ইসলামী ব্যাংকিং : প্রাসঙ্গিক কিছু কথা-২
হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উছমানীর এবারের বাংলাদেশ সফর এমন একটি সময়ে হয়েছে যখন এদেশে ইসলামিক ব্যাংকিং (সংখ্যার বিচারে) তার যৌবন কাল অতিক্রম করছে। দেশী-বিদেশী মিলে ৮টি ব্যাংকের সকল শাখাই ইসলামী। আর সনাতনী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনেকেরই রয়েছে এক বা একাধিক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা ইউনিট। এভাবে বাংলাদেশে কয়েক শত ইসলামী ব্যাংকিং ব্রাঞ্চ রয়েছে, যার সংখ্যা নিয়মিতভাবে বাড়ছে। বর্তমানে শুধু বেসরকারী ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংকিং করছে এবং বেসরকারী ব্যাংকসমূহের গড় মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশ তাদের দখলে। একাউন্ট হোল্ডার (আমানতকারী), বিনিয়োগকারী, বিনিয়োগগ্রহীতা ও ভোক্তা এবং আমানতকৃত টাকার অংক সকল ক্ষেত্রেই ইসলামী ব্যাংকগুলোর এখন জয়জয়কার। তাই সনাতনী সূদী পদ্ধতির অনেক ব্যাংকই এখন পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রবেশের পথে রয়েছে। এর কারণ সুস্পষ্ট। তা হচ্ছে, এদেশের সাধারণ মুসলিম জনগণ তাদের প্রিয় ধর্মের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও বিশ্বাস, যা তাদেরকে ইসলাম নামের প্রতি দারুণভাবে আকর্ষিত করে। বিশ্বব্যাপী ইসলাম, মুসলমান ও ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুন নিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও অব্যাহত বিরূপ প্রচারণা সত্ত্বেও ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমনকি অমুসলিম মালিকদের বিদেশী ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্যাংকিং ইউনিট খুলেছে।
অতএব বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকিং-এর ব্যাপারে জানার আগ্রহ স্বাভাবিক কারণেই আগের চেয়ে অনেক বেশি। মাওলানা তকী উছমানী সাহেব তাঁর এবারের সফরে এ বিষয়েই আলোকপাত করে গেছেন। যেহেতু তাঁর সফরটি ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত এবং এতে কর্মশালা বা প্রশিক্ষণমূলক কোনো আয়োজন ছিল না এবং তাঁর বক্তৃতাগুলোও দীর্ঘ সময় নিয়ে হয়নি তাই তিনি শুধু মৌলিক বিষয়গুলোই বলে গেছেন। সে বিষয়গুলোর কোনো কোনোটির সামান্য ব্যাখ্যা আজকের লেখায় পেশ করা হয়েছে।
মুযারাবা-মুশাকারা
হযরত মাওলানা যথার্থই বলেছেন, ইসলামের মৌলিক বিনিয়োগ পদ্ধতি হচ্ছে মুযারাবা ও মুশারাকা। কারণ এ দু’টিই এমন যুগান্তকারী পদ্ধতি যেগুলোর মাধ্যমে ইনসাফভিত্তিক সামজব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। ইসলামী অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থার সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র এবং কল্যাণমুখিতার প্রমাণ একমাত্র মুযারাবা-মুশারাকার মাধ্যমেই করা সম্ভব।
মুযারাবা কী?
