স ত র্ক তা : ছকের জঙ্গি শখের জঙ্গি
হঠাৎ করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একটি অডিও রেকর্ড গণমাধ্যমের বড় জায়গা দখল করল। শিরোনাম বড়, কলাম বেশি এবং বিষয় এক হলেও আইটেমও বেশি। কী-খুব ভালো কোনো সংবাদ? হতেই পারে না। অন্তত বাংলাদেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমের প্রবণতা এমন নয়। সুতরাং খবরটি নেতিবাচক এবং সেই নেতিবাচকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলাম, মুসলিম ও ধর্মপ্রাণ মানুষের ভাবমার্যাদা। সেটি হচ্ছে আলকায়েদার বর্তমান প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরির একটি অডিও রেকর্ড। তীব্র সেক্যুলার কোনো কোনো অনলাইন পেপার ও ব্লগে খবরটি প্রথমে চাউড় করা হয়। এরপর সেটি আসে মূলধারার গণমাধ্যমে। খবরে বলা হয়েছে, ওই অডিওবার্তায় তিনি বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার হুমকি দিয়েছেন। ব্যস, আর যায় কোথায়? বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশে কে কবে কোথায় জঙ্গিবাদী তৎপরতা চালিয়েছে তার বর্ণনা এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর ধমক-ধামক ও ফাঁকা হুংকারের খবর প্রকাশের মচ্ছব শুরু হল। যেন জঙ্গিবাদের বারুদে একদিনেই দেশটা একদম অন্ধকার হয়ে গেছে। কোনো দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করেছে। অথচ দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই প্রায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, পুরো অডিওটাই ছিল কাঁচা হাতের একটা জাল ঘটনা। এটি প্রচারণার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশী এক তরুণ তিন-চার দিনের মাথায় পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। কিন্তু তাতে কী? ওই দুই তিনদিনেই দেশের গণমাধ্যম আর সরকারদলীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের জঙ্গি জঙ্গি ধ্বনিতে দেশবাসীর কান ঝালাপালা হয়ে গেছে।
এর কয়েক দিন পর গেল উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্ব। কেউ কেউ ধারণা করেছিল, জঙ্গিকার্ড খেলে উপজেলা নির্বাচনে উগ্র সেক্যুলার গোষ্ঠী বিরাট সুবিধা হাতিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টা। আশাহত হয়েছে তারা। কিছুটা হোঁচট এবং ধাক্কাও খেয়েছে। কিন্তু এর তিনদিনের মাথায় ২২ ফেব্রুয়ারি আবার আয়োজন করে জঙ্গিবাদ বিষয়ে ঢাকার একটি তারকা হোটেলে ‘জঙ্গিবাদের হুমকি : বাংলাদেশ ভাবনা’ নামে জমকালো একটি সেমিনার করা হল। ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের মতো মানুষের উপস্থাপনায় ওই সেমিনারে বক্তব্য রাখে দুই-একজন বাদে ক্ষমতাসীনপন্থী ও উগ্র সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের একটি দল। যাদের প্রায় সবাই জঙ্গিবাদ, মাদরাসা ও জামায়াতকে একাকার করে সবকিছু নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। মানবাধিকার কমিশনের মিজান সাহেব তো খোলাসা করেই বললেন, ‘নির্বাচন নয়, এখন দরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’ অর্থাৎ জঙ্গিবাদের কার্ড সামনে রেখে সাধারণ জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের গতি রুদ্ধ করার একটি এজেন্ডাভিত্তিক প্রজেক্ট ছিল সেটি। সেমিনারের আলোচকদের বক্তব্যে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশ যেন সশস্ত্র জঙ্গিতে থিক থিক করছে। ছাত্রলীগের খোলা তলোয়ার আর অ্যাকশনমুখি পিস্তলের চেয়েও যেন জঙ্গিদের দৌরাত্ম দেশে বেড়ে গেছে। ভাবসাবে কিছুটা অবাকই লেগেছে। তাহলে গিজ গিজ করা এতসব জঙ্গি গেল কোথায়?
