Zilhajj 1435   ||   October 2014

মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১৩

Mawlana Muhammad Abdul Malek

  

(৪) এ কেমন দায়িত্বহীনতা?

অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম

‘চান্দ্র মাসের সঠিক তারিখ নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রচারিত, অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম (উজিরপুর, বরিশাল)-এর পুস্তিকাও হস্তগত হয়েছে, যার শিরোনাম- ‘রোজা, ঈদ, কুরবানীসহ চাঁদের তারিখনির্ভর সকল ইবাদত পালনে দেশবাসীর প্রতি জাতীয় হেলাল কমিটির এ কেমন দায়িত্বহীনতা?’

পূর্বোক্ত তিন পুস্তিকায় (শাবান-রমযান ও যিলক্বদ সংখ্যায় যেগুলোর উপর পর্যালোচনা করা হয়েছে।) যা আছে এর অতিরিক্ত কিছু এতে নেই। তবে গালমন্দের মাত্রা এতে কিছু চড়া। আর আছে এক লক্ষ টাকার একটি চ্যালেঞ্জও। এ কারণে এ পুস্তিকার উপর বিস্তারিত পর্যালোচনার প্রয়োজন মনে করিনি।

হ্যাঁ, একটি বিষয় এতে অতিরিক্ত আছে। তা এই যে, একটি ভিত্তিহীন কথাকে হাদীস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আর একটি সহীহ হাদীসে নিজের পক্ষ হতে একটি কথা সংযোজন করে নিজ দাবির পক্ষে প্রমাণ সরবরাহের চেষ্টা করা হয়েছে।

ভিত্তিহীন কথাকে হাদীস বানানো

পুস্তিকার ৩য় পৃষ্ঠায় সূরা বাকারার ১৮৯ নং আয়াত উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, ‘এ আয়াত প্রমাণ করছে, দেশ-মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র মানবজাতির জন্য নতুন চাঁদ একক তারিখ নির্ধারণ করবে।’

এখানে ‘একক’ কথাটি প্রক্ষিপ্ত। লেখক নিজের ঝুলি থেকে তো আয়াতের মধ্যে সংযুক্ত করেছেন এরপর লিখেছেন, ‘মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও অনুরূপ আমল করেছেন। যেমন আবু দাউদ শরীফ ৩২০ পৃষ্ঠা, তিরমিযী শরীফ ১৪৮ পৃষ্ঠা, নাসায়ী শরীফ ২৩১ পৃষ্ঠা এবং ইবনু মাজাহ শরীফ ১১৯ পৃষ্ঠা থেকে মিশকাত শরীফের ১২৭ ও ১৭৪ পৃষ্ঠায় হযরত ইবনু উমার রা., ইবনু আববাস রা. এবং আবু উমাইর রা. হতে বর্ণিত ৩ খানা হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দূরবর্তী এলাকার চাঁদ দেখার সংবাদ গ্রহণ করে রোযা রেখেছেন, ঈদ করেছেন, ...।’

জনাব রফীকুল ইসলাম সাহেব কি দয়া করে বলবেন, দেশ-মহাদেশের সীমা অতিক্রম করে দূরবর্তী কোন্ এলাকার চাঁদের ভিত্তিতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারিখ গণনা করেছেন এবং রোযা ও ঈদ করেছেন?

জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব যে তিনটি হাদীসের দিকে ইশারা করেছেন তার কোনোটিতেই একথা নেই যে, দূরের অঞ্চল থেকে আসা সংবাদের ভিত্তিতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রেখেছেন।

আবু উমায়ের রা.-এর হাদীস তো ঈদ সম্পর্কে, যাতে ৩০ রমযান সন্ধ্যায় সফর থেকে ফেরা কাফেলা সাক্ষ্য দিয়েছিল যে, গতরাতে আমরা চাঁদ দেখেছি। তাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রোযা ভাঙ্গার আদেশ করা হয়।

