দাঈর গুণ
وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ، وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ، فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ، وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ، الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ، وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ، إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উপরে সূরা শূআরার কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে ইসলামের প্রথম দিকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মক্কায়। ইসলামের দাওয়াত শুরু করেছেন। এসময় আল্লাহ পাকের ইরশাদ, আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন। আর আপনি বিনয়ী হোন আপনার অনুসারী মুমিনদের সাথে। আর তারা যদি আপনার অবাধ্য হয়, তাহলে বলে দিন, তোমাদের কাজ কর্মের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর আপনি ভরসা করুন পরাক্রমশালী করুণাময় (আল্লাহ)র উপর, যিনি আপনাকে দেখেন যখন আপনি দাঁড়ান এবং দেখেন সিজদাকারীদের সাথে আপনার উঠাবসা। নিঃসন্দেহে তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।-সূরা শুআরা ২৬ : ২১৪-২২০
আল্লাহ পাক এ আয়াতগুলোতে কয়েকটি মৌলিক কথা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন। যে কথাগুলো দাওয়াতের ক্ষেত্রে খুবই জরুরী এবং একজন মুমিনের যে কথাগুলো জানা থাকা দরকার।
নিকটাত্মীয়দের ঈমানের দাওয়াত
প্রথম কথা হল, আপনার নিকত্মীয়দের ঈমানের কথা বলুন, ইসলামের কথা বলুন। ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদের কী ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে, সে ব্যাপারেও সতর্ক করুন।
এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হল তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে আরোহণ করলেন এবং আওয়াজ দিলেন- يَا صَبَاحَاهْ বিপদ! বিপদ! এ আওয়াজ শোনামাত্রই গোত্রের লোকেরা পাহাড়ের পাদদেশে হাযির হয়ে গেল। এটা ছিল আরবের রীতি। আপনারা জানেন আরবদের মাঝে গোত্রীয় শত্রু তা-মিত্রতা খুব প্রকট ছিল । কিছু গোত্রের সাথে কিছু গোত্রের মিত্রতা ছিল। আবার কিছু গোত্রের সাথে ছিল শত্রু তা। যে কোনো মুহূর্তে এক গোত্রের উপর অন্য গোত্রের আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। সামান্য বিষয় নিয়েও দুই গোত্রের মাঝে যুদ্ধ বেঁধে যেত। সেজন্যে এমন কোনো আশঙ্কা বা প্রেক্ষাপট তৈরী হলে কেউ পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আওয়াজ করলে গোত্রের লোকেরা মুহূর্তে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতো।
তো হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আওয়াজ দিলেন তখন বনু আবদিল মুত্তালিব ও তার শাখা গোত্রের লোকজন, যারা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আত্মীয় ও বংশের লোক, তারা ঐ পাহাড়ের পাদদেশে হাযির হয়ে গেল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের লক্ষ্য করে বললেন, আমি যদি এ সংবাদ দিই যে, এই পাহাড়ের পেছনে একটি শত্রু বাহিনী ওঁৎ পেতে আছে তোমাদের উপর আক্রমণের জন্য- তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? সবাই একবাক্যে বলে উঠল, জ্বী হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা বিশ্বাস করব। কারণ- مَا جَرَّبْنَا عَلَيْكَ إلا صِدقًا আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যা বলতে শুনিনি।
