তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-৯
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
এরপর স্বর্ণশৃঙ্গের কাছে যে বাইজান্টাইন জাহাযগুলো ছিলো,ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে তারা জেনে গেলো,রাতের আঁধারে কী সর্বনাশ ঘটে গেছে! ছোট ছোট সত্তরটি জাহাজ যেন নয়,জ্যান্ত সত্তরটি দৈত্ত-শাবক যেন তাদের দিকে মুখ হা করে চেয়ে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে হুশ সামলে কামান দাগাতে দাগাতে প্রায় অর্ধশত বৃহদাকার জাহায ছুটে এলো। ইতিহাসের সেরা একটি নৌযুদ্ধ স্বর্ণশৃঙ্গের অল্পপরিসর স্থানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। সুলতানের জাহাযগুলো আকারে ছোট হওয়ার কারণে কম গভীরতার পানিতে স্বচ্ছন্দ্যে ছোটাছুটি করছে,পক্ষান্তরে বাইজান্টাইন জাহায আকারে ছিলো এত বড়, যেন ‘হাতি পড়েছে হাঁটুজল খালেতে’। ফলে সেগুলো সুবিধামত নড়াচড়াই করতে পারছিলো না। অল্প সময়ের মধ্যে শত্রুপক্ষের কয়েকটি জাহায ডুবে গেলো। ডুবে গেলো মানে, রীতিমত ‘সলিল সমাধি’ লাভ করলো। তবে ইতিহাসের কোন নৌযুদ্ধে কোন বিজয়ীপক্ষ যা করেনি সুলতান মুহাম্মদ আলফাতিহ তাই করলেন। আফসোস, ইউরোপের সব ঐতিহাসিক আলফাতিহ-এর এমন একটি মহানুভবতার কথা এখনো পর্যন্ত চেপেই রেখেছে। আশ্চর্য! কৃতজ্ঞতা নামে কোন কিছু কি নেই ইউরোপের চরিত্রে! সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! উছমানিদের ছোঁড়া আগুনের গোলার আঘাতে জ্বলতে থাকা বাইজান্টাইন জাহাযগুলো তাদের ডুবন্ত নৌসেনাদের কোন পরোয়া না করে পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে। ‘পালিয়ে যাচ্ছে’ কথাটা ইচ্ছে করেই বললাম না পরাজিত শত্রুর মানরক্ষার জন্য, কিংবা বলুন মনরক্ষার জন্য। এদিকে শত শত সৈন্য হাবুডুবু খাচ্ছে, আর প্রাণরক্ষার জন্য শত্রুরই কাছে আকুতি জানাচ্ছে। মুহাম্মদ আলফাতিহ কী করলেন? তার আগে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম, বাইজান্টাইন সম্রাট কনস্টান্টাইন কী করতেন? এর জবাব অবশ্য লেখা আছে, বাইতুল মাকদিসের ইতিহাসে, স্পেনের ইতিহাসে; লেখা আছে আধুনিক যুগের বসোনিয়া হার্জেগোভিনার রক্তাক্ত মানচিত্রে। আমি কিছু বলবো না, আপনি ইতিহাস পড়–ন।
এবার শুনুন, মুহাম্মদ আলফাতিহ কী করলেন? তিনি তাই করলেন যা করেছিলেন আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক গাজী ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী বাইতুল মাকদিস বিজয়ের পর, সেই পরাজিত ক্রুসেডারদের সঙ্গে, সেখানকার পবিত্র ভ‚মিতে যারা মুসলিমরক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো। মুহাম্মদ আলফাতিহ আদেশ দিলেন প্রতিটি ডুবন্ত সৈন্যকে যেন উদ্ধার করা হয়। পানিতে রশি ফেলা হচ্ছে। যার সামনেই রশি পড়ছে, আকড়ে ধরছে। কখনো একজন, কখনো দু’জন। দু’জনকে টেনে তুলতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে, তবু আলফাতিহ-এর বিজয়ী সৈনিকরা তাদের টেনে টেনে তুলছে জাহাযে। কোন কোন রশি আকড়ে ধরেছে তিনজন, চারজন। তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। উপর থেকে হয়ত বলা হচ্ছে, একজন ধরো, তাহলে আমরা উদ্ধার করতে পারবো। তখন একজন আরেকজনকে হিংস্রভাবে আঘাত করে রশিটা নিজের দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। এই উদ্ধারপ্রচেষ্টার মধ্যেও কিছু সৈন্য প্রাণরক্ষার আকুতি জানাতে জানাতেই পানিতে ডুবে গেলো। বড় মর্মান্তিক দৃশ্য। হোক না শত্রু, মানুষ তো! এবং ডুবন্ত মানুষ!! যাই হোক, অল্পক্ষণেই ময়দান সাফ। ভুল বললাম, অল্পক্ষণেই সাগর সাফ! উছমানী নৌবহর স্বর্ণশৃঙ্গের সমগ্র এলাকায় পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে বন্দর অবরোধ করলো এবং সুলতান মুহাম্মদ আলফাতিহ শহরের দক্ষিণ প্রাচীরের উপর হামলার আয়োজন পূর্ণ করলেন।
সুলতান আরেকটি সময়োপযোগী কাজ করলেন। স্বর্ণশৃঙ্গে ভাসমান পোল তৈরী করে তাতে হালকা কিছু তোপ স্থাপন করলেন।
এবার শুরু হলো পূর্ব ও দক্ষিণ উভয়দিক থেকে একযোগে বড় বড় তোপের গোলাবর্ষণ। ওরে আল্লা! একটা করে গোলা এসে পড়ে, আর পুরো শহর কেঁপে ওঠে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা নিয়ে! এখানে ওখানে আগুন জ্বলে ওঠে এবং জ্বলতে থাকে। লাশ পড়ে এবং পুড়তে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য! এমন কঠিন হামলার পরো প্রায় শহরের পাচিল স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকলো, সামান্য কিছু ফাটল ছাড়া তেমন কোন ক্ষতি হলো না। সুলতান নিজেও অবাক শহর-পাচিলের মযবূতি দেখে। সুলতান এবার নিজের তৈরী প্রিয় তোপটির কাছে গেলেন। আটমন ওজনের গোলা ভরার কাজে নিজেও শরীক হলেন। তারপর বিসমিল্লাহ বলে নিজের হাতে গোলার সলিতায় আগুন ছোঁয়ালেন। সামান্য সময় ঝড়পূর্ব শান্ত নীরবতার মত কেটে গেলো। সুলতান মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন, আল্লাহর কাছে তখন তিনি কী দু’আ করছেন তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কাছে যারা ছিলো তারা শুধু দেখলো, ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে চোখ থেকে। হঠাৎ তোপের গোলা ছুটে গেলো, যেন জাহান্নামের গহ্বর থেকে বের হয়ে আসা আগুন। প্রাচীরের গায়ে বিরাট ফাটল তৈরী হয়ে গেছে! সবাই বুঝলো, এটা সুলতানের কারামাত ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহ তা’আলা সুলতানের দু’আর লাজ রক্ষা করেছেন।
গোলাবর্ষণ চলছে, লাগাতার নয়, কিছুটা বিরতি দিয়ে দিয়ে। অন্যান্য তোপের গোলায় শুধু আগুন জ্বলে, আর বড় তোপের গোলায় প্রাচীর-গাত্রে ফাটল সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু শত্রুগোলা এদিকেও এসে পড়ছে, আর অবরোধকারী মুজাহিদদের তাঁবুতে এখানে ওখানে আগুন জ্বলে উঠছে। আগুন লাগামাত্র রশি কেটে তাঁবুগুলো ফেলে দেয়া হয়, তাই আগুন ছড়াতে পারে না।
আমাদের যুগে কামান থেকে গোলাবর্ষণের দৃশ্য দেখেছি, বাস্তবে এবং ছবিতে। কিন্তু সুলতানের কামান তো কামান নয়, রীতিমত ‘তোপ’, যেন আস্ত এক হাতি। যখন গোলা বর্ষণ করে, আজকের কামানের মত দ্রিম দ্রিম আওয়ায হয় না, যা হয় সেটা বোঝাতে দ-এর পরিবর্তে দরকার ‘ধ’ এবং একটা নয় একসঙ্গে কয়েকটা। উর্দুভাষার ‘ধামাকা’ শব্দটা এখানে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাভাষার নিরীহ ‘বিস্ফোরণ’ শব্দটি এখানে একেবারে অচল। শহরের ভিতরেও গিয়ে পড়ছে কিছু গোলা। বড় বড় ইমারতে আগুন লেগে যেন কেয়ামতের প্রলয় সৃষ্টি করছে। দৃশ্যের ভয়াবহতায় আমাদেরও যেন বুক কেঁপে উঠছে।
ঐতিহাসিক গীবন লিখেছেন-
‘যে প্রাচীর বহু শতাব্দী ধরে বড় বড় শত্রুর প্রচণ্ড থেকে প্রচণ্ড হামলার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো, উছমানী তোপের গোলা তার চেহারাটাই যেন বিগড়ে দিলো। স্থানে স্থানে বড় বড় ফাটল ধরে গেলো। সেন্ট রোমানূস-এর দরজার নিকটবর্তী চারচারটি মিনার মটির সঙ্গে মিশে গেলো।’
গীবন যা লেখেননি তা হচ্ছে, বিজয়ের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ানো মুসলিম ফৌজের গগনবিদারী তাকবীরধ্বনি। ৮৭৫ হিজরী ১৫ই জুমাদাল উলা, মোতাবেক ২৪শে মে ১৪১৫ খৃ. সকালে এশরাকের পর সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ সম্রাট কনস্টান্টাইন-এর কাছে পয়গাম পাঠালেন, ‘দেখতেই পাচ্ছো, আমার তোপের আঘাতে তোমার নগরপ্রাচীর কীভাবে ভেঙ্গে পড়ছে! এ প্রাচীর হাজার বছর তোমাকে রক্ষা করেছে, কিন্তু আমার তোপের গোলা থেকে আর কয়েক ঘণ্টাও তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
আমি অযথা জানমালের ক্ষতি চাই না, না তোমার না আমার। এখনো সময় আছে, হাতিয়ার ফেলে দাও। তোমার ও প্রজাদের জানমাল, আবরু নিরাপদ থাকবে। তদুপরি ‘মূরিয়া’ অঞ্চল পুরোটাই তোমাকে দিয়ে দেয়া হবে।’
কিন্তু সুলতানের এমন উদার ও মহানুভবতাপূর্ণ প্রস্তাবের মর্যাদা সম্রাট কনস্টান্টাইন রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন।
সন্ধিপ্রস্তাবের জবাবে সম্রাট কনস্টান্টাইনের প্রেরিত বার্তাটি ছিলো এই-
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, সুলতান সন্ধির আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি জিযিয়া দিয়ে সন্ধি করতে প্রস্তুত আছি; তবে ঈশ্বরের শপথ, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আমি কনস্টান্টিনোপলের জন্য যুদ্ধ করবো। হয় আমার সিংহাসন রক্ষা পাবে, না হয় নগরপ্রাচীরের নীচে আমার কবর হবে।’
সম্রাটের বার্তাটি পড়ে সুলতান মৃদু হেসে বললেন, ‘স্বীকার করি, তোমার সাহস আছে। আচ্ছা, আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, কনস্টান্টিনোপলের আকাশে হেলালি ঝাণ্ডা ওড়বে, না হয় তার মাটিতে আমার কবর হবে।’
মোটকথা, আরো কিছু রক্তক্ষয় ছাড়া সুলতানের সামনে কোন উপায় থাকলো না।
সুলতান তাঁর ফৌজকে একএক করে পাঁচদিন সময় দিলেন বিশ্রামের জন্য। তারপর ২০শে জুমাদাল উলা সন্ধ্যায় ঘোষণা করলেন, ইনশাআল্লাহ ফজরের পর হামলা শুরু হবে। খবর যেন বাইরে যেতে না পারে সেজন্য ঐ রাত্রে কোন একটি প্রাণীকেও শিবিরের বাইরে যেতে দেয়া হলো না।
পুরো ফৌজ রাত জেগে দু’আ যিকির ও ছালাত তেলাওয়াতে মশগুল ছিলো।
প্রিয় পাঠক, চলো এখানে তোমাকে ইতিহাসের পাতা থেকে একটি ঘটনা বলি, তাহলে তুমি বুঝতে পারবে, মুজাহিদের তলোয়ার যে বিজয় অর্জন করে তার ফায়ছালা আসলে কোথায় হয় এবং কীভাবে হয়! সর্বোপরি বুঝতে পারবে, কাকে বলে যুদ্ধ, আর কাকে বলে জিহাদ!
