Ramadan 1429   ||   September 2008

মেরী ‘ইলমী ও মুতালা‘আতী যিন্দেগী

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আমার মুহতারাম দোস্ত ও দ্বীনী কাজের সহকর্মী মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নুমানী যখন আলফুরকান-এর শাহ ওয়ালিউল্লাহ সংখ্যা বের করার ইচ্ছা করলেন তখন এই নিঃস্বকেও তাতে অংশগ্রহণের ফরমায়েশ করেন। আমি শাহ ওয়ালিউল্লাহ বহাইছিয়তে মুসান্নিফ (গ্রন্থকার শাহ ওয়ালিউল্লাহ) শিরোনামটি পছন্দ করলাম। এর ওপর লেখার জন্য শাহ ছাহেবের রচনাবলিতে নজর বুলানো প্রয়োজন ছিল। তাঁর কিছু রচনা আমার ইতোপূর্বে পড়া ছিল, কিছু পড়া ছিল না। এই সুযোগে ইযালাতুল খাফা আদ্যোপান্ত পড়া হল। গ্রন্থটি শাহ ছাহেবের উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তির দ্বিতীয় নমুনা। খুব অল্প সংখ্যক রচনা দ্বারাই এতটা প্রভাবিত হয়েছি, যতটা মাকতূবাতইযালাতুল খাফা দ্বারা। মনে হয় যেন, ইলমের ঝর্ণাধারা উৎসারিত হচ্ছে। একটি নতুন তত্ত্বের স্বাদ ফুরোতে না ফুরোতে দ্বিতীয় তত্ত্ব হাজির। এরপর তৃতীয় ...।

কুরআন মজীদের আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ, খিলাফতের বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতা এবং দ্বীনী অধঃপতনের ইতিহাস ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন তা জ্ঞান-গবেষণায় উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রস ও শিল্পগুণের বিচারেও কাব্য ও সাহিত্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়?

হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ আমি পড়েছিলাম মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর বিশিষ্ট শাগরিদ, পাঞ্জাবের মশহুর আলিম ও মুসলিহ হযরত মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী ছাহেবের কাছে। এর যুক্তিভিত্তিকতা এবং দলীল প্রমাণের সুদৃঢ়তার পাশাপাশি শাহ ছাহেবের সূক্ষ্মদর্শিতার পরিচয়ও এ গ্রন্থ থেকে লাভ করি। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ থেকে ইলমী ও উসূলী আলোচনা আত্মস্থ করার এবং কালাম ও ফালসাফা ধর্মী দ্বীনী গ্রন্থাদি বোঝার যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। এ দিক থেকে এ কিতাবের অবদান অনেক।

বলা যায় যে, বিগত শতাব্দীগুলোর কোনো ব্যক্তিত্বের দ্বারা দিল-দেমাগ এতটা প্রভাবিত হয়নি এবং কারো জ্ঞান ও গবেষণার সঙ্গে এতটা একাত্মতা অনুভব করিনি যতটা শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর রচনাবলীর সঙ্গে।  নিজের চিন্তা ও মননের জন্য যদি বিশেষ কোনো চিন্তাধারার সনদ জরুরি মনে করা হয় তাহলে আমি তাঁর নাম উল্লেখ করতে পারি। আর বাস্তবিকই আমাদের শিক্ষা ও চিন্তার বংশ-লতিকা তাঁর সঙ্গেই যুক্ত।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ ছাহেবের সংক্ষিপ্ত রচনা-আলফাওযুল কাবীর ফী উসূলিত তাফসীর (যাকে আমি শাহ ছাহেবের ইয়াদ দাশত স্মরণ-সহায়িকা বলে থাকি।)এর কিছু সংক্ষিপ্ত ইশারা ও ছোট ছোট তত্ত্ব থেকে কুরআন মজীদ অধ্যয়নে গভীর নির্দেশনা পেয়েছি। তাঁর ছোট ছোট বাক্য ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে অনেক বিশদ ভাবনার পথ উন্মুক্ত হয়েছে এবং চিন্তার অনেক জট খুলে গিয়েছে।

হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর মালফুযাত সিরাতে মুসতাকীম (সংকলনে মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা আবদুল হাই) অনেক  পরে  হস্তগত হয়। তবে তাসাওউফ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রচনা, আইম্মায়ে তাসাওউফের মালফূযাত, বিশেষত চিশতী বুযুর্গানের মালফূযাতের গোটা সিলসিলা অধ্যয়ন করার পর এ গ্রন্থটি পড়ি। আমার মনে হয়েছে যে, তাসাওউফের রচনা-সম্ভারে এটা এক বিপ্লবী ও ব্যতিক্রমী রচনা। নববী পথ ও পন্থার অনুসরণ এবং ফরয দায়িত্ব সম্পাদনের মাধ্যমে (যে বিষয়ে সাইয়েদ ছাহেব ইমাম ছিলেন এবং যা এই যুগে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ ও প্রশস্ত রাস্তা) আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রয়াস ছাড়াও তরীকত ও হাকীকত এবং সুলূক ও তরবিয়তপ্রসঙ্গে যে তত্ত্ব ও তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন তা তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত মেধা, উলূমে নবুওয়তের সঙ্গে একাত্মতা, অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের রূহানিয়ত এবং সুতীক্ষ্ম চিন্তাশক্তির দলীল। আহলে জাহের ও আহলে মারিফাতের মধ্যে বিতর্কপূর্ণ বিষয়গুলোর তিনি যেভাবে সমাধান দিয়েছেন এবং যে সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা করেছেন এটা তাঁর বিশুদ্ধ স্বভাব-রুচি এবং নিখুঁত চিন্তাশক্তির দলীল। আহা! যদি এ কিতাবটির ওপর যথাযোগ্য কাজ হত এবং নতুন আঙ্গিকে তা বিন্যস্ত করে পেশ করা যেত!

এই কিতাবগুলোর একটি অবদান এই ছিল যে, উলূমে নবুওয়তের সঙ্গে রুচি ও পরিচয়ের যে দূরত্ব মনুষ্যপ্রণীত শাস্ত্র ও রচনা থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে তা দূর হয়েছে এবং এই প্রত্যয় অর্জিত হয়েছে যে, সময় ও শাস্ত্রের ভাষা-পরিভাষা ছাড়াও জ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞান পরিবেশন করা সম্ভব। তদ্রূপ গ্রন্থ ও রচনার পথ ছাড়াও এমন কিছু পথ রয়েছে যার দ্বারা ওই জ্ঞান ও অর্ন্তজ্ঞান আসে যা বর্ণমালার বেষ্টনীতে আবদ্ধ করা যায় না। এমন যদি হয় যে, খোসা ও আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে শুধু সার অংশটুকুই এল! শুধু মর্মটুকুই এল শব্দের আবরণ গৌণ হয়ে গেল। বাণীটাই শুধু এল, টীকা ও টিপ্পনির সকল আয়োজন বাহুল্য হয়ে গেল!

এ যুগের আরেফ তত্ত্বজ্ঞানী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস ছাহেব কান্দলভী  (মৃত্যু : ১৩৬৩ হি./১৯৪৪ ঈ,)-এর সঙ্গে যখন সাক্ষাত লাভ করি তখন তার বাণী ও অভিজ্ঞতা বুঝতে উপরোক্ত অধ্যয়ন আমাকে সাহায্য করেছে। সুন্দর ভাষাশৈলী ও আধুনিক পরিভাষা অন্বেষণের প্রচেষ্টা মূল বক্তব্য অনুধাবনে অন্তরায় সৃষ্টি করেনি। আমি এক প্রসঙ্গে তাঁকে আরয করেছিলাম যে, আমি যদি ইতোপূর্বে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর জীবনী না লিখতাম এবং হযরত মুজাদ্দেদ আলফে ছানী রাহ.-এর মাকতূবাত না পড়তাম তাহলে আপনার কথাবার্তা আমার কাছে খুব অপরিচিত মনে হত। মাওলানা কথাটা পছন্দ করেছিলেন এবং অন্যদের কাছেও বর্ণনা করেছিলেন।

