Rabiul Auwal 1436   ||   January 2015

প্রসঙ্গ আদিবাসী : কিছু ভাবনা কিছু শংকা

Mawlana Abdullah Bin Sayeed Jalalabadi

পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোর মত আমাদের এই বাংলাদেশেও তাদের মত করে আদিবাসী দিবস পালন এবং এই নিয়ে মাতামাতি, লেখালেখি, টেলিভিশনের টক-শো প্রভৃতি জোরেসোরেই চলছে। এইমাত্র গতকাল রাতে (২রা ডিসেম্বর) প্রচারিত সময় টেলিভিশনের- টক-শোটি শোনার সুযোগ হল। তাতে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বাঙ্গালীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকরূপে বিবেচনা, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘ সতের বছরেও উন্নতি না হওয়ায় তিন মাস পরেই সরকারের বিরুদ্ধে সন্তু লারমার উচ্চারিত অসহযোগ আন্দোলনের হুমকি, পার্বত্য চট্টগ্রামে দশ বারোটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি প্রভৃতি প্রসঙ্গের আলোচনা শুনলাম। শুনলাম পার্বত্য এলাকা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি প্রিয়বর উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর তাদেরকে সংখ্যালঘু বলে অভিহিত করে সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী নাগরিকদের পর্যায়ে উন্নীত করার সংকল্পের কথাও। সেই প্রেক্ষিতেই আমার এই ছোট্ট নিবন্ধটি।

গোড়াতেই বলে রাখি, আমি একজন মুসলমান, একজন আলেম এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে সম্মানিত  একজন। তিনি আমাকে ও আমার অনুজ মওলানা উবাইদুল্লাহ জালালাবাদীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইজ্জত-সম্মান করেছিলেন। সুতরাং আমার প্রতি কেউ তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত করলে তাকে করুণা করা ছাড়া উপায় নেই। বাঙ্গালী মুসলমানদের জননেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের মত করেই আমি বলব, আমি প্রথমে মুসলমান, তারপর বাঙ্গালী বা বাংলাদেশী। আমার মুসলমান, আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ পরিচয় বিসর্জন দিয়ে আমাকে বাঙ্গালী হওয়ার  উপদেশ দিলে আমি তা কোনোমতেই গ্রাহ্য করব না। মুসলমান অন্য কারো এরূপ চিন্তার নৈরাজ্যে বসবাসকেও আমি মানসিক দৈন্য ও হীনম্মন্যতা বলে মনে করি।

আলোচ্য ব্যাপারে আমার সর্বপ্রথম বক্তব্য হচ্ছে, পাশ্চাত্যের যেসব উন্নত দেশে আদিবাসী দিবস পালিত হয়ে থাকে, তাদের তুলনায় আমাদের গোটা দেশই আদিবাসী পর্যায়ের অনুন্নত দেশ। তাদের উন্নতদের তুলনায় তাদের আদিবাসীদের অনগ্রসরতা স্পষ্টত দৃশ্যমান। তাই তাদের অনগ্রসরতা, বঞ্চনা ও  অধিকার খর্বের বিষয়টা অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে। আর আমরা? আমাদের অতি ভাগ্যবান স্বল্পসংখ্যক লোক ছাড়া সকলেই তো বঞ্চিত অনগ্রসরদের তালিকায়-যাদের শতকরা আশিজনই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পর্যায়ের অভাবী লোক। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের দিক থেকে অধিকাংশই  এহেন হীন পতিত অবস্থায় জীবন যাপন করছে- যারা স্বদেশে বঞ্চনার শিকার হয়ে বে-দিশা হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সোনার হরিণ ধরবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিদেশযাত্রার নেশায় দালালদের হাতে লাখ দুলাখ টাকা তুলে দিয়ে সাগরপথে মালয়শিয়ায় পাড়ি জমায়। কখনো এরা সাগরে ডুবে মরে, কখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে স্বদেশের কারাগারে পঁচে, আবার ভাগ্যগুণে বিদেশের সাগরতীরে গিয়ে পৌঁছতে সমর্থ হলেও বনে-জঙ্গলে গাছের পাতা খেয়ে খেয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকে। কখনো এরা বিদেশী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ঐ দেশের কারাগারে ঠাঁই পায়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট চাকুরী পাওয়া গেলেও এরা অবৈধ অভিবাসী, পুলিশের কাছে নালিশ জানাবার সুবিধাবঞ্চিত বলে নিয়োগকারীরা তাদেরকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয় না। এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের ধনী মুসলিম দেশগুলোতেও তাদের এ সমস্যা অহরহই  হচ্ছে।

