স্বা স্থ্য : সরিষার দানায় দানায় ভূত! দুধের ঘষায় ঘষায় বিষ!
রোগীর জীবন ও চিকিৎসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বহু ঘটনা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। এজন্য দায়ী চিকিৎসকের নাম-ভূমিকার কথাও উল্লেখ হয়। কিন্তু ভুল চিকিৎসার জন্য, গাফিলতি ও অমানবিকতার জন্য এদেশের দু’-চার-দশজন চিকিৎসক শাস্তি পেয়েছেন বা কারাগারে গিয়েছেন এমন খবর পাওয়া যায় না। রোগীর প্রয়োজনীয় প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় চরম দায়িত্বহীনতা, ভুল ও ফাঁকিবাজির জন্য বহু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কীর্তিকাহিনী পত্র পত্রিকা থেকে নিয়ে মানুষের মুখে মুখে চালু থাকে,কিন্তু দশ-বিশজন ডায়াগনষ্টিক সেন্টার-মালিকের কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- এমন চিত্র কদাচিৎ-ও দেখা যায় না। আর আটা-ময়দা ও ট্যালকম পাউডার দিয়ে ভুয়া ট্যাবলেট-ক্যাপসুল বানিয়ে বাজারে চালিয়ে মানুষের জীবন ধ্বংসের জন্য ওষুধ কোম্পানির কোনো মালিকের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কিংবা ফাঁসির রায় ঘোষিত হতেও কেউ দেখে না। এ দেশে গণমানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন নিয়ে তিন পর্যায়ে এসব অমানবিক তামাশা সেজন্যই কখনও বন্ধ হয় না।
আরোগ্য লাভের জন্য চিকিৎসা করতে গিয়ে তাই দেশের সাধারণ মানুষ মুমূর্ষ হয়ে ঘরে ফিরে, কখনও এই ফেরাটা হয় খাটিয়ায় চড়েও। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকার পিলে চমকানো প্রধান শিরোনামটি ছিল-‘কিছু কোম্পানির ওষুধে পাওয়া গেছে আটা, ময়দা ও ট্যালকম পাউডার।’ রিপোর্টে লেখা হয়েছে-দেশের একশ্রেণীর কোম্পানি নিম্নমানের ও ভেজাল ‘জীবন রক্ষাকারী’ ওষুধ তৈরি করে দেদারসে বাজারজাত করে যাচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানির এন্টিবায়োটিক ও এমক্সোসিলিন ক্যাপসুলে ওষুধের কোনো উপাদানই পাওয়া যায়নি। পরীক্ষাগারের কর্মকর্তাদের মতে এই সকল নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ সেবনে রোগীর অবস্থার আরো অবনতি এবং অনেকের অঙ্গহানি হওয়ার আশংকা রয়েছে। অনেক রোগীর মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে বলে তারা জানান। এ যেন আধুনিক কালের সরিষার দানায় দানায় ভূতের বাসা। অথচ এসব
ভেজালের ঘটনা ধরা পড়লে কেবল কোম্পানির লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করা হয়। আর মামলা দায়ের করা হয়। এ পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক কোম্পানির লাইসেন্স স্থগিত হয়েছে আর মামলা দায়ের হয়েছে শতাধিক। বাস এ পর্যন্তই ছিল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দৌড়। অপরদিকে ওই রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, খ্যাতিমান চিকিৎসকরা বলেছেন, নিম্নমান ও ভেজাল ওষুধ তৈরিকারীরা নিরবে মানুষ হত্যা করছে। এদের বিরুদ্ধে শুধু লাইসেন্স বাতিল নয়, কঠোর শাস্তির বিধান থাকা প্রয়োজন।
চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর সর্বনাশ হওয়ার ঘটনা তো পুরনো খবর। এজন্য মাঝে মাঝেই বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালে ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। হাজার হাজার টাকা খরচ করে একেক ডায়াগনস্টিকের রিপোর্ট পাওয়া যায় একেক রকম। কোনোটার সাথে কোনোটার মিল নেই। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে এ দু’টি পর্যায়ের খামখেয়ালি ও বিড়ম্বনার সঙ্গে দেশের মানুষের কিছুটা পরিচিতি গড়েই ওঠেছে। এবার ওষুধ কোম্পানিগুলোর মানুষ মারার ফাঁদ নির্মাণের রিপোর্ট
পাওয়ার পর এ খাত নিয়ে চরম হতাশা সৃষ্টি হওয়া ছাড়া মানুষের আর গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এসব সর্বনাশা কায়কারবারের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণের কথা কেন শোনা যায় না, তা বোধগম্য নয়। হালের শক্তিশালী দুদক আর এক-এগার পরবর্তী দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে তো এই অঙ্গনেও কিছু ‘সুবাতাস’ বওয়ার কথা ছিল।
দেশবাসীর প্রত্যাশাও ছিল। সরকার যদি স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান অমানবিকতা নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? চিকিৎসার প্রতিটি ধাপই হচ্ছে উন্নত, সতর্ক ও অতি মানবিক সেবার একেকটি স্তর। এই স্তরগুলোতে বাসা বাঁধা ঘুণ পোকাগুলোকে কঠোরভাবে নির্মূল করতে না পারলে সুচিকিৎসা থেকে দেশের মানুষের বঞ্চিত হওয়ার পথ বন্ধ হবে না। এ খাতে দেশের মানুষ সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কিছু দৃশ্য দেখতে চায়। এ খাতের সুস্থতা ও শুশ্রূষায় সরকারের সযত্ন পরিচর্যার কাহিনী সবাই শুনতে চায়।
একই রকম ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে গুঁড়ো দুধের ক্ষেত্রে। গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে সাপের বাক্স খোলার মতো চীন থেকে আসা গুঁড়ো দুধে মেলামাইন মেশানোর আতংকজনক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথমে হাজার হাজার চীনা শিশুর অসুস্থ হওয়ার খবর, পরে চীন থেকে যে সব কোম্পানির দুধ বাংলাদেশে এসেছে তাতেও মেলামাইন মিশে থাকার খবর প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির দুধের রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বেশ কয়েকটি কোম্পানির গুঁড়ো দুধ ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েরেছ। যে দুধ প্রচুর টাকায় কিনে বাচ্চাদের খাওয়ানো হয় স্বাস্থ্য রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য, সে দুধেই মেলামাইনের মতো বিষ মেশানো থাকলে বাচ্চারা যাবে কোথায়? খাবে কী?
প্যাকেটজাত তরল দুধে পচনরোধকারী ফরমালিন মেশানোর কথা জানা গিয়েছিল কিছুদিন আগে। এখন গুঁড়ো দুধে মেলামাইনের মিশ্রণ। পুষ্টিকর পথ্য, ওষুধ ও ওষুধতুল্য খাবারে যদি এভাবে বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায়-তাহলে সাধারণ মানুষের বাঁচোয়া কী? উগ্র ও জীবন বিনাশী মুনাফাখোরি বন্ধে প্রথমে বিবেকের জাগরণ ও খোদাভীতির দরকার। পরে দরকার কঠোর আইন, শাস্তি ও নজরদারি। #