মুযারাবা হচ্ছে এমন একটি কারবার যেখানে ২টি পক্ষ থাকবে। ১টি মূলধন সরবরাহকারী, অন্যটি ব্যবসায়ী। একটি চুক্তির মাধ্যমে কারবারটি সংগঠিত হবে, যাতে ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফায় কে কতভাগ লাভ পাবে তা সুনির্ধারিত থাকবে। লাভের কোনো নির্দিষ্ট অংক কারো জন্য নির্ধারণ করা যাবে না; বরং সম্ভাব্য মুনাফার শতকরা হার নির্ধারিত থাকবে। যেমন মুলধন দাতা ৫০%, ব্যবসায়ী ৫০% অথবা এক পক্ষ ৬০% অন্য পক্ষ ৪০%। এভাবে উভয়ের সম্মতিতে যেকোনো পরিমাণ নির্ধারণ করা যেতে পারে। লাভের পরিমাণ কমবেশি যাই হোক তা উভয়ের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত শতকরা হারে বন্টিত হবে। আর যদি লোকসান হয় তবে অর্থদাতার টাকা যাবে আর ব্যবসায়ীর শ্রম বৃথা যাবে।
প্রচলিত সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার সাথে মুযারাবার কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যাক :
১. সুদী ব্যবস্থায় অর্থদাতার মুনাফার অংশটি সুনির্ধারিত থাকে। যেমন-বিনিয়োগকৃত টাকার ১৫%। ব্যবসায় যে পরিমাণ লাভই হোক না কেন সে ঐ অংকের সুদ পাবেই। পক্ষান্তরে মুযারাবা কারবারে এভাবে মুনাফা ফিক্সড করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যবসায় লাভ বেশি হলে উভয়েই তা পূর্ব নির্ধারিত হার অনুযায়ী ভাগ করে নিবে। ব্যবসায়ী এক তা ভোগ করতে পারবে না। আবার লাভ কম হলে বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীর নিকট তার নির্ধারিত হারের বেশি দাবি করতে পারবে না।
২. ব্যবসা যদি লসের সম্মুখীন হয় তবে তা মুযারাবা কারবারে বিনিয়োগকারীকে বহন করতে হবে। অর্থাৎ যে পরিমাণ মূলধন খোয়া যাবে বিনিয়োগকারী তা ব্যবসায়ী থেকে দাবি করতে পারবে না। কিন্তু সুদী ব্যবস্থায় ব্যবসায় ক্ষতি হলেও অর্থদাতা শুধু তার মূলধনই নিবে না; বরং এর উপর নির্ধারিত সুদও আদায় করবে। ব্যবসায়ীর বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রয় করে অথবা অন্য যেকোনো পন্থায় এ টাকা সে আদায় করে নিবেই।
৩. পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যবসায়ী যত বেশি পরিমাণ লাভই করুক অর্থদাতা শুধুমাত্র নির্ধারিত হারের সুদই পাবে। অতিরিক্ত লাভ ভোগ করবে ব্যবসায়ী একাই। কিন্তু মুযারাবা ব্যবস্থায় লাভ যত বেশি হবে অর্থদাতার মুনাফায় অংশদারিত্ব ততই বাড়বে।
বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলোর টাকার মূল উৎস হচ্ছে আমানতকারী তথা একাউন্ট হোল্ডারদের জমাকৃত টাকা। বলাবাহুল্য যে, এদের মধ্যে ধনী-দরিদ্র এবং কম ও বেশি জমাকারী সব ধরনের লোকই রয়েছে। তবে অধিকাংশরাই যে তুলনামূলক কম আয়ের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের কর্তৃক ব্যাংকে জমাকৃত টাকা দ্বারা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ তাদের ব্যবসা গড়ে তোলে এবং এক সময় প্রচুর মুনাফার মারিক হয় অথচ ব্যাংককে প্রদান করে সেই নির্ধারিত ১৪-১৫%। বাকি পুরোটাই ভোগ করে তারা একা। মূলত যে ১৫% সুদ প্রদান করে তাও কস্টিং চার্জের আওতায় এনে এর উপর মুনাফা হিসাব করে তা ভোক্তাদের থেকে আদায় করে নেয়। অর্থাৎ লাভের পুরোটিই থাকে তাদের কাছে। এভাবে সম্পদ হয়ে উঠে এককেন্দ্রিক, ধনী ও দরিদ্রের তারতম্য বাড়তে থাকে দিন দিন। কিন্তু মুযারাবা ব্যবস্থায় যেহেতু প্রকৃত মুনাফাই কেবল বন্টনযোগ্য তাই ব্যবসার হিসাবের পূর্বে অর্থদাতার লভ্যাংশকে কস্টিং চার্জের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই এবং বেশি মুনাফা হলে কোনো পক্ষেরই এককভাবে তা কুক্ষিগত করার সুযোগ নেই।