এ কাফেলা কতদূর থেকে এসেছিল তা পাঠকবৃন্দ নিজেরাই বুঝতে পারেন। এ-তো ২০-২৫ মাইল, সর্বোচ্চ ৩০ মাইল ব্যবধানের রাস্তা

ইবনে ওমর রা. ও ইবনে আববাস রা.-এর হাদীস দু’টি রোযা সম্পর্কে। ইবনে ওমর রা.-এর হাদীস এই যে, লোকেরা চাঁদ দেখার চেষ্টা করল, (কিন্তু দেখতে সক্ষম হল না) আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ দিলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। তখন তিনি রোযা রাখলেন এবং অন্যদেরও রোযা রাখার আদেশ করলেন। (আবু দাউদ, দারেমী, মিশকাত ১২৭)

এ তো মদীনার ঘটনা। এখানে নিকট-দূরের প্রসঙ্গ কোথায়? আর আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর হাদীস এই যে, এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এল এবং বলল যে, আমি (রমযানের) চাঁদ দেখেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মুসলিম পরিচয় সম্পর্কে জেনে আদেশ করলেন, বেলাল! মানুষের মাঝে ঘোষণা কর, তারা যেন আগামীকাল রোযা রাখে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী- মিশকাত ১৭৪)

এ ব্যক্তি যদি আগেই মদীনায় এসে থাকেন তবে তো এটা মদীনার ঘটনা। আর যদি গ্রামে চাঁদ দেখে মদীনায় এসে সংবাদ দিয়ে থাকেন তাহলে তা মদীনার পার্শ্ববর্তী বসতির ঘটনা। সুতরাং এটাও দূরের ঘটনা নয়।

তো জনাব অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম সাহেব যে বিনা দলীলে এ দাবি করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দূরের এলাকার (তাও আবার নাকি দেশ-মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে) চাঁদ দেখার সংবাদ কবুল করে রোযা রেখেছেন। তার এ দাবি সম্পর্কে কী বলা যায়? এটা হাদীস জাল করার অপরাধে শামিল হচ্ছে না তো? তদ্রূপ এ জাতীয় কর্মকা- দায়িত্বহীনতার মধ্যে পড়ে যায় না তো?

সহীহ হাদীসে সংযোজন

একটি হাদীস আছে

الصوم يوم تصومون ، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون

বর্তমান প্রবন্ধেই (রজব, ১৪৩৫ হি.) এ হাদীস উল্লেখিত হয়েছে এবং এর মর্ম সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু জনাব মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম সাহেব এর তরজমা করেছেন এভাবে : ‘রোযা হবে একই দিনে যে দিনে তোমরা সকলেই রোযা রাখবে, ঈদ হবে একই দিনে, যে দিনে তোমরা সকলেই ঈদ করবে, কুরবানী হবে একই দিনে, যে দিনে তোমরা সবাই কুরবানী করবে।’

তরজমার ‘একই দিনে’ কথাটা হাদীসে নেই। এটা তিনি নিজের থেকে যুক্ত করেছেন। এজাতীয় মারাত্মক ভ্রষ্টতা থেকে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে হেফাযত করুন।

বাকি রইল এ হাদীসের মর্ম কী? এ বিষয়ে পূর্বে আলোচনা হয়েছে। আরো বিস্তারিত আলোচনা মুহাম্মাদ ইকবাল বিন ফখরুলের পুস্তিকা সম্পর্কে পর্যালোচনার সময় করা হবে ইনশাআল্লাহ।

 

(৫) সিয়াম ও ঈদ

বিশ্বব্যাপী একই তারিখে পালন করা সম্ভব কি?

মাওলানা মুহাম্মাদ জসীমুদ্দিন রাহমানী

আলহাদীদ পাবলিকেশন্স, বছিলা, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা

(১৪৩৩ হি. মোতাবেক ২০১২ ঈ.)

এ বইয়ের আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। কারণ, বিভিন্ন আলামত থেকে পরিষ্কার যে, বইটির সিংহভাগই ড. মাহবুবুর রহমান সাহেবের কিতাব থেকে (যা সম্পর্কে গত সংখ্যায় পর্যালোচনা করা হয়েছে) প্রায় হুবহু গৃহীত। এমনকি ভুল-ত্রুটির মধ্যেও লেখক তারই মুকাল্লিদ। ড. মাহবুব সাহেবের পুস্তিকা মুদ্রিত রূপে আসার আগে যখন একটি কম্পোজকৃত ফতোয়া আকারে ছিল সে সময়ের কপিও আমার কাছে এসেছিল। তাতে এমন কিছু ভুলত্রুটি ছিল যা পরে সংশোধন করা হয় বা বাদ দেয়া হয়। কিন্তু ‘আলহাদীদে’র বন্ধুদের কাছে যেহেতু পুরনো কপিটিই ছিল তাই তাদের পুস্তিকায় আগের কিছু ভুলত্রুটিও রয়ে গেছে। যেমন, দুই পুস্তিকায় উল্লেখকৃত ফতহুল বারীর ইবারতের তরজমা যদি মিলিয়ে দেখা হয় তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ولكنه مصروف عن ظاهره বাক্যের তরজমা পুরনো কপিতে যেমন ভুল ছিল এখন আলহাদীদ ওয়ালাদের পুস্তিকাতেও তা ভুল আছে। (দ্র. পৃ. ৩৪) অথচ ড. মাহবুব সাহেবের মুদ্রিত বইয়ে এ বাক্যের তরজমা বাদ দেয়া হয়েছে। আলহাদীদ প্রকাশিত পুস্তিকায় যে অতিরিক্ত বস্তগুলি আছে তাতেও মারাত্মক ভুলত্রুটি বা কূট আলোচনা রয়েছে।

(টীকা : পরে জানা গেছে যে, এ অতিরিক্ত অংশেরও সিংহভাগ অন্য এক তরুণ আলিমের প্রবন্ধ থেকে নেয়া।) যেমন :

১. ৪৭ পৃষ্ঠায় ইবনে কুদামা মাকদিসী হাম্বলী রাহ.-এর গ্রন্থ ‘আলমুগনী’-কে মালেকী মাযহাবের মশহূর কিতাব বলা হয়েছে। অথচ তালিবে ইলমরাও জানেন, এটি হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব। যদিও তা ‘ফিকহে মুজাররাদ’ শ্রেণির নয়, ‘ফিকহে মুকারান’ শ্রেণির গ্রন্থ।

২. ৩১-৩২ পৃষ্ঠার ‘সুনানে আবু দাউদ থেকে রিবয়ী ইবনে হিরাশ রা.- এর হাদীস নকল করা হয়েছে। যাতে আছে

-فقدم أعرابيان فشهدا عند رسول الله صلى الله عليه وسلم، بالله لأهلا الهلال أمس عشية، فامر رسول الله صلى الله عليه وسلم الناس أن يفطروا، زاد خلف في حديثه- وأن يغدوا إلى مصلاهم

হাদীসের মতনে চিমত্মা করলে জানা যাবে যে, এই দুই বেদুঈন ৩০ রমযান (বাস্তবে পয়লা শাওয়াল) সকালে এসেছিল এবং বিগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাক্ষ্য কবুল করে রোযা ভাঙ্গার আদেশ করেন এবং সকাল সকাল ঈদগাহে যেতে বলেন।