এই সাক্ষ্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব লোকের সাক্ষ্য, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচে’ নিকটবর্তী। যারা নবুওতের আগের চলিস্নশটি বছর তাঁকে একেবারে কাছে থেকে দেখেছে। তাঁর সাথে চলাফেরা উঠাবসা করেছে। লেনদেন ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। তারা এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যা বলতে শুনিনি। আর এ তথ্য সাধারণ কোনো ইতিহাস-গ্রন্থের তথ্য নয়, সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিমের মত হাদীস-গ্রন্থের তথ্য। হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস ও হাদীস-বিচারের নীতিমালা সম্পর্কে যাদের জানাশোনা আছে তারা বুঝবেন, নির্ভরযোগ্য হাদীস-গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য সনদে কোনো তথ্য সংকলিত হওয়ার তাৎপর্য কী। সূত্র ও বক্তব্য সংক্রামত্ম কত নিখুঁত পরীক্ষার পর একটি হাদীস মুহাদ্দিসগণের কাছে ‘ সহীহ হাদীস ’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যাই হোক, আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে তাঁর চারপাশের লোকদের সাক্ষ্য তো এমন এক বাসত্মবতা যা ইতিহাসের ‘মুতাওয়াতির’ অংশের অমত্মর্ভুক্ত যা সকল সন্দেহ সংশয়ের উর্ধ্বে।
হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বললেন,
فَإِنِّي نَذِيرٌ لَكُمْ بَيْنَ يَدَيْ عَذَابٍ شَدِيدٍ আমি তোমাদের জন্যে এক কঠিন আযাবের অগ্রবর্তী সতর্ককারী। তখন তাঁর চাচা আবু লাহাব বলে উঠল,
تَبًّا لَكَ سَائِرَ الْيَوْمِ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا তুমি চিরদিনের জন্যে ধ্বংস হও! এই জন্যেই কি আমাদের ডেকেছ? আল্লাহ তাআলাও কুরআনে কারীমে আয়াত নাযিল করলেন-
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ
(ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দু’হাত । আর সে নিজে তো ধ্বংস হয়েই গেছে। তার সম্পদ ও উপার্জন তার কোনো কাজে আসেনি। )- সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৭০; মুসনাদে আহমাদ ১/২৮১, হাদীস ২৫৪৪
রাসূল অবমাননার পরিণাম
এখানে কত কঠিন ভাষায় স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আবু লাহাবকে লানত করলেন! আবু লাহাব তার বাক্যটি একবার বলেছে। আর আল্লাহ তাআলা তার অভিশাপ ঘোষণা করলেন কুরআন মাজীদে, যা কিয়ামত পর্যমত্ম পড়া হবে। এখান থেকে তার দুর্ভাগ্য উপলব্ধি করা যায়। দুর্ভাগ্য ও লানত তো সব কাফিরের জন্যেই। কিন্তু সবার নাম নিয়ে কুরআন মাজীদে দুর্ভাগ্য ও অভিশপ্ততা ঘোষিত হয়নি। কিন্তু যে কাফির জনসমক্ষে এবং সরাসরি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অপমান করার চেষ্টা করেছে তার অপমান ও লাঞ্ছনা আল্লাহ তাআলা খুব কঠিন ভাষায় কুরআন মাজীদে ঘোষণা করে দিয়েছেন।
তো হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সময় থেকেই নিকটাত্মীয়দের মাঝে দাওয়াতের কাজ শুরু করে দিলেন। এক বর্ণনায় এসেছে-
لما أنزلت هذه الآية ! "وأنذر عشيرتك الأقربين " دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم قريشا، فاجتمعوا، فعم وخص فقال: يا بني كعب بن لؤي! أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني مرة بن كعب! أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد شمس! أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد مناف! أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني هاشم! أنقذوا أنفسكم من النار، يا بني عبد المطلب! أنقذوا أنفسكم من النار، يا فاطمة! أنقذي نفسك من النار، فإني لا أملك لكم من الله شيئا، غير أن لكم رحما، سأبلها ببلالها.
এই আয়াত যখন নাযিল হল, হযরত রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ গোত্রের সবাইকে ডাকলেন। তারা উপস্থিত হল। তিনি কুরাইশকে সম্বোধন করে এবং তার বিভিন্ন শাখা গোত্রকেও সম্বোধন করে করে দাওয়াত দিলেন। বললেন, হে বনী কা‘ব ইবনে লুআই! তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। হে বনী মুর্রা ইবনে কা‘ব! তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে বাঁচাও । হে বনী আবদে শামস! হে বনী আবদে মানাফ! হে বনী হাশেম! হে বনী আবদিল মুত্তালিব! তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে বাঁচাও । এমনকি কন্যা ফাতিমাকে লক্ষ্য করেও বললেন, হে ফাতিমা! তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। আর বললেন, আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে কোনো কিছুরই অধিকার রাখি না। তবে এটুকু যে, তোমাদের সাথে আমার আত্মীয়তা রয়েছে, সে আত্মীয়তার দাবি আমি পূরণ করব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৪ আরো দেখুন- সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৭১
