ভাষায়-শব্দে স্বাতন্ত্র্য
ভাষা তো হচ্ছে ভাব ব্যক্ত করার মাধ্যম। এটা সরাসরি আল্লাহ তাআলার দান। আল্লাহ শিখিয়েছেন মানুষকে। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন: (তরজমা) তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাকে শিখিয়েছেন ভাষা। (সূরা আর রাহমান ৫৫ : ৩-৪) সেজন্যই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যসহ দুনিয়ার সব ভাষাকে আল্লাহর দান হিসেবে গ্রহণ করা সঙ্গত ও বাঞ্ছনীয়। এবং একারণে অনুভূতি, কথা ও আচরণে আল্লাহর প্রতি বান্দার কৃতজ্ঞতার বিষয়টিও প্রয়োজনীয়, সঙ্গত ও প্রাসঙ্গিক। অমত্মত বিশ্বাসী বা মুমিন বান্দাদের ক্ষেত্রে এর প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত।
ভাষা বা ভাব ব্যক্ত করার সাধারণ কৃতজ্ঞতার ধরনটি পরিষ্কার। উচ্চারণ-আবৃত্তিতে মহান রাববুল আলামীনের হামদ-সানা পাঠ করা, গুণগান গাওয়া। আল্লাহ তাআলার নাফরমানি হয়-এমন কথা বর্জন করা। তবে, এর সবচেয়ে প্রয়োগ-বহুল ধরনটিই অনেক সময় ধারণায় বিরাজ করে অপরিষ্কার বা অস্পষ্টরূপে। সেটি হলো শব্দ-ভাষার সাধারণ প্রয়োগে আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশক অবস্থান বা পরিস্থিতি বজায় রাখা। আল্লাহর একত্ববাদ পরিপন্থি কিংবা ইসলামী স্বাতন্ত্র্য বিনাশকারী শব্দ-ভাষা পরিহার করা। স্বতন্ত্র ইসলামী জাতিসত্তা ও চিন্তাচেতনা রহিতকারী শব্দ পরিভাষা এড়িয়ে চলা। অথচ বাস্তবে শব্দ প্রয়োগ ও ভাষার সাধারণ উপস্থাপনায় এই সতর্কতা রক্ষার কাজটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পালিত হয় না। আর এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি ঘটে থাকে অনারব ভাষা-শব্দাবলির ক্ষেত্রে। আমরা বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও এ সমস্যাটি অহরহ ঘটতে দেখি। সে সম্পর্কেই এখানে সামান্য কথকতা।
দুই
বাংলাভাষার শব্দাবলির একটি বড় উৎস সংস্কৃত ভাষা। সংস্কৃত-আশ্রয়ী বাংলাভাষার প্রভাবশালী ব্যবহারকারী হচ্ছে এ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়। এ জন্য বাংলায় ব্যবহৃত বহু সাধারণ শব্দে হিন্দুধর্মীয় বোধ ও প্রতীকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সে অর্থে প্রচুর শব্দ আপাত চোখে নিরীহ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তীব্র শিরকি মর্মের বাহক। যেমন: ব্রহ্মান্ড, রাহু, সূর্যসন্তান, লক্ষ্মী, অগ্নিপুত্র ইত্যাদি। অপর দিকে এমন কিছু শব্দও রয়েছে যেগুলোর শাব্দিক অর্থে মন্দত্ব নেই, কিন্তু প্রয়োগ ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে সেই শব্দটিই ইসলামী বোধ-বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন হিসেবে প্রতিভাত হয়। বলা যায় অর্থের বৃত্তে শব্দের অস্তিত্ব নির্দোষ হলেও প্রয়োগের পরিবেশে সেটি অপাংক্তেয়। এর মূল কারণ প্রয়োগের পরিবেশ, পূর্বাপর অবস্থা, সমাজ ও মানুষের সাধারণ রেওয়াজ এবং পরিস্থিতির উপাদান। যেমন এবছর দেশের বৃহত্তর ডায়েরী ও ক্যালেন্ডার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটির একটি ক্যালেন্ডার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের মসজিদের ছবি এবং ছবির বর্ণনা দিয়ে। এরকমই একটি ছবির বর্ণনায় বলা হল, সেখানে এত সংখ্যক লোক একসঙ্গে ‘প্রার্থনা’ করতে পারে। মসজিদের ভিতরে যে ইবাদতটি করা হয় সেটির নাম সালাত অথবা নামায। বাংলাদেশে এই ভাষাতেই শব্দটিকে চিহ্নিত করা হয়। এর বাইরে গিয়ে এই সমাজে ওই ইবাদতটিকে ‘প্রার্থনা’ হিসেবে প্রয়োগ করা আসলে সামঞ্জস্যহীন কিংবা অপ্রাসঙ্গিক। সিয়াম বা রোযাকে যদি কেউ স্বাভাবিক বর্ণনায় লেখে ‘উপবাস-পালন’ তাহলেও একই সমস্যা হয়। অবশ্য যে সমাজে ব্যাপকভাবে ইসলামের ইবাদতগুলোর পরিচয় অস্পষ্ট সেখানে প্রাথমিক পরিচিতি তুলে ধরার জন্য এ জাতীয় শব্দের প্রয়োগ চলতে পারে। সাধারণ পর্যায়ে সাধারণ পরিস্থিতিতে ইসলামী পরিচিতিমূলক শব্দের পরিবর্তে এ-জাতীয় শব্দের ব্যবহার সঙ্গত ও শোভন হতে পারে না।
একইভাবে মুসলিম জীবনাচারের সঙ্গে জড়িত প্রাচীন ও সুপরিচিত শব্দগুলোর হঠাৎ বাংলাকরণ নিয়েও অভিন্ন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। লাশকে ইদানীং বলা হচ্ছে, মরদেহ। দাফন-কাফনকে বলা হচ্ছে সৎকার এবং কাফফারাকে বলা হচ্ছে প্রায়শ্চিত্ত। এবং এ জাতীয় বহু শব্দ হঠাৎ ‘বাংলা-প্রবণতা’-রোগে আক্রামত্ম হয়ে স্বকীয়তা হারাচ্ছে। মরদেহ-সৎকার বা শেষকৃত্য এবং ‘প্রায়শ্চিত্ত’টা কার দিতে হচ্ছে? সে কি মুসলিম নাকি অমুসলিম? এটা চিহ্নিত করাও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এটি ভাষায়-শব্দে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টিকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করার একটি ধীর ও লঘু পদক্ষেপ কি না অনেকে তেমন সন্দেহ করছেন। কারণ অন্য কোথাও সেভাবে না চললেও ইদানীং বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলো আর এফএম রেডিওগুলো এ জাতীয় শব্দ ও বাক্যের ব্যবহারে যেন উঠে পড়ে লেগেছে।
তিন
মুসলিম সমাজে নির্দোষ সংস্কৃত বা বাংলা শব্দের আরেকটি অসঙ্গত ব্যবহারের বাড়তি প্রবণতা শুরু হয়েছে গত দেড় দশক ধরে। এর আগেও এ প্রবণতা ছিল। তবে সেটি ছিল অত্যন্ত অনুল্লেখ্য ও সীমিত পরিসরে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ক্ষেত্রে যেন উঠেপড়ে লাগার মতো অতি বাঙ্গালিয়ানার একটি মহড়া শুরু হয়েছে। সেটি হচ্ছে, বাংলা বা বাংলায় ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দে মুসলিম নাম রাখা। অত্যন্ত শ্রুতিকটু এসব ‘বাংলা-সংস্কৃত’ নামের কারণে এখন মুসলিম পরিচিতি নিয়েও সমস্যা তৈরি হওয়ার ঘটনা ঘটছে। ভাষার স্বাভাবিক ধারায় ওইসব শব্দের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ হয়তো নেই। কিন্তু কোনো মুসলিমের নামে এমন সব শব্দের প্রয়োগ যথেষ্ট প্রশ্ন ও জটিলতার সৃষ্টি করে চলেছে। কিছু নামের শব্দ এখানে উল্লেখ করা যাক : সেণহা, ঐশ্বর্য, পরম, শুভ্র, আশীষ, বর্ষণ, মেঘ, শতাব্দী, শরৎ, শিমুল, সমর। একটু চোখ মেলে দেখলেই অনুভব করা যাবে এ জাতীয় শব্দে এখন বহু মুসলিম শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর নাম রয়েছে আমাদের সমাজে। অবশ্য পঞ্চাশ বছর আগেও এ জাতীয় কিছু কিছু শব্দ নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন : শিমুল, সজল, রতন, বাদল। তবে প্রবণতার মাত্রাটা ছিল কম। আর শব্দগুলো অত বেশি হিন্দুসমাজে ব্যবহৃত নাম-শব্দের কাছাকাছি তখন ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বহু কিশোর-কিশোরীর নাম শুনে প্রথমে ধর্মীয় পরিচিতি নির্ধারণের প্রশ্নে থমকে থাকতে হয়। বুঝতে একটু দেরি হয়- সে কি মুসলিম নাকি অমুসলিম? এরপর আরো কিছু কথা, আরো কিছু আচরণে সেটি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়। এছাড়াও অর্ধেক বাংলা অর্ধেক আরবী শ্রুতিকটু ও মিশ্রভাষার এক ধরণের মুসলিম নামেরও প্রচলন শুরু হয়েছে। যেমন, আশীষ-উর-রহমান, প্রভাষ আমীন, সুমন রহমান, সকাল আহমদ, সমর হোসেন। এসব নামেও পরিচিতি সংকটের পাশাপাশি হীনম্মন্যতার নতুন দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়। এসব নামের মধ্য দিয়ে আচরণ ও ভাবে এটাই প্রকাশ হয় যে, নামের জন্য ইসলামী ও আরবী শব্দ যথেষ্ট হয়নি। বাধ্য হয়েই বাংলা কিংবা সংস্কৃত শব্দের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে। এটাও সমীচীন হতে পারে না। নামে-শব্দে মুসলিম পরিচয়ের এই ইচ্ছাকৃত সংকট তৈরি কি খুব শোভন কিছু? খুব লাভজনক কিছু? মনে হয় না।
মুসলমানের ওপর মুসলিম নিধনকামী আগ্রাসী শক্তির হামলা নেমে এলে নামের অস্পষ্টতা দিয়ে বাঁচা যায় না। বসনিয়া-চেচনিয়ায় বাঁচা যায়নি। অপরপক্ষে দ্বীনী পরিচয়ে কোনো রহমত আসার কথা থাকলে এ অস্পষ্ট পরিচয়ের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। যেমন, ওই নামের কারণে অপরিচিত মানুষ সালাম দিতে দ্বিধায় পড়ে যায়। এটি একটি সরল ও সাধারণ হিসাব। নামের শব্দসংকট থেকে উদ্ভূত আত্মপরিচিতি সংকট মুসলমানকে ধর্মীয় ও জাগতিক নানা রকম সমস্যায় ফেলতে পারে।
চার
সমস্যার সবটুকু অতি বাংলায়ন প্রবণতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর একটি দিক ইংরেজির দিকেও গেছে। কারণ মুসলিম নামের বাংলায়ন ঘটার পেছনে সাধারণত যে মানসিকতা কাজ করেছে সেটি হচ্ছে প্রতিবেশ থেকে প্রভাবগ্রহণ, প্রচার ও পতিষ্ঠার অনুকরণ এবং আত্মপরিচিতিমূলক ঐতিহ্যবাদী আরবী-ফার্সী উর্দু শব্দ ব্যবহারে হীনম্মন্যতা। সে কারণে যেভাবে কিছু প্রবণতা বাংলা নামের দিকে গেছে, একইভাবে গেছে ইংরেজিসহ পশ্চিমা কোনো কোনো ভাষার শব্দের দিকেও। সেজন্যই জর্জ, লিংকন ইত্যাদি নাম-শব্দের কিছু ব্যবহারও বাংলাদেশী মুসলমানদের মাঝে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বেশি ঘটে সেটি হচ্ছে, পশ্চিমা সমাজে ব্যবহৃত এমন কিছু বাক্যের ব্যবহার যা মুসলিম বোধ-বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। যেমন : কোনো আক্ষেপ ও বিস্ময়সূচক ক্ষেত্রে বলা হয় -ও মাই গড! সুবহানাল্লাহ,
আলহামদুলিল্লাহ, ইন্নালিল্লাহ-এর পরিবর্তে ‘ও মাই গড’ বলায় কেবল ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ হয়- এতটুকুই নয়। বরং এ বাক্যে ব্যবহৃত ‘গড’ শব্দ সব অর্থে ইসলামী বিশ্বাসের ‘আল্লাহ’ কিংবা ‘রহমান’-এর প্রতিশব্দ নয়।