বেদুঈনরা সাধারণত মদীনার পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে বসবাস করত। একারণে এটি দূরের সাক্ষ্য নয়, নিকটবর্তী এলাকার সাক্ষ্য। কিন্তু আলহাদীদের বন্ধুদের পুস্তিকায়  وأن يغدوا -এর তরজমা করা হয়েছে ‘পরের দিন সকালেই’ অথচ এ তরজমা তখনই সঠিক হত যদি হাদীসে من الغد শব্দও থাকত। কিন্তু হাদীসে শব্দটি নেই; না ঐসব কিতাবে যেগুলোর বরাতে তিনি হাদীসটি উল্লেখ করেছেন, আর না হাদীসের অন্য কোনো কিতাবে। একারণে  أن يغدوا -এর অর্থ ঐদিনেরই সকালে (অর্থাৎ সূর্য ঢলার আগে) ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে যাওয়া।

সুনানে আবু দাউদের বর্ণনায় যদিও ঐ দুই ব্যক্তির আসার সময়টি স্পষ্ট  উল্লেখিত হয়নি, কিন্তু মুসনাদে আহমদ খ. ৪ পৃ. ৩১৪ ও খ. ৫ পৃ. ৩৬২-৩৬৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক খ. ৪ পৃ. ১৬৪; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস ১১০৩ (বাবুল ঈদাইন) ; আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী খ. ৪ পৃ. ২৪৮ -এর রেওয়াতেসমূহে স্পষ্ট আছে যে. ঐ বেদুঈন সকালেই এসেছিল, হাদীসের আরবী পাঠ এই-

أصبح الناس لتمام ثلاثين يوما فجاء أعرابيان فشهدا أنهما أهلاه بالأمس عشية

 (মুসনাদে আহমদ খ.৪ পৃ. ৩১৪)

أصبح الناس صياما تمام الثلاثين، فجاء أعرابيان فشهدا أنهما أهلا الهلال بالأمس

(আলমুনতাকা, ইবনুল জারুদ পৃ. ১৪২, হাদীস ৩৯৬; মুসনাদে আহমদ খ. ৫ পৃ. ৩৬২-৩৬৩)

এ হল বাস্তব অবস্থা, কিন্তু আলহাদীদের বন্ধুরা হাদীসে নিজেদের পক্ষ হতে ‘পরদিন’ শব্দ যোগ করে একে দূর থেকে আসা সাক্ষ্যের ঘটনা বানিয়েছেন এবং নিজেরা এ আবিষ্কারও করেছেন যে, বেদুঈন দু’জন দিনের শেষে এসেছিল। তারা লিখেছেন : এ হাদীস থেকে সুস্পষ্ট হল যে, নিজ এলাকায় চাঁদ না দেখার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ সিয়াম পালন অব্যাহত রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট দিনের শেষভাগে অনেক দূর থেকে আসা দু’জন গ্রাম্য লোকের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন এবং তার উপর আমল করারও নির্দেশ দিয়েছেন। ( সিয়াম ও ঈদ, পৃ. ৩২)

মদীনার আশপাশের গ্রামাঞ্চলকে ‘অনেক দূর’ বলা, أصبح শব্দ উপেক্ষা করে নিজেদের পক্ষ হতে ‘দিনের শেষভাগে’ শব্দ বাড়ানো এরপর সরাসরি হাদীসের অনুবাদে ‘পরদিন’ শব্দের সংযোজন এগুলো সম্পর্কে কী মন্তব্য করা উচিত তা তারা নিজেরাই যদি বলে দেন তাহলে ভাল হয়।

পাঠক যদি লক্ষ্য করে থাকেন তাহলে উপরের ঘটনার প্রেক্ষাপটও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় চাঁদ দেখার জন্য মদীনার আশপাশের বসতিগুলোতে মদীনা থেকে কাউকে পাঠানোর রীতি ছিল না। তেমনি চাঁদ দেখা গেল কি না  সে সংবাদ সংগ্রহের জন্যও মদীনার বাইরে লোকজন পাঠানোর নিয়ম ছিল না। মদীনাতে চাঁদ দেখার চেষ্টা করা হত, না দেখা গেলে আগামী দিনকে ত্রিশ তারিখ সাব্যস্ত করে তারাবী, সাহরী ও রোযা জারি থাকত।

