Rabiul Auwal 1435   ||   January 2014

খোদার পরে তুমিই শ্রেষ্ঠ ...

ড. হাফেয মুহাম্মাদ ছানী

বিশ্বজাহানের গৌরব, নবীকুল শিরোমনি বিশ্বশান্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণুই তাঁর বিশ্বময় মর্যাদা এবং খ্যাতি ও মাহাত্মের সাক্ষী।

আরব-আজমের সর্দার, শ্রেষ্ঠ রাহবর হযরত মুহাম্মাদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনন্য ব্যক্তিত্ব ও অনুপম জীবন আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত প্রতিটি যুগ ও স্থানজুড়েই ব্যাপৃত।

বিশ্বজাহানের সবকিছুই রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়ত ও রিসালাতের সীমাহীন মাহাত্ম্য ও মাধুর্যের দ্বারা প্রভাবিত। পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণুই তাঁর খ্যাতি ও মাহাত্মের সাক্ষী।

إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ     এবং وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

এর চিত্তাকর্ষক ধ্বনি গোটা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে প্রতিধ্বনিত। সৃষ্টির সেই শ্রেষ্ঠ মানবের সম্মানিত নাম মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ। আর তাঁর খ্যাতি এতই সমুচ্চ যে, স্থান-কালের সকল উচ্চতা ও বুলন্দি এই পবিত্র নাম ও ব্যক্তিত্বের তুলনায় নেহাৎ তুচ্ছ। পাতাল-ভূমি থেকে উর্ধ্ব আরশ পর্যন্ত সবকিছুই তাঁর স্মরণে মুখর। এত উচ্চ মর্যাদা গোটা জগতে তিনি ছাড়া আর কেউ পায়নি। কেউ পাবেও না। এই অমোঘ সত্য কী সুন্দর করে বলেছেন কবি সাইয়েদ সাবীহ রাহমানী-

كوئى مثل مصطفى كا كبهى تها، نہ ہے، نہ ہوگا

كسى اور كا يہ رتبہ كبهى تها، نہ ہے، نہ ہوگا

অর্থ : মুস্তফা  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মতো কখনো কেউ ছিল না, এখনও নেই আর ভবিষ্যতেও হবে না।

এই মর্যাদা অন্য কারো কখনো ছিল না, এখনও নেই আর ভবিষ্যতেও হবে না।

প্রসিদ্ধ মুফাসসির আল্লামা সাইয়েদ মাহমুদ আলূসী রাহ. (১২৭ হি.)

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

এর তাফসীরে লেখেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মর্যাদা ও সমুচ্চতা,  তাঁর অনুপম আদর্শ ও নামের খ্যাতি এর চেয়ে অধিক আর কী হবে যে, আল্লাহ তাআলা নিজের নামের সঙ্গে কালিমায়ে শাহাদাতে তাঁর প্রিয়তমের নামটিও যুক্ত করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করাকে নিজেরই আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। ফেরেশতাগণের সাথে তিনিও রাসূলের প্রতি দরূদ প্রেরণ করেছেন এবং মুমিনদেরকেও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠের আদেশ দিয়েছেন। আর যখনই সম্বোধন করেছেন অতি সম্মানিত ও সুন্দর উপাধিসহ সম্বোধন করেছেন। যেমন, হে মুদ্দাছছির! (চাদর আবৃত), হে মুযযাম্মিল! (কম্বল আবৃত), হে প্রিয় নবী!, হে প্রিয় রাসূল! ইত্যাদি।

 

পূর্বের আসমানী কিতাবগুলোতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন এবং সকল নবী ও উম্মত থেকে তাঁর প্রতি ঈমান আনার প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন।

এক ঐতিহাসিক ও অনস্বীকার্য বাস্তবতা এই যে, ভূ-পৃষ্ঠে এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে দিনরাত সরওয়ারে দো আলম  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালাত ঘোষিত হয় না। চবিবশ ঘণ্টার ১৪৪০ মিনিটেই পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে, কোনো না কোনো অঞ্চলে আযানের ধ্বনি বাজতে থাকে।

 

আর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার নামের সাথে সৃষ্টির শ্রেষ্ট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম উচ্চারিত হতে থাকে। সুতরাং তাঁর নামের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য এদিক থেকেও প্রোজ্জ্বল যে, আযানের ধ্বনি যতদিন পৃথিবীতে বাজবে ততদিন আল্লাহর নামের সাথে তাঁর প্রিয়তম পয়গম্বর, সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র নামটিও প্রেমিক-হৃদয়ে সুধাবর্ষণ করবে।

 

আজও ধর্মহীনতার এই যুগে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যসরল ধর্মের প্রচার ও তাঁর জীবনচরিত ও বাণী ব্যাপকতর করার প্রয়াস পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে অব্যাহত আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র নাম স্মরণ করে, তাঁর সপ্রশংস আলোচনা করে করে ও তাঁর অনন্য গুণ-বৈশিষ্ট্য শুনে হাজার কোটি মানুষের মনে যে আনন্দ ও প্রফুল্লতা অনুভূত হয় তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। আপন-পর নির্বিশেষে এমনকি বিরুদ্ধ শত্রুদেরও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ ছাড়া উপায় নেই।