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শাফাআতের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই শাফাআত হবে মুমিনদের জন্যে। যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তাদের জন্য। হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
شفاعتي لأهل الكبائر من أمتي
-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৬৪৬৭
তো শাফাআত হবে গোনাহগার উম্মতের জন্য। কিন্তু যারা মুমিন নয়, যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহ পাকের প্রেরিত দ্বীন ও শরীয়তকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা করার অধিকার আল্লাহ পাক কোনো নবীকেও দেননি, কোনো ফিরিশতাকেও না, কোনো ওলী বুযুর্গকেও না। সুতরাং তাদেরকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই। সেজন্যেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন গোত্র ও শাখাগোত্রের নাম ধরে ধরে বলেছেন যে, তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। কীভাবে রক্ষা করবে? তাওহীদ গ্রহণ কর, শিরক বর্জন কর। ঈমান গ্রহণ কর, কুফর বর্জন কর। যদি ঈমান ও তাওহীদ গ্রহণ কর আর শিরক ও কুফর বর্জন কর তাহলে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন।
তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতের আদেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করেছেন। এইজন্য নিজের পরিবারবগ,র্ আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন- এরাই কিন্তু আপনার দাওয়াতের, আপনার কল্যণকামিতা লাভের সবচে’ বেশি হকদার। সেজন্যে তাদেরকে ঈমানের দিকে, ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। যদি আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দেখা যায় কেউ শিরকে লিপ্ত, অজ্ঞতার কারণে সে কোনো শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, কোনো বিদআতী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, কোনো কুফরের সাথে তার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে, ঐসময় কল্যাণকামিতা হল, খুব আমত্মরিকতার সাথে তাকে সেই কুফর শিরক বিদআত থেকে ফিরিয়ে আনা। এটি ইসলামের দাওয়াতের সত্যতা ও যথার্থতার একটি দিনদর্শন। ইসলাম এমন কোনো ‘আন্দোলনের’ নাম নয়, যার উদ্দেশ্য কিছু পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা, ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব অর্জন করা কিংবা বিশেষ কোনো শ্রেণির প্রভুত্ব কায়েম করা। যেমনটা জাগতিক বিভিন্ন আন্দোলন ও বিপস্নবের বৈশিষ্ট্য, যেখানে আদর্শ মূলকথা নয়, স্বার্থই মূলকথা, আদর্শ যেখানে স্বার্থ হাসিলের উপায় মাত্র। আল্লাহর দ্বীন ইসলাম এমন কোনো স্বার্থ হাসিলের নাম নয়। ইসলাম এমন এক দ্বীন, এমন এক আদর্শ, যা সবার জন্যে সমান প্রয়োজন, সবার জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য। এ আদর্শের দিকে যিনি ডাকেন তারও ঠিক ঐ পরিমাণ প্রয়োজন যাকে ডাকা হয় তার যে পরিমাণ প্রয়োজন। এ কারণে দ্বীনের কোনো দাঈ যখন নিজে দ্বীনী আদর্শের অনুসারী না হন তখন তার সম্পর্কে কুরআন মাজীদের এ আয়াত প্রযোজ্য হয়-
أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنْسَوْنَ أَنْفُسَكُمْ وَأَنْتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ
তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও আর নিজেদের ভুলে যাও! অথচ তোমরা তিলাওয়াত কর কিতাব!? তবে কি তোমরা বোঝ না? -সূরা বাকারা ২ : ৪৪
