আমেরিকা আবিষ্কার : একটি সাহসী উচ্চারণ
গত ১৭ নভেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খুব গরীবানা হালতে (ভিতরের পাতায় সিঙ্গেল কলামে) একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার মুসলিমদের এক সভায় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন, আমেরিকা মহাদেশ কলম্বাস নয়, মুসলমানরাই প্রথমে আবিস্কার করেছেন। কলম্বাস তার ডায়েরিতে লিখেছেন, কিউবার একটি পাহাড়ের উপর তিনি একটি মসজিদ দেখতে পেয়েছিলেন। এরদোগান ঐ পাহাড়টিতে একটি মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।
বিবিসি এরদোগানের এ বক্তব্য ‘সটীকা’ প্রকাশ করেছে! টীকাটি হচ্ছে, কোনো কোনো গবেষকের মতে, কলম্বাসের ঐ মন্তব্যের অর্থ, পাহাড়টি তার কাছে মসজিদের মতো মনে হয়েছিল!
কলম্বাস মুসলিম ছিলেন না, সুতরাং তার স্মৃতিতে ‘গীর্জা’ না এসে ‘মসজিদ’ কেন আসবে তা এক সাধারণ প্রশ্ন! যাহোক, বিশেষজ্ঞগণ তাদের মতামত প্রকাশ করলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। এখানে আমরা শুধু একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আর তা এই যে, মুসলিম নেতৃত্ব ও সুশীল সমাজের কোথাও কোথাও এখনো কিছু প্রাণের স্পন্দন আছে। সংখ্যায় ও শক্তিতে খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও এখানে সেখানে কিছু সপ্রাণ মানুষের বিচরণ যে নেই তা নয়। সাধারণ মুসলমানের কর্তব্য, তাদের সাহসী অবস্থানগুলো সমর্থন ও কৃতজ্ঞতার দ্বারা উৎসাহিত করা।
মুসলিম-সমাজের নেতৃত্ব এখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু মেরুদণ্ডহীন লোকের হাতে। ফলে ইসলাম ও মুসলমানের বিশেষ প্রসঙ্গগুলোতে তাদের অমার্জনীয় নির্লিপ্ততা ও ন্যক্কারজনক হীনম্মন্যতার দৃশ্য দেখে যাওয়াই এখন মুসলমানের নিয়তি। এ অবস্থায় দূর দেশের কোথাও কোনো একজন সাহসী মুসলিমের কণ্ঠে আত্মমর্যাদার ধ্বনি নিঃসন্দেহে পরম শান্তির কারণ।
একটা সময় ছিল তখন দ্বীনদার জনসাধারণ ও দ্বীনী শিক্ষা বিস্তারে সরাসরি জড়িত উলামা-মাশায়িখ ছাড়াও, অন্যান্য শ্রেণির মাঝেও ইসলাম, প্রিয়তার অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যেত। মুসলিম ভূখণ্ডর শাসক ও ক্ষমতাসীনদের থেকেও এমনসব উদাহরণ প্রকাশিত হত যা তাদের জাতীয় তথা মুসলিম পরিচয়ে গৌরব-বোধের সাক্ষর বহন করত। আর খাইরুল কুরূন তথা ইসলামের শ্রেষ্ঠ যুগের কথা তো বলাই বাহুল্য। সেই আলোকিত সময়ের সৌভাগ্যবানেরা তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ঈমানের দীক্ষা। তাই একমাত্র আল্লাহই ছিলেন তাদের রব। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ছিলেন তাদের ‘উসওয়া’। আর ইসলামই ছিল তাদের দ্বীন। আল্লাহ ছাড়া তাঁদের আর কোনো প্রভু ছিল না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া আর কোনো ‘উসওয়া’ ছিল না এবং ইসলাম ছাড়া আর কোনো আদর্শ ছিল না। ঈমানের এ মহাসম্পদে তাঁরা এমনই সম্পদশালী ছিলেন যে, জগতের আর সব কিছু তাদের কাছে তুচ্ছ ও নগণ্য হয়ে গিয়েছিল।
তাঁরা পরস্পর একত্র হয়ে এজন্য আল্লাহর হামদ ও শোকর করতেন যে, আল্লাহ তাদের ইসলামের সম্পদে সম্পদশালী করেছেন। আর শুধু নিজেদের সমাবেশে নয়, সময়ের প্রবল-প্রতাপ সভ্যতাগুলোর কেন্দ্রভূমিতে দাঁড়িয়েও তাদের দীপ্ত ও তৃপ্ত উচ্চারণ ছিল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমরা মুসলিম!’