ইস্তাম্বুল বিজয়ের পূর্বরাত্রে সুলতান মুহাম্মদ আলফাতিহ-এর উৎকণ্ঠা যেমন ছিলো মুজাহিদীনের জানমালের জন্য তেমনি ছিলো দুশমনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য। বিজয়ের অবস্থানে দাঁড়িয়েও তিনি শেষ চেষ্টা করেছেন বিরাট ছাড় দিয়ে হলেও সন্ধি করার। কিন্তু দুশমন জানে শুধু যুদ্ধ করতে, রক্ত ঝরাতে; অশ্রু ও রক্তের দায় কত কঠিন তা তো তার জানা নেই। আগামীকাল সূর্যোদয়ের পর কী হবে? আর কত জানের নাযরানা পেশ করতে হবে ইস্তাম্বুলের জন্য? আর কত নারী বিধবা হবে? আর কত শিশু এতীম হবে? সম্ভবত এই অস্থিরতা থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই তিনি মুলাকাতের আরযি পাঠালেন যামানার শ্রেষ্ঠ ওলী শায়খ শামসুদ্দীন আক-এর খেদমতে, যিনি ছিলেন শৈশব থেকে সুলতানের শিক্ষক ও দীক্ষক, সুলতান যাকে ভয় করতেন, সমীহ করতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং ভালোবাসতেন। শায়খ শামসুদ্দীন আক-এর কাছ থেকেই কিশোর মুহাম্মদ সর্বপ্রথম শুনেছিলেন কুসতুনতুনিয়া জয়ের সুসংবাদের হাদীছ। সুলতানকে তিনি এই চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-জযবার উপরই গড়ে তুলেছিলেন যে, তোমাকেই হতে হবে কুসতুনতুনিয়া জয়কারী সেই মহান আমীর।
সুলতানের ইচ্ছা চ‚ড়ান্ত হামলার সময় শায়খ যেন তাঁর পাশে থাকেন। কিন্তু সুলতানের দূত শায়খের তাঁবুর সামনে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলেন। প্রহরী বললেন, কারো জন্য ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। শত হোক, তিনি হলেন উছমানী সালতানাতের মহান সুলতান। এটা তার কাছে মনে হলো অপমানজনক। তিনি নিজেই গেলেন এবং বাধাপ্রাপ্ত হলেন। প্রহরীর সাফ জবাব, এমনকি সুলতানের জন্যও ভিতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। সুলতানের ক্রোধ তখন চরমে পৌঁছলো। তিনি প্রহরীকে হটিয়ে খঞ্জর দ্বারা তাঁবুর পর্দা ফেড়ে ফেললেন এবং .. এবং অবাক বিস্ময়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। শায়খ শামছুদ্দীন আক তখন সিজদায়। মাথার পাগড়ী পড়ে আছে মাটিতে। সফেদ চুলগুলো আসমানি নূরে ঝলমল করছে। সিজদায় পড়ে শায়খ অঝোরে কাঁদছেন আর দু’আ করছেন। শায়খের কান্না দেখে সুলতানেরও চোখ ভিজে উঠলো। তিনি শুনলেন শায়খের কান্নাভেজা আওয়াযের সেই মুনাজাত, ‘হে আল্লাহ, মুহাম্মাদ আমার বেটা, আমি তাকে বিজয়ের খোশখবর বলে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি বিজয় দান করে বান্দার লাজ রক্ষা করো।’
সুলতানের অবস্থা তখন এই যে, পারলে মাটির সঙ্গে মিশে যান, আবার আনন্দে আত্মহারা হন। তিনি অনুতপ্ত ও আনন্দিত হৃদয়ে সেখান থেকে ফিরে এলেন। তিনি তখন একেবারে ভারমুক্ত ও নিশ্চিন্ত। আকাশের অদৃশ্য থেকে তিনি তখন বিজয়ের আলোকরেখা দেখে ফেলেছেন।
প্রিয় পাঠক, ইতিহাসের পাতায় আছে আরো অনেক কথা,
ফজরের ছালাত সুলতান নিজেই পড়ালেন। তারপর চূড়ান্ত হামলার হুকুম দিলেন।
হামলা হলো বিভিন্ন দিকে, তবে আসল জোর ছিলো সেন্ট রোমানূস-এর দরজাকে কেন্দ্র করে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকের ভাষায়, ‘দুপুর পর্যন্ত যেন আগুন-খুনের খেলা হলো। হাজার হাজার লাশ আগুনে পুড়লো, আর খুনের দরিয়ায় ডুবলো। বাইজান্টাইন যোদ্ধারা এমন সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করলো যার উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে কমই আছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, হওয়ার কথাও নয়। দুপুরের দিকে এমন প্রবল হামলা হলো যে, সব প্রতিরোধ ঢলের মুখে খড়ের মত ভেসে গেলো। কনস্টান্টিনোপলের নগরপ্রাচীরে বাইজান্টাইন পতাকার স্থানে লাল হেলালী ঝাণ্ডা উড়তে দেখা গেলো।’
***
ফিরে আসি অনুষ্ঠানস্থলে। এখানে এরই মধ্যে ঘটে গেলো অভাবিতপূর্ব ঘটনা। প্রথমে তো ভয় পাওয়ার মত অবস্থা হলো। ‘কখন কী হয়’ উৎকণ্ঠা তো আগে থেকেই ছিলো; দূর থেকে একটা শোরগোল হোটেলের দিকে এগিয়ে আসছে শুনে সবার মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়লো যে, হয়ত দাঙ্গা পুলিশের দল আসছে সমাবেশ ভেঙ্গে দিতে। মঞ্চেও সবাই যার যার আসনে উপবিষ্ট থাকলেও কিছুটা চঞ্চলতা অনুভ‚ত হলো। কিন্তু না, ঘটনা উৎকণ্ঠার নয়, আনন্দের! তাকসীম স্কয়ারের সমাবেশ বাতিলের খবর শুনে দলে দলে মানুষ এসে হাজির হচ্ছে! বাসের পর বাস আসছে! আয়োজকদের তখন দিশেহারা অবস্থা। প্রথমে সম্মেলনকক্ষের প্রায় সব চেয়ার সরিয়ে ফেলা হলো। মানুষ বসারও জায়গা পেলো না। সে প্রয়োজনও যেন নেই। একটু দাঁড়াতে পারলেই যেন কৃতার্থ। পিছনের দিকে অনেকে দাঁড়িয়েই থাকলো। তাৎক্ষণিকভাবে কক্ষের বাইরে স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা হলো। শেষ পর্যন্ত হোটেলের সামনের মাঠ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলো মানুষের সমাবেশ। তাদের জন্য মাইকের একটা দু'টো সাউন্ডবক্স-এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হলো। আয়োজকদের ধারণা অনুযায়ী এরই মধ্যে পঞ্চাশ হাজারের মত মানুষের সমাবেশ হয়ে গেছে। তখনো মানুষ আসছে দলে দলে।
বিপুল অভিনন্দন ও তাকবীর ধ্বনির মধ্যে শায়খ মাহমূদকে মঞ্চে তোলা হলো। অর্থাৎ তিনি মঞ্চে আরোহণ করেননি। হুইল চেয়ারসহ তাঁকে মঞ্চে এনে তাঁর জন্য নির্ধারিত আসনে বসানো হলো। এমন মা’যূর অবস্থা যে, পুরো অনুষ্ঠানে একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি। কিন্তু বসে ছিলেন দু’ঘণ্টারও বেশী সময় শান্তসমাহিত রূপ নিয়ে। চেহারার সজীবতা দেখে বোঝার উপায় নেই, বয়সের ভারে তিনি কতটা কাতর।