যেসব ভাগ্যহত শ্রমজীবি বা চাকুরী অন্বেষীর কথা উপরে বর্ণিত হল, এরাও কিন্তু এদেশের সর্বহারা পর্যায়ের লোক নয়। এদের কিছু জমিজমা ছিল বলেই তা বিক্রী করে দালালকে টাকা দিতে পেরেছে। যাদের অতটুকু সম্বলও নেই, তারা দালালকে টাকা দেবে কোত্থেকে? দেশে বসবাসকারী পোশাককর্মী প্রভৃতি নারী শ্রমিকদের তো শতকরা পঁচাশি ভাগই যৌন হয়রানির শিকার বলে আজই একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে একটি মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে। আর আমাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যারা এনজিও খুলে দীর্ঘকাল ধরে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে সেসব বিদেশীদের তাদের হেফাযতে থাকা এনজিও মহিলাকর্মীদের মুখে তুলে দেয়া শ্লোগানই তো হচ্ছে এই যে ‘‘যার দেহ  তার মন, স্বামী আবার কে?’’  ঐ বিদেশী এনজিও কর্মকর্তাদের অধিকাংশই হচ্ছে এমন সব সমাজ থেকে আসা লোকজন

যারা তাদের পিতৃপরিচয় নিশ্চিতভাবে জানে না। তাই তারা  এদেশের পারিবারিক ব্যবস্থা তুলে দিয়ে  তাদেরই মত পিতৃপরিচয়বিহীন প্রজন্ম গড়ে তাদের  তথাকথিত শান্তির ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে আমাদেরই ভূখন্ডে একটি নতুন পূর্বতিমূর প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। ঐ সব এনজিওরা যে সমভূমির কোটি কোটি দরিদ্র জনতাকে উপেক্ষা করে তথাকথিত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাসমূহে সেবা বিতরণে অধিকতর আগ্রহী এর মূলেও এ সত্যটাই অত্যন্ত সক্রিয় এবং তা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশ বলুন, অথবা ভারতই বলুন, ঐসব এনজিওদের চারণক্ষেত্র আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাসমূহে। ধর্মান্তরিতকরণের বিগত পঞ্চাশ বছরের পরিসংখ্যান একটু খতিয়ে দেখলেই সে দৃশ্যটি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। এ জন্যে ভারত সরকার অনেক পূর্বেই বিদেশী এনজিওদের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে এবং অনেক স্থানেই তাদের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশেও সে সময় এল বলে। সে সতর্কতা এখনই অবলম্বন না করলে আমাদেরকেও আমাদের পার্বত্য এলাকায় একটা পূর্ব তিমুরের মত খ্রিস্টীয় রাষ্ট্রের জন্যে স্থান করে দিতে হবে। এজন্যে বিশ্বমোড়লদের পৃষ্ঠপোষকতারও অভাব হবে না; আর তাদের প্রভাবকে অগ্রাহ্য করার মত মরদ্ বা লৌহমানবী নেত্রী এদেশে নেই। তারপর আমাদের অবস্থা যে প্রাচীন আমলের সমৃদ্ধ ফিলিস্তীন রাষ্ট্রের হাজার হাজার পুরনো ঐতিহ্যের অধিকারী নাগরিকদের মত হবে না, যা বৃহৎ শক্তিবর্গের অবৈধ সন্তান ইসরাইলের মোকাবেলায় তাদের হয়েছে- তা কে বলবে?