একথা আমি বারবার বলেছি যে, সাক্ষ্য এসে গেলে তা কবুল করার নযীর থেকে ‘সাক্ষ্য খোঁজ করা’ দাবি করা সঠিক নয়। উপরের ঘটনা থেকে এ বাস্তবতাই সামনে আসছে।

৩. ১২ পৃষ্ঠায় চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে একটি মত এই বলা হয়েছে যে, শুধু জোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবের ভিত্তিতে চাঁদ হওয়া না হওয়ার ফয়সালা করা।

তাদের উচিত ছিল এই ভিত্তিহীন মতটি উল্লেখ না করা। উল্লেখ করলেও তা খণ্ডন করে দেওয়া। কিন্তু তারা তা করেননি। অথচ এ মতটি অনেকগুলো ‘সহীহ সরীহ’ হাদীসের বিরোধী এবং খাইরুল কুরূনের ইজমার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ ভুল একটি মতামত। আলহাদীদ ওয়ালারা তা গ্রহণ করেননি তবে তা ভুলও বলেননি এবং এই ভুল বক্তব্য কার তা বর্ণনা করতে গিয়ে আশ্চর্য ভুলত্রুটির শিকার হয়েছেন! যেমন এ মতটিকে তাবেয়ী মুতাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহর সাথে সম্বন্ধ করেছেন। অথচ ইমাম ইবনে আব্দুল বার রাহ. লিখেছেন Ôولا يصح عنهÕ অর্থাৎ মুতাররিফ থেকে তা প্রমাণিত নয়। (আত তামহীদ খ. ১৪  পৃ. ৩৫২  নাফে’ আন ইবনে উমর থেকে বর্ণিত ৪০ নং হাদীসের অধীনে)

দুই নম্বরে একে সম্বন্ধ করেছেন ‘ইবনে শুরায়হ’-এর সাথে এবং দাবি করেছেন যে, তিনি হানাফী ছিলেন। অথচ এ ব্যক্তি ‘ইবনে শুরায়হ’ নন, ‘ইবনে ছুরাইজ’। আরবী উচ্চারণ ‘শীন’ দিয়ে নয়, ‘ছীন’ দিয়ে। আর তিনি হানাফী ছিলেন না বরং পুরোমাত্রায় শাফেয়ী ছিলেন। এরপর তার কথা এই ছিল না যে, সর্বাবস্থায় শুধু হিসাবের ভিত্তিতে চাঁদ হওয়া না হওয়ার ফায়সালা করা হবে। তাঁর বক্তব্য ছিল, কখনো অবস্থা যদি এই হয় যে, মেঘ-ধুলায় আবৃত হওয়ার কারণে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু হিসাবের দিক থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত যে, দিগমেত্ম চাঁদ দর্শনযোগ্য অবস্থায় রয়েছে তাহলে হিসাব জানা ব্যক্তি এর উপর নির্ভর করে রোযা রাখতে পারে। ইবনে ছুরাইজের এ কথাও ভুল। একে তার ‘যাল্লাত’ (ভুলত্রুটির)-এর মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। (দ্র. আরিযাতুল আহওয়াযী, আবু বকর ইবনুল আরাবী খ. ৩ পৃ. ২০৭-২০৮ ; আল মুয়াসসির শরহুল মাসাবীহ, ফযলুল্লাহ তূরবিশতী খ. ২ পৃ. ৪৫৯-৪৬০ ; ফতহুল বারী, ইবনে হাজার খ.৪ পৃ.১৪৬-১৪৭, ১৫১-১৫২; শরহুল মুহাযযাব, ইমাম নববী খ. ৭ পৃ. ৪৩৭-৪৩৮; তরহুত তাছরীব ফী শরহিত তাকরীব, ওলীউদ্দীন ইরাকী খ. ৪ পৃ. ১০৮-১১০

