হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানী-এর ঢাকা সফর ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যের সারসংক্ষেপ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
প্রায় ৭/৮ বছর পর আবার বাংলাদেশ সফর করে গেলেন হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম। ৫দিন ব্যাপী সফরের বেশিরভাগ সময় তিনি ঢাকাতেই কাটিয়েছেন। শুধু শেষের দেড় দিন ছিলেন সিলেটে। মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বসুন্ধরা মাওলানার সফরের আয়োজক হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছে এবারও। ধন্যবাদ তাদেরকেও।
হযরত মাওলানা তকী উছমানীর এ সফরকে ঘিরে আগে থেকেই আশাব্যাঞ্জক উৎসাহ জেগে উঠেছিল উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মুসলমানদের মাঝে। তাঁর দু’টি মূল ভাষণেই কানায় কানায় ভর্তি হয়েছিল অনুষ্ঠানস্থলগুলো। অনেকে এসেছেন দূর দূরান্ত থেকে।
মূলত এ সফরে আয়োজকদের পক্ষ থেকে মাওলানার জন্য ২টি বক্তৃতা পূর্ব-নির্ধারিত ছিল : ১. ১৪ ফেব্রুয়ারি শেরাটনের বলরুমে সেন্ট্রাল শরীয়া কাউন্সিল আয়োজিত কনফারেন্সে ভাষণ। ২. ১৫ ফেব্রুয়ারি মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বসুন্ধরায় ‘ইসলামী ব্যাংকিং পর শোবহাত কা এযালা’ শিরোনামে আলোচনা।
আলহামদুলিল্লাহ দু’টি মজলিসেই এই লেখকের অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে। মাসিক আলকাউসারের সম্মানিত পাঠকদের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং এর উপর উক্ত দু’টি মজলিসে পেশকৃত তাঁর উপদেশাবলি ও মন্তব্যসমূহ প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহ সংক্ষেপে পেশ করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।
হযরত মাওলানার প্রথম বক্তৃতাটি হয়েছে হোটেল শেরাটনে ১৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল ১০ টায়। বলা হয়েছিল, এটি ব্যাংকারদের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকিং-এর সাথে সংশ্লিষ্ট জেনারেল শিক্ষিতগণ এতে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং সে উদ্দেশ্যেই অনুষ্ঠানটির ভাষা রাখা হয় ইংরেজি। মাওলানাও ইংরেজিতেই ভাষণ দিয়েছেন। অথচ অনুষ্ঠানটি সফল হয়েছে, বলতে গেলে উলামায়ে কেরামের উপস্থিতির দ্বারাই। যাদের উদ্দেশ্যে তা আয়োজন করা হয়েছে আলেমদের তুলনায় তাদের অংশগ্রহণ ছিল একেবারেই নগণ্য সংখ্যায়। ব্যাংগুলোর শরীয়া কাউন্সিলের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিও ছিল হতাশাজনক।
২য় মজলিসটিতে হযরত উছমানী তাকরীর করেছেন উর্দু ভাষায়। শ্রোতাদের প্রায় সকলেই ছিলেন আলেম।
মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বসুন্ধরা থেকে শিক্ষাসমাপনকারী আলেমদের ২০ সালা দস্তারবন্দী উপলক্ষে আয়োজিত ২ দিনব্যাপী মাহফিলের ২য় দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এ বসুন্ধরায় এ মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। দু’টি মজলিসের শেষে ছিল সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব। যেহেতু উভয় বক্তব্যের বিষয়বস্ত্ত ছিল এক তাই অনেক কথাই তিনি উভয় জায়গায় বলেছেন। তাই হযরতের উভয়স্থানের বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তরসমূহকে ভিন্ন ভিন্ন উল্লেখ না করে সকল কথার সারাংশ পেশ করে দেওয়া সমীচীন মনে হচ্ছে।
১. সনাতনী ধারার ‘ব্যাংকগুলোর প্রচলিত সুদ কুরআনে নিষিদ্ধ ‘রিবা’-এর অন্তর্ভুক্ত।’
