যে জীবন ও আদর্শের কোনো তুলনা নেই : প্রসঙ্গ : প্রামাণিকতা
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী এবং কোনো না কোনো ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত। এটা অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই যে, অনুসরণ এবং অনুকরণই মানব-স্বভাবের শাশ্বত প্রবণতা। অতএব অনুসরণ আমাদের করতেই হবে। জীবনে কারো অনুসরণ করব না-একথাটা স্ববিরোধিতা। অনেক সময় দেখা যায়, এই স্ববিরোধিতাও কারো না কারো অনুকরণেই হয়ে থাকে। যা হোক, অনুসরণ আমরা করবই। আমাদের কর্তব্য হল, সেটা যেন সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ হয়-এইটে নিশ্চিত করা।
আমরা মুসলিম। আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে, আমাদেরকে তিনি ঈমান দান করেছেন। আর ঈমানের সূত্রে এমন এক আদর্শ দান করেছেন, যা পৃথিবীর সর্বোত্তম আদর্শ। কুরআন মজীদের ভাষায়- (তরজমা) ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আহযাব : ২১)
সেই উত্তম আদর্শ হলেন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এই প্রবন্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও আদর্শের যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে চাই তা হচ্ছে এর প্রামাণিকতা। এটা এমন এক বৈশিষ্ট্য যার কোনো তুলনা পৃথিবীর কোনো জাতির মধ্যেই পাওয়া যায় না।
ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞানলাভের পদ্ধতি
কোনো ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার দু’ টো পদ্ধতি হতে পারে : ১. ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া। ২. কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে অবগত হওয়া। অর্থাৎ যে প্রত্যক্ষদর্শী নয় সে একটি সূত্রের মুখাপেক্ষী, যার মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে তার সেতুবন্ধন স্থাপিত হবে। মধ্যবর্তী সূত্র কখনো একটি হয়, কখনো সূত্র-পরম্পরা দীর্ঘও হয়, যদি ঘটনাটি হয় প্রাচীন।
আবার ঘটনাভেদে বর্ণনাকারীর সংখ্যাও কম-বেশি হয়। কখনো সংখ্যাটা এত বিপুল হয় যে, এদের মিথ্যার বিষয়ে একমত হওয়ার কল্পনাই করা যায় না। আবার কখনো এর চেয়ে কমও হয়। শেষোক্ত ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর সততা ও সত্যবাদিতা এবং স্মৃতি ও ধীশক্তি পরীক্ষা করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। তা এই যে, সবক্ষেত্রে সূত্র যে জীবন্ত মানুষই হবে-এটা অপরিহার্য নয়। এটা হতে পারে একটি গ্রন্থ, যা দু’টি সুদূর যুগের মধ্যেও সেতুবন্ধনের কাজ দিবে। গ্রন্থকার যদি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হন তাহলে তাঁর মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। অন্যথায় ওই গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করতে হবে তাঁর নিজস্ব সূত্র। একটি দৃষ্টান্ত দেই :
সহীহ বুখারীর গ্রন্থকার ইমাম বুখারী রাহ.-ইন্তেকাল করেন ২৫৬ হিজরীতে। এখন চলছে ১৪৩০ হিজরী। তো এই গ্রন্থটি হাজার বছরেরও অধিক কালিক ব্যবধান মোচন করেছে। এই গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা যেন সরাসরি ইমাম বুখারীর নিকট থেকে হাদীস শ্রবণ করা।
আর যেহেতু ইমাম বুখারী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত তাঁর সূত্র লিপিবদ্ধ করেছেন তো আমরা নির্ভরযোগ্য ও অবিচ্ছিন্ন সূত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও কর্ম পর্যন্ত পৌঁছতে পারছি। যদিও এখানে কালের ব্যবধান প্রায় দেড় হাজার বছরের, কিন্তু আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হইনি। আলহামদুলিল্লাহ!