হাবশা-রাজা নাজাশীর সামনে আশ্রিত মুসলিম দলের নেতা হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব রা.-এর বক্তৃতা কিংবা যুদ্ধের ময়দানে রোম-সম্রাটের প্রতিনিধির সামনে মুসলিম সেনাপতি মুগীরা ইবনে শো’বা রা.-এর ভাষণ, সব জায়গায় সেই একই ধ্বনি, একই ব্যঞ্জনা- সেই ঈমান ও ইয়াকীন, বিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাস, সেই প্রাচুর্য ও প্রশান্তি।
হায়! সালাফের এই উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আজ আমরা কত নিঃস্ব, কত রিক্তহস্ত! কুরআন ও সুন্নাহ তো আজো সুরক্ষিত, ইসলামের শিক্ষা আজো অবিকৃত, শুধু নেই সেই ঈমান ও ঈমানের তৃপ্তি, সেই বিশ্বাস ও বিশ্বাসের দীপ্তি।
এমনকি সময় ও আদর্শের দূরত্বের কারণে আজ মুসলিম জাতীয়তাবোধ ও আত্মপরিচয়ের অভিমানটুকুও বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে।
আত্মমর্যাদাবোধ তো একজন সুস্থ মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঈমানী দুর্বলতার কারণে কারো মধ্যে যদি ‘ঈমানী গাইরত’ না-ও থাকে, একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে অন্তত আত্মমর্যাদাবোধ তো থাকতে হবে। যে ব্যক্তি মুসলিম নাম-পরিচয় ধারণ করেছে, মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে এবং মুসলিম পরিবারে আত্মীয়তা করেছে, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় মুসলমানদেরই যে পাশে পেয়েছে, পর্বে-উৎসবে, জীবনের নানা অনুষঙ্গে মুসলিম-সমাজের একজন হিসেবেই জীবন যাপন করেছে, এরপরও, এত বন্ধন ও সম্বন্ধের পরও যদি এই ধর্ম, এই সমাজের প্রতি তার কিছুমাত্র মমতা না থাকে, এই সমাজ ও ধর্মের অবমাননা যদি না হয় তার নিজের অবমাননা তাহলে এ ব্যাক্তিকে আর যা-ই বলা যাক, একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ বলা যায় কি? বলা যায় না। কারণ এতখানি ভীরুতা ও নির্জীবতা কিংবা হীনতা ও হীনম্মন্যতা কোনো সপ্রাণ মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, মুসলিম-সমাজে বিভিন্ন নামে ও শিরোনামে একদিকে চলছে অন্যায় অহমিকার শিক্ষা এবং বিভেদ-বিভক্তিকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা। অন্যদিকে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও উদারনৈতিকতার নামে দেয়া হচ্ছে ইসলাম ও মুসলিম বিষয়ে চরম হীনম্মন্যতা ও চূড়ান্ত নির্লিপ্ততার দীক্ষা। এ পরিস্থিতিতে কোনো মুসলিমের কণ্ঠ যখন সোচ্চার হয় ইসলাম ও মুসলিমের উপর কৃত কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিংবা ধ্বণিত হয় কোনো সত্য-সাহসী উচ্চারণ তখন তাকে সম্মান জানাতে ইচ্ছে করে। ঈমানী গাইরত থেকে হলে মুমিন হিসেবে, নতুবা একজন সুস্থ ও পরিণত মানুষ হিসেবে। এ কারণেই এরদোগানের এ সামান্য বক্তব্যও অসামান্য তাৎপর্যপূর্ণ।
রজব তাইয়েব এরদোগান! আপনাকে ধন্যবাদ।