পাহাড়ে আলোর কাফেলা
পার্বত্য রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে ৭/৮ জনের দ্বীনী সফর। এন্তেজাম করেছেন মিফতাহুল উলুম বাড্ডা মাদরাসার উস্তাযুল হাদীস, উদ্যমী আলেম মাওলানা আব্দুল মাজীদ হাফিজাহুল্লাহ। বিনীত ও মার্জিত ভাষায় তিনি আমাকে শরীক থাকার দাওয়াত দিলেন। জানালেন, এই সফরে হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব, হযরত মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব প্রমুখ অংশগ্রহণের সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।
উলামায়ে কেরামের সোহবতের আশায় আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এমন মুবারক সফরে আমাকে সঙ্গী করায় মাওলানার প্রতি কৃতজ্ঞ হলাম। বললাম, ফেনী হয়ে যাবেন যেহেতু এ গরিবকে অবশ্যই মেহমানদারির সুযোগ দিবেন। কিছু সময় গরিবালয়ে কাটাবেন এবং উলামাবাজার মাদরাসা যিয়ারত করবেন। মাওলানা আগ্রহের সাথে আমার নিবেদন রাখলেন এবং আবদুল মালেক ছাহেব হুযুরকে দাওয়াত করতে বললেন।
মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের প্রতি দেশ-বিদেশের ওলামা-মাশায়েখের নেক তাওয়াজ্জুহ রয়েছে। আহলে ইলম সবাই তাঁকে অন্তর থেকে মুহাব্বত করেন। এই গুনাহগারের অন্তরেও আছে তাঁর প্রতি সামান্য ভালোবাসা। ঐটুকু ভালোবাসা দিয়ে আমি ‘আল হুব্বু ফিল্লাহ’-এর স্বাদ অনুভব করি। দুআর সময় বে-এখতিয়ার তাঁর কথা মনে পড়ে। আমি মাওলানাকে ফোনে দাওয়াত করলাম। তিনিও দাওয়াত কবুল করলেন। আল্লাহর শোকর।
২রা জানুয়ারি বাদ জুমা ফেনীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা। রাত যাপন উলামাবাজার। সকালে রাঙ্গামাটি। আমি ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে এলাম আগের দিন বৃহস্পতিবার। অন্তরে এক অনির্বচনীয় স্বর্গীয় আনন্দ। ফেনীর দক্ষিণে সাগর-স্নাত সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া গ্রাম। সেখানে উলামাবাজার মাদরাসার একেবারে কোলঘেষে আমাদের বাড়ি। শহরের সুযোগ সুবিধা, গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, সর্বোপরি দ্বীনী পরিবেশ ইত্যাদি কারণে মনোমুগ্ধকর আমাদের মুসাফিরখানা।
জুমাবার সকাল দশটার ভিতর বাজার করে উম্মে মাসরুরের হাতে অর্পণ করলাম। ইকামতে জুমাসহ অন্যান্য বাইরের কাজে আমার মাগরিবের পর হয়ে গেল। ওদিকে সকাল থেকে চলছে উম্মে মাসরুরের নীরব সাধনা। অবিরাম চলবে গভীর রাত পর্যন্ত। উঠান জুড়ে থৈ থৈ করছে চাঁদের স্নেহময় জোছনা। রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক গলে বের হচ্ছে সোনালি আলোর বিলম্বিত রেখা, তিরতির করে কাঁপছে। চুলা থেকে ঠিকরে পড়ছে সোনার বরণ আলো। আগুনের তাপ আর হৃদয়ের উত্তাপে মনোমোহন পরিবেশ রান্নাঘরে। বাহিরে থেকে থেকে ছুটছে হিমেল হাওয়া।
মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবকে ফোন করলাম, রাতের খাবারের তরতিব জানার জন্য। ভাত না রুটি? বললেন, ‘রুটি খেলে আপনার দস্তরখানের হক আদায় হবে না; ভাতই খাব।’ সুবহানাল্লাহ! কথা বলার কী চমৎকার আন্দায! রাত দশটার দিকে মাওলানারা পৌঁছে গেলেন। অসুস্থতার কারণে মাওলানা আবদুল মতিন ছাহেব আসতে পারেননি। মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ছাহেব ও মাওলানা আবদুল গাফফার ছাহেবও আসার কথা ছিল, আসতে পারেননি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
জিজ্ঞেস করলাম, নামাযের এন্তেজাম আগে না খাবারের এন্তেজাম? মাওলানা বললেন, ‘আগ’ আশা, পরে ইশা!’