কিছু সংখ্যক শিক্ষিত লোক এমনকি কুরআন-হাদীস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে এমন কিছু লোকও দাবি করে থাকে যে, সনাতনী ধারায় প্রচলিত ব্যাংকগুলোর সুদ কুরআনে নিষিদ্ধ ‘রিবা’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ ব্যাংকের আবিষ্কার হয়েছে কুরআন নাযিল হওয়ার অনেক অনেক পরে। হযরত মাওলানা উছমানী দৃঢ়ভাবে উক্ত মতকে খন্ডন করেছেন এবং এ যুগের সুদও যে রিবা তথা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম কারবার তা বুঝিয়ে বলেছেন। তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত দলীল-প্রমাণের জন্য পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়া এ্যাপিলেট ব্যাঞ্চে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে তার দেওয়া ঐতিহাসিক রায়টি (যা পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে) পড়ে দেখার আহবান জানান।
আসলে হারামকে হালাল বলে চালিয়ে দেওয়ার এ অপকৌশল যুগ যুগ থেকেই চলে আসছে। হারাম কার্যক্রমের সাথে জড়িত কিছু লোক তো এমন রয়েছে যারা আল্লাহকে ভয় পায় এবং নিজের গুনাহের অনুভূতি তাদের মধ্যে কাজ করে এবং আল্লাহ তাওফীক দিলে একসময় হয়তো তাওবাও তাদের নসীব হয়। পক্ষান্তরে কিছু লোক এমনও আছে, যারা নিজেরা কোনো হারামে জড়িত হয়ে গেলে তাতে বিভ্রান্তিমূলক হিলা-তাবিল ও বাহানা-অজুহাত শুরু করে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই হারামকে হালাল বলে চালিয়ে দিতে এবং এর জন্য বিভিন্ন ভ্রান্ত যুক্তি ও দলীল পেশ করতে দ্বিধা করে না। এ যেন ‘... সিনা জুরি’-এর মতো অবস্থা। আল্লাহ তাআলা এ ধরনের লোকদের খপ্পর থেকে উম্মতকে হেফাযত করুন।
২. পশ্চিমা অর্থনীতিতে মন্দার কারণ
মাওলানা উছমানী স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, ক্যাপিটালিজম (পুঁজিবাদ)-এর দুর্বলতার কারণেই আজ পশ্চিমা অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। ইসলাম নিষিদ্ধ পন্থায় লাগামহীনভাবে ঋণপ্রদান, বাস্তব সম্পদের সাথে সামঞ্জস্য না রেখে কৃত্রিম মুদ্রার ব্যাপক ক্রয়-বিক্রয়, চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ আদায় এবং স্টক এক্সচেঞ্জে তথা শেয়ার বাজারের বর্তমান লেনদেন পদ্ধতিই মূলত আমেরিকার অর্থনীতিতে ধস নামার বড় কারণ।
হযরত তকী উছমানী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসারতা এবং ইসলামে নিষিদ্ধ কারবারগুলোর যে এক সময় ধ্বংস অনিবার্য সে বাস্তবতার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
৩. ইসলামে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে, ইসলামী ব্যাংক সম্ভব
কেউ কেউ ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের সাথে তুলনা করে তা মসজিদ ও ঘর পর্যন্ত সীমিত রাখতে চায়। তারা অর্থনীতি, বাজার ও রাষ্ট্রীয় কার্যে ইসলামের কোনো ভূমিকার বিরোধী। সেকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের এ বাতিল বক্তব্য তিনি সুস্পষ্টভাবে খন্ডন করেন এবং অর্থনীতি, রাজনীতিসহ মানবজীবনের সকল স্তরে ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও নীতিমালা অবলম্বনের আহবান জানিয়ে বলেন যে, খৃষ্টানদের মতো ‘ধর্ম শুধু গির্জায়’-এ ধারণা ইসলামে নেই; বরং ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেনদেনেও ইসলামী নীতিমালার প্রয়োগ জরুরি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, সুদী ব্যাংকগুলোর বিপরীতে সুদমুক্ত ব্যাংক করাও সম্ভব এবং সে চেষ্টা করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যকীয় কাজ।
৪. মূল পদ্ধতি হচ্ছে ‘মুযারাবা ও মুশারাকা’
ব্যাংকিং পদ্ধতিতে বিনিয়োগে মুযারাবা ও মুশারাকার গুরুত্বের কথা তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। ইসলামের ইনসাফভিত্তিক সম্পদের সুষম বন্টন পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়ন একমাত্র এ দুটি পন্থার মাধ্যমেই সম্ভব। লাভ-লোকসানে অংশিদারিত্ব, মুনাফা নেওয়ার সাথে সাথে রিস্ক তথা ঝুঁকির দায়িত্ব বহন ইসলামী অর্থব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তিনি ইসলামী ব্যাংকগুলোকে এ আদর্শ পদ্ধতি দুটি অবলম্বনের জন্য উদাত্ত আহবান জানান। তিনি বলেন, সমাজে ইসলামী অর্থনীতির সু-প্রভাব ছড়িয়ে দিতে এবং গণমানুষের ব্যাপক আর্থিক কল্যাণ বয়ে আনতে হলে অবশ্যই মুযারাবা-মুশারাকা করতে হবে।