উপরের বর্ণিত মুযারাবা পদ্ধতি ইসলামী শরীয়তের এমন একটি আদর্শ বিনিয়োগ ব্যবস্থা, যা শরীয়তের স্বাতন্ত্র, সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায়ের রক্ষাকবচ। কিন্তু প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো এ পদ্ধতি পালনে আগ্রহী নয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে মানুষের আমানত-দিয়ানতের অবস্থা অত্যন্ত নিম্নমুখি। তাদেরকে যদি বলা হয় যে, আমরা লোকসান বহন করব, তবে সে ব্যবসায় লোকসান বৈ লাভ কখনো হবে না। আর সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পাতানো লোকসানের বোঝা বহন করতে করতেই ব্যাংকগুলোর অবস্থা কাহিল হয়ে পড়বে।
এই যুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে এবং বর্তমান যুগে মুযারাবার কার্যকারিতা ও সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেক কিছুই বলার আছে। তবে যেহেতু ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুযারাবা করছেই না তাই এই বিষয়টি আজ থাক। সুযোগ হলে অন্য কোনো দিন তা আলোচনা করা যাবে। ইনশাআল্লাহ।
মুরাবাহা
মুরাবাহ হচ্ছে ইসলামী ফিকহের ক্রয়-বিক্রয়ের একটি প্রকারের নাম। মূলত এটি কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অধিকাংশ বিনিয়োগ মুরাবাহা নামেই হয়ে থাকে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, ফিকহের কিতাবাদিতে বর্ণিত মুরাবাহা ও ব্যাংকগুলোতে প্রচলিত মুরাবাহার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। ফিকহে বর্ণিত মুরাবাহা হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি তার কোনো বস্ত্ত ক্রয়মূল্যের অধিক দামে অন্যের নিকট বিক্রয় করা। এখানে পণ্যটি আগে থেকেই বিক্রেতার মালিকানায় রয়েছে এবং তা নগদ বা বাকি যেকোনো মূল্যে বিক্রি হতে পারে। কিন্তু ব্যাংকের মুরাবাহায় বিক্রেতার (ব্যাংক) নিকট আগে থেকে কোনো পণ্য থাকে না; বরং ক্রেতার (বিনিয়োগ গ্রহণকারী) সাথে বিক্রয়-চুক্তি সম্পাদনের পর ব্যাংক তা ক্রয় করে থাকে। অতঃপর অধিকমূল্যে বাকিতে/কিস্তিতে বিনিয়োগগ্রহীতার নিকট বিক্রি করে থাকে। এক্ষেত্রে মূল্য আদায়ের সময় বিবেচনায় এনে পণ্যের দাম কমবেশি করে থাকে।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর অবলম্বন করা উক্ত ‘মুরাবাহা’ যদিও শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতি নয় তথাপি শর্তসমূহ যথাযথ পালন করলে তা জায়েযের পর্যায়ে এসে যায়। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার সূচনালগ্নে পরিবেশ-পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে যুগের ফকীহগণ প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংকগুলোকে মুরাবাহা করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং যত দ্রুত সম্ভব ব্যাপকভাবে মৌলিক ও আদর্শ বিনিয়োগ মুযারাবা চালু করার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন।