আমি আমার ক্ষুদ্র দস্তরখান হাজির করলাম। উলামাবাজার মাদরাসার ‘দুজন উস্তাযও শরিক হলেন। তারা মাদরাসায় রাত যাপনের দাওয়াত দিলেন।’ ঈছার ফিত তআত’-এর কথা স্মরণ করে আমি মেহমানদের ছাড়তে রাজি হলাম। মাওলানা বললেন, আউয়াল ওয়াক্তে ফযর পড়ে আমরা রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে বের হতে চাই। আমি আরয করলাম, এই ঘরে অল্প সময়ে হালকা নাস্তাও হতে পারে। মাওলানা বললেন, সাথে নিয়ে যাব। মেহমানরা মাদরাসায় চলে গেলেন।
দারুল উলূম আল হুসাইনিয়া উলামাবাজার মাদরাসা এতদঞ্চলের বৃহত্তম দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাতেনী দিক থেকেও অনেকের মারকায। অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সিপাহসালার, শাইখুল ইসালাম সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহিমাহুল্লাহ-এর নামে মাদরাসার নাম। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সমর্থক আলেম ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এ-বাজারের পত্তন করেন বলে বাজারের নাম উলামাবাজার।
ফেনী জেলার কৃতি সন্তান, এলাকার কিংবদন্তীতুল্য জনপ্রিয় চেয়ারম্যান, হযরত মাদানীর একান্ত অনুরক্ত, হাকীম মাওলানা আব্দুল হক রাহ.-এর উদ্যোগে এবং তার সহযোগীদের প্রচেষ্টায় এ-মাদরাসা ও বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসার প্রথম মুহতামিম ছিলেন হযরত মাওলানা ফজলুল হক বাকী রাহ.। দ্বিতীয় মুহতামিম পীরে কামেল হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম (উলামাবাজারের হুযুর) রাহ.। তিনি হাকীমুল উম্মত থানবী রাহ.-এর মুজায মাওলানা নূর বখশ (শর্শদী হুযুর) রাহ.-এর খলীফা। তাঁর সময়ে মাদরাসা জাহেরী বাতেনী উভয় দিক থেকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে এবং দেশব্যাপী সুখ্যাতি লাভ করে।
তৃতীয় মুহতামিম বর্তমান বড় হুযুর হযরত মাওলানা সাইয়েদ আহমদ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। তিনি হযরত মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ এবং হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা। পরে হারদুঈ হযরত রাহ.-এর কাছ থেকেও ইজাযত লাভ করেন। বর্তমানে তাঁর বয়স প্রায় একশত বছর। ইবাদত বন্দেগিতে সালাফের নমুনা। গেল রমজানেও তারাবীর নামায দাঁড়িয়ে আদায় করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায এখনও মসজিদে আদায় করেন। দীর্ঘ আওয়াবীন ও তাহাজ্জুদ পড়েন। ফজরের নামাযের পর ইশরাক পর্যন্ত প্রায় একঘণ্টা মুরাকাবা করেন। এখনও খালি চোখে চশমা ছাড়া তেলাওয়াত করেন। সারা দেশে তাঁর ভক্ত মুরিদান রয়েছে।
মাদরাসায় আকাবিরের সোহবতপ্রাপ্ত আরো দুজন মুরুব্বী আছেন। হযরত মাওলানা আহমদ করীম মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর, হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম আদীব ছাহেব হুযুর। মাওলানা আহমদ করীম ছাহেব হুযুরও হযরত মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ এবং হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম রাহ.-এর অত্যন্ত আস্থাভাজন মুরিদ ও খলীফা। আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালোবাসা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাস-আন্দোলন, আকাবিরের জীবনী, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ইতিহাস তাঁর নখদর্পণে। তিনি গভীর ইলম ও প্রজ্ঞার অধিকারী বিচক্ষণ আলেম। মাদরাসার ইলমী এবং ইনতেযামী তরক্কীর পেছনে তাঁর অবদান অনেক। মাদরাসার ফতোয়ার দায়িত্বও তিনি আঞ্জাম দিতেন। এখন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। তবু রিক্সাযোগে প্রত্যহ মাদরাসায় আসেন। সহীহ বুখারীর দরস দেন।
মাওলানা নূরুল ইসলাম আদীব ছাহেব হুযুর বাংলার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সন্দীপী রাহ.-এর খাস শাগরিদ এবং হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম রাহ.-এর খলীফা। বর্তমানে মাদরাসার শাইখুল হাদীস পদে অধিষ্ঠিত। সারা দেশে তাঁর ইলমী সুনাম রয়েছে। উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে তিনি শক্তিমান লেখক। আমি এ মাদরাসার আদনা তালিবে ইলম। আমার শিক্ষাজীবনের ভিত রচিত হয়েছে এখানে। আমাদের বিছানায় যেতে যেতে রাত একটা বেজে গেল। শেষ রাতে উম্মে মাসরুর ঝটপট কিছু নাস্তা প্রস্তুত করে দিল। আমি মসজিদে জামাত দাঁড়ানোর আগেই মাদরাসায় হাজির হলাম। বড় হুযুরের সাথে মাওলানার সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি আগেই মসজিদে চলে গেছেন। তাই মসজিদে নামায আদায় করে রওয়ানা। নামায শেষে তাঁর আগমন ও বয়ানের কথা ঘোষণা হল। সংক্ষিপ্ত বয়ান ও দুআ শেষে আমরা গাড়িতে উঠলাম রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে।