মাওলানা বলেন, মুশারাকা-মুযারাবার কথা বললে ইসলামী ব্যাংকের মালিকগণ সব-সময় পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং মানুষের আমানত-দিয়ানতের নিম্নমুখিতার ওজর দেখান। আমি তাদেরকে বলে থাকি, ‘আপনারা অল্প অল্প করে হলেও তা শুরু করুন এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাছাই করে এ আদর্শ পদ্ধতি দু’টির উপর আমল শুরু করুন।’
৫. ‘শর্ত পালন করলে মুরাবাহাও জায়েয’
হযরত মাওলানা তকী উছমানী বলেন, যদিও আমি শুরু থেকেই ব্যাংকগুলোকে মুযারাবা-মুশারাকার উপর আমল করতে তাগিদ দিয়ে আসছি কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমি প্রচলিত মুরাবাহা বা ইজারা (এইচ.পি.এস.এম) কে নাজায়েয মনে করি; বরং শর্তাবলি পালন করে যথাযথ পন্থায় সম্পাদন করলে এগুলোও জায়েয। যদিও এগুলো আদর্শ ও উত্তম বিনিয়োগব্যবস্থা নয়, তথাপি শর্তাবলির অনুসরণ করলে এগুলোকে নাজায়েযও বলা যাবে না। এ প্রসঙ্গে তিনি সুদী লেনদেন ও মুরাবাহা কারবারের বিভিন্ন পার্থক্য তুলে ধরেন।
মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল ও এইচপিএসএম ইসলামী ব্যাংকগুলোতে ব্যবহৃত ও বহুল প্রচলিত কিছু পরিভাষা। শর্তাবলি ও নিয়মনীতি অনুসরণ করলে যথাযথ পন্থায় করলে প্রায় সকল ফকীহর নিকটেই তা জায়েযের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল, ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঐ সকল শর্ত ও নীতিমালা অনুসরণ করে কি না? নাকি পরিভাষা ব্যবহার পর্যন্তই তাদের ইসলাম সীমাবদ্ধ থাকে? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
৬. শর্ত পালন না করলে মুরাবাহাও হারাম
মাওলানা উছমানী বলেন,‘শর্তাবলি ও নিয়মনীতি অনুসরণ না করলে মুরাবাহা বা বাইয়ে মুয়াজ্জালও হারাম। শুধুমাত্র নাম ব্যবহারের দ্বারা তা হালাল হয়ে যাবে না। শরীয়তের নিয়মনীতি না মানলে শুধু নাম দ্বারা কিছু আসবে যাবে না।’
ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগ বিনিয়োগ মুরাবাহার নামে হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে শর্তাবলি পালন করা হয় না এবিষয়টি সংশ্লিষ্ট কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। আসলে মুরাবাহা (বাইয়ুল মুরাবাহা লিল আমেরে বিশ্ শিরা) হচ্ছে হালআমলের ফকীহগণ কর্তৃক ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া একটি বিকল্প ব্যবস্থা। শরীয়তের মৌলিক বিনিয়োগ পদ্ধতি মুযারাবা ও মুশারাকার উপর আমল করা সম্ভব না হলে কিছু শর্ত সাপেক্ষে অস্থায়ী ভিত্তিতে এ পদ্ধতিটি প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হযরত মাওলানা তকী উছমানী তাঁর বিখ্যাত ফিকহী সংকলন ‘আহকামুত তাওয়াররুক’ এ দুঃখ করে বলেছেন যে, মুরাবাহা ও ইজারার মতো বিকল্প ব্যবস্থাগুলো ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়েছিল খন্ডকালিন অস্থায়ী পন্থা হিসাবে। যেহেতু তারা পুঁজিবাদী সুদী অর্থনীতির মোকাবেলায় সবেমাত্র কারবার শুরু করেছিল আর এ অবস্থায় মুযারাবা-মুশারাকা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, ৩০ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তারা সে প্রাথমিক অবস্থার (হীলা) বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকছে। মৌলিক বিনিয়োগ পদ্ধতি এখনও তারা অবলম্বন করছে না।’ (বুহুছ ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছারা ২/১৪৫-১৪৭)