শর্তাবলি
আলমুরাবাহা লিল আমির বিশশিরা অর্থাৎ ব্যাংগুলোতে প্রচলিত মুরাবাহা জায়েয হওয়ার শর্তাবলি নিম্নরূপ :
১. ব্যাংকের মালিকানায় ও দখলে পণ্য আসার পূর্বে তা বিক্রি করতে পারবে না। অর্থাৎ বিনিয়োগগ্রহীতা ব্যাংকের নিকট পণ্য চাওয়ার পর প্রথমে ব্যাংককে তা খরিদ করতে হবে এবং হস্তগত করতে হবে। এরপর সে ক্লায়েন্ট-এর নিকট তা বিক্রি করতে পারবে।
২. কোনো না জায়েয-হারাম পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
৩. ব্যাংক যে পণ্য গ্রাহকের নিকট বিক্রি করবে তা যদি এমন হয় যে, গ্রাহক নিজেই এর মালিক এবং সে ব্যাংকের নিকট তা নগদে কম মূল্যে বিক্রয় করে পরে আবার বাকিতে বেশি মূল্যে তা ক্রয় করে নিচ্ছে তবে কারবারটি হারাম হবে এবং সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ যার নিকট বিক্রি করবে তার থেকেই এ মুহূর্তে পণ্যটি খরিদ করেছে এমন হওয়া চলবে না।
৪.বাস্তবভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় হতে হবে। এমন হওয়া চলবে না যে, কোনো দোকানে আগে থেকেই ব্যাংকের এমন চুক্তি রয়েছে যে, আমরা তোমার কাছ থেকে কোনো পণ্য খরিদ করে গ্রাহকের নিকট বিক্রি করলে সে আবার তোমার নিকট কম মূল্যে তা বিক্রি করে দিবে। অর্থাৎ বাস্তবভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয় হতে হবে, হীলা-বাহানা হলে চলবে না।
৫. কারবারটি এমন হতে হবে যাতে বাস্তবেই ক্রেতার (ক্লায়েন্ট) ঐ পণ্যের জন্য অর্থায়ন দরকার। যদি এমন হয় যে, শুধু পণ্যের নাম ব্যবহার করে নগদ টাকা বিনিয়োগ নিচ্ছে পণ্য খরিদের কোনো ইচ্ছা নেই তাহলে কারবারটি হারাম হবে।
৬. ব্যাংকের নিকট বিনিয়োগপ্রার্থী (ক্লায়েন্ট) যদি এমন জিনিস খরিদের নামে টাকা নেয়, যা আগেই সে খরিদ করে ফেলেছে অথবা তা কাজেও লাগিয়ে ফেলেছে এখন সে সব পণ্যের বকেয়া মূল্য পরিশোধের জন্য অথবা টাকার অন্য কোনো প্রয়োজন হওয়ায় ঐ পণ্যের নামে ব্যাংকের সাথে মুরাবাহা করছে তবে তা-ও হবে হারাম ও সুদী কারবার।
উল্লেখ্য যে, ৫ ও ৬ নং-এর ত্রুটিগুলো হয়ে থাকে এজন্য যে, ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রেই নিজে পণ্য খরিদ করতে যায় না এবং তা নিজ রিস্কেও নেয় না।
৭. মুরাবাহার একটি অপরিহার্য শর্ত হল, পণ্যটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ব্যাংকের দায়িত্বে ও তার রিস্কে যেতে হবে। যে সময়ের মধ্যে সেটি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তা ব্যাংকের ক্ষতি বলেই ধর্তব্য হবে। যদি মুরাবাহার পণ্য ক্লায়েন্ট (গ্রাহক) কে বিক্রির পূর্বে এমন কোনো ঝুঁকি (রিস্ক) ব্যাংক বহন না করে তবে কারবার হারাম হবে।
হযরত মাওলানা তকী উছমানী এবং অন্যান্য ফকীহগণের (যারা ব্যাংকের মুরাবাহার অনুমোদন দিয়েছেন) মতে এটিই একমাত্র শর্ত যা মুরাবাহাকে সুদী কারবার থেকে ভিন্ন করে। কারণ সুদী লোনের মধ্যে ব্যাংক ক্লায়েন্টকে টাকা দেওয়ার পর তার কোনো রিস্ক সে বহন করে না। এখন যদি মুরাবাহাতেও এমনটি ঘটে এবং গ্রাহক তথা ক্লায়েন্টকে পণ্য হস্তান্তরের পূর্বে ব্যাংক তার ঝুঁকি বা রিস্ক গ্রহণ না করে তবে কারবারটি হবে সুদী লেনদেনের নামান্তর।