শীতের সকাল। তবে ঠাণ্ডা কম। কুয়াশাও নেই। রাস্তা ফাঁকা। গাড়ী দ্রুত এগিয়ে চলল। মিরেরসরাই রায়পুর বাজারে একটি সি.এন.জি স্টেশনে যাত্রা বিরতি হল। সফরসঙ্গী ভাই শহীদুল ইসলাম দাওয়াতের মজবুত সাথী। বাড্ডায় বাসা। দ্বীনের জন্য অনেক কুরবানী করেন। বৃহস্পতিবার ঢাকার বাহির থেকে সফর করে এসেছেন। শুক্রবার আবার উলামায়ে কেরামের সফরসঙ্গী হয়েছেন। খেদমতের খুব জযবা।
আমাদের গন্তব্য রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানাধীন কবিরপুর গ্রাম। গাড়ি ছুটছে খাগড়াছড়ির রামগড়ের দিকে। পার্বত্য জেলার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা আগে শুনেছি। আজ স্বচক্ষে দেখছি। এক অনাস্বাদিতপূর্ব পুলক অনুভব করছি অন্তরে।
মাওলানার সাথে কিছুক্ষণ ‘হায়াতুন্নাবী’ ও‘সিফাতে বারীর’ মাসআলা আলোচনা হল, ইস্তেফাদা হল। একসময় মাওলানা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমীর ছাহেব আরো আগ থেকে যাকে বলে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন! অন্য সাথীরাও ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছেন। আমি একা জেগে। সফরে গাড়ীতে আমার ঘুম হয় না। এটা আমার দুর্বলতা। আল্লাহর পথের মুজাহিদদের তো এমন হওয়ার কথা নয়। হযরত মাদানীর ঘটনা শুনেছি। ট্রেন আসতে দশ মিনিট বিলম্ব। তিনি ঘুমিয়ে যেতেন, ঠিক দশ মিনিট পরে জেগে উঠতেন। এমনই প্রশান্ত আত্মার মানুষ ছিলেন তাঁরা।
রামগড় অতিক্রম করে গাড়ী মাটিরাঙ্গার পথে। আদিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা, সবুজের সমারোহ, উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ। রোমাঞ্চকর যাত্রা। মাওলানাকে জাগানোর চেষ্টা করলাম। তিনি দৃষ্টি মেলে তেলাওয়াত করলেন,ربنا ما خلقت هذا باطلا سبحانك فقنا عذاب النار এবং فتبارك الله أحسن الخالقين
আর ঘটনা শোনালেন, শফীক উস্তায হযরত মাওলানা আব্দুল বারী ছাহেব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় শুরু হলে স্বস্নেহে জাগিয়ে দিতেন। আপনিও এখন তাই করলেন।
পাহাড়ের পথ ধরে ছুটে চলেছে গাড়ী। ক্রমেই প্রকৃতির একেক রূপ যেন উন্মোচিত হচ্ছে। অপরূপ সবুজাভ পর্বতমালার এক স্বপ্নিল রাজ্য।
পথে পড়ল আলুটিলা নামে একটি পর্যটন কেন্দ্র। মাওলানা রাইয়ান, ভাই শহীদুল ইসলাম ও টিপু সুলতান আগে এখানে এসেছেন। তাদের ইচ্ছায় গাড়ী থামল।
এখানে আছে একটি রহস্যময় গুহা। ‘গারে হেরা’ এবং ‘গারে ছওর’ এর কারণে পৃথিবীর সব গুহার প্রতিই অন্তরে কেমন একটা মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করি। এজন্য সবার সাথে আমিও গুহা দেখতে যাব মনস্থ করলাম।
২০০৯ সালে আমি হবিগঞ্জ সফরে মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের সফরসঙ্গী ছিলাম। সেই সফরে আমরা চা বাগান, রাবার বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ইত্যাদি ঘুরেছি। মাওলানা তো আগাগোড়া ইলমী ভাবগাম্ভীর্যে ভরপুর। তার ভালোলাগা-ভালোবাসা আবর্তিত হয় ইলম আর আহলে ইলমকে কেন্দ্র করে। আমি তাই ভেবেছিলাম, উপর থেকে সবেগে ঝরে পড়া অজস্র পানির মনোহর ঝর্ণা, জলকণায় ভাসমান রংধনুর বর্ণিল ছটা, স্বচ্ছ-শীতল পানির সুখদ স্পর্শ, রিমঝিম রিমঝিম জলপতনের মনোরম আওয়ায- মাওলানার হৃদয়ে এসবের কোন আবেদন বুঝি নেই, দিগন্ত বিস্তৃত শ্যামল বিথীর সারি, দোলায়িত চা বাগানের প্রগাঢ় সবুজ সৌন্দর্য, এর প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার সময় বুঝি মাওলানার নেই, কিন্তু না, সেই সফরেও আমি মাওলানার প্রকৃতি-প্রেম লক্ষ করেছি, আজও করছি। তিনি এরই মাঝ দিয়ে তাঁর ইলমী আত্মার বিপুল খোরাক তুলে নেন।
জায়গাটা নামে ‘আলুটিলা’ হলেও কোন আলুখেত চোখে পড়েনি। তেমনি ‘টিলা’ বলা হলেও এটি মূলত সুউচ্চ পর্বত। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় তিনহাজার ফুট! এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের বিরাট অংশ দেখা যায়। উপরে আকাশের কোল ঘেঁষে যেন এক স্বপ্নীল রাজ্য। এখানে আকাশ পাহাড়ের সাথে মিতালী করে। মেঘমালা চুমু দেয় পাহাড়ের চূড়ায়। যেন উড়ে বেড়াচ্ছি আকাশের বুকে মেঘের সায়রে। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আলুটিলা এবং খাগড়াছড়ি শহরের মধ্যকার বিরাট এবং গভীর উপত্যকাটি এখন শুকনো। ভরা বর্ষায় উপত্যকা রূপালী জলে টইটুম্বুর থাকে। চোখ বন্ধ করে সেই জলবতী উপত্যকার দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করলাম।
ফটক থেকে দুটি মশাল সংগ্রহ করেছি। কারণ গুহাটি চির অন্ধকার। অজানা অতীত থেকে আজ পর্যন্ত গুহাটি সূর্যের মুখ দেখেনি। বাম দিকের রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকলাম। রাস্তা শেষে সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে হয়। মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দ্রুত হাঁটতে পারেন। যারা কাজের লোক, তাদের পুরো জীবনই গতিময়। এমনকি মহৎ থেকে মহত্তর কাজের ডাকে তাদের হাঁটাও হয়ে যায় অন্যরকম গতিময়। মাওলানা সকলের আগে নেমে গেলেন। অবশ্য এর মাধ্যমে মাওলানার ডায়াবেটিসের প্রাত্যহিক ওজিফাটাও আদায় হয়ে গেল!