দ্বিতীয়ত নাম-শব্দে হোক কিংবা সাধারণ ভাষার ব্যবহারে হোক স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখা মুসলমানের জন্য অবশ্য-করণীয়। অপর কোনো জাতি অথবা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুকরণ-সেটা পোশাকে, আচারে, ভাষায় যে ক্ষেত্রেই হোক- মুসলামানের জন্য শোভন নয়। আঞ্চলিক জাতীয়তা, আঞ্চলিক ভাষা কিংবা ভূখন্ডগত অর্থে মাতৃভাষার দোহাই দিয়ে যেমন আমাদের ইবাদতের ভাষাবদল করা যায় না, তেমনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য-পরিচায়ক ভাষার ক্ষেত্রেও শব্দ ও ভাষা বদলের পথ ধরা সমীচীন হয় না। মুসলিম আত্মপরিচিতির সংকট তৈরির ক্ষেত্রে এ-জাতীয় ছোট ছোট শব্দের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। কিন্তু বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে আমাদের ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম-টিভি ও রেডিও এ জাতীয় সংকটের ক্ষেত্র তৈরিতে অতি-উৎসাহী দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
পাঁচ
হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক শিশু ও বয়স্কদের নাম বদলে দেয়ার ঘটনা রয়েছে। রয়েছে ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষা বদলে দেয়ার ঘটনাও। নাম বদলের ক্ষেত্রে কেবল শিরক নয়, অর্থগত অন্য বিষয়েরও ভূমিকা ছিল বলে জানা গেছে। সুন্দর-অসুন্দর মর্ম, ক্ষতিকর-কল্যাণকর অর্থ, ডাকার সময় অর্থের হেরফের হওয়ার আশংকা ইত্যাদি কারণেও নবীজী নাম বদলে দিয়েছেন।
মুসলিম শরীফের ২১৩৬/২১৩৭/২১৩৯ নম্বর হাদীস, তিরমিযী শরীফের ২৮৩৯ নম্বর হাদীস এবং সুনানে আবু দাউদের ৪০২৭ নম্বর হাদীস পাঠ করলে এ বিষয়ে কিছু নিদর্শন, নযীর এবং নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
সুতরাং বাংলাভাষাভাষী মুসলমান হিসেবে আমাদের করণীয় অনুধাবন করতে হবে। আমরা একটি সমৃদ্ধ ভাষার অধিকারী- এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ভাষার অধিকার আমাদেরই গৌরব ও কৃতজ্ঞতার একটি নিদর্শন। কিন্তু কোনো ভাষার সব শব্দ ওই ভাষাভাষীর সব পর্যায়ে, সব পরিস্থিতি ও পরিচিতির জন্য প্রয়োগসিদ্ধ ও প্রাসঙ্গিক হয় না। এ কারনেই আরবী ভাষায় অনেক শব্দ বদল করে ব্যবহার করতে সাহাবায়ে কেরামকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়ান করেছিলেন। এতে বোঝা যায় উপযোগিতা বিবেচনা করে সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক শব্দের প্রয়োগ ও যথোপযুক্ত ভাষারীতির ব্যবহারই কাম্য হয়। এ প্রয়োগই ভাষার গৌরবের জন্য সবচেয়ে সহায়ক ও কল্যাণকর। তাই আমাদের সবার উচিত, স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচিতি ধরে রাখার জন্য আল্লাহর দেয়া ভাষার যথোপযুক্ত প্রয়োগ ও ব্যবহার। শব্দে-ভাষায় এ স্বাতন্ত্র্যের উজ্জ্বলতার অনুসন্ধানই হোক আমাদের আমত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার। ষ