউ ফরমের মূল্য ২০ টাকা করে নেয়ার পরও এ ফি নেয়। আর এ ফি-কে ব্যবসার মূলধন বা আয় ধরা হয় না; বরং মুদারিবের নিজস্ব আয় গণ্য করা হয়। রাববুল মাল (জমাকারী) থেকেএ ধরনের ফি গ্রহণের কোনো বৈধতা শরীয়তে নেই। এ ফি ফিকহে ইসলামীর দৃষ্টিতে ঘুষ (রেশওয়াত)-এর শামিল।
২) কোন কোন সোসাইটির নিয়ম হল, কোন সদস্য যদি মাসিক সঞ্চয়ের পরপর চার কিস্তি আদায় না করে তবে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। আর এ বাতিল সদস্যপদ নতুন ভর্তি ফি প্রদানের মাধ্যমে চালু করতে হয়।
এই টাকাকেও ব্যবসার টাকা গণ্য করা হয় না। বরং এটি সোসাইটির (মুযারিব) নিজস্ব আয় গণ্য করা হয়। জমাকারী (রাববুল মাল) থেকে এ ফি গ্রহণও সম্পূর্ণ নাজায়েয। কারণ এটি হয়ত -رشوة (ঘুষ), না হয় تعزير بالمال (আর্থিক দন্ড)। এ ছাড়া এ টাকাগুলো গ্রহণ করার অন্য কোনো শরঈ ব্যাখ্যা নেই।
উল্লেখ্য, যদি এ ফি গ্রহণ করা জায়েযও হত তবুও এ টাকা মুযারিবের আয় গণ্য করা বৈধ হতো না।
৩) কোন কোন সোসাইটিতে উন্নয়নকর্মী (ব্রোকার) থেকে ১,০০০/- টাকা বা কমবেশী ফি নেওয়া হয়। ফিকহের দৃষ্টিতে এরা أجير (শ্রমিক) কিংবা سمسار (দালাল)। এদের থেকে ফি গ্রহণ করাও রেশওয়াতের শামিল। কারণ সোসাইটির পক্ষ থেকে এ ফি যে সকল জিনিসের বিনিময়ে নেওয়া হয় বলে উল্লেখ রয়েছে তা মূলত বিনিময়যোগ্য বিষয় নয়। কারণ, সোসাইটির পক্ষ থেকে এই ১,০০০/-টাকা একটি ব্যাগ, প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র এবং প্রশিক্ষণ বাবদ নেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে যা দেওয়া হয় এর মূল্য বড়জোড় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা হবে। আর এগুলোও প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বার্থেই দেওয়া হয়। ব্যাগে সোসাইটির সিল লাগানো থাকে। সোসাইটির প্রয়োজনেই তা ব্যবহৃত হয়। কাগজ-পত্র, আইডি কার্ড এগুলোও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে ব্যবহৃত কাগজ-পত্র। আর প্রশিক্ষণ, সেটিও তেমন কোনো ভিন্ন পেশার প্রশিক্ষণ নয় বাজারে যার মূল্য রয়েছে। বরং এতে সোসাইটির কাজের নিয়মাবলিই শিক্ষা দেওয়া হয় যা সোসাইটির স্বার্থেই দেওয়া হয়। সুতরাং এসব সামগ্রী সোসাইটির নিজ খরচে সরবরাহ করতে হবে। এর জন্য কর্মী থেকে ফি নেওয়া বৈধ হবে না।
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে যেসব কারণে একটি কারবার নাজায়েয বলে গণ্য হয় সে কারণসমূহের অন্তত পাঁচটি কারণ এ সোসাইটিগুলোর মধ্যে রয়েছে। যেমন- الخيانة، الغصب، الغش، الرشوة، الغرر। ফিকহে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ অবগত রয়েছেন যে, উপরোক্ত কারণগুলোর যেকোনো একটির উপস্থিতি একটি কারবার নাজায়েয হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানে ৫টির উপস্থিতি এ কারবারগুলোকে কোন্ পর্যায়ের নাজায়েযে পরিণত করেছে তা তো সহজেই অনুমান করা যায়।
বিনিয়োগ পদ্ধতি
প্রকাশ থাকে যে, উপরে কেবল সোসাইটিগুলোর অর্থ সংগ্রহ ও তা ফেরত দান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখানে তাদের অর্থ বিনিয়োগ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। খেয়াল রাখতে হবে যে, বর্তমানে ইসলামী পন্থায় অর্থ বিনিয়োগের নামেও অনেক নাজায়েয ও আজব-আজব হীলা-বাহানা হয়ে থাকে। বাই মুআজ্জাল ও মুরাবাহার নাম করে অনেক তেলেসমাতি কারবার ঘটানো হয়ে থাকে। বাস্তবে কোনো বেচা-কেনা না করেও মুরাবাহা নাম দিয়ে টাকার মোকাবেলায় টাকা নিয়ে সুদী কারবার করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ ফরম বিক্রির নামে টাকা ধার দিয়ে সুদ কামিয়ে থাকে। আবার কেউ রিসিডিউল (পুনঃবিনিয়োগ) এর নামে কিস্তি আদায়ের মধ্য মেয়াদে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে চক্রবৃদ্ধিসুদে আবদ্ধ হয়ে থাকে। এ ধরনের আরো বহু নাজায়েয পন্থা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আবিস্কৃত হয়েছে। মুসলমানদের কারবারগুলোকে এসব কিছু থেকে পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি।