প্রায় ৩৫০টি সিঁড়ি ভেঙ্গে আমরা গুহার মুখে পৌঁছলাম। ভিতরটা অজ্ঞাত অন্ধকার ও শীতলতায় মূক হয়ে আছে। একটা আদিম সোঁদা গন্ধও নাকে বাড়ি দিচ্ছে। গাঁ ছমছম করা পরিবেশ। মূল গুহার আগে একটা সুড়ঙ্গ পার হতে হয়। খুব সাবধানে পা ফেলছি। তলদেশে একটি ঝর্ণা প্রবহমান। জায়গাটা পিচ্ছিল পাথুরে। পা ফসকে যেতে পারে। ভিতরে জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। রয়েছে বড় বড় পাথর। ক্রমেই সুড়ঙ্গটি সংকীর্ণ হয়ে আসছে। ভয় পেয়ে গেলাম। আবদুল মালেক ছাহেব বললেন, একটা ধারণা নেওয়া উদ্দেশ্য ছিল, তা হয়ে গেছে। সামনে আর না, ফিরে যাই। আমরা ফিরে আসতে লাগলাম। দাওয়াতের দুসাথী ফিরলেন না।
অবতরণ তো একরকম হয়েছে। কিন্তু উত্তরণটা বড় কঠিন হয়ে গেল। জীবনের উত্তরণ-উন্নতিও হয় কষ্টে আর অবতরণ-অবনতি হয় সহজে। মাওলানা কষ্ট করে সবার আগে উঠে আসলেন। আমি জিরিয়ে জিরিয়ে উঠলাম। তবু হাঁপিয়ে গেলাম।
সামনে খাগড়াছড়ি জেলা শহর। ধীর গতিতে গাড়ী চলছে। যেদিকে চোখ যায় অবারিত সবুজ ও নীল আকাশের হাতছানি। পাহাড়ের সারিগুলো সবুজের চাদর গায়ে আকাশের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। কোনো শিল্পী যেন তুলির নিপুণ স্পর্শে ছবি এঁকে রেখেছে।
শহর অতিক্রম করে গাড়ী দিঘীনালা সড়কে। পুরো জেলাই মনোরম দৃশ্যে ভরপুর। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা উচু নিচু পথ। গাড়ী কখনও উপরে উঠছে কখনও নিচে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই বুঝি আকাশ ছুঁতে চলছি। ঘন ঘন বাঁক আর খাড়া রাস্তা দেখে বোঝা যায়, পাহাড়ের জীবন কত কঠিন। প্রতিটি বাঁকে ভয় হয়; গাড়ীটা এই বুঝি নিচে পড়ে গেল। ছয় সাত শত ফুট নিচের উপত্যকায় দৃষ্টি পড়লে গা ছমছম করে উঠে, আবার মুগ্ধতায় ভরে যায় মন। কখনো পাহাড়, কখনো উপত্যকা, কখনো বনজঙ্গলের মাঝে আঁকাবাঁকা পথ। পথের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে বিস্ময় আর আনন্দ। পাতায় পাতায় কী সতেজ আর সবুজ কারুকাজ...
