Rabiul Auwal 1431   ||   March 2010

আইন প্রণয়ন ও চলমান বাস্তবতা

Muhammad Abdullah Fahad

আল্লাহ তাআলা সমগ্র বিশ্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা। দুনিয়া ও আখিরাতের অধিপতি। সকল বাদশাহর বাদশাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন, যার নিকট থেকে ইচ্ছা ছিনিয়ে নেন। সকল কিছুর একচ্ছত্র ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার। অতএব একমাত্র তারই ইবাদত করতে হবে এবং তাঁর বিধান অনুযায়ীই জীবন যাপন করতে হবে। যুগে যুগে নবীগণ মানুষকে এ দিকেই আহ্বান করেছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই দাওয়াতেই দিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামই হল আল্লাহর মনোনীত ধর্ম।

কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন (তরজমা) নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন হল ইসলাম।’-সূরা আল ইমরান : ১৯
অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন, (তরজমা) আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’-সূরা মায়েদা : ৩
সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে ইসলাম অনুযায়ী চলতে হবে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন যেমন ইসলামের অনুগত হবে তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবনও। অতএব ইসলামই হবে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধান।

ইসলামের নীতিমালা ও বিধি-বিধানের উৎস হল চারটি : কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস। কোনো হুকুম ও নিয়ম-নীতির পিছনে উপরোক্ত চারটি উৎসের কোনো একটির সমর্থন থাকা আবশ্যক। এছাড়া তা ইসলামের বিধান হিসেবে গৃহিত হয় না। যে কোনো সংবিধানের দুইটি দিক থাকে। মৌলিক নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নীতিমালা। পৃথিবীর ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিমালা কুরআন-সুন্নাহর আদর্শ অনুযায়ী হওয়া আবশ্যক। তবে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাগত নীতিমালা যুগ ও জাতির অবস্থা এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির নিরিখে তৈরি করা হয়। তবে এগুলোও প্রস্তুত করা হয় মৌলিক নীতিমালা ও কুরআন-সুন্নাহর আদর্শ অনুযায়ী। কুরআন-সুন্নাহর আদর্শ পরিপন্থী কোনো নীতি গ্রহণযোগ্য নয়।

পক্ষান্তরে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো পার্থিব ও জাগতিক দিক বিচারে তাদের সংবিধান প্রণয়ন করে এবং সে অনুযায়ী তাদের রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এজন্যই এরিস্টটল, জেলিনেক, অধ্যাপক ফাইনার, ডাইসী, কে.সি. হুইয়ার, সি.এফ. স্ট্রং প্রমুখ আইন-বিশারদ বিভিন্নভাবে সংবিধানের যেসব সংজ্ঞা প্রদান করেছে তাতে বিষয়বস্তু বড় করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোন সূত্র থেকে বিধান ও নীতিমালা গ্রহণ করা হবে সে সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। বলাবাহুল্য, বিভিন্ন মানবীয় দর্শন ও চিন্তা এক্ষেত্রে মূল নিয়ামক। এমনকি সি.এফ.স্ট্রং-এর সংজ্ঞা, যাকে সকল দিক বিচারে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয় তাও জাগতিক তথা পরিচালনা ও ব্যবস্থাগত সংবিধানের সংজ্ঞা।

তার মতে সংবিধান হল, “Constitution is a collection of principles according to which the powers of the government, the rights of the governed and the relationship between in two are adjusted. অর্থাৎ সংবিধান হচ্ছে সে সকল নিয়ম-কানূনের সমষ্টি, যা সরকারের ক্ষমতা নির্ধারণ করে, শাসিতগণের অধিকার বর্ণনা করে এবং শাসন ও শাসিতের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ করে। আর অন্যান্য সকল সংজ্ঞার সারকথাও এটাই দাঁড়ায় যে, সংবিধান হচ্ছে কতিপয় নিয়ম-কানূনের সমষ্টি, যা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা নির্ধারণ, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতা বণ্টনের রীতি নির্ধারণ করে, জনগণের মৌলিক অধিকার নির্ণয় ও তা সংরক্ষণ করে এবং শাসন ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক স্থির করে।

কিন্তু মৌলিক প্রশ্ন হল, এসব বিষয়ের সূত্র কী হবে? এবং সেই সূত্র কতটা নিরপেক্ষ, নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য? এক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা একদম পরিষ্কার। ইসলামের ঘোষণা হচ্ছে, দুনিয়া আখিরাতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী তিনিই। তাই পৃথিবীর সব কিছু পরিচালিত হবে তাঁরই বিধান অনুযায়ী। আল্লাহর এই দুনিয়ায় আল্লাহর বান্দারা যেন পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, জুলুম ও অত্যাচার থেকে নিরাপদ থাকে এবং ইবাদত-বন্দেগী করে রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে-এসব বিষয় নিশ্চিত করা প্রতিটি ইসলামী ভূখণ্ডের নীতি হওয়া আবশ্যক। আর এ লক্ষ্যে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল রাজ্য পরিচালনার জন্য কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে যেসব নীতিমালা প্রস্তুত করবে তা পালন করাও প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং মান্য কর তাদের নির্দেশ, যারা তোমাদের দায়িত্বশীল। এরপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হও তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হও। আর এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।’-সূরা নিসা : ৫৯
তবে কোনো বিধান কুরআন-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হলে কিংবা কুরআন-সুন্নাহর আদর্শের পরিপন্থী কোনো নীতি প্রনয়ণ করলে তা আপনা থেকেই বাতিল বলে গণ্য হবে। কেননা, ইসলামের পরিষ্কার নীতি-স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।