‘নূরানী ছ‚রত’ ও ‘নূরানী ছীরত’ এই মহান মানুষটি বর্তমান তুরস্কের অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব। জনপ্রিয় শব্দটি ইচ্ছে করেই বলিনি। কারণ প্রিয় ও জনপ্রিয় শব্দদু’টির মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে। ইসলামী মহলে তো বটেই এমনকি আধুনিক মহলেও তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। দূর থেকে তার নূরানি চেহারা অবলোকন করে প্রথমেই যে কথাটা আমার মনে হলো, তা এই, ‘আমি কি তুরস্কের হযরত হাফেজ্জি হুজুরকে দেখছি’! কোন দিক থেকেই কোন ভিন্নতা খুঁজে পেলাম না। হাঁ, একটা পার্থক্য ছিলো; আত্মসমাহিত অবস্থায়ও তাঁর ঠোঁট নড়তো, হালকা মৃদু; যাকে বলা যায়, ‘অবচেতন মনের যিকির’, কিংবা অন্যকিছু যা সাধারণ জ্ঞানের ব্যাখ্যার উর্ধ্বে। সবসময়ের জন্য তাঁর ঠোঁট দু’টো ছিলো সজীব, জীবন্ত এবং ‘ব্যস্ত’। আমার সামনে যিনি বসে আছেন, তাঁর ঠোঁট দু’টো নীরব। সেটাও হয়ত আমাদের দেখার সীমানার মধ্যে; ভিতরে কী হয়, কী হচ্ছে তা শুধু আল্লাহ জানেন। শায়খ মাহমূদ সম্পর্কে আমার বলতে গেলে কিছুই জানা ছিলো না। এমনকি তাঁর নামটিও গোচরে এসেছে বর্তমান সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। শ্রদ্ধার সঙ্গে কারো মুখে তাঁর নামটি উচ্চারিত হতে আজই প্রথম শুনেছিলাম এই হোটেলে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেকুতীনের কক্ষে। তিনি বলেছিলেন, শায়খ মাহমূদের ছোহবত ও সান্নিধ্যের কল্যাণেই তরুণ বয়সে তার জীবনের শুভ পরিবর্তনটি এসেছিলো। ...
***
আবার কোরআন তেলাওয়াত হলো। তারপর হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী মাইকের সামনে এলেন। সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উপস্থিত কিছু কথা বললেন, ইমাম মুহম্মদ কাসিম নানুতবী রাহ.-এর পরিচিতি লিখিত আকারে পড়ে শুনালেন, যা সংক্ষিপ্ত হলেও মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ ছিলো। হযরত নানুতবী রহ.-এর ইলমী ও তাছনীফী খিদমাতের উপরও আলোকপাত করা হলো। তবে তাঁর জীবনের সবচে’ বড়, সবচে’ গৌরবময় কীর্তি হিসাবে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হলো। কী প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে কত ভয়াবহতার মধ্যে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সাহসী ও বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; কী কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এর প্রতিষ্ঠার পিছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্রিয়াশীল ছিলো এবং তা কত দূর অর্জিত হয়েছে তার কিছুটা আভাস দেয়া হলো। এককথায় ইংরেজি শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক সর্বগ্রাসী সায়লাব মুসলিম উম্মাহর তরুণ প্রজন্মকে ভাসিয়ে নেয়ার উপক্রম করেছিলো, আশঙ্কা দেখা দিয়েছিলো যে, নতুন প্রজন্মের ঈমান আকীদাও আর নিরাপদ থাকবে না। দ্বীন ও ঈমানের সেই গভীর দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তিনি তাঁর শায়খ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ.-এর নির্দেশনায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ভারতবর্ষের মাটিতে ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হলো ব্যাপকহারে দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা এবং মুসলিম সন্তানদের দ্বীনী শিক্ষার নিরাপদ ছায়ায় নিয়ে আসা। তিনি নিজে এ সম্পর্কে লর্ড ম্যাকালী-এর একটি বক্তব্যের জবাবে বলেছিলেন,‘আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে এমন এক প্রজন্ম তৈরী করা যারা রক্তে ও বর্ণে হবে হিন্দুস্তানী, কিন্তু হৃদয় ও চিন্তাচেতনায় হবে ইসলামের আলোকে আলোকিত; রাজনীতি ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হবে ইসলামের ভাবধারায় উজ্জীবিত।’
উল্লেখ্য, লর্ড ম্যাকালীর বিখ্যাত বক্তব্যটি ছিলো, ‘আমাদের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতীয়দের মধ্যে এমন একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করা যারা রক্তে ও বর্ণে তো হবে ভারতীয়, কিন্তু চিন্তা ও চেতনায় হবে ইউরোপীয়।’
এরপর দারুল উলূম দেওবন্দের শতবর্ষব্যাপী অবদান সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘দেওবন্দ আজ শুধু একটি দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই নাম নয়, বরং সারা বিশ্বে তা হিন্দুস্তানের আলআযহার নামে পরিচিত, বরং কোন কোন দিক থেকে তা হাজার বছরের সুসমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী আলআযহারকেও অতিক্রম করে গিয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামেও রয়েছে দেওবন্দের অগ্রণী ভূমিকা।
ইমাম মুহাম্মাদ কাসিম নানুতবী রহ.-এর আখলাক ও চরিত্র সম্পর্কে শুধু একটি কিতাবের উদ্ধৃতি পেশ করে বলা হয়েছে-
الإعلام بمن في تاريخ الهند من الأعلام
কিতাবে ভারতবর্ষের স্বনামধন্য ঐতিহাসিক আল্লামা আব্দুল হাই আলহাসানী (সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রাহ.-এর পিতা) বলেন, ‘যিকির-ইবাদতে, আধ্যাত্মিক মুজাহাদা ও মুরাকাবায় এবং দুনিয়ার প্রতি নির্মোহতায় তিনি ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।’
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সবচে’ প্রসিদ্ধ ছিলেন হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান রাহ., যিনি শায়খুল হিন্দ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন,যার রেশমি রুমাল আন্দোলন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গৌরবময় একটি অধ্যায় রূপে স্বীকৃত, যদিও সময়ের আগে গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে বাহ্যত তাঁর সে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিলো এবং তাঁকে বরণ করতে হয়েছিলো সুদূর মালটার দীর্ঘ ও অসহনীয় বন্দিজীবন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দেরও প্রথম ছাত্র ছিলেন।
