Ramadan 1429   ||   September 2008

মাহে রমযান ও আমাদের ঈদ প্রস্ত্ততি

Mawlana Mufti Taqi Usmani

রমযান মাস মহান আল্লাহর অনন্ত রহমত ও বরকতের সেই ঋতুরাজ বসন্তকাল, যাতে বিশ্বচরাচরের মহান স্রষ্টার পক্ষ হতে দয়া ও অনুগ্রহের নানা বাহানা অন্বেষণ করা হয়, যে মাসে ঈমানের দৌলতে ধন্য মুমিনের উপর রহমতের বৃষ্টি মুষলধারায় বর্ষিত হয়। যে মাসে ক্ষমাশীল প্রভূ স্বীয় বান্দাদের পাপ মোচনের লক্ষ্যে সর্বদা ক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন। জানি না এ মসে কত অসংখ্য-অগণিত মানুষকে মাগফেরাত করে জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার শাহী ফরমান জারি করা হয়।          

মহান আল্লাহর পক্ষ হতে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি, নূরের স্রোত আমাদের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রান্ত হয়, কিন্তু আমরা অজ্ঞতা-অন্ধতার কারণে তার মাহাত্ম ও গুরুত্ব  বুঝি না। ফলে অতি বরকতপূর্ণ দামী মুহূর্তগুলোকে অবজ্ঞা-উপেক্ষা, গাফিলতি ও যাচ্ছেতাইভাবেই নিঃশেষ করে দিতে দ্বিধা বোধ করি না। হাদীসে বর্ণিত-ধ্বংস হোক সেই ব্যক্তি যে রমযান মাস পেল তারপরও তার গুণাহ মাফ হল না। সবার জন্য ক্ষমার দুয়ার উন্মুক্ত থাকার এই বিশেষ সময়েও যে ব্যক্তি নিজের গুনাহ ক্ষমা করাতে পারে না তবে তার অর্থ হবে এটাই  যে, সে ব্যক্তি নিজেকে খোদার রহমত হতে (নাউযুবিল্লাহ) নিজেকে স্বাধীন ও অমুখাপেক্ষী মনে করে। আর এই বেপরোয়া মানসিকতাই সবচেয়ে বিপদজনক বস্ত্ত, যার ব্যাপারে হযরত জিবরাঈল আ. ধ্বংসের বদদুআ করলেন আর নবীয়ে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সমর্থনে আমীন বললেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের মজলিসে সেই ধরনের কিছু অন্যায়-অবহেলার বিষয় উল্লেখ করাই উদ্দেশ্য, যা আমরা এই মুবারক মাসেও অব্যাহত রাখি। ভয় লাগে যে, আল্লাহ না করুক এই অবজ্ঞা-অবহেলার কারণে সেই ভয়াবহ হুমকি ও বদদুআর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে না যাই। (আল্লাহ এমন ফয়সালা না করুন)

রমযান মাসে আমাদের সবচেয়ে ব্যাপক ও সীমাহীন অনৈতিক কর্ম এটাই যে, এই মুবারক মাসে নিজেদের দুনিয়াবি চাহিদা ও খরচের পরিধি সঙ্কুচিত করার পরিবর্তে আরো অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি করে দেই। ব্যবসায়ী মহোদয়গণ তো এই মাসকে বিশেষ উপার্জনের মাস ঘোষণা দিয়ে রাত-দিন সেই ধ্যানেই মগ্ন থাকেন। অনেক সময় এই ধ্যান-মগ্নতার কারণে নামাযও কুরবান হয়ে যায়।

ঈদের প্রস্ত্ততি আমাদের জন্য এখন একটা বড় ধরনের ফিতনা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা ঈদুল ফিতরকে মুসলমানদের জন্য আনন্দ-উৎসবের দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সর্বজনীন বাৎসরিক আনন্দের বিশেষ দিবস হিসেবে মনোনিত করেছেন। এমনকি এ বিষয়টিও শরীয়তে স্বীকৃত ও প্রমাণিত যে, এই দিনে কোনো উত্তম থেকে উত্তম পোশাক কেউ যদি সহজে লাভ করতে পারে সে যেন তা পরিধান করে। কিন্তু বর্তমানে এ উপলক্ষে উত্তম পোশাকের অজুহাতে যে অসীম-অগণিত বেহুদা খরচের জোয়ার সৃষ্টি করা হয়, অন্যায়-অপব্যয়ের যে মহা প্লাবণ বইয়ে দেওয়া হয় এবং সেটাকে ঈদের অপরিহার্য অনুষঙ্গ বলে মনে করা হয় তার সঙ্গে দ্বীন ও শরীয়তের কোনো সম্পর্ক নেই।