برگ درختان سبز در نظر ہوشيار
ہر ورقے دفتريست معرفت كردگار
‘জ্ঞানীর চোখে সবুজ বৃক্ষের প্রতিটি পাতা/ আল্লাহর পরিচয়ের একেকটি খোলা কিতাব।’
গাড়ী চলছে সাবধানে, ধীর গতিতে। রাস্তা অসমতল হওয়ায় গাড়ীর গতি কম। অনেক সময় লেগে গেল। দুপুর আড়াইটায় আমরা রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার মাইনিমুখ পৌঁছে যোহরের নামায আদায় করলাম। স্থানীয় আলেম মাওলানা আমীনুর রশীদ আমাদের ইস্তিকবাল করেন। তাঁর ব্যবস্থাপনায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা-যোগে আমরা কবীরপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। প্রায় এক ঘন্টা নৌকা চলল।
নিমিষেই দীর্ঘ সফরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এটা কাপ্তাই হ্রদ। ১৯৬০ সালে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্টি হয় সুবিশাল এ হ্রদ। আমরা হ্রদের উত্তর অংশে ভ্রমণ করছি। সবুজের কোল ঘেষে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা শান্ত হ্রদ আমাদের বুকে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। বিকাল চারটায় ‘কবীরপুর জমিরিয়া খতমে নবুওত মাদরাসায়’ পৌঁছলাম। ছোট্ট মসজিদ, একটি নূরানী মক্তব- এই হল মাদরাসা। আসরের নামায শেষে মাওলানা নাজমুল হকের ঘরে দুপুরের খাবারের দস্তরখান। তাজা সুস্বাদু রকমারী খাবার। আন্তরিকতাপূর্ণ দস্তরখান। আহার হল তৃপ্তির সাথে।
মাদরাসার নতুন ঘরের ভিত্তি স্থাপন, ওয়াজ ও দুআর মাহফিল এবং এলাকায় দ্বীনী মেহনত গতিশীল করার উদ্দেশ্যে আমাদের এখানে আসা। এ গ্রামটি কাদিয়ানী উপদ্রুত। এখানে আছে কাদিয়ানীদের আস্তানা ও অবৈতনিক স্কুল। খ্রিস্টান মিশনারী অপতৎপরতাও আছে। ২০০৩ সালে এই গ্রামের সরদার -নাউযুবিল্লাহ- কাদিয়ানী হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে কোনো এক দাওয়াতী সফরে ড. লুৎফুল কবীর সাহেবের মেহনতে তিনি তিন চিল্লার জন্য বের হন এবং আলহামদুলিল্লাহ ইসলামে ফিরে আসেন। কিন্তু তার দাওয়াতে যারা কাদিয়ানী হয়েছে তাদের কী হবে! কাকরাইলের মুরব্বীগণ সেখানের অবস্থা জানতে পেরে ঢাকার বাড্ডা এলাকার দাওয়াতী সাথীদেরকে সেখানের খোঁজ-খবর নেয়ার যিম্মাদারী দেন। তারা মাওলানা আব্দুল মাজীদ ছাহেবকে অবগত করেন। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম মাওলানা আব্দুল মাজীদ ছাহেব দাওয়াতের উদ্দেশ্যে এখানে আসেন। এবং এলাকার দ্বীনী প্রয়োজন পূরণে এ মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ঢাকা বাড্ডা এলাকার কতিপয় দাওয়াতের সাথী এ মহৎ কাজে তাঁকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেন। শুরু থেকেই মাদরাসার প্রতি মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের নেক তাওয়াজ্জুহ রয়েছে।
মূলত দ্বীনী খেদমতের অনেক অঙ্গন রয়েছে এবং সব অঙ্গনেই খেদমত হওয়া দরকার। প্রত্যেক অঙ্গনের দ্বীনের খাদেমদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই মূলত ইকামাতে দ্বীন ও হেফাজতে দ্বীন সম্ভব হবে। সুনির্দিষ্টভাবে একটি অঙ্গনের কাজকেই দ্বীনের একমাত্র কাজ বা একমাত্র নবীওয়ালা কাজ বলার কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ বাস্তবতা অনুধাবন করার তাওফিক নসীব করুন।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ঘিরে খ্রিস্টান মিশনারী ও তাদের দোসর কাদিয়ানীদের গভীর ষড়যন্ত্রের কথা এখন দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। সাহায্য ও সেবার ছদ্মাবরণে আমাদের ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তারা অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত। বিশেষত পার্বত্য এলাকায় উপজাতীয় খ্রিস্টানদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং সে এলাকাকে পৃথক খ্রিস্টান-রাষ্ট্র বানানোর নীল নকশা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অধিকাংশ এনজিও দরিদ্র জনগণের জন্য সংগৃহীত অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করে যাচ্ছে তাদের এটার্গেট বাস্তবায়নে। সংগৃহীত অর্থের ১০ থেকে ২০ ভাগ ছাড়া বাকি সমুদয় অর্থ খ্রিষ্টধর্ম প্রচার, কাদিয়ানীধর্ম প্রচার ও তাদের মোটা বেতন-ভাতা ও বিলাসবহুল বাড়ী-গাড়ীর জন্য ব্যয় করে। সেবার আড়ালে তারা আমাদের যে ক্ষতি করছে তার প্রধান কিছু শিরোনাম নিম্নরূপ :
১. আমাদের ঈমান আকীদা, নৈতিক মূল্যবোধ ও শিক্ষা-সংস্কৃতি ধ্বংসের পাঁয়তারা
(ক) গরীব নিরক্ষর জনগণকে আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে।
(খ) ইসলামী-আকীদা বিশ্বাসের বিকৃত ব্যাখ্যা সম্বলিত বই-পুস্তক দেশের আনাচে কানাচে বিনামূল্যে বিতরণ করছে।
(গ) আলেমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও কুৎসা রটনার মাধ্যমে মুসলিম জনগণকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
(ঘ) মুসলিম উম্মাহর ঐতিহ্য যে সুদৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের উপর প্রতিষ্ঠিত তা ধ্বংস করা এবং সামাজিক মূল্যবোধসমূহকে বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।
(ঙ) মহিলাদের ইসলামী পোষাকের ব্যাপারে বিদ্বিষ্ট করে তুলছে।
(চ) মহিলাদেরকে চাকরির নামে স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দূরে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টি করছে। তাদেরকে স্বামীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।
