Rabiul Akhir 1430   ||   April 2009

যে জীবন ও আদর্শের কোনো তুলনা নেই প্রসঙ্গ : প্রামাণিকতা - ২

Mawlana Muhammad Zakaria Abdullah

মুসলমানদের কাছে ইসনাদের প্রাচূর্য

ইসনাদ ও অবিচ্ছিন্ন সূত্রের সঙ্গে হাদীস শরীফ সংকলিত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শায়খুল ইসলাম মুসতফা সাবরী রাহ. (১৩৭৩ হি.) বলেন, হাদীস শরীফের জন্য রেওয়ায়েত পরীক্ষার সর্বোত্তম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে।  সূক্ষ্মতা ও সাফল্যের বিচারে পাশ্চাত্যের আধুনিকতম ইতিহাস-পরীক্ষার পদ্ধতিও এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। সহীহ বুখারীতে পুনরোল্লেখ বাদ দিলে ২০৬২টি মুসনাদ হাদীস রয়েছে, যা ইমাম বুখারী বাছাই করেছেন তাঁর মুখস্থ এক লক্ষ হাদীস থেকে (এই সংখ্যাটা সনদ ভিত্তিক) এবং তাতে প্রায় দুহাজার রাবী রয়েছে। সহীহ বুখারী চার খন্ডে প্রকাশিত, কিন্তু সনদগুলো বাদ দিলে তা হবে মাঝারি আকারের এক খন্ডের একটি গ্রন্থ  প্রশ্ন এই যে, পৃথিবীতে এমন কোনো ইতিহাস-গ্রন্থ আছে কি, যার তথ্যগুলো দুই হাজার নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বিবরণ? আর তাঁদের সম্পর্কে গ্রন্থকার নিজেও যেমন  অবগত তদ্রূপ বিশেষজ্ঞরাও তাদের সম্পর্কে ওয়াকিফহাল?

উপরন্তু এই গ্রন্থের প্রতিটি তথ্য, যা গড়ে এক লাইনের মতো, কে কার কাছ থেকে শুনেছেন, তিনি কার কাছ থেকে, এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পূর্ণ সনদ উল্লেখিত হয়েছে। তো গ্রন্থের প্রতিটি  তথ্যের সঙ্গে তার সাক্ষ্যদাতা বর্ণনাকারীদের পূর্ণ ধারা উল্লেখিত হয়েছে, যারা ওই তথ্যের পূর্ণ দায়িত্ব বহন করবেন।’’ (মাওকিফুল আকলি ওয়াল ইলমি ওয়াল আলম ... ৪/৮৭)

উপরের দৃষ্টান্ত থেকে মুসলমানদের কাছে ইসনাদের পর্যাপ্ততা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। এটা শুধু সহীহ বুখারীর বৈশিষ্ট্য নয়, গোটা হাদীসশাস্ত্রেরই বৈশিষ্ট্য। এত বিপুল সংখ্যক মানুষ হাদীস শরীফের চর্চায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং ইসনাদের প্রতিটি স্তরে এত বিপুল সংখ্যক রাবীর উপস্থিতি ছিল যে, এক একটি হাদীস শতাধিক সনদে বর্ণিত হওয়া ছিল খুবই বিষয়।

এখানে এই বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়া প্রয়োজন যে, মুহাদ্দিসগণ হাদীসকে সনদসহ গণনা করে থাকেন। এজন্য একটি হাদীস একাধিক সনদে বর্ণিত হলে তা একাধিক হাদীস গণ্য করা হয়। যেমন-প্রসিদ্ধ হাদীস ‘‘ইন্নামাল আমালু বিন নিয়্যাত’’ যেহেতু সাত শত সনদে বর্ণিত হয়েছে তাই সনদসহ তা সাত শত হাদীস গণনা করা হবে।

ইসনাদের এই পর্যাপ্ততার কারণ এই যে, একদম গোড়া থেকেই অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের স্তর থেকেই বিপুল সংখ্যক মানুষের মাধ্যমে হাদীস শরীফ সংরক্ষিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং ইসলামের সকল কর্মতৎপরতা শুধু এর অনুকূলেই ছিল না; বরং একে অপরিহার্য করে তুলেছিল। কেননা, কুরআন ও সুন্নাহই হল ইসলামের সকল বিষয়ের মূল সূত্র। অতএব এ দুটো ছাড়া যেকোনো পর্যায়েরই ইসলামী কর্মতৎপরতার চিন্তাই অবান্তর। আমরা যদি একদম গোড়ায় যাই তাহলে বিষয়টা আমাদের সামনে আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

রাবীদের প্রথম স্তর

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যক্ষ সাহচর্য গ্রহণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। আর তাঁরাই হাদীস শরীফের প্রথম রাবী। তাঁদের মাধ্যমেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও আদর্শ সংরক্ষিত হয়েছে। এটা ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য এবং এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে কোনো শূন্যতা নেই।