দ্বিতীয় কথা এই যে, ইসলামী শরীয়তে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের যে দায়িত্ব তা অর্পন করা হয়েছে যোগ্য ব্যক্তিদের উপর। যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কুরআন-সুন্নাহর গভীর প্রজ্ঞা দান করেছেন, যারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেন-তাদের উপর। মোটকথা, ইসলামের দৃষ্টিতে আইন প্রনয়ণ একটি দায়িত্ব, যা শুধু যোগ্য ব্যক্তির উপরই অর্পিত হতে পারে।। পক্ষান্তরে প্রচলিত ব্যবস্থায় আইন হয়ে গিয়েছে পদের অধীনে। বাস্তবে কারো মাঝে আইন প্রণয়নের যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, নির্দিষ্ট পদ বা আসনের অধিকারী হলেই আইন প্রণয়নের অধিকার তার হাসিল হয়ে যায়!

বলাবাহুল্য, এই ব্যবস্থা আইন প্রণয়নের মতো নাযুক বিষয়কে স্বেচ্ছা চারিতার উপাদানে পরিণত করে ফেলে। ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে কিংবা নির্দিষ্ট শ্রেণী বা গোষ্ঠীর স্বার্থে কোনো আইন প্রণয়ন করা বা সংবিধানে পরিবর্তন ও সংস্কার করা সাধারণ নিয়ম হয়ে যায়। ইদানীং হাইকোর্টের একজন বিচারপতি নজরুল ইসলামের মুখেও ফুটে উঠেছে এর বাস্তবতা। এ প্রসঙ্গে তার কথাটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর ’০৯ শনিবার রাজধানীর মহাখালীল ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ আয়োজিত ‘‘গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সহিংসতা : রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’’ শীর্ষক এক সভায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন। এ সময় তিনি আইন প্রণয়নের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘‘কেরানিরা আইন তৈরি করে, আর মূর্খ সংসদ সদস্যরা হাত তালি দিয়ে তা পাস করিয়ে দেন। (দেখুন : দৈনিক নয়া দিগন্ত; দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ ডিসেম্বর)

বিচারপতির এ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে যখন পরিবেশ বেশ উত্তপ্ত তখন ফরহাদ মাজহার তার একটি প্রবন্ধে আরেকটি তথ্যও তুলে ধরেছেন ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না। এই অপকর্মটি করলে সংসদে তাঁর পদ বাতিল হয়ে যেতে পারে। খুবই মধুর আমাদের সংবিধান।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংসদ-সদস্যদের আইনের খসড়া পড়ারও বা কী দরকার। দল বলেছে, অতএব আইনের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।’ (দেখুন : দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৩ ডিসেম্বর)

আমরা মনে করি, সহিষ্ণুতার সঙ্গে এই কথাগুলো গ্রহণ করা উচিত এবং গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত যে, বাস্তবেই একটি সফল ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রের জন্য কেমন সংবিধানের প্রয়োজন। বলাবাহুল্য, যা সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করে, তার ঈমান-আমল, চরিত্র, নৈতিকতা রক্ষা করে আখেরাতের মুক্তি ও সাফল্য অর্জনে সহায়তা করে এমন সংবিধানই প্রয়োজন। যে সংবিধান গরীব-ধনী, দিনমজুর-উচ্চ পদাধিকারী থেকে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী মোটকথা সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং তাদের জন্য ন্যায়-ইনসাফ নিশ্চিত করবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষের সকল জ্ঞান, চিন্তা-ভাবনা শুধু বর্তমানকে ঘিরে। ভবিষ্যতের জ্ঞান তার নেই। এ কারণে যত প্রজ্ঞাপূর্ণ ও গভীর চিন্তা-ভাবনা করে কোনো আইন প্রণয়ন করা হোক তা বর্তমান সময়ের সার্বিক অবস্থার বিচারে হবে। ফলে স্বভাবতই তার কার্যকারিতাও আবর্তিত হবে বর্তমানকে ঘিরেই।

পক্ষান্তরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জ্ঞান অসীম, অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যত সবই তাঁর কাছে সমান। তিনি সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী। তিনি আলিমুল গায়ব। ফলে তাঁর আইনই হল প্রকৃত আইন, যা অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল যুগের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য সমান উপযোগী। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রণিত আইনই হল একমাত্র আইন, যা কেয়মত পর্যন্ত কার্যকর ও সমান উপকারী। এতে কোনোরূপ সংশয় ও দ্বিধার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং কোনো দেশ ও রাষ্ট্রের সংবিধান কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক হওয়া এবং কোনো দেশের আইন কুরআন-সুন্নাহর আইন হওয়াই জরুরি। কখনো নতুন কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দিলে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দেশের শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানী ও যোগ্য লোকদের গভীর চিন্তা-ভাবনা ও দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে তা হওয়া একান্ত জরুরি।

 

advertisement