শি ক্ষা : উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি শ্বাপদের অভয়ারণ্য?
সহশিক্ষার দরজা বন্ধ করা কিংবা পার্থিব বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষার সম্পর্ক দৃঢ় করার বিষয়ে কোনো কথা পেশ করতে চাইলে যারা ঘাড় ঘুরিয়ে নেন তাদের জন্য ভাবনা-দুর্ভাবনার নতুন একটি অঙ্গন তৈরি করেছে গত মাসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ এবং এ বিষয়ক খবরাখবর। গত ১৫ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল-‘যৌন নিপীড়ন ইস্যু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি।’ সংবাদের সূচনাতেই লেখা হয়েছে-যৌন নিপীড়নের ইস্যু নিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। বারবার যৌন নিপীড়ন করেও কর্তৃপক্ষ ও সহকর্মীদের সহযোগিতায় নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করছেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফোরাম ও তদন্ত কমিটিতে শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করায় এটি সম্ভব হচ্ছে। এদিকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগামী দু’মাসের মধ্যে ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।’ রিপোর্টে জানা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের অব্যাহত যৌন নিপীড়নের অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।
গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস জুড়েই
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন এবং সে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে আন্দোলন জোরালো রূপ ধারণ করে। এক পর্যায়ে সে আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে গিয়ে দেশের এক শ্রেণীর ‘বুদ্ধিজীবী’দের একটি দল জাবি চত্বরে যান এবং তাদের একজন বলতে বাধ্যই হন যে, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অশিক্ষিত।’ তার এ বক্তব্যে ‘মান হারানো’ শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করা হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখিও হয় বিস্তর। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে এক শিক্ষক কর্তৃক ছয় ছাত্রীর শ্লীলতাহানি, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্রীর ধর্ষিতা হওয়ার পর আত্মহত্যা, ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরো দু’শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা ফাঁস হওয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সাংবাদিকতা বিভাগ ও ইতিহাস বিভাগের তিন শিক্ষক কর্তৃক বিভিন্ন সময় ছাত্রীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রীদের নিপীড়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শাস্তি না পাওয়ায় ঢাকা ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। জানা যায়, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও সাজেশান দেওয়া, খাতায় বেশি নম্বর দেওয়া, উন্নত নোট সরবরাহের প্রলোভনের পাশাপাশি পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে একশ্রেণীর শিক্ষক এই অপকর্ম করেন। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়া এবং শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ছাত্রীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েও ঘটনা প্রকাশ করতে সাহস পায় না। এতে যৌন নিপীড়ক ও প্রভাবশালী শিক্ষকরা আরো বে-পরোয়া হওয়ার সুযোগ পায়।
‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ সম্পর্কে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ স্থানে পরিণত করতে হবে। ছাত্রীরা নির্বিঘ্নে সেখানে থাকবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ হচ্ছে।’
যে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে উৎপীড়ক হচ্ছে শিক্ষকশ্রেণী আর উৎপীড়িত হচ্ছে তাদেরই ছাত্রীরা, সেখানে ‘নিরাপত্তা’ কে কাকে কীভাবে দিবে-এ মৌলিক প্রশ্নটির সহজ কোনো উত্তর পাওয়া কঠিন। কাগুজে নীতিমালার অপর পাশে যদি থাকে কামার্ত ও পাশবিক চরিত্রসম্পন্ন ‘সর্বোচ্চ’ শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু মানুষ, তাহলে ‘নীতিমালা’ করে কতটুকু কল্যাণ কিংবা নিরাপত্তা দেওয়া যাবে ছাত্রীদের, এটা বোধগম্য নয়। উচ্চশিক্ষিত এসব মানুষের কাছে নিখাঁদ ধর্মীয় শিক্ষা কোনো শিক্ষা নয়, সহশিক্ষার পরিবেশে কোনো দূষণ নেই এবং সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আয়োজন অবাঞ্ছিত বিষয়। এদের হাতেই যখন এ দেশের শিক্ষার্থী কন্যারা নিপীড়িতা, ধর্ষিতা হয়,
তখন বলতে হয়, আসলে এরা তাদের প্রবৃত্তির অনুকূল একটি অতি সুরসুরিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতেই এ ধরনের ‘প্রগতিশীলতার’ তত্ত্ব ছড়িয়ে চলেন। এদের ভেতর ও অন্দরের পংকিলতা এত বেশি যে, সাধারণ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান পরিবেশ ও ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে ‘ছাত্রীদের নিরাপত্তা’ দেওয়া কোনো নীতিমালার পক্ষে সম্ভব নয়। শিক্ষক নামের এক শ্রেণীর শ্বাপদের অভয়ারণ্য এসব প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, সিস্টেম ও কারিকুলামেও পরিবর্তন আনার মতো সাহসী কোনো নীতিমালা ও পদক্ষেপ রচনা না করলে ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ একটি ফুটা কলসে পরিণত হওয়ার আশংকা শতভাগ। এদেশের শিক্ষার্থী নারীদের জীবন ও সম্ভ্রমের বিষয়টিকে একটি ফুটা কলসের মতো অকার্যকর নিরাপত্তা বলয়ে দেখতে আমাদের মাঝে কে আগ্রহী হতে পারে বলুন!