কিন্তু এ বিকল্প ব্যবস্থাগুলোও অনেক ক্ষেত্রে শুধু নাম পর্যন্তই মানা হয়ে থাকে। সেদিকে ইঙ্গিত করেই হযরত মাওলানা তকী উছমানী সাহেব বলেছেন, যদি শর্তাবলির অনুসরণ না করা হয়ে থাকে তবে নিঃসন্দেহে কারবারটি হবে হারাম।
বিচারপতি উছমানী সাহেব মুরাবাহার যে সকল শর্তের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন এ লেখার শেষ দিকে সেগুলোর কিঞ্চিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
৭. প্রসঙ্গ : শরীয়া বোর্ড
(ক) যোগ্যতা
ব্যাংকগুলোর শরীয়া বোর্ড সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে হযরত মাওলানা তকী উছমানী সাহেব বলেন, শরীয়া বোর্ডেও সদস্যকে অবশ্যই মেধাবী ও যোগ্য আলেম হতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও আধুনিক লেনদেন সংক্রান্ত ফিকহের মাসায়িল সম্পর্কে হতে হবে দক্ষ, বর্তমান সময়ের ব্যাংকগুলোর লেনদেন ও চুক্তিগুলো ভালোভাবে বুঝে তাতে সংগঠিত ভুলত্রুটি ধরতে পারা ও তা সংশোধন করার যোগ্যতা থাকতে হবে।
(খ) দায়িত্ব
মাওলানা বলেন, শরীয়া বোর্ডকে অবিরাম তাদের তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণ চালু রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো অবহেলার সুযোগ নেই। নামে মাত্র শরীয়া বোর্ড থাকলে চলবে না।
(গ) ব্যাংক ওয়ালারা কথা না মানলে শরীয়া বোর্ড থেকে পৃথক হয়ে যেতে হবে।
একটি ইসলামী ব্যাংকের একজন শরীয়া বোর্ড সদস্য, সাক্ষাত করতে গিয়ে মাওলানাকে তাদের করুণ অবস্থা এভাবে বলেন যে, ‘হযরত আমরা আছি উভয় সংকটে। একদিকে বাহিরের উলামায়ে কেরাম ব্যাংকের শরীয়া বোর্ডে যাওয়ায় তিরস্কার করেন। অন্য দিকে ব্যাংক ওয়ালারাও সঠিক পথে চলতে চায় না। শর্তাবলি মেনে চলে না, এখন আমরা কী করতে পারি?
তাঁর প্রশ্নের জবাবে মাওলানা তকী সাহেব বলেন, ‘যদি অন্যান্য সদস্য আপনাকে সহযোগিতা করে, ব্যাংকের লোকজন আপনাদের কথার উপর চলে, তাদের সংশোধনের আশা করা যায় তবে তো ঠিক আছে। কিন্তু যদি কেউ এই প্রান্ত এবং আরেকজন অন্য প্রান্তের কথা বলে এবং সংশোধন করা সম্ভব না হয়ে উঠে তবে বোর্ড থেকে ইস্তফা দিয়ে দিতে হবে। এমন পরিবেশে মানুষের জন্য কাজ করা ঠিক নয়।
বিচারপতি মাওলানা তকী সাহেব শরীয়া কাউন্সিলের ঐ সদস্যকে যে উপদেশ দিয়েছেন তার উপর তিনি নিজেও আমল করেছেন একাধিকবার। ব্যাংকওয়ালারা শরীয়া পরিপালনে গড়িমসি করার তিনি সে ব্যাংকের বোর্ড থেকে পৃথক হয়ে গেছেন যথারীতি ঘোষণা প্রদান করে।
আর আমাদের দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শরীয়া বোর্ডের করুণ দশার কথা কোনো অভিজ্ঞ মহলের অজানা নয়।
৮. বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকসমূহের ব্যাপারে মন্তব্য :
হোটেল শেরাটনের অনুষ্ঠানের পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় ঐ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সংবাদ পরিবেশনের আন্দাজ দেখেই বুঝা যায় যে, ঐ প্রতিবেদনগুলো ছিল মূলত আয়োজকদের পক্ষ থেকে সংবাদ কর্মীদের দেওয়া প্রেস রিলিজ। পত্রিকাগুলোতে (যেমন আমার দেশ, নয়া দিগন্ত) লেখা হয় যে, মাওলানা তকী উছমানী বলেছেন, ‘বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলো ইসলামী শরীয়তে হালাল তাতে সন্দেহ নেই। তবে ইসলামী আদর্শ পদ্ধতি গ্রহণ করলে দেশ ও জাতি সবাই ইসলামী ব্যাংকিং এর সুফল পাবে।’
উক্ত রিপোর্ট দেখে অনেকেরই ধারণা জন্মে যে, মাওলানা তকী সাহেব এ দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর কারবারকে হালাল ঘোষণা প্রদান করেছেন এবং অতি উৎসাহী লোকেরা তা প্রচারও শুরু করে। ১৫ তারিখ দুপুরে বসুন্ধরার বয়ানের পর প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর বর্তমান লেনদেন পদ্ধতি হালাল, এমন কথা আপনি বলেছেন কি?