দেশবাসীর এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্যই যেন ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশালে ৩ জেএমবি সদস্যকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি ঘটল। একদম ফিল্মী পদ্ধতিতে কমান্ডো স্টাইলে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালানো হল। সকাল ১০ টার দিকে ঘটানো হল বোমা ও গুলির বিস্ফোরণ। এতে ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ নিহত হল এবং দুজন আহত হল। খবরে বলা হয়, ডান্ডাবেড়ি পরা ৩ জন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে মুক্ত করে দুটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে কেটে পড়ে অপহরণকরীরা। এ যেন জঙ্গিবাদের হঠাৎ বিস্ফোরক প্রত্যাবর্তন। কথা নেই, বার্তা নেই, খবর নেই, এমনকি কোনো আলামতও নেই। তারপরও আসামীদের মুক্ত করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এতবড় সশস্ত্র হামলা। বিস্ময়কর! অভাবনীয়!! প্রায় ছয় বছর আগে জেএমবির মূল নেতা ও হোতাদের ফাঁসি হয়ে গেল। কোথাও কোনো টু শব্দ হলো না। এই ছয় বছরে দেশের কোথাও ছয়টি পটকাও ফুটলো না। অথচ এই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনী তামাশার পর একে একে বাংলাদেশকে নিয়ে আইমান আলজাওয়াহিরি ব্যস্ত হয়ে গেল! রেডিসন হোটেলে সরকারি বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে জঙ্গিবাদ নিয়ে হাপিত্যেস শুরু হল! আর তার পরপরই জেএমবির নামে সশস্ত্র হামলা করে আসামী ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটল। ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, দুষ্ট চক্রে-ঘটনাচক্রে সবকিছুই যেন ছক ধরেই ঘটতে লাগল। কী জানি, জঙ্গিবাদীরা একদম ছক ধরেই কর্মকান্ড ঘটাল। সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দাবি ও বক্তব্যের সত্যতা তুলে ধরার দায়িত্বও নিজেদের কাঁধে তুলে নিল। বোকামির কারণে জঙ্গিদের গভীর কর্মকান্ড আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
ঘটনা এখানে শেষ হলেও হতে পারত। কিন্তু হয়নি। খবরে বলা হয়েছে, মুক্ত করে নিয়ে যাওয়া ৩ আসামীর একজন হাফেয মাহমুদ ওরফে রাকিব ওইদিন আড়াইটার দিকে টাঙ্গাইলের সখীপুরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। মির্জাপুর থানার এসআই শ্যামল দত্ত নাকি তাকে গ্রেফতার করেন। এরপরের ঘটনা আরেকটু অন্যরকম। পরের দিন ভোররাতে পুলিশের সঙ্গে থাকা অবস্থায় রাকিব বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, পুলিশ তাকে নিয়ে অভিযানে বের হলে জেএমবি সদস্যরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তখন গুলি বিনিময়ের সময় রাকিব গুলিবিদ্ধ হন। এখানেও দেখা যাচ্ছে শখের জঙ্গিরা একদম ছক মেলানো কাজ করেছে। তারা যাকে কমান্ডো হামলা চালিয়ে মুক্ত করে নিয়ে গেছে, কয়েক ঘণ্টা পর রাস্তা থেকে তাকেই নিরীহ অবস্থায় শ্যামল দত্ত নামের পুলিশের এক এসআই পাকড়াও করে নিয়ে যায়। কেউ কোনো প্রতিরোধ গড়ারও সাহস পায়নি। সকাল ১০ টায় যেসব জঙ্গি দুর্ধর্ষ কমান্ডো, দুপুর আড়াইটায় তারাই ভেজাবেড়াল। আর পরদিন ভোরে তাদেরই একজন বিনাপ্রতিরোধে বন্দুকযুদ্ধে নিহত!
জঙ্গিবাদের ফিল্মী উত্থান, বললেন এক পর্যবেক্ষক। আরেকজন বললেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে ছক ও শখেরও একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে পুরো ঘটনার মধ্যে। বিরোধীদলীয় (সাবেক) মহাসচিব অভিযোগ করেছেন, আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতেই রাকিবকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে। এখানে আসল-নকলের খেলাটা যে কী-আমাদের পক্ষে সেটা বুঝা মুশকিল। তবে এ কথা আমরা বলতে পারি, কথিত জঙ্গিদের পুনঃউত্থানের পেছনে প্রশাসনের কারো সহযোগিতা থাকলে তাকে ছাড় দেওয়া যায় না। একইভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক কোনো লক্ষ্যপূরণে জঙ্গি জঙ্গি ছক ও শখের কোনো গর্তে কেউ মাথা ঢুকালে তার পরিণতিও ভালো হতে পারে বলে মনে হয় না।