পর্দানশীন: মৃত্যুর স্মরণ - (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
Mawlana Mufti Taqi Usmani
[হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সফরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ’০৯ ঈ. সুন্নত চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে মহিলাদের উদ্দেশে এই বয়ানটি করেছিলেন। তা রেকর্ড করা হয়েছিল। পরে তা কাগজে লেখা হয় ও অনুবাদ করা হয়। লিখেছেন মাওলানা সায়ীদ আহমদ, অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবদুল্লাহ ফাহাদ। আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।]
আশ্চর্য দর্শন এই যে, মহিলা যখন বিমানে বিমানবালা হয়ে মানুষের সেবা করে, তাদের সামনে ট্রে সাজিয়ে পরিবেশন করে এবং তাদের কামাসক্ত দৃষ্টিতে বিদ্ধ হয় তখন তা হয় ‘স্বাধীনতা’। পক্ষান্তরে সে যদি নিজের ঘরে নিজের জন্য, স্বামী ও সন্তানের জন্য, পিতামাতার জন্য খাবার রান্না করে তাহলে তা পরাধীনতা।
এই আশ্চর্য দর্শনে নারীকে ভুলিয়ে বণিক সমপ্রদায় তাকে ব্যবহার করেছে বাণিজ্যিক স্বার্থে। তাকে বানানো হয়েছে প্রদর্শনীর বস্তু। সেলসগার্ল দরকার তো মহিলা হতে হবে, পণ্য বিক্রির প্রয়োজন তো মহিলারই বিক্রি করতে হবে। যেন তার রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষ পণ্য ক্রয় করে। তার প্রতিটি অঙ্গ খোলা বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে। এমন কোনো বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে না, যাতে নারীর ছবি নেই। নারীকে পণ্য বানিয়ে নিজেরা অর্থ উপার্জন করছে। এর নাম দিয়েছে নারী স্বাধীনতা!
প্রিয় বোন, আমি এই নিবেদন করতে চাই যে, আল্লাহর ওয়াস্তে এই প্রতারণার শিকার হয়ো না। আল্লাহ তাআলা তোমাকে যে মর্যাদা দান করেছেন তা অনুধাবন কর। তোমার মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যত তৈরি হয়। তোমার কোলে লালিত-পালিত হয় উম্মাহর আগামী প্রজন্ম।
নারীকে বাইরে বের করার জন্য ভদ্রতার ভেক ধারণ করা হয়েছে। বোঝানো হয়েছে যে, মুসলমানরা একাধিক পত্নী রাখা বৈধ মনে করে। অথচ আমাদের দেখ, আমরা কত ভদ্র! আমাদের কারো একাধিক পত্নী নেই! এভাবে ভদ্রতার ছলে নারীকে বাইরে টেনে এনে, পথে নামিয়ে, হোটেলে বসিয়ে অবস্থা এমন করেছে যে, ঘরের স্ত্রীও এখন আর ঘরে নেই, সেও এখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতি স্থানে নতুন নতুন পত্নী সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিটি দাওয়াত, প্রতিটি ডিনার, প্রতিটি হোটেল সর্বত্রই একাধিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে। ফলে অবৈধ যৌন সম্পর্ক ব্যাপক হয়ে গেছে, বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এখন লোকেরা বলে, বিয়ের কী প্রয়োজন? পশ্চিমা বিশ্বে এমন রাষ্ট্রের সংখ্যাই বেশি যার নাগরিকদের অধিকাংশই পিতৃ পরিচয়হীন।
যেহেতু পশ্চিমা প্রতারক-গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য হল নারীকে বাইরে বের করে আনা এবং তাকে অবাধ ভোগের বস্তুতে পরিণত করা তাই তার পোশাকও তারা নির্বাচন করে দিয়েছে। পোশাক যত আঁটসাঁট ও উন্মুক্ত হবে ততই ফ্যাশনেবল হবে!