(ছ) বেহায়াপনা ও অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ করে সম্ভাবনাময় যুব-চরিত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
(জ) বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি খ্রিস্টান-রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতা চলছে। বিশেষত পার্বত্যজেলা, পার্শ্ববর্তী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা, নাগাল্যন্ড, মিজোরাম এবং আসামের বিশাল অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা খ্রিস্টান-রাষ্ট্র গঠনের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র চলছে।
২. এনজিওগুলো গরীবদের স্বনির্ভর করার নামে মহাজনী কায়দায় শোষণ করছে। বরং তাদের বিনিয়োগ সুদী মহাজনদের চাইতেও জঘন্য।
(ক) তারা সাধারণত শতকরা ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা সুদে গরীব জনগণকে অর্থ দেয়। অশিক্ষিত জনগণ এই চড়া সুদের সিস্টেম বুঝতে পারে না। ফলে তাদের চরম খেসারত দিতে হয়। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে ভিটামাটি খোয়াতে হয়। আর এনজিওগুলো তাদের দেয়া ঋণ সুদসহ দৈনিক, অর্ধ সাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক উসুল করার পদ্ধতির মাধ্যমে অসহায় গরীব জনগণকে বিভিন্নভাবে শোষণ করে। তাদের হয়রানির কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়।
(খ) দেশের শিল্প ও কৃষিতে এনজিওর ভূমিকা প্রায় শূন্য। কৃষি ও শিল্পে বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের বিষয়টি খুবই সন্দেহজনক।
৩. বর্তমানে এনজিওগুলো জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। এনজিওগুলোর মনে করা হয় নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এরা ঠিক এর উল্টো। এরা যেভাবে সংগঠিত হচ্ছে, আজ হোক কাল হোক, নিঃসন্দেহে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর মত দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে ছাড়বে। আল্লাহই একমাত্র রক্ষা করার মালিক।
ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই ইহুদী-খ্রিস্টানরা ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করেনি। যখন তারা বুঝতে পারল, অস্ত্রবলে ইসলামকে নির্মূল করা সম্ভব নয়, তখন তারা ইসলামের ভিতরে থেকেই মুসলিম নামধারী ক্রীড়নক দিয়ে ইসলাম নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ ক্রীড়নকরা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামের স্বরূপ বিকৃত করে ইসলামের নামে নতুন নতুন ধর্মমত সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায়। পাঞ্জাবের কাদিয়ান নামক গ্রামের অধিবাসী মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তেমনি এক ক্রীড়নক। ইংরেজ-পোষ্য এবং শিয়ালকোট আদালতের কেরানী। এ ব্যক্তি তার প্রভুদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে নিজেকে নবী এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী দাবী করে। ইসলামের নামে সম্পূর্ণ নতুন ধর্মমত প্রচার করে। এবং ইসলামে যা অকাট্য কুফুর সেটাকেই ইসলাম বলে চালিয়ে দেয়। এভাবে ধোকা দিয়ে মুসলমানদেরকে ঈমানহারা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। আমাদের দেশে তার অনুসারীরা ব্যাপকভাবে সক্রিয়। তারা এবং মিশনারিরা মিলে এদেশকে খ্রীস্টান-কাদিয়ানী রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকার, উলামায়ে কেরাম ও জনগণের জন্য নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরী-
১. এনজিওগুলোর জন্য সেবাদান বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে অন্য কোন ধর্ম বা মতাদর্শ প্রচার নিষিদ্ধ করা। কারণ মুসলমানদের ঈমান হেফাযতের ব্যবস্থা মুসলিম সরকারের উপর ফরয। তাছাড়া কাদিয়ানী ও খ্রীস্টধর্ম প্রচারের পিছনে সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা সক্রিয় এবং তারা ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
২. ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করা।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ স্পর্শকাতর এলাকাগুলো এনজিও-মুক্ত ঘোষণা করা এবং পাহাড়িদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা করা।
৪. কাদিয়ানীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা।
৫. কোনো এনজিও যাতে কোনো এলাকাকে ঘাটি হিসাবে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। দারিদ্র্য বিমোচনের সকল অর্থ যেন শুধু খ্রীস্টান-কাদিয়ানী অধ্যুষিত এলাকায় বা বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন থাকা। দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থ যেন কোনো বিশেষ মতাদর্শ প্রচারে ব্যয় না হয় সেদিকে নযর দেওয়া।
৬. সুদ ভিত্তিক অর্থনীতি পরিহার করে ইসলামী অর্থনীতি চালুর জন্য উদ্যোগী হওয়া।
৭. দারিদ্র্য বিমোচনে বিত্তবানদের এগিয়ে আসা। বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলিম ভাইদের জন্য সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করা।
