উ ম্মা হ : বিদায় মোশাররফ! লাল মসজিদের লাল সালাম
শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে স্বেচ্ছায় অথচ বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করার পথেই গেলেন সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। দীর্ঘ ৮ বছর ১০ মাস ক্ষমতায় থাকার পর গত ১৮ আগস্ট দুপুরে তিনি পদত্যাগ করেন। তার এই পদত্যাগ ঘটেছে ক্ষমতাসীন জোট পিপিপি ও মুসলিম লীগ (নওয়াজ)-এর পক্ষ থেকে তাকে ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের শতভাগ প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করার মুখে। নির্বাচিত সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে প্রেসিডেন্ট-এর শাসন জারির আইনগত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশের ভেতরে তার প্রতি সেনাবাহিনীর বর্তমান নেতৃত্বের সর্বাত্মক সমর্থন না থাকা এবং দেশের বাইরে প্রধান মিত্র আমেরিকার গ্রিন সিগনাল না পাওয়ায় পদত্যাগ করা ছাড়া গ্রহণযোগ্য কোনো পথ মোশাররফের সামনে খোলা ছিল না।
বলা যায়, বাধ্য হয়েই তিনি বিদায় নিলেন। নিঃসঙ্গ হয়ে ছাড়লেন ক্ষমতার মসনদ। বর্তমানে তিনি সরকারের কঠোর নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন।
তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাভাজন মিত্র মোশাররফের এই বিদায়যাত্রা কি একদম হঠাৎ করেই সূচিত হয়েছে? এর সব আয়োজনই কি কিছু রাজনীতিকের কাজ নাকি এর পেছনে গুঢ় ও স্পষ্ট অন্য কোনো কারণও বিদ্যমান? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক
বেশ কিছুৃ কার্যকারণ এ ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে, একটি জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসা জোট সরকারের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে অনমনীয় সিদ্ধান্তে অভিশংসনের প্রস্ত্ততি চূড়ান্ত করার পর মোশাররফ পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু কার্যকারণ হিসেবে এই দৃশ্যটিই সম্পূর্ণ দৃশ্য নয়। এর
সঙ্গে আরো কারণও বিদ্যমান। অন্য কোনো কারণ যদি এর পেছনে না-ই থাকত তাহলে মোশাররফ তাকে অভিশংসনের প্রস্ত্ততি গ্রহণে নিযুক্ত এমপিদের এমপিত্ব শেষ করে দিতে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিলেই হত। এ ক্ষমতা প্রয়োগের আইনী সুযোগ তার ছিল। অথবা তিনি অভিশংসনের উত্থাপিত অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে যুক্তিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ-পাল্টা চ্যালেঞ্জের নতুন খেলায় নামতে পারতেন। সে সুযোগও তার ছিল। বিভিন্ন সূত্রমতে এ পথে যেতে সম্ভাব্য প্রস্ত্ততিও তিনি নিচ্ছিলেন। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পদত্যাগই তিনি করলেন।
আসলে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে পাকিস্তানের ধর্মীয় মহলগুলোকে মার্কিন খেয়ালখুশি মতো নির্যাতন করা, প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতের প্রায় অর্ধশত বিচারপতিকে বরখাস্ত করা, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার জনক ও মুসলিম বিশ্বের গর্ব জনাব ড. আবদুল কাদির খানের প্রতি চরম অবমাননাকর আচরণ এবং ইসলামাবাদের লাল মসজিদের ট্রাডেজির মধ্য দিয়ে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে মোশাররফ হয়ে পড়েছিলেন চূড়ান্ত রকমের জনভিত্তিহীন একজন প্রেসিডেন্ট। সম্ভাব্য সমর্থন ও সহযোগিতার কোনো প্রান্ত থেকেই ইতিবাচক কোনো সাড়া তাই তাকে কেউ দেয়নি। উপরন্তু সন্ত্রাস দমনের নামে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে জনগণের একটি বড় অংশের মুখোমুখি নামিয়ে দিয়েছেন তিনি সেনাবাহিনীকে।
সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি ও দেশের ঐক্য ও সংহতিকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। বেদনাদায়ক ব্যাপার হল, এসব কিছুই তিনি করেছিলেন আমেরিকার অন্ধ আনুগত্যের নজির স্থাপন করতে কিংবা পাকিস্তানে আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়নের বাধা দূর করতে অথবা আমেরিকার কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নাতীত করতে। হয়তো তার সে সব উদ্দেশ্যে তিনি সফল হয়েছিলেন। কিন্তু একদম শূন্যে নেমে যাওয়া জনসমর্থনের পারদটিকে তিনি ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি, পারেননি বহু মজলুম মুসলমানের বুকফাটা অশ্রুর ধাক্কা সামাল দিতে। বলা যায়, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই তার পরিণতির এ সূচনাপর্বটি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে।
মোশাররফ তো গেলেন কিন্তু পাকিস্তানে মার্কিন এজেন্ডা নিয়ে কাজ করার ‘যোগ্য’ লোক ও গ্রুপ ‘নির্বাচনের’ নতুন মহড়া শুরু হয়েছে। কিছু ইস্যুতে ক্ষমতাসীন জোটের ভেতর ভাঙ্গনের সুরও বেজে উঠেছে।এ লেখা প্রকাশ হতে হতে পরিস্থিতি কোন্ পর্যায়ে গিয়ে পৌছবে, বলা যচ্ছে না। এই ভাঙ্গাগড়ার সব সম্ভাবনা ও শঙ্কা নিয়ে এখনই কথা বলার চেষ্টা না করাই সঙ্গত। কিন্তু একটি কথাতো আমরা বিনয়ের সঙ্গেই বলতে পারি। লাল মসজিদের মতো ঘটনা বন্দুকের জোরে ঘটিয়ে অভিশাপের পাহাড় যিনি যেই দেশেই কিনবেন, দুঃসময়ে তাকে আশির্বাদ দেওয়ার মতো কেউ-ই হয়তো থাকবে না।