আমার কুরআন মজীদ অধ্যয়নে মাওলানা আহমদ আলী ছাহেবের দরসের ফয়য ও বরকতের অনেক অবদান রয়েছে। নেসাবভুক্ত ও সুপ্রচলিত এবং কিছু স্বল্প প্রচলিত দীর্ঘ তাফসীরগ্রন্থ কোনো কোনোটা শব্দে শব্দে পড়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু মূল উপকার হয়েছে মূল কুরআন মজীদ সহজ-সরল ভাবে বারবার পড়ার দ্বারা।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে দেওয়া জরুরি যে, কুরআন মজীদ থেকে নিজের অংশটুকু আহরণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান ও শরীয়তী জ্ঞানের পর দুটো বিষয় সর্বাধিক উপকারী হয়ে থাকে। এক. উলূমে নবুওয়ত ও মেযাজে নবুওয়তের ধারক ব্যক্তিদের সাহচর্য, যাদের বাস্তব জীবন- কানা খুলুকুহুল কুরআন-এর প্রতিচ্ছবি এবং যার আনাল কুরআনুন নাতিক (হযরত আলী রা.-এর উক্তি)-এর রুচি ও হৃদয়ের কিছু উত্তরাধিকার যারা লাভ করেছেন। এঁদের ইলমের সজীবতা ও অনাবিলতা এবং বিস্তৃতি ও গভীরতার দ্বারা কুরআন মজীদের বাণী ও বাক্যের বিপুল ব্যাপ্তি সম্পর্কে একটা আনুমানিক ধারণা অর্জিত হয়। অনেক শব্দ যার অর্থ ও মর্ম লিসানুল আরবমুফরাদাতে গরীবুল কুরআন-এর সাহায্যেও বোধগম্য হয়নি এবং অনেক আয়াত যেগুলোর মর্ম-বাণী যমখশরীর আদবী তাফসীর কাশশাফ, ইমাম রাযীর আকলী তাফসীর ফুতুহুল গায়ব এবং ইবনে কাছীরের নকলী তাফসীর দ্বারা পরিষ্কার হয়নি সেগুলো তাদের দুচার কথায় পরিষ্কার হয়ে যায়। তখন শব্দে ও মর্মে এক অভিনব দৃঢ়তা ও গভীরতা পরিলক্ষিত হয় যা ইতোপূর্বে ছিল দৃষ্টির অগোচরে।

দ্বিতীয় বিষয় এই যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম যে পথে চলেছেন সে পথে কদম রাখার দ্বারাও কুরআন মজীদ উদ্ভাসিত হতে থাকে। আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামের যে অবস্থা কুরআন মজীদে বয়ান করা হয়েছে তা তখন অনুভবে আসতে থাকে। বিভিন্ন কওম তাদের নবীকে যে জওয়াব দিয়েছে তার প্রতিধ্বনি শোনা যেতে থাকে এবং সেই অতীত দৃশ্য চোখের সামনে উদ্ভাসিত হতে থাকে। যেসব প্রশ্ন ও জটিলতা ইলমে কালামের গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে এবং যেগুলো নিছক অধ্যয়নভিত্তিক চিন্তাধারা থেকে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো তখন অসার ও অর্থহীন মনে হতে থাকে। কুরআন বোঝার এই হল দুটি স্বাভাবিক পন্থা।

শুনেছি যে, যখন কুরআন মজীদে মানুষের মন বসতে থাকে তখন মনুষ্য রচনাবলির প্রতি বিরাগ ও বিতৃষ্ণা জন্ম নিতে থাকে। মানুষের বই, মানুষের কথা সবই তখন তুচ্ছ ও অসার মনে হতে থাকে। সাহিত্যিক, দার্শনিক ও         চিন্তাবিদদের কথাবার্তা অবুঝ শিশুর বাক্যালাপ বলে মনে হতে থাকে। আর সাদা কাগজে মুদ্রিত সারিবদ্ধ কালো হরফগুলোকে মনে হতে থাকে কাগুজে ফুল। যাতে রং আছে কিন্তু সুঘ্রাণ নেই।

মানুষের জ্ঞান ও চিন্তা অন্তসারশূন্য মনে হতে থাকে এবং দীর্ঘক্ষণ তা অধ্যয়ন করা মন ও প্রাণের জন্য ক্লান্তিকর হতে থাকে যে বস্ত্ত উলূমে নবুওয়তের ধারা-উৎস থেকে উৎসারিত হয়নি তাকে শব্দের ফুলঝুড়ি বলে মনে হতে থাকে। প্রশান্তি শুধু ওই ইলমের দ্বারাই অর্জিত হয় যা ওহী ও নবুওয়তের পথে এসেছে এবং যাকে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগদ্বাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, যা ওহীর ভাষায় কুরআন মজীদে ও আরবী ভাষায় হাদীস শরীফে সংরক্ষিত রয়েছে।

 

advertisement