৮. সারা দেশে বিশেষত খ্রিস্টানমিশনারী ও কাদিয়ানী উপদ্রুত এলাকায় মসজিদ, মক্তব ও মাদরাসা কায়েম করা।
৯. সর্বত্র দাওয়াতী কার্যক্রম জোরদার করা। নির্দিষ্ট এলাকায় স্থায়ীভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দাঈ নিযুক্ত করা।
১০. ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থা করা। মুসলিম জনগণকে উলামায়ে কেরামের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তাদের সোহবত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।
১১. খ্রিস্টান ও কাদিয়ানী ধর্মমতের অসারতা এবং এনজিও অপৎপরতা সম্পর্কে বই-পুস্তক ও হ্যান্ডবিল তৈরি করে ব্যাপকভাবে প্রচার করা।
১২. দাওয়াহ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা।
এ-সমস্ত কাজের প্রধান দায়িত্ব মুসলিম-সরকারের। যারা আমাদের অভিভাবক তাদের। কিন্তু আফসোস, তাদের অবস্থা তো সবার জানা। এমতাবস্থায় উলামায়ে কেরাম -যারা ইসলাম এবং দেশ ও জাতির অতন্দ্রপ্রহরী- তাদের দায়িত্ব হল, জনগণকে সাথে নিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং সত্যধর্ম রক্ষার্থে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে মিশনারি ষড়যন্ত্রের নাজুকতা বোঝার এবং প্রতিকারার্থে দাওয়াতি কাজ করার, কাজের সহযোগী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
বাদ মাগরিব মাহফিল শুরু হল। পুরো গ্রামে দ্বীনী জযবা এবং আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঠ কানায় কানায় ভরে গেল। মাওলানা আব্দুল মাজীদ ছাহেব খতমে নবুওয়াত এবং কাদিয়ানী ধর্মমত সম্পর্কে আলোচনা করেন। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনে এবং ঈমান-আকীদার ব্যাপারে সচেতন হয়। এশার নামাযের পর প্রথমে মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব মাদরাসার নতুন ঘরের কাজ উদ্বোধন করেন। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের কয়েকজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। তারা মাদরাসার প্রতি আন্তরিক। এরপর যথারীতি বয়ান শুরু হয়। আমি আমার বয়ানে বর্তমান ফেৎনার জমানায় ঈমান-আমলের হেফাযতের জন্য নেককারদের সোহবত গ্রহণ, মাদরাসা-মক্তব প্রতিষ্ঠা এবং দাওয়াত-তাবলীগের মেহনতে শরীক হওয়ার গুরুত্ব আলোচনা করি। শেষে কাদিয়ানীদেরকে ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসার আহ্বান জানাই। মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব তাঁর বয়ানে দ্বীনী তা’লীমের গুরুত্ব তুলে ধরেন। শিশুদেরকে মাদরাসায় ভর্তি করানো এবং বড়দেরকেও অবসর সময়ে মাদরাসায় এসে দ্বীন শেখার নসীহত করেন। মাদরাসাকে নিজের মাদরাসা মনে করার আহ্বান জানান। রাত এগারটার দিকে মাওলানার দোয়ার মাধ্যমে মাহফিল শেষ হয়।
ফেৎনাকবলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বীনী মাদরাসার প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত কঠিন। এর জন্য দরকার উঁচু মানের এখলাস ও কুরবানী। এখানকার প্রথম মুআল্লিম ও দাঈ মাওলানা হুসাইন আহমাদ, দ্বিতীয় মুআল্লিম ও দাঈ মাওলানা নাজমুল হক। উভয়ে মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ এবং মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের শাগরিদ। তাঁদের পরামর্শেই তারা এখানে এসেছেন এবং জান-মাল, মেধা-যোগ্যতা সব কিছু কুরবান করছেন। মাওলানা নাজমুল হক সাহেবের ঢাকায় বাসা-বাড়ী আছে। এখন তিনি কবীরপুরের দুর্গম পাড়াগাঁয়ে একটি দোচালা টিনের ঘরে বাস করেন। ঘরে চৌকি নেই, মিয়া-বিবি ফ্লোরেই থাকেন। দাওয়াতের সাথী আরিফ ভাই। চিটাগাং শহরের ব্যবসায়ী। বিত্তবান মানুষ। শহর ছেড়ে তিনিও এই গ্রামে সস্ত্রীক বসবাস করেন। এলাকায় দাওয়াতের কাজ করেন। এখানে তিনিই আমাদের মেজবান। আল্লাহ তাআলা সকলের মেহনত ও কুরবানী কবুল করুন। আমীন।
ফজরের পরে আমরা স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে গেলাম। ক্যাম্পের কয়েক সদস্য রাতে সেখানে যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। টিলার উপরে ক্যাম্প। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম পরিবেশ। বাহিরে বসে এক ভাই কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। আমাদেরকে দেখে আরো দুজন এগিয়ে আসেন এবং বসার ব্যবস্থা করেন। ক্যাম্পের অন্য সদস্যরাও একে একে হাজির হন। মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব সংক্ষিপ্ত নসীহত এবং দু’আ করেন।
দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ ও জাতি রক্ষার মতো মহান কাজে নিয়োজিত আমাদের এসকল বাহিনী। একজন বিজিবি জোয়ান যদি সওয়াবের আশায় সীমান্ত পাহারা দেয়, তবে সে কত বড় মর্যাদার অধিকারী! রিবাত ফী সাবীলিল্লাহ’র সওয়াব স্মরণ হলে তো চোখে পানি এসে যায়। আহ! একটি বারও যদি ওদের সঙ্গে দ্বীন, দেশ ও জাতির হেফাযতে অতন্দ্র রাত কাটাতে পারতাম! আমরা যদি আমাদের জোয়ানদের নিয়তটা শুদ্ধ করে দিতে পারতাম!
মুসলিম বাহিনী তো হবে জনমানুষের আস্থা ও ভালোবাসার সবুজ প্রতীক! আমর বিল মারূফ নাহি আনিল মুনকারের জিন্দা নমুনা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আজ আমাদের বাহিনীগুলোর ভাবমূর্তি ও মনমানসিকতা সেক্যুলারনীতি ও অপরাজনীতির বলি হয়ে গেছে! আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে!