রাবী সাহাবীদের সংখ্যা

লক্ষাধিক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর সাহচর্য লাভ করেছেন। এঁদের মধ্যে মুহাজির ও আনসারী সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য এই যে, তাদের পূর্ণ জীবন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তারা তাঁর ঘনিষ্ট সাহচর্য লাভ করেছেন, জীবনের সকল বিষয়ে তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন, তাঁর নিকট থেকে ওহীর ইল্ম গ্রহণ করেছেন এবং জিহাদে ও গযওয়ায় তাঁর সঙ্গে জীবনবাজি রেখেছেন। তাঁদের এই সাহচর্য ছিল ওই পূর্ণতম আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে, যা ইসলামী পরিভাষা ছাড়া প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেটা হচ্ছে ঈমান

সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, তাঁর প্রতি তাঁরা ঈমান এনেছিলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেন (তরজমা) তারা (মুনাফিকরা) যদি সেভাবে ঈমান আনত যেভাবে তোমরা ঈমান এনেছ তাহলে তাঁরা হেদায়েত লাভ করত। (সূরা বাকারা : ১৩৭)

সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে দ্বীনের ধারণ, প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সকল কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, এর জন্য বহুমুখী খিদমতের প্রয়োজন ছিল। দাওয়াত, তালীম, আমর বিল মারূফ, নাহি আনিল মুনকার, জিহাদ ও রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি সকল বিষয়ে উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত জনবলের প্রয়োজন ছিল। সাহাবায়ে কেরামের নেতৃত্বে আল্লাহ তাআলা সকল অঙ্গনের কাজ সুসম্পন্ন করিয়েছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ হাদীস শরীফের বর্ণনা ও প্রচারের খিদমতও শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, হাদীস শরীফের রেওয়ায়েত ও বর্ণনার বিষয়ে কোনো গোপনীয়তা কখনোই ছিল না। যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁরা হাদীস ও সুন্নাহর পরিবেশেই তা বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ অসংখ্য সাহাবী ও তাবেয়ীর বর্তমানে হাদীস বর্ণনার ধারা অগ্রসর হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম একে অপরের কাছে অপরিচিত ছিলেন না। তাঁরা একটি মহাকেন্দ্রের চারপাশে অনবরত আবর্তিত হয়েছেন। তাই প্রত্যেকে প্রত্যেকের সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অবগত। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর তারা যখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন তখন তাবেয়ীনের বিশাল জামাত তাদেরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। একই সঙ্গে হাদীস শরীফের বিভিন্ন কেন্দ্রে সাহাবা-তাবেয়ীনের সফর ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অধ্যায়। এভাবে তাবেয়ীগণ যেমন সাহাবায়ে কেরামকে জেনেছেন তেমনি জেনেছেন তাদের সমসাময়িক ও সহগামী তাবেয়ীদেরকেও। হাদীস শরীফের বর্ণনাধারা এভাবেই সামনে অগ্রসর হয়েছে।

মোটকথা, সম্পূর্ণ প্রকাশ্য ও উন্মুক্ত পরিবেশে অসংখ্য সাহাবা-তাবেয়ীনের বর্তমানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসসমূহ বর্ণিত হয়েছে। সে যুগে নির্ভরযোগ্য সনদ ছাড়া হাদীস গ্রহণ করার প্রশ্নই যেহেতু অবান্তর ছিল তাই হাদীস শরীফের সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে রাবী ও বর্ণনাকারীদের পূর্ণ ধারা বিস্তারিত বিবরণসহ সংরক্ষিত ও সংকলিত হয়েছে।

এজন্য সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যাঁদের সূত্রে একটি মাত্র হাদীসও বর্ণিত হয়েছে তাঁদেরও নামধাম, পরিচয় সংরক্ষিত। তাঁদের সর্বমোট সংখ্যা দেড় হাজারের কিছু অধিক। (যাহাবী, তাজরীদু আসমাইস সাহাবা)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে ৯০৪ জন সাহাবীর মুসনাদ সংকলন করেছেন। মুসনাদে বাকী ইবনে মাখলাদ-এর তালিকা থেকে জানা যায় যে, অতিরিক্ত আরো ৫৬৮ সাহাবীর মুসনাদ তাতে (মুসনাদে বাকীতে) সংকলিত হয়েছে। অতঃপর হাফেয আবু বকর বারকী (২৭০ হি.) সেই তালিকায় আরো ৮৭ জন সাহাবীর নাম যোগ করেছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি.) বিভিন্ন উৎস থেকে যোগ করেন আরো ৬ সাহাবীর নাম। সর্বমোট সংখ্যাটা তা-ই দাড়ায় যা হাফেয যাহাবী রা. (৭৪৮ হি.) বলেছেন। অর্থাৎ দেড় হাজারের কিছু বেশি। ১৫৬৫ জন।