নবী জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সূত্র
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও আদর্শের মূল সূত্র দু’টি : কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ।
কুরআন মজীদের কথা তো বলাই বাহুল্য। যাঁর উপর কুরআন নাযিল হয়েছে, তাঁর যেমন সম্পূর্ণ কুরআন কণ্ঠস্থ ছিল তেমনি তাঁর সঙ্গীদেরও। অসংখ্য সাহাবী কুরআন মজীদের হাফিয ছিলেন। আর এটা ছিল প্রাত্যহিক চর্চার বিষয়। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে কুরআন তেলাওয়াত হত। নফল নামাযে দীর্ঘ কিরাত শুধু নবীজীরই অভ্যাস ছিল না, তাঁর সাহাবীদেরও অভ্যাস ছিল। রমযান মাসে তো কুরআন তেলাওয়াতের যেন উৎসব আরম্ভ হত। নামাযে ও নামাযের বাইরে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত রমযান মাসের বিশেষ আমল হিসেবে গণ্য হত। এরপর বহু সাহাবীর ব্যক্তিগত ‘মুসহাফ’ ছিল। আর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ তত্ত্বাবধানের পূর্ণ কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করিয়েছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর তাঁর খলীফাগণও কুরআন মজীদের সংরক্ষণ ও প্রচার এবং এর পঠন-পাঠনের বিপুল উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষের সীনায় কুরআন মজীদ সংরক্ষিত হয়েছে তেমনি তার অসংখ্য কপি মুসলিম জাহানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
কুরআন মজীদের বৈশিষ্ট্য এই যে, এর পঠন-পাঠন কোনো বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমিত ছিল না, সকল পেশার মানুষ, সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তা তেলাওয়াত করার ও হেফয করার পূর্ণ সুযোগ ছিল। ফলে কুরআন শুধু দু’ চার জনের মাধ্যমে নয়, লক্ষ-কোটি মানুষের কাছ থেকে লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে এসেছে। এভাবেই কুরআনের প্রতিটি সূরা, প্রতিটি বাক্য এমনকি প্রত্যেকটি বিন্দু পর্যন্ত সংরক্ষিত হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, এটা একমাত্র কুরআন মজীদেরই বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো ধর্মের ধর্মগ্রন্থ এভাবে সংরক্ষিত ও প্রচারিত হয়নি।
কুরআন মজীদের এক একটি আয়াত হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের এক একটি অংশ। কেননা এই আয়াতগুলো তো তাঁরই উপর নাযিল হয়েছে। এই আয়াতগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য, বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য এবং এর মাধ্যমে মানবজাতির সংশোধন ও পরিশুদ্ধির জন্যই তো তিনি প্রেরিত হয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- (তরজমা) ‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট তেলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, অথচ তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪)
অন্য আয়াতে এসেছে-(তরজমা) ‘আর আমি আপনার প্রতি যিক্র (কুরআন) নাযিল করেছি যাতে আপনি তা মানুষের সামনে পরিষ্কারভাবে বয়ান করে দেন।’
আর সব কিছুর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও ছিলেন কুরআন মজীদের জীবন্ত নমুনা।
একজন সাহাবী উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা.কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক কেমন ছিল? উম্মুল মু’মিনীন উত্তরে বললেন, তুমি কি কুরআন পড় না? তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন।
এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও দাওয়াতকে জানার প্রধান সূত্র কুরআন মজীদ।
দ্বিতীয় সূত্র হাদীস শরীফ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা-কাজ এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি সবই ‘হাদীসে’র অন্তর্ভুক্ত। তাই হাদীস শরীফ হচ্ছে নবী-জীবনের বিশদ বিবরণ। হাদীস শরীফ যেমন শরীয়তের বিধিবিধানের উৎস তেমনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি, তাঁর আচার-ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়েরও মূল্যবান দলীল। নবী-জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘটনাই বিস্তারিতভাবে হাদীসের কিতাবসমূহে বিদ্যমান রয়েছে।
হাদীস শরীফের প্রতিটি তথ্য, প্রত্যেকটা বিবরণ পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। এবং সকল তথ্যের সম্পূর্ণ সূত্র (সনদ) সংরক্ষিত। হাদীস শরীফের মৌলিক গ্রন্থগুলো খুললেই দেখা যাবে, প্রত্যেকটি হাদীস, অন্য ভাষায় নবী-জীবনের প্রত্যেকটি তথ্যের সঙ্গে সনদ বা সূত্র-পরম্পরা উল্লেখিত হয়েছে। এর তাৎপর্য হল গ্রন্থকার থেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বর্ণনাকারীদের সবার নাম উল্লেখিত রয়েছে। শুধু তাই নয় অত্যন্ত মৌলিক মানদন্ডের ভিত্তিতে পরীক্ষাও করা হয়েছে।
এই বিষয়টি সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা আলোচনা করতে পারি যে, মুহাদ্দিসগণ একটি বর্ণনা কখন গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রথমেই তিনটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেন। সেই প্রশ্নগুলো হচ্ছে-১. মূল ঘটনা পর্যন্ত সূত্র (সনদ) বিদ্যমান আছে কি না, এবং সনদের সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য কি না?