মাদরাসায় ফেরার পথে একটি চা দোকানে এলাকার প্রবীণ কাদিয়ানী রিয়াজ মিয়ার সাথে কথা হয়। আসলে কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। শুধু শিখানো বুলি আওড়ান। আমরা তাকে উলামায়ে কেরামের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে এবং আল্লাহর কাছে হেদায়াত লাভের দু’আ করতে বললাম।
মাদরাসায় ফিরে নাস্তা করলাম। এরপর ঢাকার উদ্দেশ্যে মাইনীমুখ বাজারের দিকে রওয়ানা হলাম। কাপ্তাই হ্রদের প্রশান্ত পানিতে নৌকা ভাসানো হল। মাঝপথে লংগদু উপজেলার গাউসপুর মাদরাসা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রাবিরতি হল। সুন্দর গ্রামীণ পরিবেশে নূরানী মক্তব। শিক্ষার মান ভালো। কিতাবখানার প্রথম জামাতের ছাত্রদেরকে সবক দিলেন মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব। মাদরাসার নির্মানাধীন একটি খোলা ঘরে গিয়ে দু’আ করলেন। হৃদয় গলে অশ্রু ঝরল। আল্লাহ মাদরাসাকে কবুল করুন। এ-ধরনের মাদরাসা দান-অনুদানের উত্তম খাত। আল্লাহ তাওফীক দাতা।
বেলা এগারটা নাগাদ আমরা মাইনীমুখ বাজার মসজিদে পৌঁছি। এখানে আমাদের গাড়ী রাখা ছিল। মাওলানা আমীনুর রশীদ দুপুরের খাবার গাড়ীতে দিয়ে দেন। তিনি গতকাল থেকে পুরো সময় আমাদের সাথে ছিলেন। মাদরাসার জন্য আন্তরিকভাবে মেহনত করেন। আল্লাহ উত্তম বদলা দান করুন। আমীন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দ্বীনী কাজের বিশাল ক্ষেত্র। এখানকার উপজাতিদের আমরা গুরুত্ব দিইনি, উপেক্ষা করেছি। তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাইনি। আমরা যদি তাদের অধিকারের কথা বলতাম, দরদ নিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে তাদেরকে দ্বীনের প্রতি ডাকতাম, তবে তারা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিত। এসুযোগ খ্রিস্টান মিশনারীরা গ্রহণ করছে। আজ এ অঞ্চলের অর্ধেক লোকই খ্রিস্টান। তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদদ জোগাচ্ছে। সুতরাং ইসলামই এদেশের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের একমাত্র রক্ষাকবচ। এমতাবস্থায় প্রতিটি পাহাড়ে, বন-বাদাড়ে, গাঁওগ্রামে দাওয়াত ও তালীমের মশাল জ্বালিয়ে দিতে হবে। তাহলে কাদিয়ানী ও মিশনারী ফেৎনার অমানিশা দূর হবে। আমাদের ধর্ম ও স্বাধীনতা সুসংহত হবে।
আমরা আসর আদায় করলাম জালিয়াপাড়া বাজার জামে মসজিদে। নামায শেষে দুপুরের আহার হল। লক্ষ করলাম, মসজিদের দান-বাক্সে কাবা শরীফের ছবি। আমরা অনেক কাজ আবেগে করি। বিবেচনা করি না। কাবা শরীফ আল্লাহর ঘর। ইসলামের মহান শিআর ও প্রতীক। অপাত্রে ব্যবহারে এর সম্মান হানি হয়।
এশার সময় আমরা ফেনী জামিয়া মাদানিয়ায় পৌঁছলাম। গুণগতমানে এটি জেলার অন্যতম দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মাওলানার আগমনে মাদরাসায় আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল।
এ-সফরে প্রতি পদে আমরা আল্লাহ পাকের রহমত ও বরকত অনুভব করেছি। ইলমের নিসবতে সব জায়গায় আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছি। আল্লাহর শোকর। আনুমানিক রাত নয়টায় আমরা ফের রওনা হলাম।
আগামীকাল ৫ই জানুয়ারী সোমবার। সরকারী দল ও মাঠের বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচীর কারণে সব ধরনের সভা-সমাবেশের উপর ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। ঢাকায় যাত্রীবাহী গাড়ী ঢুকছে না। সারা দেশে টানটান উত্তেজনা। সবার মাঝে আতংক। তবু দায়িত্বের খাতিরে আমাদেরকে ঢাকায় যেতে হবে। হে আল্লাহ! আমাদেরকে সৎ, যোগ্য এবং ঈমানদার ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব দান কর। আমীন।
মাত্র দুদিনের সফর। এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে আমরা একসাথে ছিলাম। এখন বুকের ভিতর কোথায় যেন চিনচিন করছে। কারণ একটু পরই আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। তবে শান্ত্বনা হল, আল্লাহর জন্যই আমাদের মিলিত হওয়া, আল্লাহর জন্যই আমাদের পৃথক হওয়া।
আফিয়াত-সালামাতের সাথে রাত একটার দিকে আমরা ঢাকায় পৌঁছলাম। আলহামদুলিল্লাহ।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উলামায়ে কেরামের বেশি বেশি সফর হওয়া উচিত। এতে উম্মতের হাল জানা যায়। উম্মতের প্রতি দরদ পয়দা হয়। দ্বীনী কাজের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সাধারণ মানুষের অন্তরে ঈমানী জাগরণ সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ পাক আমাদের দ্বীন ও ঈমান, দেশ ও জাতিকে হেফাযত করুন। আমীন হ