৮. মুরাবাহার আরেকটি শর্ত হল ক্লায়েন্টের নিকট নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার পর তা আর বৃদ্ধি করা যাবে না। অর্থাৎ সনাতনী ব্যাংকগুলো যেমন বছরান্তে বা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সুদের হার বাড়িয়ে দেয় সেভাবে মুরাবাহা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। করলে তা সুদ হবে।
এদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে অথবা তাদের কারবার সম্পর্কে অবগত আছেন এমন যে সকল পাঠক মুরাবাহার উপরের শর্তগুলো এখানে পড়লেন তারা হয়ত অবাক হয়ে লক্ষ করবেন যে, এগুলোর অনেকাংশই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পালন করে না।
ক্লায়েন্টগণ ও অভিজ্ঞমহল ব্যাংকের মুরাবাহা বলতে বুঝেন, কাঙ্খিত টাকার জন্য সে পরিমাণ মূল্যের মেমো ক্লায়েন্ট কর্তৃক ব্যাংকে হাজির করা এবং কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ক্লায়েন্টকে ব্যাংককর্তৃক চেক প্রদান করা। অনেক ব্যাংকের কর্মকর্তাগণই স্বীকার করে থাকেন যে, তারা গ্রাহক কর্তৃক প্রদর্শিত মেমোর মাধ্যমেই ব্যাংকের খরিদদার হওয়া এবং তা হস্তগত করার দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। ব্যাংক বা তার প্রতিনিধি কর্তৃক প্রথমে পণ্য ক্রয় করে তা হস্তগত করে নিজরিস্কে নিয়ে অতপর গ্রাহককে বিক্রি করা এত কিছুর প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেন না।
কোনো কোনো ব্যাংক অবশ্য গ্রাহক থেকে যে সকল কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে থাকে তার মধ্যে একটি কাগজ ওকালত সম্পর্কিত নিয়োগপত্রও থাকে। অর্থাৎ ব্যাংক গ্রাহককে তার পক্ষ থেকে মালামাল ক্রয়ের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনা এ পর্যন্তই শেষ হয়ে যায়। এরপরই পণ্য বিক্রয়ের পেপারসে স্বাক্ষর রেখে কাঙ্ক্ষিত টাকার চেক দিয়ে গ্রাহককে ছেড়ে দেওয়া হয়। অথচ ঐ নিয়োগের দ্বারা সে প্রতিনিধির দায়িত্ব পেল মাত্র। এরপর যদি লোকটি সৎ হয় এবং বাস্তবেই ঐ টাকা দ্বারা পণ্যটি খরিদ করে তবে ঐ পণ্যের মালিক তো হল ব্যাংক। এখন ব্যাংক তার কাছে বিক্রির পূর্বে এটি তো তার পণ্য হল না। সে ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসাবে নিজের কাছে তো আর তা বিক্রয় করতে পারে না। এতো গেল ভালো গ্রাহকের কথা, যে টাকা দ্বারা পণ্য ক্রয় করছে। কিন্তু ব্যাংকের উদাসীনতার সুযোগে অনেক গ্রাহক এমনও থাকে যারা বাস্তবে পণ্য ক্রয়ের কাছেও যায় না; বরং কাঙ্ক্ষিত টাকা হস্তগত করে তা ইচ্ছামতো খরচ করে। আবার কেউ কেউ ঐ টাকা দ্বারা পূর্বে খরিদকৃত পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে থাকে, যা ব্যাংকে যাওয়ার আগেই সে নিজের জন্য খরিদ করেছিল। গতকাল এক আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নিজ বাড়িতে কাজের জন্য কিছু রড/সিমেন্ট বাকিতে ক্রয় করেছেন। সময়মতো টাকা হাতে না আসায় মূল্য পরিশোধ করতে পারেননি। ভদ্রলোক গেলেন তার এলাকার একটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায়। তারা