Rabiul Akhir 1430   ||   April 2009

স্ব দে শ : জঙ্গিবাদ বিরোধী একজন !

Waris Rabbani

জঙ্গিবাদ দমনে প্রশাসনের উঁচু স্তর থেকে জোরালো কথাবর্তা বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ আরো বহু মন্ত্রীর সাফল্য প্রকাশক বিষয়ই হয়ে গেছে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ নিয়ে নুতন ও চমকপ্রদ কিছু না কিছু বলা। এদেশে ঘুষখোর, মুনাফাখোর, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী, সশস্ত্র সর্বহারা খুনী, রাজনৈতিক দখলদার ও বন্দুকবাজদের মতো কিছু জঙ্গির অস্তিত্ব হয়তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু আগুন লাগা থেকে নিয়ে মাথাব্যথা পর্যন্ত সব জায়গায় জঙ্গির ছায়া আবিষ্কার করা, জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়ে আলেম-উলামা, মাদরাসা-মসজিদ ও দ্বীনদার শ্রেণীকে সংশয়গ্রস্ত ও কোন্ঠাসা করার মতো কোনো পথ অবলম্বন নিশ্চয়ই দেশ ও জাতির জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। সরকার ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ একটি ইস্যুকে এভাবে ঢালাওকরণের কুফল কত মারাত্মক হতে পারে  তার একটি নজির দেখুন। গত ২৯ মার্চ রোববার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ছেপে আসা একটি রিপোর্ট হুবহু তুলে দেওয়া হল।

সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ শুধু ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি

সন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মাদ আফজাল বলেছেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রয়েছে তার সবই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আমার অধীনে সারাদেশে ৩৬ হাজার আলেম কর্মরত আছেন। মাত্র দুমাস কয়েক দিন হলো দায়িত্ব পেয়েছি। এখন দেখছি এখানে ধর্ম-টর্ম কিচ্ছু নেই। একটি গোষ্ঠী নিজেদের আখের গুছিয়েছে।

গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় শামীম মোহাম্মদ আফজাল আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি বাঙ্গালি ও একজন খাঁটি মুসলমান ছিলেন। এটা সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। আমার মতো কৃষকের ছেলে আজ এ চেয়ারে বসেছি বঙ্গবন্ধুর কল্যাণে। আমি তার ও তার পরিবারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। উল্লেখ্য, শামীম মোহাম্মদ আফজাল বাংলাদেশ সরকারের যু্গ্ম-সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগদানের আগে তিনি জেলাজজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মসজিদ কাউন্সিল আয়োজিত গতকালের গোলটেবিল আলোচনায় ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন আর্চবিশপ পৌলিনুস কস্তা, প্রফেসর ড. পরেশ চন্দ্র মন্ডল, প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া, প্রফেসর ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও, বুয়েটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সুলতানা রাজিয়া, ড. মনজুরে ইলাহী, বাংলাদেশ ধর্মীয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আজিজুর রহমান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মসজিদ কাউন্সিলের সভাপাতি মাওলানা আবুল কালাম আযাদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যারয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ ইউসুফ।

মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যের ভিত্তিতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম জাতিসত্তাকে আক্রমণ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি তার বক্তব্য অব্যাহত রাখলে এক পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আজিজুর রহমান ফ্লোর নিয়ে বলেন, ডিজি সাহেব বলেছেন কেবল ইসলাম সন্ত্রাস করে-এটা সত্য নয়। সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে অনুমানসর্বস্ব তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে আমাদের তিনি হতবাক করেছেন। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হচ্ছে এটাই।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে শ্রোতাদের মধ্যে আরিফুর রহমান নামে একজন বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির বক্তব্য যদি হয় মিথ্যা তথ্যনির্ভর তাহলে ইসলাম ও মুসলমানদের যে কী করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারতের গুজরাটে হাজার হাজার মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। শত বছরের ঐতিহ্য বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। কাশ্মীরের মুসলমানদের ওপর কী অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে হিন্দুরা, তা বিশ্ববাসী জানে। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা মিলে ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংস করে হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ হত্যা করল। স্বাধীন ফিলিস্তিনের নারী ও শিশুদের অমানবিকভাবে হত্যা করে চলেছে। বসনিয়া ও চেচনিয়াতে খ্রিষ্টানরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে মুসলমানদের হত্যা করেছে। স্পেনের কর্ডোভায় লাখ লাখ মুসলমানকে জড়ো করে আগুন দিয়ে পুড়ে মেরেছে খ্রিষ্টানরা। এ ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সাহেব এগুলো জেনেও না জানার ভান করে উল্টো ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসের দায় চাপালেন, যা মুসলমানদের জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়।