বর্তমান যুগে এ বিষয়টি ফরয-ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয়, (ঈদ পালনের জন্য) অতি আবশ্যকীয় জরুরি বিষয় মনে করা হয় যে, কোনো ব্যক্তির আর্থিক সচ্ছলতা থাকুক বা না থাকুক কিন্তু সে কোনো না কোনো উপায়ে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য নিত্য-নতুন ডিজাইন ও ফ্যাশনেবল পরিধেয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করবে। ঘরের প্রত্যেক সদস্যের জন্য জুতা-টুপি থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিস নতুন নতুন ক্রয় করবে। শুধু তাই নয় ঈদের প্রকৃত স্বাদ অনুভবের জন্য, ঘরের সাজ-সজ্জা ও শোভাবর্ধনের জন্য নিত্য-নতুন আসবাবপত্র ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের ফার্নিচারের ব্যবস্থাও করা হয়। দূর-দূরান্তে অন্যান্য শহরে বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের নিকট মূল্যবান গিফট ও দামি ঈদকার্ড প্রেরণ করা হয়। আর এসব কাজ এমন এক তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা নিয়ে সম্পন্ন করা হয় যে, কেউ যেন কারো থেকে পিছে পড়ে না যায়। কেউ যেন কারো কাছে কোনো ক্ষেত্রে হেরে না যায়।

এসবের অনিবার্য পরিণতি এটাই হয় যে, একজন মধ্যম স্তরের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্য ঈদের প্রস্ত্ততি একটি বাড়তি  দুশ্চিন্তা ও আলাদা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় যখন সে দেখে যে, হালাল উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারের সবার চাহিদা ও আবদার পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং বৈধ টাকা-পয়সা তার জন্য পর্যাপ্ত হচ্ছে না, তখন সে অবৈধ পথের সন্ধান করে। বিভিন্ন পন্থায় অন্যের পকেট মেরে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে। যা দ্বারা সেই লাগামহীন চাহিদা ও অন্তহীন কুপ্রবৃত্তির পেট ভর্তি করে।

এসব বাদ দিলেও ঈদের প্রস্ত্ততির সবচেয়ে ন্যূনতম ক্ষতি তো এটাই যে, মহামূল্যবান ও বিশেষ করে শেষ দশকের রজনীগুলো-যা একান্ত নীরবে, নিরালা পরিবেশে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা ও মুনাজাতের শ্রেষ্ঠতম সময়, খোদার সান্নিধ্য লাভের মোক্ষম সুযোগ ও অনন্য মুহূর্ত, তা বাজারের মধ্যে অতিবাহিত হয়ে যায়।

এসব আলোচনার উদ্দেশ্য-আল্লাহ না করুন-কাউকে তিরস্কার করা, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা কিংবা সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা করা নয়; বরং অন্তরের দরদ ও সহানুভূতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এ দাওয়াতী চিন্তা-চেতনা পেশ করা যে, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ মাস আল্লাহ তাআলা কোন্ কাজের লক্ষ্যে সৃষ্টি করলেন, কী উদ্দেশ্যে এমন একটি শ্রেষ্ঠ মাস দান করলেন। আর আমরা সেটাকে কোন্ বেহুদা কাজে ব্যয় করি। অনর্থকভাবে সেটাকে বিনষ্ট করি।

যদি আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদর্শিত পথ, শিক্ষা-দীক্ষা ও তার আদর্শের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও অনুরাগ থাকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাফায়াত লাভের তপ্ত বাসনা অন্তরে জাগ্রত থাকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বদদুআকে সত্যিকারভাবেই বিপদজনক মনে করে ভয় করি তাহলে জামার আঁচলে মুখ ঢেকে আমাদের হিসাব করা উচিত এবং অতীত গাফিলতি হতে খাঁটি মনে তওবা করে এই অঙ্গীকার উচিত যে, এই পবিত্র মাসে সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকব। একনিষ্ঠ মনে আল্লাহর দিকে ফিরে আসব। রমযানের এই অতি মূল্যবান সময়গুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির মধ্যেই ব্যয় করব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এ অঙ্গীকার পূরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

অনুবাদ : মুহাম্মদ আনছারুল্লাহ হাসান

 

advertisement