তাহলে জানা গেল যে, ইবনে ছুরাইজ যা বলেছেন তা ভুল, কিন্তু তিনি এত কিছু বলেননি যা আলহাদীদের বন্ধুরা তার সাথে সম্বন্ধ করেছেন। এরপর তাকে হানাফী বানিয়ে দেওয়া তো স্পষ্ট ভুল। তিনি তো ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের।

এরপর ‘আশশাশী’কে ইবনে ছুরাইজের শাগরিদ বলা হয়েছে। এটাও ভুল। (আবু বকর আল কাফফাল) আশশাশী, ইবনে ছুরাইজের যুগ তো পেয়েছেন, কিন্তু তার শীষ্যত্ব লাভের সুযোগ হয়নি। তার ইরাক পৌঁছার আগেই ইবনে ছুরাইজের ইন্তিকাল হয়ে যায়। (তবাকাতুশ শাফিয়িয়্যাহ, ইমাম ইবনুস সালাহ খ. ১ পৃ. ২২৮-২২৯)

এই ভুল মতের সম্বন্ধ ইবনে দাকীকুল ঈদের সাথেও করা হয়েছে। অথচ তিনিও আকাশ পরিষ্কার থাকা অবস্থায় শুধু হিসাবের ভিত্তিতে চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার কথা বলেননি। তিনি শুধু বলেছেন মেঘাচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে। আর তা-ও ভুল। হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী। পরের আহলে ইলমগণ তাঁর মতটিকে অশুদ্ধ বলেছেন। দেখুন, তাঁর কিতাব ইহকামুল আহকাম পৃ. ৩৯২ হাদীস ১৭৯ ও তরহুত তাছরীব খ. ৪ পৃ. ১১০

৪. ১২ পৃষ্ঠায় রশীদ রেযার কথা এসেছে তো তাকে ‘কাহহালা’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে! কোথায় ওমর রেযা কাহহালা, ‘মুজামুল মুআললিফীন’-এর গ্রন্থকার আর কোথায় রশীদ রেযা মিসরী ‘মাজাল্লাতুল মানার’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক এবং তাফসীরুল মানার-এর লেখক!!

৫. ৫৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘প্রসংগত উল্লেখ্য যে, ইমাম যায়লায়ী রাহ. ৬ষ্ঠ স্তরের ফকীহ। তাই তিনি মুজতাহিদ ফিদ দ্বীন নন; বরং একজন মুকাল্লিদ। অতএব একজন মুকাল্লিদ  হিসেবে নিজ ইমামের সিদ্ধান্তের  অনুসরণই তার জন্য যুক্তিযুক্ত।’

ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে ইমাম ফখরুদ্দীন যায়লায়ী রাহ. (৭৪৩ হি.) -এর যে উচুঁ মাকাম; হাদীস, ফিকহ ও উসূলে তাঁর যে, গভীর পাণ্ডিত্য সে হিসেবে তিনি অবশ্যই ‘আসহাবুত তারজীহ’-এর মধ্যে শামিল। এ তাঁর কিতাব থেকেও বোঝা যায়। তাঁর জীবনী পাঠ করেও বোঝা সম্ভব। কিন্তু এখানে কৌতুকের বিষয় এই যে, এইসকল পুস্তক পুস্তিকার লেখকেরা একদিকে নিজেরা ‘নীমমোল্লা’ হয়েও আচার আচরণে মুজতাহিদ হওয়ার দাবিদার! বড় বড় আলিমগণ তাদের দৃষ্টিতে গোমরাহ!! ইমামগণের তাকলীদ ও আকাবিরে আহলে হকের অনুসরণ তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বিষয় অন্যদিকে যায়লায়ীর নামের সূত্রে ‘ইমাম’ বিশেষণ যুক্ত করেও তাকলীদ করার নসীহত!! এদের তো কর্তব্য ছিল আগে যায়লায়ীর মাকাম উপলব্ধি করা এবং এরও আগে ঐ মত ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে প্রমাণ করা!

 

advertisement