মুরাবাহা করতে রাজি হল। তিনি ঐ দোকান থেকেই মেমো নিয়ে দিলেন এবং তার কাঙ্ক্ষিত এক লক্ষ টাকা গ্রহণ করে দোকানের বকেয়া আদায় করলেন। ওয়াকিবহাল মহল জানেন যে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়; বরং এ জাতীয় ঘটনাই ব্যাংকগুলোর ‘মুরাবাহার’ সাধারণ চিত্র। দু-এক জন ব্যতিক্রমী। আল্লাহওয়ালা শাখা ম্যানেজারের অথবা বিনিয়োগের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কে ভালো কথাও অবশ্য শোনা যায়, যারা মুরাবাহার শর্তগুলো পুরো করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ব্যাংকপাড়ায় তা শুধুই ব্যতিক্রম।
ইজারা (লিজিং)
ইসলামী ব্যাংকগুলো মুরাবাহার পর যে বিনিয়োগটি বেশি করে থাকে তা হচ্ছে ইজারা বা লিজিং। মুরাবাহার মতো ইজারাও শরীয়তের মৌলিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়।ইসলামী ব্যাংকিং শুরুর পর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে এটির অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। কিমত্ম মুরাবাহার মতো এখানেও শর্তের লংঘন হয়ে থাকে বহুভাবে। যেমন শরীয়তের নির্দেশ হল, লিজকৃত পণ্যের কোনো ক্ষতি হলে (তা যদি লিজগ্রহীতা ইচ্ছাকৃত না ঘটিয়ে থাকে) তবে এর দায় দায়িত্ব লীজ দাতার উপর বর্তাবে এবং গ্রহীতা থেকে কোনো ক্ষতি পূরণ নেওয়া যাবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে কি হয়ে থাকে তা তো সবারই জানা রয়েছে। এমনিভাবে মধ্য মেয়াদে একক সিদ্ধান্তে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টিও শরীয়তে নিষিদ্ধ।
‘মুরাবাহা’ সম্পন্ন হওয়ার পর মূল্য বাড়ানো যায় না এমতাবস্থায় মাঝপথে এসে মুরাবাহাকে এইচপিএসএম (হায়ার পারচেজ শিরকাতুলমিলক) এ রূপান্তর করে ১১% লভ্যাংশ (ভাড়া) থেকে ১৩% এ উন্নীত করে কোনো কোনো ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহককে নোটিশ দেওয়ার নজিরও এ ঢাকাতেই আছে।
ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসমূহ এবং এগুলোতে শরীয়া লংঘনের বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। তবে যেহেতু এ লেখার উদ্দেশ্য নেতিবাচক নয়,তাই গ্রাহক ও সংশ্লিষ্ট মহলের জরুরি অবগতির জন্য এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে হচ্ছে ।
ইসলামী ব্যাংকগুলো ঋণের পুন: তফসিলিকরণ, ক্রেডিট ট্রান্সফার, কলমানি দেওয়া ও নেওয়া এবং সনাতনী ধারার ব্যাংকগুলোর সিন্ডিকেটের সাথে মিলে প্রজেক্ট ফাইনান্স করা, আমদানি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পণ্য নিজের দখলে ও রিস্কে আনার পূর্বেই বিক্রি করে দেওয়া, বাইয়ে সালামে শর্তগুলোর অনুসরণ এবং আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের বিভিন্ন পর্যায়ে শরীয়া পরিপালনের বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করে থাকে তাও অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন।