***
এরপর শায়খ মাহমূদ আফিন্দী-এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লিখিত আকারে তুলে ধরেন তাঁরই স্বনামধন্য শিষ্য শায়খ আহমদ আলজুব্বালী।
‘শায়খ মাহমূদ ১৯২৯ সালে তারবুযূন শহরের পার্শ্ববর্তী মীজূ নামক ছোট্ট একটি গ্রামে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতা উভয়ে ছিলেন তাকওয়া ও দ্বীনদারিতে অতি উচ্চস্তরের অধিকারী। তাঁর পিতা ছিলেন গ্রামের মসজিদের ইমাম। পেশায় ছিলেন কৃষিজীবী। মসজিদ ছিলো কৃষিখামার থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তিনি প্রত্যেক ওয়াক্তে মসজিদে হাজির হতেন, অনেক সময় এমন হতো যে, তিনি জানতেন, মসজিদে তিনি ছাড়া আর কোন মুসল্লী আসবে না, তবু তিনি জমির কাজ ছেড়ে মসজিদে যেতেন এবং আযান দিয়ে একাই নামায পড়তেন।
বহু কষ্টে অর্থ সঞ্চয় করে ১৯৫৫ সালে তিনি হজ্ব আদায় করেন এবং সেখানেই ইনতিকাল করেন। মক্কার ‘জান্নাতুল মুআল্লা’ কবরস্থানে তাঁর পিতা মুস্তফা আফিন্দী-এর পাশে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
তাঁর আম্মা ফাতেমা খানম-এর ধার্মিকতা পুরো জনপদে প্রসিদ্ধ ছিলো। কথিত আছে, তিনি খুব সতর্ক থাকতেন যেন তার গবাদি পশু কারো ফসলে মুখ না দেয়। কখনো যদি এমন হতো, তিনি জমির মালিকের কাছে গিয়ে মাফ চাইতেন এবং গাভীর দুধ তাকে দিয়ে দিতেন। এমন পিতা-মাতার ঘরে এমন নেক সন্তান পয়দা হবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি পিতার কাছে কোরআন হিফয করেন। তখন থেকেই তিনি নামাযের পূর্ণ পাবন্দ ছিলেন। তারপর তিনি যুগের শ্রেষ্ঠ আলিম শায়খ তুরসূন ফায়যী-এর নিকট দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করেন এবং মাত্র ষোল বছর বয়সে তাঁরই কাছ থেকে সনদ লাভ করেন। পরে শায়খ ফায়যী আপন কন্যাকে তাঁর হাতে অর্পণ করেন।
শায়খ মাহমূদ যখন বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যান তখন শায়খ আলী হায়দার আফিন্দী-এর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শায়খ আলী হায়দার আফিন্দী ছিলেন তাঁর যুগে মুসলিম জাহানের শীর্ষস্থানীয় আলিম ও আধ্যাত্মিক পুরুষ। বস্তুত শায়খ আলী হায়দার-এর আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও তারবিয়াতই শায়খ মাহমূদ-এর জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। শায়খের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর ছোহবত থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। ফলে শায়খের পক্ষ হতেও তিনি লাভ করেন এমন স্নেহ-মুহাব্বত যার কোন তুলনা ছিলো না।
শায়খের মৃত্যুর পর শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। ইস্তাম্বূল শহরের আলফাতিহ বস্তির ইসমাঈল আগা মসজিদের ইমাম ও শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তাঁকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের বিরাট জামাত একত্র হয়, আর তিনি তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও তা’লীম-তারবিয়াতের মহান কাজে নিজেকে সঁপে দেন। এছাড়া আমর বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার-এর দায়িত্বও তিনি সর্বোচ্চ সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেন। সময়টা ছিলো কামালবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদের চরম উত্থানকাল। হাজার হাজার আলিমকে তখন হত্যা করা হয়েছে। শত শত মসজিদ-মাদরাসা ধ্বংস করা হয়েছে। এমন কঠিন দুর্যোগের সময়ও তিনি দাড়ি রাখা ও পর্দা পালন করার উপদেশ দিতেন। ফলে তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের উপর নেমে আসে অত্যাচার ও নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়বাহ সব অবস্থা। এমনকি তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্ত ঘাতক নিয়োগ করা হয়, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি নিরাপদ থাকেন।
তিনি বিভিন্ন শহর, গ্রাম ও জনপদে দাওয়াতি সফর করতেন এবং মানুষকে আমলের দাওয়াত দিতেন। অন্যায় কাজ থেকে বাধা দিতেন এবং সৎ কাজের আদেশ করতেন, এ ক্ষেত্রে কারো কোন পরোয়া করতেন না। তিনি যেখানেই যেতেন, মানুষকে দ্বীনী মাদরাসা ও মকতব প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিলো মুসলমানদের কোন একটি জনপদও যেন দ্বীনী মাদরাসা ও মকতব থেকে খালি না থাকে। তখনকার সময়ে এটা যে কী কঠিন ও বিপদসঙ্কুল কাজ ছিলো বর্তমান অবস্থায় কেউ তা কল্পনাও করতে পারবে না।
তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, শরীয়ত ও তরীকতকে তিনি সমার্থক বলে বিশ্বাস করেন। আপন ভক্ত- মুরীদদেরও তিনি এভাবেই গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, শরীয়ত ছাড়া তাছাওউফ এবং তাছাওউফ ছাড়া শরীয়ত কোনটা বিশুদ্ধ পথ নয়। তিনি সবসময় বলে আসছেন, মুরশিদ যদি নিজের জীবনে শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণকারী হন তাহলেই তিনি প্রকৃত মুরশিদ, কিন্তু যিনি শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী নন, তিনি মুরশিদ হওয়ার যোগ্য কিছুতেই নন।
আমাদের শায়খ তাঁর সারা জীবনে আদনা থেকে আদনা কোন সুন্নত তরক করেছেন বলে কেউ দেখেনি। বড় কোন সুন্নত তরক করার কথা তো তাঁর সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না, যেমন সোমবার ও বৃহস্পতিবারের রোযা এবং রামাযানের ইতিকাফ।
তিনি নিজে যেমন সুন্নতের উপর আমল করেছেন তেমনি তাঁর অনুসারীদেরও সুন্নতের উপর আমল করার তাকীদ করেছেন। ফলে আজ তুরস্কের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত যখন তাকওয়া ও ইত্তেবায়ে সুন্নত শব্দদু’টি উচ্চারিত হয়, সবার আগে আমাদের শায়খের নাম মানুষের চিন্তায় উদ্ভাসিত হয়। এটা হলো আল্লাহ তা’আলার ফযল যা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন দান করেন।