যে পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তা সামনে রেখে আয়াতটি তিলাওয়াত করলে নিঃসন্দেহে তিলাওয়াতের স্বাদ ও আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যাবে। কুফর-শিরকের ঘোর অন্ধকার, গোটা দুনিয়াই তাঁর বিরুদ্ধে, মক্কার নামকরা সর্দাররা মুস্তফা-প্রদীপ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্বাপিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ... এ অবস্থায় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।

কে তখন ভাবতে পেরেছিল যে, মক্কার এই এতীমের পবিত্র আলোচনা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে উচ্চারিত হবে! তাঁর ধর্মের আলোয় সভ্য দুনিয়ার বিরাট অংশ আলোকিত হয়ে উঠবে এবং কোটি কোটি মানুষ তাঁর নামে জীবন বিসর্জন দেওয়াকে নিজের জন্য শতসহস্র গৌরব ও সৌভাগ্য বলে মনে করবে। কিন্তু আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর প্রিয় রাসূল ও সম্মানিত বান্দা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যে প্রতিশ্রুতি করেছিলেন তা তো সত্য হওয়ারই ছিল এবং তা সত্য হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর সপ্রশংস আলোচনায় তিনি সূর্যের মতো বিরাজ করবেন।

মাওলানা আবদুল মাজিদ দরয়াবাদী সুন্দর লিখেছেন, স্রষ্টার সাথে যে সৃষ্টির নাম মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, আল্লাহর নামের সাথে যে বান্দার নাম শ্রুতিগোচর হয় তা তো দুনিয়ার কায়সার বা কিসরার  নাম নয়, দুনিয়ার কোনো কবি-সাহিত্যিকের নাম নয়, কোনো বিদ্বান বা দার্শনিকের নাম নয়, কোনো নেতা বা সেনাপতির নাম নয়, তা কোনো ঋষি বা পাদ্রীরও নয়, এমনকি অন্য কোনো নবীরও নাম নয়। বরং তা হল আবদুল্লাহর কলিজার টুকরা, আমিনার চোখের মণি, বাতহার ভূমিতে জন্মগ্রহণকারী সেই উম্মি ও এতীমের। 

কাশ্মিরের সবুজ ভূমিতে, দাকানের পাহাড়-পর্বতে, আফগানিস্তানের উঁচু ভূমিতে, হিমালয়ের চূড়ায়, গঙ্গার অববাহিকায়, চীন-জাপানে, বার্মা-রাশিয়ায়, মিসরে, ইরাক-ইরানে, ফিলিস্তিন ও আরবের বিস্তীর্ণ ভূমিতে, তুর্কী-নজদে, ইয়ামান-মরক্কোয়, ইস্তাম্বুলে, হিন্দুস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র-লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিনেও বছর বা মাস নয়, প্রতি দিন পাঁচ বার সুউচ্চ মিনার থেকে স্রষ্টার নামের সাথে যে নাম ইথারে ছড়িয়ে পড়ে তা এমন এক মহান ও সম্মানিত সত্ত্বার নাম, যাকে অন্তর্দৃষ্টিহীন দুনিয়া একসময় শুধু এতীম বলেই জানত।  তো এ  হল এতীমের রাজত্ব, আর এই হল

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

এর তাফসীর। কোনো নির্দিষ্ট গোত্র কিংবা প্রদেশ নয়; গোটা পৃথিবীর বুকে, পৃথিবীর হৃদয়ে আজ কারো হুকুমত থাকলে তা এই এতীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই আছে, কোনো রাজত্ব থাকলে এই উম্মী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই আছে।

সাহাবী হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, একবার জিবরীল আমীন আ. আমার নিকট আগমন করলেন এবং বললেন, আমার ও আপনার রব আমাকে প্রশ্ন করেছেন যে, তিনি কীভাবে আপনার স্মরণ সমুচ্চ করেছেন? আমি আরয করলাম আল্লাহই ভালো জানেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, যখন আমার নাম উচ্চারণ করা হবে তখন আমার সাথে আপনার নামও উচ্চারণ হবে।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৩৩৮১; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস : ১৩৭৫

কবিতার ভাষায়-তাকবীরে-কালিমায়, নামাযে-আযানে/আল্লাহর নামের সাথে মিলেছে  মুহাম্মাদের নাম।

সুতরাং আজ এমন কোন অঞ্চল, এমন কোন মুহূর্ত আছে, যা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্মরণ ছাড়া অতিবাহিত হয়?

এই পৃথিবীর দশদিকে ভূমির আঙ্গিক আবর্তনের সাথে সাথে প্রতি আযানে নাম উচ্চারিত হয়। উঁচু উঁচু মিনার থেকে সরওয়ারে কায়েনাতের সম্মানিত নামও খালেকে কায়েনাতের মহিমান্বিত নামের সাথে সমুচ্চ স্বরে উচ্চারিত হয়। জলে-স্থলে, শহরে-গ্রামে, জনবসতিতে-বিরাণভূমিতে, পাহাড়ের চূড়ায় সর্বত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম উচ্চারিত হয়।

আরব-আজমের সর্দার, বিশ্বমানবতার রাহবার হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক নামে মুখরিত থাকে। ষ

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

advertisement