তবে আগেই বলা হয়েছে যে, এই সংখ্যার সিংহভাগ হল যাঁদের সূত্রে খুব অল্পসংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রায় পাঁচ শতাধিক সাহাবী এমন রয়েছেন যাঁদের সূত্রে মাত্র একটি করে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এভাবে দুটি হাদীস কাদের সূত্রে, তিনটি হাদীস কাদের সূত্রে ... মুহাদ্দিসগণ তা গণনা করে ফেলেছেন।

প্রসঙ্গত বলে দেওয়া প্রয়োজন যে, যাঁদের সূত্রে অল্পসংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এর অর্থ এই নয় যে, তিনি স্বল্প পরিচিত বা স্বল্প মর্যাদার অধিকারী। অনেক বদরী সাহাবী থেকেও কেবল দুএকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাদের রেওয়ায়েত কম হওয়ার কারণ হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্ধৃতি দানে সতর্কতা। প্রয়োজন ছাড়া হাদীস শরীফ বর্ণনা করা সাহাবায়ে কেরামের নীতি ছিল না।

ইলমের প্রচারের বিষয়ে তাঁরা যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্ধৃতি দেওয়াকেও তাঁরা অত্যন্ত কঠিন দায়িত্বের বিষয় বলে মনে করতেন। এজন্য দেখা যায় যে, তুলনামূলক অধিক হাদীস তাঁদের সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে যারা বয়স বেশি পেয়েছেন ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পয়গাম পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের উপর এসে গেছে, কিংবা যারা কোনো অঞ্চলে শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন কিংবা বিচার বা শাসনভার যাঁদের উপর অর্পিত হয়েছে, অথবা হাদীস শরীফের বর্ণনা ও রেওয়ায়েতকেই যাঁরা জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

সারকথা এই যে, দেড় হাজারেরও অধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রত্যক্ষ সাহচর্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্বের সূত্রে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও জীবন বর্ণিত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা।

এখানে তুলনামূলক অধিক হাদীস যে সাহাবীদের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তাদের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। অত্যন্ত সংক্ষেপে উল্লেখিত তথ্যগুলোর মাধ্যমে যে বিষয়গুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হল :

১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য।

২. দ্বীনের জন্য ত্যাগ ও কুরবানী।

৩. হাদীস ও সুন্নাহর বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা এবং বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীস ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা।

অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করার একটি উদ্দেশ্য হল, দ্বীন প্রতিষ্ঠা এবং হাদীস ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসারের জন্য তাঁদের মাতৃভূমি ত্যাগ ও মিশনারী জীবন যাপনের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র যেন আমরা পেয়ে যাই। বিস্তারিত জানতে হলে তাঁদের জীবনীমূলক গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করতে হবে।

এই পরিসংখ্যানে হারামাইন, কুফা, বসরা, শাম ও মিসরের নাম এসেছে। কেননা তুলানমূলক অধিক সংখ্যক সাহাবী এসব কেন্দ্রেই অবস্থান করেছেন। এর বাইরেও বহু অঞ্চলে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান। বিস্তারিত জানতে তবকাতে ইবনে সাদ এবং অন্যান্য গ্রন্থের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। 

হারামাইনের অধিবাসী সাহাবায়ে কেরাম

একথা বলাই বাহুল্য যে, মদীনাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিল সকল মুহাজির ও আনসারী সাহাবীর আবাসভূমি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর যখন ইসলামের বিজয়াভিযান বিস্তৃত হতে লাগল এবং নতুন নতুন শহরের গোড়াপত্তন হল তখন অসংখ্য সাহাবী সেসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেন। তাঁরা যেমন জিহাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে গমন করেছেন তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের দ্বীন ও ঈমান শিক্ষাদানের জন্যও  প্রেরিত হয়েছেন। এভাবে মদীনার চেরাগ থেকে অসংখ্য চেরাগ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে এবং ইলম ও ঈমানের নতুন নতুন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বড় বড় মনীষী সাহাবী ওই সব কেন্দ্র আলোকিত করে রেখেছিলেন। এরপরও মদীনায় এমনসব ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ছিল যাঁদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল প্রবাদতুল্য। খোলাফায়ে রাশেদীন, বিশেষত হযরত উমর ফারূক রা.-এর কথা তো বলাই বাহুল্য, তাঁরা ছাড়াও যাদের সূত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে তারা হলেন-

১. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. (৫৭ হি.)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শীর্ষস্থানীয় ফকীহ সাহাবার অন্যতম। তাঁর পবিত্রতার বিষয়ে কুরআন মজীদের আয়াত নাযিল হয়েছে।

সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস যাঁদের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তিনি তাঁদের অন্যতম।

২. যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. (৪৫ হি.)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাতিবীনে ওহীর অন্তর্ভুক্ত। খন্দক ও অন্যান্য গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে মাত্র পনেরো দিনে সুরিয়ানী ভাষা শিখে ফেলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খিলাফত-আমলে কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়েছিল। মদীনার ইলম ও ফিকহের অন্যতম স্তম্ভ।

৩. উবাই ইবনে কাব রা.। তাঁর মৃত্যু সন নিয়ে বেশ মতভেদ রয়েছে। বাইয়াতে আকাবায় (২য়) শামিল ছিলেন। বদর, উহুদ ও পরবর্তী সকল গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। মনীষী সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

৪. আবু হুরায়রা রা. (৫৭ হি.)। আহলে সুফফার অন্তর্ভুক্ত। সকল কাজ ত্যাগ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যে  উপস্থিত থাকতেন। বার বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সার্বক্ষণিক সাহচর্য লাভ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস তাঁর সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে।

৫. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. (৭৩/৭৪ হি.)। পিতার সঙ্গে মদীনায় হিজরত করেন। উহুদ যুদ্ধে বয়স ছিল ১৪। এজন্য শরীক হওয়ার অনুমতি পাননি। খন্দক ও পরবর্তী গযওয়াসমূহে নবীজীর অনুকরণ করতেন। ফকীহ ও মনীষী সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

৬. জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. (৭৮ হি., মদীনায়)। বাইয়াতে আকাবায় (২য়) শামিল ছিলেন। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম রা. বদরী সাহাবী; উহুদ যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। পিতার আদেশক্রমে বোনদের দেখাশোনার জন্য জাবির রা. মদীনায় থাকতে বাধ্য হন। তাঁর শাহাদতের পর খন্দক ও পরবর্তী গযওয়াসমূহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণ করেন। নবীজীর ঘনিষ্ট সাহচর্যপ্রাপ্ত ফকীহ সাহাবীদের অন্যতম।

৭. উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. (৬২ হি.)। প্রথম স্বামী আবু সালামা রা.-এর সঙ্গে হাবাশায় হিজরত করেছিলেন। এরপর মদীনায় হিজরত করেন। তাঁর হিজরতের ঘটনা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। উহুদ যুদ্ধে আবু সালামা রা.-এর শাহাদাতের পর ৩য় বা ৪র্থ হিজরীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গভীর প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার অধিকারিনী ছিলেন। উম্মুল মুমিনীনদের মধ্যে সবশেষে ইন্তেকাল করেন।

এছাড়া আরো যাঁদের সূত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে তারা হলেন-

৮. সালামা (ইবনে আমর) ইবনুল আকওয়া রা. (৭৪ হি.)। বাইয়াতে রিদওয়ানে শামিল ছিলেন। সাতটি গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। গযওয়া যুকারাদ-এর ঘটনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাদের সর্বোত্তম পদাতিক সালামা ইবনুল আকওয়া।

উছমান রা.-এর শাহাদাতের পর রাবাযায় বসবাস করেন। সেখানে তাঁর অবস্থানকাল চল্লিশ বছরের মতো। মৃত্যুর কিছুদিন আগে মদীনায় ফিরে আসেন। ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

৯. কাব ইবনে মালিক রা.। বাইয়াতে আকাবায় শামিল ছিলেন। উহুদ ও পরবর্তী গযওয়াগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি ওই তিন সাহাবীর একজন যারা গযওয়ায়ে তবুকে অংশ নেননি। পরে কুরআন মজীদে তাঁদের ক্ষমার কথা নাযিল হয়। আলী রা.-এর খিলাফত-আমলে ইন্তেকাল।

১০. সাহ্ল ইবনে সাদ ইবনে মালিক আনসারী রা.। (৯১ হি. বা তার পরে, মদীনায়)। পিতা-পুত্র দুজনই সাহাবী। মদীনায় ইন্তেকালকারী সর্বশেষ সাহাবী।

১১. রাফে ইবনে খাদীজ আনসারী রা. (৭৩ বা ৭৪ হি. ৮৬ বছর বয়সে)। বদর যুদ্ধে বয়স অল্প হওয়ায় অনুমতি পাননি। উহুদ ও পরবর্তী গযওয়াগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। উহুদ যুদ্ধে তীরবিদ্ধ হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার একটি চমকপ্রদ ঘটনা রয়েছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে হাদীস শরীফ লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

১২. আবু সায়ীদ খুদরী (সাদ ইবনে মালিক ইবনে সিনান আনসারী) (৭৪ হি.)। পিতা-পুত্র দুজনই সাহাবী। তাঁর পিতা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। বয়স অল্প ছিল বলে তিনি সে যুদ্ধে অনুমতি পাননি। পরবর্তী গযওয়াসমূহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। নওজওয়ান ফকীহ সাহাবীদের মধ্যে অগ্রগণ্য।