শ্রোতা ও অন্যান্য আলোচকরা প্রতিবাদ করায় আরো উত্তেজিত হয়ে পড়েন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালনক শামীম মোহাম্মাদ আফজাল। তিনি অনেকটা চিৎকার করে বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার, আল-বদরদের থেকে এদেশে সন্ত্রাসের শুরু। আলেম ওলামাদের কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে  ভূমিকা রাখেননি। তার এ বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই একজন শ্রোতা তার কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত ও পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই সন্ত্রাস হচ্ছে। ওইসব দেশে  তো রাজাকার ও তালেবান নেই। ওইসব দেশের সন্ত্রাসের জন্য কে দায়ী? এ প্রশ্নের জবাবে ডিজি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, মুসলমানদের দ্বিধাবিভক্ত করার মাধ্যমেই এই সন্ত্রাসের জন্ম।

সূচনা বক্তব্যে অনুষ্ঠানের পরিচালক মসজিদ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সন্ত্রাস নির্মূলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মের নেতাদের একমঞ্চে আন্তরিক সংলাপ অনুষ্ঠানকে নজিরবিহীন মন্তব্য করে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে একটি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সমাবেশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অনুষ্ঠানে দরগাহ ও মাজারের লোকদের আমন্ত্রণ না জানানোয় তিনি আয়োজকদের সমালোচনা করেন।

পরে ডিজিকে উদ্দেশ করে আবুল কালাম আযাদ বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক একজন সরকারি কর্মকর্তা ও সম্মানিত ব্যক্তি। ধর্মীয় ব্যাপারে আমাদের সহনশীল মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। যার ধৈর্য্য সহ্য নেই, তিনি সন্ত্রাস দমনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পৌলিনুস কস্তা ধর্মের শান্তির বাণী কেবল কথায় না বলে কাজে পারিণত করার আহবান জানান।

প্রফেসর ড. পরেশ চন্দ্র মন্ডল বলেন, সন্ত্রাস কেবল কোনো বিশেষ ধর্মে সীমাবদ্ধ নয়, যে কোনো ধর্মেই তা হতে পারে। ২০০৫ সালে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মাওলানারা খুতবা দিয়ে বোমা হামলা বন্ধে সহায়তা করেন। কাজেই যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো ধর্ম নেই। এটাই আমরা বিশ্বাস করি।

ড. সুকোমল বড়ুয়া বলেন, ধর্মের আদেনই হচ্ছে, সম্প্রীতি। ইসলামধর্মে আমরা আশরাফুল মাখলুকাত, হিন্দুধর্মে অমৃতের মানুষ, খ্রিষ্টধর্মে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, আর বৌদ্ধধর্মে মানবজন্ম দুর্লভ অর্জন। ঘুরেফিরে সবধর্মের বাণীই এক। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমরা এর মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হলেই সন্ত্রাস নির্মূল হতে বাধ্য। ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও বলেন, ধর্মীয় নেতারা সোচ্চার হলে সন্ত্রাস নিরসনে আমরা অবশ্যই সফলকাম হব। প্রফেসর ড. সৈয়দা রাজিয়া সুলতানা বলেন, রাজনীতিকরা ভোটের আগে যেমন ধর্মের কথা বলেন। তেমনি সন্ত্রাসীরাও ধর্মের কথা বলে মানুষের অন্তরে পৌছার চেষ্টা করে। আগে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হতো, কিন্তু আজকের বিশ্বে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধর্মই হবে ঢাল। কওমি মাদরাসা শিক্ষাকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উৎসশক্তি হিসেবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে-মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা গবেষণা করে দেখেছি-কওমি মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদে প্রণোদনাদায়ক হতে পারে এমন কিছু নেই।

এরপর আর কী মন্তব্য করার থাকে বলুন। অভিযুক্ত ব্যক্তি সাবেক জেলাজজ ও সরকারের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার লোক। সরকারী প্রতিষ্ঠানের এ রকম চেয়ারে বসা বহু লোকদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে এখন এই রূপটি দেখা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে-অন্য ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন ধর্মগুরুদের সামনে এমন ঢালাও ও মিথ্যা বক্তব্য কি জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে সহায়ক নয়? তাই সব মহলে সজাগ ও সাবধানী অবস্থান গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এই রিপোর্টটি ছাপা হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক প্রতিবাদ এসেছে। অপরদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও দেওয়া একটি ব্যাখ্যা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। #

 

 

advertisement