আর চার্জের বিষয়টিতে কোনো কোনো ইসলামী ব্যাংক তো বেশ অগ্রগামী। টিটির টেলিফোন করতে চার্জ নেওয়া হয় ৩০/- টাকা। অথচ সময় ব্যয় হয় ১ থেকে ২ মিনিট। বাস্তব খরচ ১ থেকে ২টাকা। আজব ধরনের অনলাইন চালু করে সিটির ভিতরও চার্জ নেওয়া হচ্ছে। গ্রাহক তার একাউন্টে একই সিটির অন্য ব্যাংকে চেক জমা করল, চেকটি হয়ত ফেরত আসল, অমনিতেই তার একাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেওয়া হল ইত্যাদি অনেক নজির রয়েছে। যেগুলোর শরঈ মাসআলা জানারও প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি? এখানে একথাও উল্লেখ্য যে, কারবারের ক্ষেত্রে সুদ থেকে বাঁচা যেমন জরুরি তেমনি অন্যান্য নাজায়েয ও নিষিদ্ধ কাজ থেকেও বিরত থাকা কর্তব্য। কোনো কারবার বাতিল নয়; বরং তা ফাসিদ অথবা পুরো সুদী নয়; বরং আংশিক সুদী শুধু এ কারণে তা জায়েয হয়ে যায় না।
আগেই বলা হয়েছে, এ লেখার উদ্দেশ্য ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা নয়; বরং শুধুই সংশোধনের বা ইসলাহের জন্য তা লেখা হয়েছে।
একটি তাহকীকী তথা গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার পক্ষ থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, আমরা মনে করি, এ যুগে ইসলামী ব্যাংকিং সম্ভব এবং যতগুলো ইসলামী ব্যাংক দেশে আছে সেগুলো সমৃদ্ধি লাভ করুক আর এ কাতারে আরো ব্যাংক শামিল হোক কিন্তু অবশ্যই নতুন বা পুরাতন সকল ইসলামী ব্যাংককে হতে হবে শরীয়া পরিপালনের দিক থেকে আপোষহীন ও কোয়ালিটি সম্পন্ন।
শুধু ইসলামী নামসর্বস্ব কোনো কিছুই কাম্য নয়।
দুনিয়ার সকল ব্যাংকে টাকা রাখতে গিয়ে মানুষ প্রথমেই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে থাকে। তাই অনেক মহলের কয়েকগুণ বেশি সুদের অফারে সাড়া না দিয়ে স্বল্প সুদের বিনিময়ে ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখে থাকে। সুতরাং ব্যাংকের দায়িত্ব হল তাকে সে নিরাপত্তা দেওয়া এবং তারা তা দিয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলোর একাউন্টধারী ডিপোজিটারগণ শুধু নিরাপত্তার বিবেচনায় তাদের কাছে টাকা রাখেন না; বরং তারা কষ্টার্জিত অর্থ এ ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করে কিছু হালাল মুনাফার আশায়। সুতরাং ইসলামী ব্যাংকগুলো তথা এর মালিকপক্ষের প্রধান দায়িত্ব হল মানুষকে দেওয়া মুনাফা হালাল হওয়ার বিষয়টি শরীয়তের কষ্টিপাথরে নিশ্চিত করা।
কিছু সুপারিশ
ইসলামী ব্যাংকগুলোর ইসলামাইজেশনের জন্য সংক্ষিপ্ত কিছু সুপারিশ নিম্নে প্রদত্ত হল। এ সুপারিশগুলোর প্রতি নজর দেওয়া ছাড়াও আমরা মনে করি ইসলামী ব্যাংকগুলোর কর্তব্য হল তাদের শরীয়া পরিপালনের সূচক উর্ধ্বগামী করার জন্য আর যা যা করার দরকার সবকিছু করার জন্য এখনেই নেমে পড়া এবং সুদ ও নাজায়েয-হারাম কারবারের লানত থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষার জন্য বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১. মালিক পক্ষের সদিচ্ছা
ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরীয়া পরিপালন তথা ইসলামাইজেশন নিশ্চিত করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন মালিক পক্ষ তথা বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের সাদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। শরীয়া বিষয়ে যদি তারা আপোষহীনভাবে ঐকান্তিক ও আন্তরিক না হন, যদি ইসলামী হওয়া সত্ত্বেও তারা সুদের সাথে একই গতিতে, একই পথে এবং একই পন্থায় (শুধু নাম ভিন্ন করে) দৌড়াতে থাকেন তবে ইসলামাইজেশন কখনো সফল হবে না।