সোসাইটিগুলোর শরয়ী হুকুম
সোসাইটিগুলোতে বিভিন্নভাবে গছব, খেয়ানত, রিশওয়াত, গারার, গাশ থাকায় এবং তাদের কর্মপদ্ধতি ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তাদের কারবার ফাসিদ ও বাতিল। প্রশ্নোক্ত সোসাইটিগুলো ছাড়াও দেশে এধরনের আরো বহু প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোতে উপরোক্ত নাজায়েয বিষয়সমূহ বা তার কোন কোনটি বিদ্যমান রয়েছে, ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের হুকুমও একই। এ ধরনের সংস্থা/সোসাইটি গঠন করা, এগুলোর সদস্য, কর্মী ও মধ্যস্ততাকারী হওয়া এবং মুদারাবা ভিত্তিতে মানুষের টাকা জমা করে তা নিজ ইচ্ছামত বিলিবন্টন করা সম্পূর্ণ নাজায়েয।
সুতরাং আসহাবুল আমওয়াল তথা জমাকারীদের মূলধন ও মুনাফা থেকে যত টাকা উপরে বর্ণিত খিয়ানত, গছব, রিশওয়াত ইত্যাদির আওতায় তসরুফ হয়েছে, কর্মী/দালালদের পিছনে ব্যয় করা হয়েছে এবং সোসাইটি/সংস্থার অফিস খরচ ও কর্মকর্তা, কর্মচারী বা উদ্যোক্তা/প্রতিষ্ঠাতাদের পিছনে ব্যয় করা হয়েছে সেসব টাকা যথাযথ হিসাব করে জমাকারীদেরকে তাদের হিস্যা অনুযায়ী ফেরত দিতে হবে এবং শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সোসাইটিগুলোর এ ধরনের নাজায়েয কারবারসমূহ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, যৌথমূলধনী কারবারের জন্য শরীয়তে মুযারাবা ও মুশারাকার বিধান রয়েছে। ফিকহে ইসলামীর অমূল্য ভান্ডারে শত শত পৃষ্ঠা এ বিষয়ে লেখা রয়েছে। কেউ জায়েয পন্থায় এ ধরনের কারবার করতে চাইলে শুরু থেকেই শরীয়তসম্মত নিয়ম নীতি প্রণয়ন করে এবং সকল প্রকার নিষিদ্ধ কার্যক্রম হতে মুক্ত থেকে তা করতে পারে। তবে অবশ্যই এর আগে আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া এবং ফতোয়া ও ফিকহের খেদমতে জড়িত বিজ্ঞ আলেমদের থেকে নীতিমালা অনুমোদন করিয়ে নেওয়া এবং সে অনুযায়ী যথাযথ আমল করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন। আমীন।
تم بتوفيق الله سبحانه وتعالى، وهو أعلم بالصواب
মুফতী বোর্ড ঢাকা
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
উপস্থিত সদস্যবৃন্দের নাম
* মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জববার, মহাসচিব, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
* মুফতী শিবিবর আহমদ ‘মাহবুর’, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
* মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, মুদীর ও প্রধান মুফতী, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
* মুফতী আবদুল হালীম, দারুর রাশাদ, মিরপুর
* মুফতী মুহাম্মদ ওমর ফারুক, জামিআ দারুল উলূম মতিঝিল ঢাকা
* মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক, আমীনুত তা’লীম, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
* মুফতী এনামুল হক, সেক্রেটারী, মুফতী বোর্ড ঢাকা
* মুফতী সাঈদ আহমদ, জামিআ রাহমানিয়া, আলী এন্ড নূর রিয়েল এস্টেট, ঢাকা
* মুফতী মুহাম্মদ হারুন, মারকাযুল বুহুস আল ইসলামিয়া, ঢাকা
* মুফতী সাঈদ আহমদ, জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া, সাত মসজিদ, মুহাম্মদপুর, ঢাকা
* মুফতী আবদুল মান্নান, ফয়জুল উলূম মাদরাসা ঢাকা
* মুফতী মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া, ঢাকা
* মুফতী জিয়াউর রহমান, দারুল উলূম, মিরপুর-৬
* মুফতী রফিউদ্দীন, মাদরাসা বাইতুল উলূম ঢালকানগর, ঢাকা
* মুফতী শাববীর আহমদ, মাদরাসা বাইতুল উলূম ঢালকানগর, ঢাকা
* মুফতী তাওহীদুল ইসলাম, জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া, সাত মসজিদ, মুহাম্মদপুর, ঢাকা
* মুফতী মুহাম্মদ আনোয়ার হুসাইন, মাদরাসা আবু বকর সিদ্দীক ঢাকা #