আল্লাহর কাছে আমাদের সকাতর প্রার্থনা, শায়খ ও তাঁর অনুসারীদের আল্লাহ দ্বীনের উপর অবিচল থাকার এবং দ্বীনকে যিন্দা করার জন্য পরিপূর্ণ মেহনতের তাওফীক দান করুন, আমীন।
***
এরপর ওলামায়ে হিন্দের পক্ষ হতে বক্তব্য পেশ করেন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ-এর প্রধান হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী। তাঁর বক্তব্য ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত, তবে সারগর্ভ। তিনি বলেন, সেমিনার, সম্মেলনগুলো সাধারণত কথা দিয়ে শুরু হয়, কথা দিয়েই শেষ হয় এবং শেষ হয়ে যায়। আমি আশা করবো, এ সম্মেলন হবে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আমি মনে করি, এ সম্মেলনের মূল আহ্বান হলো, সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে রাখা; কোন অবস্থাতেই নিজেদের মধ্যে বিভেদ অনৈক্য সৃষ্টি না করা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন-
واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا
আজ এখানে তেতাল্লিশটি দেশ থেকে চারশরও বেশী আলেম ও মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমবেত হয়েছেন। তারা যদি ই’তিছাম বিহাবলিল্লাহ (আল্লাহর রজ্জু আকড়ে ধরা)- এই কোরআনি দাওয়াত নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যান এবং মুসলমানদের সকল তাবাকা ও শ্রেণীকে এই একটি বিষয়ের উপর দাওয়াত দেন তাহলেই বিপুল অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে আয়োজিত এ মহান সম্মেলন সফল ও সার্থক হবে। বিশেষ করে আমি তুরস্কে আমার মুসলিম ভাইদের কাছে বড় দরদের সঙ্গে এ আবেদন জানাবো, মুসলিম বিশ্বের জনগণ বড় আশা ও স্বপ্ন নিয়ে আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইসলামের দিকে তুরস্কের আবার ফিরে আসার যে জাগরণ শুরু হয়েছে তাকে হিকমতের সঙ্গে এগিয়ে নেয়া আপনাদের কর্তব্য। আপনাদের চলার পথ কত দুর্যোগপূর্ণ তা আপনারা আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। এখন সময়ের সবচে’ বড় প্রয়োজন হলো ইসলামের নামে, আল্লাহর নামে, কোরআনের নামে পূর্ণ একতাবদ্ধ হওয়া এবং থাকা। এ নছীহত সর্বপ্রথম আমার প্রতি, তারপর আমার দ্বীনী ভাইদের প্রতি। আল্লাহ কবুল করুন।
আল্লাহ আল্লাহ করে সম্মেলন এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। বাকি আছে শুধু সম্মাননাপত্র অর্পণ এবং মুনাজাত।
আনন্দ ও সৌভাগ্যের বিষয় হলো, সম্মাননাপত্র অর্পণের জন্য যাকে নির্বাচন করা হয়েছে তিনি আর কেউ নন, ইমাম মুহাম্মাদ কাসিম নানুতবী রাহ.-এর স্বনামধন্য প্রপৌত্র হযরত মাওলানা সালিম আলকাসেমী। খুবই আবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হলো যখন তিনি তাঁর আসন থেকে উঠে এসে শায়খ মাহমূদ আফিন্দী-এর হাতে সম্মাননাপত্র তুলে দিলেন। সম্মেলনকক্ষে উপস্থিত চারশ মেহমান ও হাজার হাজার দর্শক মারহাবা, মারহাবা বলে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন।
কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এত উদ্যোগ, এত আয়োজন, এমন আনন্দ-শিহরণ, সেই শায়খ মাহমূদ! তিনি সম্পূর্ণ নির্বিকার। তাঁর নূরঝলমল চেহারা এবং চোখের অবনত দৃষ্টি দেখে মনে হলো, তিনি এসব কিছুর ঊর্ধ্বে। হয়ত ভাবছেন, এ সম্মাননা কিসের জন্য? জীবনে এমন কী তিনি করেছেন যাকে অভিনন্দিত করার জন্য এত আড়ম্বর, এত আয়োজন? কিংবা হয়ত ভাবছেন, যদি কোন কাজ করে থাকি তাহলে এ জাগতিক সম্মাননায় আমার কী আসে যায়, আমি তো আজর গ্রহণ করবো আমার আল্লাহর কাছ থেকে; আখেরাতের আজর!
***
ঘোষক বললেন, আমাদের এ মহান সম্মেলনে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকা, এই চারটি মহাদেশের তেতাল্লিশটি দেশ থেকে চারশর অধিক মেহমান অংশগ্রহণ করেছেন। এখন প্রতিটি প্রতিনিধিদলের প্রধানের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছে ছিলো, প্রত্যেক প্রতিনিধিদলকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদানের জন্য সময় দেয়া হবে, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না বলে আমরা আন্তরিক দুঃখিত।
ঘোষণা শুরু হলো।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম শুরুতে আসে সাধারণত দুর্নীতির বিশ্বজরীপ প্রকাশের সময়। এক্ষেত্রে এমনকি আমাদের প্রথম হওয়ার রের্কডও আছে। আরেকটা ক্ষেত্র হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন। প্রতিবছর মার্কিন পররাষ্ট্রের মানবাধিকার বিভাগসহ যে ক’টি আন্তর্জাতিক পক্ষ হতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাতে বাংলাদেশ কখনো থাকে সবার উপরে, কখনো কাছাকাছি; খুব বেশী নীচে থাকার নযীর নেই। এছাড়া বাংলাদেশের নাম তালিকার শুরুতে আসার একটিমাত্র নির্দোষ সুযোগ রয়েছে; সেটা হচ্ছে ইংরেজি বর্ণমালা। যখন ইংরেজি বর্ণমালা অনুসরণ করে নাম ঘোষণা করা হয়,‘বি’-এর সুবাদে বাংলাদেশের নাম এসে যায় তালিকার প্রায় শীর্ষে। এখানেও তাই হলো। আগেভাগেই বাংলাদেশের নাম এসে গেলো, আর তখনই আমি অবাক হলাম। আমাদের প্রতিনিধিদলের আমীর হলেন মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ। সুতরাং কোন সন্দেহ ছিলো না, প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসাবে তাঁরই নাম উচ্চারিত হবে। কিন্তু হলো না; ঘোষকের কণ্ঠে যে নামটি উচ্চারিত হলো সেটা হলো-
فضيلة الشيخ العلامة أبوطاهر المصباح
একসঙ্গে দু’টি বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে হলো। ‘ফযীলতুশ্-শায়খ কবে হলাম,জানতেই পারলাম না,তদুপরি এলেম-কালাম ছাড়াই এক্কেবারে ‘আল্লামা’!এ তো শুধু শব্দের উপরই অনাচার নয়,নিরীহ মানুষটির উপরও অবিচার! যাক, বিদেশের মাটিতে এটা না হয় হলো। দেশের মানুষ তো আর জানলো না যে,হাসবে!