আফসোসের বিষয় এই যে, পশ্চিমা সংস্কৃতির ছায়া আমাদের দেশের নারীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বাইরে বের হোক বা না হোক তাদের এমন পোশাক চাই, যা পশ্চিমারা পরিধান করে এবং যা হবে সংক্ষিপ্ত ও আঁটসাঁট। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, দুনিয়ার অনেক বস্ত্র পরিধানকারিনী আখিরাতে বিবস্ত্র হবে। অর্থাৎ এমন অনেক মহিলা আছে যারা পোশাক পরিধান করলেও আখিরাতের বিচারে তারা বিবস্ত্র। আমাদের দেশেও তাদের পোশাকের অনুকরণ শুরু হয়ে গেছে।
নারীকে আল্লাহ তাআলা এত মূল্যবান করে সৃষ্টি করেছেন, যা সংরক্ষণ উপযোগী। আর এজন্য আল্লাহ তাআলা তার পর্দার বিধান দান করেছেন। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবে পর্দা বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমাদের চিন্তা করা উচিত যে, আমরা কি দুনিয়াতেই থেকে যাব, না কখনো মৃত্যুবরণ করতে হবে? কখনো আল্লাহ তাআলার সামনে জবাবদিহী করতে হবে? তাই পর্দাহীনতার পরিবেশ দূর করা জরুরি।
মহিলাদের দায়িত্ব হল নিজেও মুসলমান হওয়া এবং সন্তানকেও মুসলমান বানানো। তার প্রতিটি কথা ও কাজে ঈমান ও ইসলামের প্রতিফলন থাকা চাই। তাকে সত্যবাদী হতে হবে। তার মুখে কখনো মিথ্যা উচ্চারিত হবে না। গীবত-শেকায়েত হবে না, গালিগালাজ হবে না। তার প্রতিটি কর্ম ও আচরণ সন্তানের জন্য আদর্শ হবে।
এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে দেখলেন, তিনি সন্তানকে নিজের কাছে ডাকছেন। কিন্তু বাচ্চাটি আসছে না। তখন সাহাবী বললেন, এস বৎস, আমার কাছে এস। আমি তোমাকে একটি জিনিস দিব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীকে তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তো বাচ্চাটিকে কিছু দেওয়ার কথা বলেছ। বাস্তবেই কি কিছু দেওয়ার ইচ্ছা করেছ? সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে একটি খেজুর ছিল। আমি ইচ্ছা করেছি যে, তাকে খজুরটি দিব। তখন নবীজী বললেন, যদি বাস্তবেই তোমার এই ইচ্ছা থাকে তাহলে তো ভালো। কিন্তু যদি শুধু বাচ্চাটিকে প্রলোভন দেখানোর জন্য বলে থাক তবে তা গুনাহর কাজ।’
এটি দ্বিগুণ গুনাহ : একদিকে ওয়াদা ভঙ্গের গুনাহ। দ্বিতীয়ত বাচ্চাটিকে এই শিক্ষা দেওয়া হল যে, ওয়াদা ভঙ্গ করা খারাপ বিষয় নয়। সে মনে করবে, আমার পিতা, আমার বড়রাও ওয়াদা করে তা পূর্ণ করে না। অতএব এতে কোনো অসুবিধা নেই। ফলে ভবিষ্যতে সেও ওয়াদা ভঙ্গ করবে। আর সে যতগুলো ওয়াদা ভঙ্গ করবে তার গুনাহ ওই পিতামাতার আমলনামাতেও লেখা হবে।
সুতরাং সন্তানের সঙ্গে মাতা-পিতার প্রতিটি আচরণের সময় লক্ষ রাখতে হবে যে, তাদের আচরণটি যেন সত্য হয়। মিথ্যা না হয়। মিথ্যা বলা হলে সন্তানের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হবে যে, মিথ্যা বলা খারাপ কিছু নয়। আমার মাতা-পিতাও মিথ্যা বলেন। তাই আমিও যদি মিথ্যা বলি তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। এসব তাকে মিথ্যুক বানিয়ে দিবে।
আর গীবত তো এমন একটি বিষয়, যাতে পুরুষ-মহিলা সবাই লিপ্ত। আল্লাহ তাআলা আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের কোনো মজলিস এমন পাওয়া কঠিন, যাতে গীবত হয় না। সম্ভবত পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এর প্রবণতা একটু বেশি। অথচ গীবত হল নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো অপরাধ। কত বড় অপরাধ! কত বড় গুনাহ! এখন যদি বাচ্চাদের সামনে এই কাজ করা হয় তাহলে তারা মনে করবে, গীবত করতে কোনো দোষ নেই।
প্রিয় মা-বোনেরা, আমরা আজ এখানে একটি মহৎ দ্বীনী উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছি এবং দ্বীন সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করেছি। আসুন আমরা চিন্তা করি যে, আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি? আমরা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। আল্লাহ তাআলার বিধান অনুযায়ী জীবন-যাপনের জন্য এসেছি। এমন যেন না হয় যে, দুনিয়ার চাকচিক্যে আত্মবিস্মৃত হয়ে এবং দুনিয়ার প্রাচুর্যে মত্ত হয়ে এ উদ্দেশ্যকেই ভুলে গেলাম। এই চিন্তাটা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া জরুরি। যেদিন এই চিন্তা সৃষ্টি হবে সেদিনটি হবে আমাদের জীবনের একটি উত্তম দিন এবং একটি ইতিবাচক বিপ্লবের দিন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)