২. সূত্রটি (সনদ) সবধরনের বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত কি না?
৩. (সনদ) বা বক্তব্য ওইসব ত্রুটি (ইল্লত) থেকে মুক্ত কি না, যা একজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তি কিংবা অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি হয়?
তো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে প্রথম প্রয়োজন সনদ বিদ্যমান থাকা। সনদ নেই তো বর্ণনা বাতিল। দ্বিতীয় প্রয়োজন সনদের সকল বর্ণনাকারীর পরিচয় ও নির্ভরযোগ্যতা-অনির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে অবগতি। এটা এক বিস্ময় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের প্রতিটা তথ্য প্রামাণিক পন্থায় সংরক্ষণের জন্য মুহাদ্দিসগণ প্রায় এক লক্ষ রাবীর জীবনী সংকলন করেছেন। তাদের সময়কাল, সততা-সত্যবাদিতা, স্মৃতিশক্তি ও ধীশক্তি, হাদীসশাস্ত্রের চর্চা ও অভিজ্ঞতা, বর্ণনার মান ও পরিমাণ, উস্তাদ ও ছাত্রদের তালিকা, আবাস ও প্রবাসের বিভিন্ন তথ্য, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন, তাঁর সমসাময়িক কিংবা পরবর্তী যুগের ইমামুল হাদীসদের তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য ইত্যাদি সকল বিষয় সংকলিত হয়েছে। এই বিস্ময়কর শাস্ত্রটি ‘আসমাউর রিজাল’ নামে পরিচিত। এটা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু শত শত মুহাদ্দিস এ কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ইসলাম-বিদ্বেষী গবেষকরা পর্যন্ত মুসলিম মনীষীদের এই অমর কীর্তিতে বিস্মিত ও হতবাক না হয়ে পারেননি। একটি প্রসিদ্ধ উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। ডা. স্প্রেঙ্গার আলইসাবার ইংরেজি ভূমিকায় লেখেন-
‘পৃথিবীতে অতীতের কোনো জাতি এমন ছিল না, আজও নেই, যারা মুসলমানদের মতো ‘আসমাউর রিজালে’র সুবিশাল শাস্ত্র প্রস্ত্তত করেছে। যার মাধ্যমে আজ পাঁচ লক্ষ মানুষের অবস্থা জানা যেতে পারে।’’ (খুতবাতে মাদরাছ পৃ. ৪৫)
দ্বিতীয় প্রশ্ন সনদের বিচ্ছিন্নতা-অবিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গ। আসমাউর রিজাল শাস্ত্রে রাবীর সততা ও স্মৃতিশক্তির সঙ্গে তার উস্তাদ-শাগরিদদের তালিকা, সময়কাল, কোথায় কোন শায়খের সঙ্গে তার সাক্ষাত ইত্যাদি তথ্য এজন্যই সংরক্ষণ করা হয়েছে যাতে সনদের বিচ্ছিন্নতা-অবিচ্ছিন্নতা নির্ণয় করা যায়। এছাড়া হাদীসের ইমামগণ এ বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে মনোযোগ দিয়েছেন। অসংখ্য সনদ পরীক্ষা করে কোনটা বিচ্ছিন্ন আর কোনটা অবিচ্ছিন্ন -এটা তাঁরা নির্ণয় করেছেন। তাঁদের এই ফয়সালাগুলো যেমন স্বতন্ত্র গ্রন্থ আকারে সংকলিত হয়েছে তদ্রূপ আসমাউর রিজাল, শুরূহে হাদীস, ইলালুল হাদীস এবং যেসব গ্রন্থে সনদ বিষয়ক আলোচনা রয়েছে তাতেও সংকলিত হয়েছে।