২. কর্মীদের প্রশিক্ষণ
প্রথম শর্ত পূরণের পর ২য় কাজটি হল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে গ্রুপ গ্রুপ করে দীর্ঘ মেয়াদী প্রয়োজনীয় (শরীয়া পরিপালন বিষয়ক) প্রশিক্ষণ দেওয়া। আমরা জানি যে, এসব ব্যাংকে কর্মরত অনেক ভাই শরীয়তের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। কিন্তু পুরো জীবন পুঁজিবাদী পদ্ধতির উপর পড়াশোনা করে আসা অথবা সে লাইনে কাজ করে আসা কাউকে ২/৪দিন বা সপ্তাহ খানেক কয়েক ঘন্টার কর্মশালার মাধ্যমে তো আর ইসলামী ব্যাংকিং শিখিয়ে ফেলা যায় না।
৩. শরীয়া কাউন্সিল
মালিক পক্ষের সদিচ্ছার পর ইসলামী ব্যাংকগুলো শরীয়া পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন একটি শরীয়া কাউন্সিল যাদের হাতে থাকবে প্রচুর ক্ষমতা যারা এডভাইজারী কাউন্সিল না হয়ে সুপারভাইজারি কাউন্সিল হবে।তবে ঐ বোর্ডের সদস্য হতে হবে এমন যোগ্য আলেমে দ্বীনকে যিনি কুরআন-হাদীসকে মূল থেকে (অনুবাদ থেকে নয়) বোঝার ও বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা রাখেন। যিনি ফিকহ বিষয়ক মৌলিক লেখাপড়া করেছেন,যিনি ফিকহুল মুআমালাত সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান রাখেন এবং যিনি একনিষ্ঠ, কর্মঠ ও সৎসাহসী। ব্যাংকওয়ালাদেরকে চেষ্টা-তদবীর করেও শরীয়া পালন করাতে ব্যর্থ হলে যিনি ঘোষণাদান পূর্বক ইস্তফা প্রদান করতে দ্বিধা করবেন না। যিনি অযথা নাজায়েয ও মাকরূহ কাজগুলোকে হীলা-বাহানার আশ্রয় নিয়ে জায়েয করার চেষ্টা করবেন না অথবা নিজে কাউন্সিলে আছেন শুধু এ কারণে কাউকে ইসলামী হওয়ার সার্টিফিকেট দিয়ে দিবেন না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মাওলানা তকী উছমানী সাহেবের কিন্তু একাধিক ব্যাংকের শরীয়া কাউন্সিল থেকে ঘোষণা পূর্বক ইস্তফা প্রদান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
৪. শাখায়-শাখায় শরীয়া বিশেষজ্ঞ
মজবুত ও যোগ্য শরীয়া কাউন্সিলের সাথে সাথে প্রতিটি শাখায় এক বা একাধিক যোগ্য ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আলেম শরীয়া কাউন্সিল প্রতিনিধিকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যার স্বাক্ষর ছাড়া কোনো বিনিয়োগ অনুমোদিত হবে না। যিনি শরীয়া পরিপালনে ঐ শাখার লোকজনকে সাহায্য করবেন এবং ব্যাংকের ক্লায়েন্ট ও অন্যান্যদের শরীয়া বিষয়ক পরামর্শ ও অভিযোগ শুনবেন আর তাদের প্রশ্নের জবাব দিবেন।
৫. শরীয়া বিষয়ক অভিযোগ সেল
উপরোক্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি রাজধানী ও বিভিন্ন জেলা শহরে শরীয়া বিষয়ক অভিযোগ সেলও থাকতে হবে। যেখানে শরীয়া বিশেষজ্ঞগণ এসংক্রান্ত অভিযোগের শুনানী করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। &
আমরা মনে করি, উপরোক্ত সুপারিশগুলো এবং এ জাতীয় অন্যান্য শর্তাবলি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলেই কেবল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইসলামী হওয়ার বিষয়টি যথার্থ হবে। আল্লাহ তাআলাই নেক কাজের তাওফীক দাতা। #