মক্কা মুকাররমা

বিশিষ্ট মুহাজির সাহাবীদের প্রায় সকলেই মক্কার অধিবাসী ছিলেন। হিজরত করে মদীনায় চলে যান। সাহাবা-যুগের শেষ দিকে যারা এখানে অবস্থান করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম এই-

১. আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. (৬৭/৬৮ হি.,তায়েফে)। হিজরতের তিন বছর পূর্বে মক্কায় জন্ম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্য দুআ করেছেন। মক্কা-বিজয়ের পরে মদীনায় চলে আসেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর ওফাতের পর বড় বড় সাহাবীর কাছে গিয়ে হাদীস শরীফ সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, আমি একটি বিষয় ত্রিশজন সাহাবীকে জিজ্ঞাসা করতাম। শীর্ষস্থানীয় ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

২.আসমা বিনতে আবু বকর রা. (৭৩ বা ৭৪ হি.)। আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর কন্যা। হিজরতের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর পাথেয় প্রস্ত্তত করে দিয়েছেন। নিজের কোমরবন্দ ছিড়ে তাদের খাবার ও পানীয় বেঁধে দিয়েছিলেন বলে তাঁর উপাধী যাতুন নিতাকায়ন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা.-এর স্ত্রী।

৩. আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. (৭৩ হি.)। মদীনায় জন্মলাভকারী মুহাজিরদের প্রথম শিশু। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার তাহনীক করেছেন এবং নাম রেখেছেন। তাঁর মা আসমা বিনতে আবু বকর রা., খালা উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা.। ইবাদতগুযার, ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত। নয় বছর ইসলামী খিলাফত পরিচালনা করেছেন।

কূফায় অবস্থানকারী সাহাবায়ে কেরাম

কূফায় অবস্থানকারী সাহাবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদীস যাঁদের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে তারা হলেন :

১. খলীফায়ে রাশেদ আলী ইবনে আবী তালেব রা. (৪০ হি.)।

২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (৩২ বা ৩৩ হি. মদীনা) সাবিকীনে আওয়ালীনের অন্তর্ভুক্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এত নিকট সান্নিধ্য লাভ করেছেন যে, আগন্তুকরা তাকে নবী-পরিবারের সদস্য মনে করতেন। কূফার অধিবাসীদের দ্বীন ও ঈমান শিক্ষাদানের জন্য হযরত উমর রা. তাকে নির্বাচন করেন। শীর্ষস্থানীয় ফকীহ ও মনীষী সাহাবীদের অন্যতম।

৩. সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. (৫৫ হি. মদীনায়)। আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত।

৪. আম্মার ইবনে ইয়াসির রা. (৩৭ হি. সিফফীন যুদ্ধে)। সাবিকীনে আওয়ালীনের অন্তর্ভুক্ত। হযরত উমর রা. তাঁকে কুফার আমীর নিযুক্ত করেছিলেন।

উল্লেখিত চারজনই বদর ও পরবর্তী সকল গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। শুধু হযরত আলী রা. নবীজীর আদেশে মদীনায় ছিলেন বলে গযওয়ায়ে তবুকে শরীক হতে পারেননি।

৫. আবু মাসউদ আনসারী রা. (৪০ হি.-এর পরে)। বাইয়াতে আকাবায় শামিল ছিলেন। ইমাম বুখারী রাহ.-এর মতে বদরের যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেছেন। উহুদ ও পরবর্তী সকল গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন।

৬. হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান রা. (৩৬ হি.)। পিতা-পুত্র দুজনই সাহাবী। মুশরিকদের বাধার কারণে তারা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেননি। উহুদ যুদ্ধে দুজনই অংশগ্রহণ করেন এবং পিতা শহীদ হন। পরবর্তী সকল গযওয়ায় হুযাইফা রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর উপাধী ছাহিবুসসির। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনেক গোপন বিষয় জানিয়ে দিয়েছিলেন।

উমর রা. তাকে মাদায়েনের আমির নিযুক্ত করেন। উছমান রা.-এর শাহাদত পর্যন্ত মাদায়েনের আমীর ছিলেন। তাঁর শাহাদাতের চল্লিশ দিন পর ইন্তেকাল।

৭. বারা ইবনে আযিব রা. (৭১ হি.)। পিতা-পুত্র দুজনই সাহাবী। বয়স অল্প হওয়ায় বদরের যুদ্ধে তিনি ও আবদুল্লাহ ইবনে ওমর অনুমতি পাননি। উহুদ ও পরবর্তী গযওয়াগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন।