উত্তরে মাওলানা বলেন, ‘কিছুতেই না। আমি কখনও এমন মন্তব্য করি না। এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য আমি কখনও দেই না। কোনো প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের নিয়মপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ, চুক্তিপত্রের শর্তাবলি যাচাই বাছাই এবং তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবগতি ছাড়া সে সম্পর্কে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’
আসলে বিচক্ষণ আহলে ইলমদের কথা এমনই হয়ে থাকে। কারণ, হযরত তকী সাহেব এবং অন্যান্য ফকীহগণ কর্তৃক প্রদত্ত ফর্মূলাগুলোর যথাযথ অনুসরণ হচ্ছে কি না সে বিষয়াটির অবিরত পর্যবেক্ষণ ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কীভাবে মন্তব্য করা যেতে পারে? একটি ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে এত বেশি গুজব ছড়ানো হয় যে, মাওলানা তাকে হালাল বলেছেন। এ কথা জানতে পেরে তিনি নিজ হাতে লিখে দিয়ে গেছেন যে, আমি তা বলিনি এবং আমি এমন কথা বলি না।
৯. প্রসঙ্গ : লাইফ ইন্সুরে্ন্স (তাকাফুল)
মাওলানাকে প্রশ্ন করা হয় যে, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে অসংখ্য ইসলামী জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা মালয়েশিয়ান মডেলে চলে। এগুলো হালাল কি না? জবাবে মাওলানা বলেন, এদের অনুসৃত পদ্ধতি আমার নিকট জায়েয নয়। অর্থাৎ আমাদের দেশের জীবন বীমা সংক্রান্ত ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো যে পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে তা মাওলানা তকী সাহেবের নিকট শরীয়তসম্মত নয়।
সারমর্ম
হযরত মাওলানা মুফতী তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর ব্যাংকসংক্রান্ত উপরোল্লিখিত বক্তব্যগুলোর সারকথা হল
১. আদর্শ ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি হল, লাভ-লোকসান অংশিদারী ভিত্তিক মুযারাবা ও মুশারাকা।
২. শর্তাবলি ও নিয়মনীতির অনুসরণ করলে মুরাবাহাও জায়েয। যদিও তা অনুত্তম।
৩. শর্তাবলি ও নিয়মনীতি না মানলে মুরাবাহাও সম্পূর্ণ হারাম।
৪. শরীয়া বোর্ডেও সদস্যকে হতে হবে এমন যোগ্য আলেম যিনি ফিকহুল মুআমালাত সম্পর্কে দক্ষ ও অভিজ্ঞ।
৫. শরীয়া বোর্ড কর্তৃক ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উপর শরীয়া পরিপালনের জন্য অব্যাহত চাপ বজায় রাখতে হবে।
৬. শরীয়া বোর্ডেও মনিটরিং হতে হবে অবিরত।
৭. ব্যাংকওয়ালারা শরীয়া পালনে আগ্রহী না হলে একজন আলেমের জন্য তাতে যুক্ত থাকা উচিত নয়। তার জন্য পৃথক হয়ে যাওয়া জরুরি।
৮. বাংলাদেশের কোনো ইসলামী ব্যাংকের হালাল বা হারাম হওয়া সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করিনি।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)