আদিবাসী শব্দটার মানে কী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অষ্ট্রেলিয়ার মত আজকের বড় বড় ধনী রাষ্ট্রের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব যেহেতু বহিরাগতদের হাতে তাই সে সব রাষ্ট্রের উপেক্ষিত আদিবাসীদের ক্ষোভ বা অভিমানের সঙ্গত কারণ আছে। এমন কি ভারতবর্ষেও বহিরাগত আর্যরা এসে সবকিছু দখল করে নিয়ে সেখানকার আদিবাসী দ্রাবিড়, তেলেগু প্রভৃতি অনার্যদেরকে বনে জঙ্গলে ঠেলে দেয়ায় সেখানেও আদিবাসীদের ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মগদেরকে আমরা আদিবাসী বলছি, তারা কি আদৌ এদেশের আদিবাসী? এদের আদি নিবাস তো আরাকান বা ব্রহ্মদেশে! মাত্র দুশ বছর পূর্বে তারা এদেশে এসে আমাদের পাহাড়ী এলাকায় বসবাস শুরু করেছে। তারও অনেক আগে থেকে যারা আরাকানে বসবাস করে আসছে, পাঁচশ বছর থেকে হাজার বছর পূর্ব থেকে-সেই আরাকানী মুসলমানদেরকে তো সে দেশের আদিবাসী এমন কি সাধারণ নাগরিকরূপেও গণ্য করা হচ্ছে না! আরাকানী মুসলমানরা যদি মায়ানমারের আদিবাসী বলে স্বীকৃতি না পায়, না পায় সাধারণ নাগরিক অধিকারও, তাহলে ঐ দেশ থেকেই আসা মগরা এখানে আদিবাসী স্বীকৃতি পাবে কোন্ যুক্তিতে? কই,  এ ব্যাপারে তো আমাদের উদারমনা, গণতন্ত্রমনা, মানবিক বোধসম্পন্ন বলে কথিত বুদ্ধিজীবিদের কোনো মাথাব্যথা দেখি না! তাহলে তাদের এই খন্ডিত ও ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন বিশ্লেষণসমূহকে আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে কেন মনে করব না? এঁরা কারো অর্থ ও স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছেন না তো? কাশ্মীরের এক কোটিরও বেশি নাগরিকের মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে তো তাদের মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায় না! কাশ্মীরী ও আরাকানী রোহিঙ্গারা ধর্মে মুসলমান, এটাই কি তাদের মানবীয় অধিকারবঞ্চিত রাখার যুক্তি? তাহলে এজাতীয় বিশ্লেষকরা ধর্মনিরপেক্ষ বা মনবিকবোধসম্পন্ন এমনটি মনে করার কী যুক্তি থাকতে পারে?

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষই এক আদমের সন্তান- একে অপরের সহোদরতুল্য। সে আদিবাসী, নাকি অভিবাসিত, সাদা না কালো, ধনী না নির্ধন, শিক্ষিত নাকি অশিক্ষিত, তার ধর্ম বা মতবাদ কী- তা বিবেচ্য বিষয় নয়। মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই তাকে দেখতে হবে। তাকে পূর্ণ মানবাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের যারা দায়িত্বশীল, তাঁদেরকে হয় এ দায়িত্ব নিতে হবে, নতুবা এ দায়িত্ব থেকে তাদের সরে দাঁড়াতে হবে।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ পড়ে, হযরত ওমর রা.-এর একটি প্রসিদ্ধ বাণী, তিনি  বলেছিলেন, যদি একটি গাধাও ইরাকের রাস্তায় পা পিছলে পড়ে যায় সে জন্যও কাল কেয়ামতে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর ব্যাপারেই যদি রাষ্ট্রের এত দায়িত্ব থাকে, তাহলে আদমসন্তান সে যে জাতির বা ধর্মের লোক হোক না কেন তার প্রতি যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কত বেশি তা বলাই বাহুল্য।

ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক নানা কারণে বিভিন্ন জনপদের অধিবাসীদের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকে। সে পার্থক্যকে কমিয়ে এনে প্রত্যেকের নাগরিক ও মানবীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই রাষ্ট্রের কাজ। এরা পাহাড়ী হলে তাদের দিকে বেশী নজর দিতে হবে, আর সমতলে, চরাঞ্চলে বা সাগরপারে বসবাসকারী হলে তাদেরকে উপেক্ষা করতে হবে, এটি সুস্থ চিন্তা ও মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে একদা একদল বেদুঈন এসে হাজির। তাদের চোখ কোটরাগত, দেহে মলিন-ছিন্ন বস্ত্র। আল্লাহর নবী সাহাবাগণকে লক্ষ্য করে এক উদাত্ত ভাষণে দিলেন এবং তাদেরকে দান করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করলেন। সাহাবীগণ সাথে সাথে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে এত বেশী খাদ্যদ্রব্য ও পোশাকসামগ্রী নিয়ে এলেন যে, একদিকে খাদ্যের স্তুপ এবং অপরদিকে বস্ত্রের স্তুপ জমে উঠল। তিনি এ সব তাদেরকে দান করে বিদায় করলেন। আল্লাহর নবীর মুখ সেদিন আনন্দে ডগ মগিয়ে উঠেছিল! (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৭)

আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে হাতিরঝিলে আঁকা বাঁকা বিলাসী পুল বানাই এবং নিয়ন বাতি দিয়ে এলাকাকে আলো ঝলমল করি, অথচ পাঁচ বছরের অধিক কাল ধরে সিডর আক্রান্ত এলাকার ঘরবাড়িহারা প্রায় এক কোটি লোকের ঘরবাড়ি তৈরী করে দেয়া দূরে থাক, তাদের সাগরের নোনাজল রোধের বেড়িবাঁধটিও সংস্কার করি না! পাহাড়ের লোকদের কথা আমরা কখন ভাবব? অথচ আমাদের বার্ষিক বাজেট কয়েক লাখ কোটি টাকা!

একটি বাস্তব সত্য হল, আমাদের পাহাড়ী উপজাতীয়রা বেদুঈন-সংস্কৃতির লোক, তাদের জীবন হচ্ছে যাযাবরের জীবন। প্রথম তারা যখন এদেশে আসে, তখন হয়ত ওরা পাঁচ হাজারও ছিল না, আজ প্রায় দশ লাখ। তখন পাহাড়ে বিস্তর জঙ্গল ছিল, জনবসতি ছিল না। আরবের বেদুঈনরা যেমন এক মরুদ্যানের সব গাছপাতা শূন্য করার পর অন্য মরুদ্যানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাত এরাও তেমনি এক এলাকায় জুম চাষ করে তারপর সব পুড়িয়ে দিয়ে এলাকা বৃক্ষপত্রশূন্য করে অপর এলাকায় চলে যেত। তারপর বেশ কয়েকবছর পর যখন অঞ্চলটি আবার আবাদযোগ্য হত তখন আবার ফিরে আসত এবং অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলত। আজ আর সে দিন নেই। বাঙালীরা স্থায়ী বসবাসে অভ্যস্ত, তাই তাদের চাষবাসের জন্যে কিছু জমিজমারও দরকার হয়। এই সংস্কৃতিতে ওদেরকেও ফিরিয়ে আনতে হবে। নতুবা ওদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য যেমন নিশ্চিত হবে না, তেমনি আমাদের ষোল- সতের কোটি মানুষ যেখানে গিজগিজ করছে, মাথা গোঁজার মত পর্যন্ত অনেকের ঠাঁই নেই, আমাদের জনগণকেও বলতে পারি না- তোমরা এখানে থেকো, ওখানে যেয়ো না! ওদের তো সমতলে ঘরবাড়ী করতে বা জমি কিনতে কেউ মানা করে না! সরকারী চাকুরীবাকুরীতেও তারা আজকাল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে! এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের কোনো এলাকাকেই কারো জন্যেই নিষিদ্ধ বা ক্রয়নিষিদ্ধ করা আদৌ উচিত হবে না।

আরো কয়েকটি ব্যাপার চিন্তাভাবনার দাবী রাখে। কমবেশি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের আমাদের এই বাংলাদেশে ষোল-সতের কোটি লোকের বাস। তথাকথিত আদিবাসি অধ্যুষিত পার্বত্য এলাকার আয়তন বাংলাদেশের একদশমাংশ। তাদের জনসংখ্যা মূল ভূখন্ডের জনসংখ্যার প্রায় পৌনে দুশ ভাগের একভাগ। এ অবস্থায় আমরা কি আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমির এ বিশাল এলাকা কেবল ঐ বিদেশ থেকে আগত পাহাড়ী জনতার জন্য খাসভাবে ছেড়ে দিতে পারি?