৮. আবু কাতাদা আনসারী রা. (৫৪ হি.)। উহুদ ও পরবর্তী গযওয়াসমূহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। উপাধী ফারিসু রাসূলিল্লাহরাসূলের অশ্বারোহী। আলী রা. তাকে মক্কার আমিল নিযুক্ত করেছিলেন।

৯. বর্ষীয়ান সাহাবী সালমান ফারেসী রা. (৪৩ হি. মাদায়েনে)। খন্দকের যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন।

১০. মুগীরা ইবনে শোবা রা. (৫০ হি. কুফায়) হুদায়বিয়া ও বাইয়াতে রিদওয়ানে শামিল ছিলেন। উমর রা. তাঁকে বসরার, পরে কুফার আমীর নিযুক্ত করেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তাঁর এক চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতুলনীয় বুদ্ধি ও কৌশলের কারণে তাঁকে মুগীরাতুর রায় বলা হত।

১১. জাবির ইবনে ছামুরা রা. (৭৪ হি.)। পিতা-পুত্র দুজনই সাহাবী। তিনি বলেছেন, আমি দুই হাজারেরও বেশি নামায নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে আদায় করেছি।

১২. নুমান ইবনে বাশীর আনসারী রা. (৬৫ হি.)। তাঁর পিতা ও মাতা দুজনই সাহাবী। হযরত মুয়াবিয়ার শাসনামলে কুফার আমীর ছিলেন। মুসলিম ইবনে আকীল তাঁর সময়েই কুফায় আগমন করেন। তাঁর সম্পর্কে নুমান ইবনে বাশীর রা.-এর উদারনীতির উপর আপত্তি করা হলে তিনি তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করেন -আল্লাহর আনুগত্যে নত হওয়া আমার কাছে অধিক প্রিয় আল্লাহর অবাধ্যতায় প্রতাপশালী হওয়ার চেয়ে।

১৪. যায়েদ ইবনে আরকাম রা. (৬৬ বা ৬৮ হি. কুফায়)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে তাঁর প্রথম গযওয়া খন্দক। সর্বমোট সতেরোটি গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল সম্পর্কে তাঁর সংবাদের সত্যতা সূরা মুনাফিকূনে নাযিল হয়েছে।

১৫. জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রা. (৫১ হি. বা তার পরে)। ইসলাম গ্রহণের আগেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আগমনের সুসংবাদ সাহাবায়ে কেরামকে দান করেছিলেন। পরে তিনি আগমন করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন। যিলখালাসার অভিযানে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং অভিযান সমাপ্ত হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুসংবাদ দিলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরকতের দুআ করেন।

১৬. আদী ইবনে হাতিম রা. (৬৮ হি.)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য লাভ করেন। ইরতিদাদের ফিৎনার সময় তাঁর অবিচল অবস্থান ছিল এবং তার কওমের যাকাত হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর দরবারে পাঠিয়ে দিতেন। ইরাক-বিজয়ী সাহাবীদের অন্যতম।

আরো অনেক সাহাবী কুফায় আগমন করেছেন এবং বসবাস করেছেন। ইমাম ইজলী রাহ. (২৬১ হি.) বলেন, ‘‘কুফা নগরীতে পনেরো শ সাহাবী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।’’

হযরত আলী রা.-এর খিলাফত আমলে কুফা ছিল দারুল খিলাফা। এ কারণেও অসংখ্য সাহাবী এখানে আগমন করেছেন।

বসরা

বসরার অধিবাসী সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু মূসা আশআরী রা., ইমরান ইবনে হুসাইন রা., আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রা. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত উমর রা. এঁদেরকে কুরআন-সুন্নাহ্র শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।

১. আবু মূসা আশআরী রা. (৫০ হি. বা তার পরে)। মূল নাম আবদুল্লাহ ইবনে কায়স। খায়বার পরবর্তী গযওয়াগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইয়েমেনের আমিল নিযুক্ত করেছিলেন। উচু পর্যায়ের ফকীহ সাহাবী। বসরার অধিবাসীদের দ্বীনী মনীষা নির্মাণে তাঁর অবদানই সর্বাধিক। উমর রা.-এর খিলাফতের সময় বসরার আমিলও ছিলেন। উছমান রা. তাঁকে কূফার আমিল নিযুক্ত করেন। কূফাবাসীও তাঁর ইলম ও প্রজ্ঞা দ্বারা উপকৃত হয়েছে।

২. ইমরান ইবনে হুসাইন রা. (৫২ বা ৫৩ হি.)। প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ। তাঁর পিতা ও বোনও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। বেশ কয়েকটি গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। ফত্হে মক্কার সময় খুযায়া গোত্রের পতাকা তাঁর হাতেই ছিল। মনীষী ও বুযুর্গ সাহাবীদের অন্যতম।