আল্লাহর রাসূলের পবিত্র জীবন উম্মতের সামনে। তিনি ছিলেন তাঁর দাওয়াতের বাসত্মব ও সর্বোত্তম নমুনা। তিনি ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁর ঈমান ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। তিনি সালাতের দাওয়াত দিয়েছেন, তাঁর সালাত ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি সুন্দর আখলাকের কথা বলেছেন, তিনি ছিলেন সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী। এ কারণে ইসলামের যিনি দাঈ তাকে নিজের দাওয়াত সর্ব প্রথম নিজের মধ্যে বাসত্মবায়িত করতে হবে। এরপর নিজের নিকটজনদের মধ্যে বাসত্মবায়নের চেষ্টা করতে হবে। ইসলামের দাওয়াত কপটতার দাওয়াত নয় যে, অন্যরা সকল কাজ করুক, আমরা শুধূ সুফলটুকু ভোগ করব। ইসলামের দাওয়াত সত্যের দাওয়াত, যা সবাইকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে এবং যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অন্যথায় তার মুক্তির কোনো উপায় নেই। এ কারণে ইসলামে আত্ন-সংশোধনের এত গুরুত্ব। পরিবার-পরিজনের সংশোধনের চেষ্টার এত গুরুত্ব। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ঘরের লোক পুরাপুরি ঠিক হওয়ার আগে অন্যদের দাওয়াত দেয়া যাবে না। দেয়া যাবে। কারণ আল্স্নাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দিয়েছেন। একই সাথে ঘরে-বাইরে দাওয়াত দিয়েছেন। গোত্রের লোকদেরও ডেকেছেন আবার অন্যদেরও ডেকেছেন। অন্যদের ডাকার জন্যে গোত্রের সবার ঈমান আনার অপেক্ষা করেননি। কিছু লোককে দেখা যায়, দ্বীনের দাওয়াত এই বলে প্রত্যাখ্যান করে যে ‘ আগে নিজের ঘরের লোকদের ঠিক করুন।’ এটা ঠিক নয়। কারণ, ঘরের লোকদের ঠিক করার শক্তি দাঈর নেই। তিনি চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু ঠিক করার মালিক আল্লাহ। এ কারণে কারো আত্মীয়স্বজনের মধ্যে দ্বীনদারী মেনে চলে না এমন কেউ থাকলেই তার দাওয়াত শোনা যাবে না, গ্রহণ করা যাবে না- এটা ঠিক নয়। এটাও প্রামিত্মকতা। তো নিজের ও নিজের পরিবারের আত্মীয়স্বজনের সংশোধনের ফিকির না করে শুধু অন্যদের ইসলাহের ফিকির করা যেমন ভুল ও প্রামিত্মকতা তেমনি সংশিস্নষ্ট কারো বেদ্বীনীর কারণে কোনো দাঈর সঠিক কথা প্রত্যাখ্যান করাও অন্যায় ও প্রামিত্মকতা।
এখানে দ্বিতীয় বিষয় হল,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ‘আপনি আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি নম্র্ হোন।’
ঐসময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী কারা ছিলেন? ঐসময় তাঁর অনুসারী ছিলেন সমাজের দুস্থ গরিব অসহায় মানুষেরা। হযরত বেলাল রা., হযরত সুহাইব রুমী রা.-এর মত মানুষেরা। অনেকে ছিলেন ক্রীতদাস, সমাজে যাদের কোনো মূল্য ছিল না। যাদেরকে মানুষ হিসাবেই গণ্য করা হত না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের সাথে বিনয়ের আচরণ করার আদেশ করা হয়েছে। তিনি সায়্যিদুল মুরসালীন, নবী-রাসূলগণের শ্রেষ্ঠ। তবে এটা তাঁর দ্বীনী পরিচয়। যারা ঈমান এনেছে, তারা বুঝবে এর মর্যাদা। তিনি বংশগতভাবেও ছিলেন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ বংশের অভিজাত একজন ব্যক্তি। তাঁকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
অসহায় ও নিতামত্ম গরিব মানুষও যখন ঈমান এনেছে তখন আল্লাহ পাকের কাছে তাদের মর্যাদা অনেক বেশি। অভিজাত বংশের কোনো কাফিরের চেয়েও একজন সাধারণ মুমিনের মর্যাদা আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক অনেক বেশি। সুতরাং আপনি সায়্যিদুল মুরসালীন হওয়া সত্ত্বেও, আরবের শ্রেষ্ঠ অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও আপনার প্রতি আমার আদেশ- ঐসব অসহায় দুস্থ দরিদ্র মুমিনদের সাথে উত্তম আচরণ করুন। আল্লাহর রাসূলের সারাটি জীবন ছিল এ অত্যুচ্চ আখলাকের জীবমত্ম নমুনা। এখান থেকে আমাদের গ্রহণ করার অনেক কিছু আছে।
নাফরমানী থেকে দায়মুক্তি
এরপর আল্লাহ তাআলা বলছেন-
فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ
‘আর ওরা যদি আপনার অবাধ্য হয় তাহলে আপনি বলুন, আমি তোমাদের কর্মকা- থেকে মুক্ত।’