***
নাম ঘোষণা করা শেষ হলো। এবার দু’আ-মুনাজাতের মাধ্যমে সম্মেলনের সুসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। মুনাজাত পরিচালনা করবেন ভারতের বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার সম্মানিত প্রতিনিধি হযরত মাওলানা সাঈর্দু-রাহমান আলআ’যামী, আন্-নাদাবী।
আমার বড় জামাই মাওলানা হাবীবুর-রহমান নদবী নদওয়ায় তাঁর কাছে পড়েছেন। তার কাছে শুনেছি, সময়ের তিনি এমনই পাবন্দ যে, শাব্দিক অর্থেই তাঁর গতিবিধি দেখে ঘড়ির সময় জানা যায়। নদওয়ার মসজিদে তখন তিনি ইমামও ছিলেন। জামা’আতের পাঁচমিনিট আগে ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদে হাযির হতেন। দীর্ঘ চারবছরে কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। ঘড়ি দেখে দরসে হাযির হতেন, ঠিক সময়ে দরস থেকে বের হতেন; কমও হতো না বেশীও হতো না।
শুনতে সহজ মনে হলেও জীবনে এর বাস্তবায়ন শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব- ‘নামুমকিন’; ‘আকলান না হলেও ‘আদাতান’ অবশ্যই।
তাঁর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় অবশ্য অনেক আগে,আরবী যখন কিছুটা বুঝতে শুরু করেছি বলতে গেলে তখন থেকে। লালবাগ মাদরাসার কুতুবখানায় নদওয়া থেকে প্রকাশিত আরবী মাসিক ‘আলবা’ছুল ইসলামী’-এর কিছু পুরোনো সংখ্যা ছিলো। আমার মুহসিন উস্তায হযরত মাওলানা আব্দুল হাই বরিশালী হুযুর, আমাকে এনে পড়তে দিতেন। চিহ্নিত করে দিতেন, এই এই অংশ পড়ো। আবার পরীক্ষা নিতেন, কতটুকু বুঝলাম, বা বুঝলাম না। তখন থেকে দু’টি নামের সঙ্গে আমার মুহাব্বতপূর্ণ পরিচয়, পত্রিকাটির সম্পাদক মুহাম্মাদ আলহাসানী এবং সহসম্পাদক সাঈদুর-রাহমান আ’যামী।
এই প্রিয় মানুষটিকে এতদিন শুধু দূর থেকে দেখেছি, দূর থেকে শুনেছি এবং দূর থেকেই ভালোবেসেছি। মুহাম্মাদ আল হাসানীকে দুনিয়াতে আর দেখা হলো না; সাঈদুর-রাহমান আ’যামীকে দেখা হলো আজ এখানে ইস্তাম্বুলের মাটিতে। নীরবে, চুপিসারে ইস্তাম্বুল দেখি আমাকে অনেক কিছু দিয়েই চলেছে। ধন্যবাদ তোমাকে হে ইস্তাম্বুল! কিন্তু তখন কি জানতাম, এখনো আরো কিছু পাওয়ার বাকি আছে আমার প্রিয় ইস্তাম্বুলে!
তিনি মুনাজাত করলেন। ভাঙ্গা মজলিসের বেদনার সুর ছিলো তাঁর মুনাজাতে। শেষ হয়েও যেন শেষ হতে চায় না বেদনার মুনাজাত। শেষ হয়ে আসে, আর অন্তরে নতুন কোন ভাবের ঢেউ বুঝি উথলে ওঠে, আবার শুরু করেন কাঙ্গালের ফরিয়াদ।
একসময় শেষ হলো মুনাজাত; শেষ হলো ইস্তাম্বুলের মাটিতে তিনদিনের জলসা, যার স্মৃতি আমার হৃদয়ে জ্বলজ্বল করবে বহুদিন, চিরদিন।
***
সম্মেলনকক্ষের বাইরে উপস্থিত জনতা মেহমানদের নিয়ে তখন রীতিমত আত্মহারা। পরে একজন মেহমান তাঁর অভিজ্ঞতা বলেছেন এভাবে-‘আমাদের নাইজেরিয়ায় এমন পরিস্থিতি হলে জান বাঁচানোই মুশকিল। সত্যকথা এই যে আফ্রিকায় ক্রোধ ও ভালোবাসা দু'টোই’ বন্য। কিন্তু এখানে দেখলাম অসংযমের মধ্যেও আশ্চর্য সংযম। আসলে তুরস্কের মানুষ ইসলামের জন্য যে নির্মম নির্যাতন ও বঞ্চনা ভোগ করেছে, ইতিহাসে তার নযীর কমই আছে। ওদের মধ্যে ইসলামের কাছে ফিরে আসার আকুতি এখন এমনই প্রবল যে, কোন একটি অবলম্বন, যত সামান্যই হোক কাছে পেলে ভিতরের সব আবেগ, উচ্ছ্বাস বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত বের হয়ে আসতে চায়; এমনকি সেই প্রিয় অবলম্বনটিকেও যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু স্বভাব- সংযম শেষ পর্যন্ত তাদের ধরে রাখে।’
এতসব দর্শন তখন আমাদের মাথায় ছিলো না। বসে বসে শুধু দেখছিলাম অভাবিতপূর্ব সেই দৃশ্য। আমীর ছাহেব বললেন, ‘কিছুক্ষণ বসে থাকি; সমাগম হালকা হলে বের হবো।’
ব্যস, বসে থাকলাম। মঞ্চে যারা ছিলেন মঞ্চেই বসে আছেন। এখন বের হওয়া যে নিরাপদ নয় তাঁরাও বোধকরি বুঝতে পেরেছেন। সাঈদুর-রাহমান আযামী যেখানে মুনাজাত পরিচালনা করেছেন সেখানেই বসে আছেন। দৃষ্টি অবনত, যেন গভীর কোন চিন্তায় নিমগ্ন। দেখছি, আর ভিতরে ভাব ও ভালোবাসার তরঙ্গ যেন দোলা দিচ্ছে। তিনি তো সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রাহ.-এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত স্নেহধন্য একজন মানুষ, আমি তো মুহাব্বত করি সেই লাঠিকেও যা তাঁর হাতে ছিলো, সেই টুপীকেও যা তাঁর মাথায় ছিলো, সেই জুতাকেও যা তাঁর পায়ে ছিলো!
কোন উপায়ে একবার যদি এই মানুষটির কাছে যাওয়া যেতো! আর কিছু নয়, শুধু মুছাফাহার মাধ্যমে তাঁর হাতের স্পর্শ লাভ করা। এ হাত তো নিশ্চয় হযরত আলী মিয়াঁর হাতের স্পর্শ লাভ করেছে!
হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী এবং হযরত মাওলানা সালিম কাসিমী পাশাপাশি বসে খুব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলছেন। দেওবন্দের মর্মান্তিক বিরোধকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে যে বিরাট দূরত্বের কথা শুনতে পাই তাতে তো আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য এ দৃশ্য শুধু বিস্ময়করই নয়, অবিশ্বাস্যও।
শায়খ মুহম্মদ আওয়ামা মঞ্চের এক পাশে, আর শায়খ ছাবূনী অন্য পাশে, দু‘জনেই মুরাকাবার অবস্থায়। এমন চেহারা দূর থেকে শুধু দেখে থাকার মধ্যেও যেন রয়েছে রূহের গেযা, কলবের খোরাক এবং হৃদয় ও আত্মার পুষ্টি।
আরো কয়েকজন আছেন মঞ্চে;তাদের পরিচয় আমার জানা নেই। তবে পোশাকে বোঝা যায়,কেউ হেজাযের,কেউ মিশর,বা মাগরিবের;কেউ ইউরোপ,বা আমেরিকার।
আজকের জলসার প্রধান আকর্ষণ, বরং এ সম্মেলনেরই প্রাণকেন্দ্র শায়খ মাহমূদ আফিন্দী, তাঁকে মঞ্চে দেখা যাচ্ছে না! তবে কি তিনি বিদায় নিয়েছেন? বাইরের এ পরিস্থিতিতে তা কি সম্ভব? আমার মনে হয়, তাঁকে মঞ্চের পাশে কোন কামরায় বিশ্রামের জন্য নেয়া হয়েছে।
ধীরে ধীরে সমাগম কমে এসেছে। নিরাপত্তাকর্মীরা হোটেলের সামনের অংশ থেকে দর্শকদের সরিয়ে দিয়েছেন। আমরা সম্মেলনকক্ষ থেকে বের হলাম। হঠাৎ দেখি, হোটেলের দোরগোড়ায় একটি গাড়ী! শায়খ মাহমূদ আফিন্দীকে হুইলচেয়ারে করে গাড়ীর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখানে দর্শকদের ‘পীড়ন’ নেই, তবে মেহমানদের ‘নিপীড়ন’ আছে! আর মেহমান তো এক দেশের নয়, বিভিন্ন দেশের, সুতরাং নিপীড়নটাও এক প্রকারের নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের। এ বিষয়ে অবশ্য আমাদের ‘সুনাম’ও কম নয়, তবু আমরা সেদিকে গিয়ে সুনামের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করতে রাজী হলাম না, শুধু কিছুটা কাছে গিয়ে আরেকটু স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টা করলাম।
***
লিফ্টের গোড়ায় গিয়ে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মনোরম এক বিস্ময়। শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ লিফ্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিসমতের পক্ষ হতে এমন ‘সন্দেশ’ আমরা মোটেই আশা করিনি। বিশিষ্ট-সাধারণ কোন আরবকেই আগে সালাম দেয়া সাধারণত সম্ভব হয় না। এটা আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। বড় বড় আলিম যেমন, তেমনি সউদী আরব, ইরাক ও কুয়েতের রাষ্ট্রদূত, তেমনি বাজারে দোকানের মালিক এবং পথে গাড়ীর চালক, সর্বক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা আমার অভিন্ন।
শায়খ আওয়ামা সালাম দিলেন, আমীর ছাহেব জওয়াব দিলেন। লিফ্টের দরজা খুললো। না, তিনি আগে ওঠবেন না, আমাদের উঠতে হবে। সুবহানাল্লাহ!
আমীর ছাহেবের দিকে একটু নিরীক্ষণের সঙ্গে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি শায়খ আব্দুল মালিককে চিন? আমরা অবাক হলেও, অবাক হওয়ার কারণ ছিলো না। কারণ এটাকে বলে ‘আরবীয় ফিরাসাত’, সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে মুমিনের ফিরাসাত। শুধু কথা বলার সুযোগটা নেয়ার জন্য আমি আগে বেড়ে বললাম, তিনি শায়খ আব্দুল মালিকের বড় ভাই এবং মারকাযুদ্-দাওয়াহ’র মুদীর।
মৃদু হেসে বললেন, চেহারা ‘শাক্ল’ থেকেই আমার ধারণা হয়েছে। لماذا لاتتعارفون কেন পরিচয় দাওনা?
তারপর তিনদিন ধরে শোনা সেই মন্তব্য, এমনকি আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ-এরও মুখে,‘শায়খ আব্দুল মালিক কেন এলেন না! এখানে তাঁর অভাব খুব অনুভূত হচ্ছে। তাঁকে আমার সালাম জানিও।’
তৃতীয় তলায় তাঁর নামার কথা কিন্তু নামলেন না! আবার বলি সুবহানাল্লাহ!
আমীর ছাহেব বললেন, ইনশাআল্লাহ তিনি হজ্বের সফরে যাচ্ছেন, আশা করি মদীনা মুনাওয়ারায় তিনি আপনার দেখা পাবেন।
-ইনশাআল্লাহ। আমিও তাঁর ইনতিযারে থাকবো।
দশতলায় লিফট থামলো। আমরা নামলাম, তিনি দরজার মধ্যে পা রেখে আমাদের হাসিমুখে বিদায় জানালেন, যেন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার সুন্নত পালন করলেন। আবারও বলি, সুবহানাল্লাহ!
শিখতে চাইলে বড়দের থেকে শেখার অনেক কিছু আছে, এমনকি এ যুগেও।
***
কামরায় প্রবেশ করে প্রথমে আমীর ছাহেবকে খানিকটা আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে, বলা যায় লৌখনবী আন্দাযে ‘শোকরিয়া’ জানালাম।
তিনি মৃদু হেসে বললেন, এমনিতে তো বহু বহু দিক থেকেই অধম বান্দা আপনাদের শুকরিয়ার হকদার, তবে এখন বিশেষ করে কী কারণ ঘটলো শুনি?
বললাম, আমি তো ভেবেছিলাম, রাতের খাবার খেয়ে একবারেই উপরে যাই; আপনি ভিড়ের কথা বলে আমার ইচ্ছেটা বাতিল করে দিলেন। তাতেই না শায়খ আওয়ামাহ’র এমন দুর্লভ ছোহবত পেয়ে গেলাম!
তিনি বললেন, এটা শুকরিয়া আদায় করারই মত বিষয়, তবে এর আসল হকদার হলো ‘ডাইনিং হলের ভিড়’!
আমীর ছাহেবের কামরায় তিনজনের মজলিস বেশ জমে উঠলো। যে উদ্দেশ্যে আসা, ইস্তাম্বুলের জলসা, তা শেষ। নিজেদের তখন বেশ নির্ভার মনে হচ্ছে। তাই তিনজনেই দিলখোলা কথা বলছি। দেশের কথাও এসে যাচ্ছে। দেশের কথা মানে, শুধু বাড়ীঘরের কথা নয়, দেশের পরিস্থিতিরও কথা। আমীর ছাহেবের জাওয়ালে দেশ থেকে ফোন এসেছে প্রতিদিন। তিনিও ফোন করেছেন। জরুরি খবর আদান-প্রদান হয়েছে। দেশের খবরও কিছু কিছু জানা হয়েছে।
আমার মন তখন ‘হালকাফুলকা’ আলোচনার দিকে ছিলো।
নির্দোষ হাস্যপরিহাসও হচ্ছিলো কম নয়। একবার তো মাওলানা আব্দুল মতীন হাসির দমকে আমার...
(চলবে ইনশাআল্লাহ)