৩. আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রা. (৫৭ বা তার পরে)। বাইয়াতের রিদওয়ানে শামিল ছিলেন। এরপর মদীনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্যে অবস্থান করেন।

৪. বিখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.ও (৯২/৯৩ হি. একশরও অধিক বয়স) বসরায় আগমন করেন। দশ বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সার্বক্ষণিক সাহচর্য লাভ করেছেন এবং খিদমত করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদিম হিসেবে বদর যুদ্ধেও শামিল ছিলেন। পরবর্তী গযওয়াগুলোতেও অংশগ্রহণ করেছেন। নবীজী তাঁর সন্তান-সন্ততি, আয়ু ও সম্পদে বরকতের দুআ করেছেন। যেসব সাহাবীর সূত্রে সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাঁদের অন্যতম।

৫. বুরাইদা ইবনে হুসাইব রা. (৬৩ হি. খুরাসানে)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতের সময় ইসলাম গ্রহণ। বদরের যুদ্ধের পর মদীনায় আগমন ও পরবর্তী সকল গযওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গলাভ।

৬. ছামুরা ইবনে জুনদুব (৫৮ হি.)। অল্প বয়স্ক হওয়ায় এক অভিযানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বাদ দিয়েছিলেন। তিনি তখন অনুমতিপ্রাপ্ত একজনকে কুস্তিতে হারিয়ে জিহাদে যাবার অনুমতি আদায় করেন।

এছাড়া আরো বহু সাহাবী বসরায় আগমন করেছেন। শুধু তাবাকাতে ইবনে সাদেই তাঁদের দেড়শ জনের আলোচনা রয়েছে।

শামে অবস্থানকারী সাহাবায়ে কেরাম

শামের সাহাবীদের মধ্যে যাদের রেওয়ায়েত অধিক তাঁরা হলেন ১.উবাদা ইবনুস সামিত রা. (৩৪ হি, ৭২ বছর বয়সে) ২. মুয়ায ইবনে জাবাল রা. (১৮ হি.)। হযরত উমর রা. যাঁদেরকে শামের অধিবাসীদের শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন এঁরা দুজন তাদের অন্যতম। দুজনই বদরী সাহাবী এবং অন্য সকল জিহাদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। দুজনই আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতে উপস্থিত ছিলেন।

৩. সাদ ইবনে উবাদা রা. (১৫ হি. শাম) আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতে শরীক ছিলেন। আকাবার বারোজন নকীবের মধ্যে সাদ ইবনে উবাদা রা. ও উবাদা ইবনুস সামিত রা. অন্যতম।

৪. বিখ্যাত সাহাবী আবুদ্দারদা রা.। উহুদ ও পরবর্তী গাযওয়াগুলোতে শরীক ছিলেন। উছমান রা.-এর খিলাফতের শেষ দিকে ইন্তেকাল।

৫. ফাদালা ইবনে উবায়দ রা. (৫৮ হি.)। উহুদ, বাইয়াতে রিদওয়ান ও পরবর্তী সকল গাযওয়ায় শামিল ছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর পক্ষ থেকে দামেস্কের কাযী ছিলেন।

৬. আবু উমামা বাহেলী রা. (৮৬ হি. শাম)। বাইয়াতে রিদওয়ানে শামিল ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার কাওমের কাছে ইসলামের দাওয়াতের জন্য প্রেরণ করেন এবং গোটা কওম তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে।

৭. আমর ইবনে আবাসা রা. (আনু : ৬০ হিজরীর পর) প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে নিজ গোত্রে অবস্থান করেন। গযওয়ায়ে উহুদের পর হিজরত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহচর্য গ্রহণ।

৮. ওয়াছিলা ইবনুল আসকা রা. (৮৫ হিজরী পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ১০৫)। আহলে সুফফার অন্তর্ভুক্ত। গযওয়ায়ে তবুকে শরীক হয়েছেন। উহুদ, খন্দকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। মনীষী সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

৯. আবদুল্লাহ ইবনে বুস্র রা. (৭৫ হি.)। গযওয়ায়ে খায়বারে অংশগ্রহণ। বাইয়াতে রিদওয়ানে শামিল ছিলেন। সিজদার হালতে ইন্তেকাল। (ইসাবা ৭/৫৮-৬০)

১১. শাদ্দাদ ইবনে আওছ রা. (৫৮ হি. ৭৫ বছর বয়সে)। তাঁর পিতা আওছ ইবনে ছাবিত খাযরামী বদরী সাহাবী ছিলেন, উহুদ যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাদ্দাদ ইবনে আওছ রা. সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, শাম বিজিত হবে এবং তুমি ও তোমার সন্তানরা সেখানে অনুসরণীয় হবে। উবাদা ইবনুস সামিত রা. তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করেছেন।

এছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. (১৮ হি., ৫৮ বছর বয়সে) ও হযরত বিলাল রা. (১৭ বা ১৮ হি., শাম, ৬০ বছরের কিছু বেশি) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া বহু সাহাবীর আগমন ও অবস্থানে এই অঞ্চল ধন্য হয়েছে।

মিসরে অবস্থানকারী সাহাবায়ে কেরাম

হযরত ওমর রা.-এর খিলাফতের আমলে বিখ্যাত সাহাবী আমর ইবনুল আস রা.-এর নেতৃত্বে মিসর বিজিত হয়। এ অভিযানে বড় বড় সাহাবী শামিল ছিলেন। অভিযান সমাপ্ত হওয়ার পর দ্বীনী শিক্ষাদীক্ষার প্রচার-প্রসারের জন্য অনেক সাহাবী সেখানেই অবস্থান করেন। যাঁদের সূত্রে অধিক রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে তারা হলেন-

১. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. ( ৬৩ হি.)। ৭ম হিজরীর পরে ইসলাম ও হিজরত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে কয়েকটি গযওয়ায় অংশগ্রহণ। ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত। নবীজী তাঁকে হাদীস শরীফ লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমর ইবনুল আস রা.-এর পরে মিসরের শাসনভার তাঁর উপর অর্পিত হয়।

২. মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রা. (৩৩ হি., ৭০ বছর বয়সে)।

৩. মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা. (৪০ হিজরীর পর)।

দুজনই বদর, উহুদ ও পরবর্তী সকল যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন।

৪. আবু রাফে রা.। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাওলা আযাদকৃত গোলাম। উহুদ, খন্দকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। মনীষী সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।

৫. আবদুল্লাহ ইবনে উনাইছ জুহানী রা. (৫৪ হি. শাম)।

দুজনই উহুদ ও পরবর্তী গযওয়াগুলোতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উনাইছ রা. আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতেও শামিল ছিলেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. শুধু একটি হাদীসের জন্য এক মাসের পথ অতিক্রম করে তাঁর কাছে এসেছিলেন।

৬. উকবা ইবনে আমির রা. (আনু. ৬০ হি.)। হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর শাসনামলে মিসরের আমীর ছিলেন। ফকীহ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা. একটি হাদীসের জন্য মদীনা মুনাওয়ারা থেকে তাঁর কাছে আগমন করেছিলেন। (হাকীম, মারিফাতু উলূমিল হাদীস)

৭. কায়েস ইবনে সাদ ইবনে উবাদা রা. (আনু. ৬০ হি.)।

পিতার মতোই চৌকস ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। দশ বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমত করেছেন এবং তাঁর ঘনিষ্ট-সাহচর্য লাভ করেছেন। এক যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পতাকা তাঁর হাতে ছিল। আলী রা. তাকে মিসরের নায়েব নিযুক্ত করেছিলেন। (আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৫/৫৯৯)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রবীণ ও মনীষী সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী রা. মিসরে অবস্থান করেছেন। মিসর-বিজেতা হযরত আমর ইবনুল আস রা.-এর সূত্রেও কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বুদ্ধি ও রণকৌশলে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তি ছিলেন। গযওয়ায়ে যাতুস সালাসিলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (৯১১ হি.) মিসরে আগমনকারী তিনশরও অধিক সাহাবীর আলোচনা করেছেন। বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী শতাধিক সাহাবী মিসরে প্রবেশ করেছেন। এছাড়া মুয়াবিয়া ইবনে হুদাইজ রা. এর নেতৃত্বে আফ্রিকায় যে অভিযান পরিচালিত হয় তাতে বহু মুহাজির ও আনসারী সাহাবী শামিল ছিলেন। (দেখুন : হুসনুল মুহাযারা ফী তারীখি মিসর ওয়াল কাহিরা খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৬৬-৩৫৪)

আশা করি, দৃষ্টান্ত হিসাবে এই সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যানটিই যথেষ্ট। উদ্দেশ্য এই যে, সংখ্যার বিচারে যেমন তেমনি গুণগত বিচারেও ইসনাদের পর্যাপ্ততা একদম গোড়া থেকেই ছিল। প্রাসঙ্গিক আরো যেসব বিষয়ের সূচনা সাহাবা-যুগে হয়েছে তার মধ্যে কিতাবাতে হাদীস (লিপিবদ্ধ আকারে হাদীস সংরক্ষণ), নকদে হাদীস (রেওয়ায়েত পর্যালোচনা) এবং ফিকহ ফিল হাদীস (হাদীস শরীফ থেকে ইসলামী বিধিবিধান আহরণ) অন্যতম। পরবর্তী মজলিসে ওই বিষয়গুলোর উপরও সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার আশা রাখি।#

 

advertisement