ঈমানের জন্য এই বিষয়টিও জরুরি। পৌত্তলিকতা বা কোনো কুফর শিরক যখন সামনে চলে আসে তখন তা থেকে নিজের সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা এবং তার থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করা মুমিনের কর্তব্য। কুফরের সাথে ঈমানের সহাবস্থান হয় না। শিরকের সাথে, নিফাকের সাথে ঈমানের সহাবস্থান হয় না। কারণ এগুলো ঈমানের সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ। এজন্য এটা কখনো সম্ভব নয় যে, ‘‘রাযী রাহে রহমান ভি রাযী রাহে শয়তান ভী’’ আল্লাহ তায়ালাও সন্তুষ্ট থাকুন, শয়তানও সন্তুষ্ট থাকুক। অতএব যদি মুমিন হতে হয় তাহলে অবশ্যই সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে কুফর থেকে, শিরক থেকে, নিফাক থেকে। فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ ‘যদি তারা আপনার অবাধ্য হয় তাহলে বলুন, তোমাদের কর্মকা--র সাথে- (শিরকের সাথে, কুফরের সাথে, পৌত্তলিকতার সাথে) আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
এরপর কথা হল, আপনি সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দিচ্ছেন। আপনি একা একজন মানুষ। আপনার সাথী সঙ্গী হল আরো দুর্বল ক’জন। বিপরীতে গোটা আরব। অভিজাত ক্ষমতাশালী বিপুল শক্তি সামর্থ্যের অধিকারী এই মানুষদের থেকে যদি আপনি সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং সেটা ঘোষণা করেন তখন আপনার অবস্থা কী হবে? সেজন্যে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ ‘আপনি ভরসা করুন পরাক্রমশালী পরম করুণাময় আল্লাহর উপর।’
এখানে আল্লাহ পাকের দুটি গুণের উলেস্নখ হয়েছে। ‘আল আযীয’ যাকে পরাজিত করা যায় না; বরং যার সাথে প্রতিযোগিতাই করা যায় না। দেখুন, লড়াই তো হয় সমতুল্য বা কাছাকাছি দুই শক্তির মধ্যে। যেখানে কোনো তুলনাই হয় না, একজন পূর্ণ ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের অধিকারী প্রভু, অন্যজন হাত-পা বাঁধা দাস সেখানে তো প্রতিযোগিতার প্রশ্নই অবামত্মর। তো আল্লাহ হলেন ঐ সত্তা যার সাথে প্রতিযোগিতাই করা যায় না এবং যার মুকাবেলাই করা যায় না। তো আপনি এমন পরাক্রমশালী সত্তার উপর ভরসা করুন যার মুকাবিলাই করা যায় না। তিনি আপনাকে রক্ষা করবেন। আপনাকে জয়ী করবেন। তাঁর আরেক গুণ, ‘আর রাহীম’ পরম দয়ালু মেহেরবান। মালিক যদি পরাক্রমশালী হন কিন্তু দয়ালু না হন তাহলে সাহায্য নাও করতে পারেন। তার উপর ভরসা করে কী লাভ হবে? তিনি তো আমার দিকে ফিরেও তাকাবেন না। কিন্তু আল্লাহ পাক হলেন ঐ মালিক যিনি একদিকে পরাক্রমশালী অন্যদিকে দয়ালুও। ফলে তিনি তাঁর বান্দাকে কখনো ত্যাগ করবেন না।
আর তিনি এমন পরাক্রমশালী দয়ালু আল্লাহ যিনি আপনার সকল অবস্থা সবসময় দেখেন। الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ ‘যিনি আপনাকে দেখেন যখন আপনি ওঠেন।’ ঘুম থেকে ওঠেন। বসা থেকে ওঠেন। নামাযে দাঁড়ান। দাওয়াতী কাজের জন্য দাঁড়ান। আপনার সকল দাঁড়ানো, সকল উঠাবসা তাঁর চোখের সামনে। وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ ‘এবং দেখেন সিজদাকারীদের সাথে আপনার উঠাবসা।’ আপনি যখন রুকুতে যান, রুকু থেকে ওঠেন, সিজদায় যান, সিজদা থেকে ওঠেন- এভাবে সিজদাকারীদের সাথে আপনার সকল উঠাবসা তিনি দেখেন। إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ আর তিনি তো সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। তিনি আপনার সকল অবস্থা জানেন। আপনার মনের সকল আকুতি শোনেন। আপনার দিবস রজনীর সকল প্রার্থনা তাঁর সামনে। তিনি তো সেই সত্তা; পৃথিবীর সকল মানুষ যদি একসাথে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে তিনি প্রত্যেকের প্রার্থনা আলাদা আলাদা শুনেন বুঝেন। এ তো মানুষের দুর্বলতা যে, একসাথে কয়েকজন কথা বললে কারো কথাই সে ভালোভাবে বুঝতে পারে না। আল্লাহ তাআলার গুণ ও সিফত এসব দুর্বলতা সীমাদ্ধতার ঊর্ধ্বে। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যমত্ম যত মানুষ আসবে তারা সবাই যদি এক ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে তিনি তাদের সবার প্রার্থনা শুনবেন বুঝবেন এবং সবার প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারবেন। তাঁর কাছে কিছুই অস্পষ্ট থাকবে না। সেই মহা পরাক্রমশালী, বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ আল্লাহর উপর আপনি ভরসা করুন।
সাপ্তাহিক দরসে কুরআন থেকে ধারণ ও লিখন: তাওহীদুল ইসলাম তাইয়েব।