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর লাভের জন্য আইম্মায়ে হাদীস যেসব পন্থা অনুসরণ করেছেন তার মধ্যে একটি হল ‘মুকারানা’। অর্থাৎ তাঁরা এক বর্ণনাকে অন্য বর্ণনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক রাবীর বর্ণনা অন্য রাবীর সঙ্গে, সাধারণ রাবীর বর্ণনা নির্ভরযোগ্য রাবীদের বর্ণনার সঙ্গে, স্বল্প পরিচিত রাবীর বর্ণনা প্রসিদ্ধ ও প্রখ্যাত ইমামদের বর্ণনার সঙ্গে, এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের তুলনার মাধ্যমে তারা সনদ ও মতন অর্থাৎ সূত্র ও বক্তব্যের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করেছেন। এটা একটা মৌলিক পন্থা। ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত এক বিষয়ের সকল সনদ একত্র করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভুলত্রুটিগুলো প্রকাশিত হবে না।’
‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রের মতো ‘ইলাল’ শাস্ত্রও এক বিস্ময়। আসমাউর রিজালশাস্ত্রে যেমন অসংখ্য রাবীর জীবন ও পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে তদ্রূপ ইলালশাস্ত্রে উদঘাটিত হয়েছে হাজারো সনদ ও বর্ণনার যাবতীয় বিষয়! হাজার হাজার পৃষ্ঠায় ‘ইলালুল হাদীসের’ গ্রন্থাবলি রচিত হয়েছে। তদ্রূপ অন্যান্য বিষয়ের গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে।
এখানে শুধু রেওয়ায়েত পরীক্ষার কাঠামো সম্পর্কে সামান্য ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিস্ময়কর শ্রম ও অধ্যাবসায়, এই অতুলনীয় প্রেম ও ভালোবাসা শুধু এজন্যই নিবেদিত হয়েছে, যাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটা কথা, প্রতিটা কাজ এবং তাঁর জীবনের প্রতিটা ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য অক্ষয় হয়ে থাকে। বাস্তব সত্য এই যে, হাদীসশাস্ত্র বিশ্ব-ইতিহাসের এক বিস্ময়ক কীর্তি। জগতের কোনো জাতিই তাদের ধর্মগুরু বা কর্মগুরুর জীবন এতটা প্রামাণিকভাবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়নি।
সীরাতশাস্ত্র
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন-চরিতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি শাস্ত্র হল ‘সীরাহ’। এই শাস্ত্রের অনেক বিষয় হাদীস শাস্ত্রেরও বিষয়। অতিরিক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে, বিভিন্ন ঘটনার সন-তারিখ, প্রেক্ষাপট ও ধারাক্রম এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক অনুসন্ধান। এই শাস্ত্রের সঙ্গে সাধারণ ইতিহাসের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে তবে সীরাতশাস্ত্র ও ইতিহাসশাস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য এই যে, ইতিহাসের ঘটনাবলি সনদ ছাড়া সংকলিত হয়। আর সীরাতশাস্ত্রের সকল বিষয় সংকলিত হয়েছে সনদের সঙ্গে। ফলে হাদীসশাস্ত্রের উসূল অনুযায়ী সীরাতশাস্ত্রের তথ্যগুলোও পরীক্ষা করে ফেলা সম্ভব।
সারকথা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও আদর্শের একটি বড় বৈশিষ্ট্য প্রামাণিকতা। এটা এমন এক বৈশিষ্ট্য যে, পৃথিবীতে অন্য কোনো জীবন ও আদর্শই এর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)