বৃটিশ আমলে বা তারও পূর্বে যখন এ দেশের জনসংখ্যা বর্তমানের ১৫/২০ ভাগের একভাগ ছিল, আর শাসকদের পক্ষে ঐ পার্বত্য জনতার নাগরিক সুযোগ সুবিধা দেয়ার সুযোগ সামর্থ্য বা আগ্রহও ছিল না, তখন না হয় তাদেরকে নিজেদের মত তাদের এলাকায় ছেড়ে রাখা হয়েছে। এখন যেখানে সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে, রাষ্ট্রের আয়তন বা গন্ডি অতি সীমাবদ্ধ হয়েছে, আমরা সরকারীভাবে অনেকাংশেই তাদের দেখাশোনা করতে পারছি, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করতে পারছি; স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল বানিয়ে দিতে পারছি, বহিরাক্রমণ থেকে তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা করে দিচ্ছি, তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির বাজারজাতের সুবিধা করে দিচ্ছি, এ অবস্থায় ১৭০ ভাগের ১৬৯ ভাগ নাগরিকই কি ঐ বিশাল এলাকা থেকে সে এলাকার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কোনো অংশিদারিত্বই পাবে না? এরূপ চিন্তা করলে ভুল বা অপরাধ হবে?

অথচ আমাদের এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মুখের গ্রাসের একটি বড় অংশ দিয়েই তাদের উন্নতি অগ্রগতির তাবৎ ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা যেমন তাদের সুখ-দুখের সাথী তেমনি তাদেরও তো আমাদের এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বৈধ অংশিদারিত্বটি মেনে নিতে হবে। এখানে দুশ আড়াইশ বছর পূর্বের আইন কীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে?

পার্বত্য এলাকায় সেবাকর্ম সম্পর্কে আমাদের সুচিন্তিত অভিমত হচ্ছে, বহিরাগত কোনো এক বিশেষ ধর্মের বা সংস্কৃতির লোকজনকে সেবার নামে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির বীজ বুনবার উর্বর চারণক্ষেত্ররূপে আমরা এই ভূমিকে ছেড়ে দিতে পারি না। বিশেষত সেই ধর্ম ও সংস্কৃতি যদি সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের কালিমাযুক্ত ইতিহাসের উত্তরাধিকারী হয়। কেননা পূর্ব তিমূর ও পূর্ব নাইজেরিয়ার উদাহরণ আমাদের সম্মুখে রয়েছে। উদাহরণ রয়েছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে বহিরাগত ইহুদিদের আগমনে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির ইতিহাসও। বৈরুত ও ম্যানিলার নামও এ তালিকায় আসে। আমার আলআযহারের উস্তায ড. আব্দুল ওয়াদুদ শালাবী আমাদের ক্লাশে একদিন বলেছিলেন, ফিলিপাইনের গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজধানীর নাম ছিল ফী আমানিল্লাহ, তার থেকেই এই মেনিলা শব্দের উৎপত্তি। বৃহত্তর জনতার অধিকার খর্বকারী এজাতীয় স্বর্ণলতার সমৃদ্ধির তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে চোখ বুজে থাকা কখনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।  এটা কোনোমতেই মেনে নেয়া যায় না। কোনো দেশপ্রেমিক ব্যক্তিই তার প্রিয়জন্মভূমির ব্যাপারে এটা মেনে নিতে পারে না।

পরিশেষে আমার বক্তব্য হচ্ছে, পাহাড়ী-বাঙালি বিভেদ সৃষ্টি করে বা সে বিভেদকে পুঁজি করে কারো কারো ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে, বৃহত্তর নাগরিক সমাজের তাতে কোনোই লাভ হবে না। তাই বাঙালি-পাহাড়ী নির্বিশেষে প্রত্যেকটি নাগরিককেই যাতে নাগরিক ও মানবীয় প্রতিটি সুযোগ সুবিধা পৌঁছানো যায়, সেভাবেই আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। বৈষম্যমূলক কোনোরূপ চিন্তাভাবনা মোটেই সুস্থ বুদ্ধির লক্ষণ নয়। 

 

advertisement