Zilhajj 1434   ||   October 2013

প্র তি বে শী : রাজনীতির অংকে রক্ত

Abu Tashrif

ভক্তি ও প্রেমের বন্যা বইয়ে দিলেও ভারতের সাম্প্রদায়িক চেহারার কোনো হেরফের হয়নি। ৫০ বছর আগে যে জায়গায় ছিল , এখনও সে জায়গাতেই আছে। ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা ভারতের ক্ষেত্রে একটা অপাদমস্তক ভড়ং হয়েই রয়েছে। এই সেদিন উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরের রক্তক্ষয়ী মুসলিমবিনাশী দাঙ্গায় আবারো সেটি প্রমাণিত হল।

সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের এ দাঙ্গায় (পড়ুন : মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের একপক্ষীয় আক্রমণ) শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। ৫০ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ৪০ টি শরণার্থী শিবিরে মার খাওয়া মুসলমানদের ভিড়। উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটছে মুজাফফরনগরের মুসলমানদের। আশ্রয় ও আশ্বাস নিয়ে সেভাবে কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। গণমাধ্যমগুলো বিশ্লেষণ করে বলেছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। দাঙ্গাবাজদের প্রতিরোধ ও দাঙ্গাকবলিত বিপণ্ণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার কোনো ভুমিকা  রেখেছে

 বলে শোনাই যায়নি। কিন্তু সংখ্যালঘুদের ভোট দখলের চেষ্টায় কেউ কসুর করছে না। প্রধান বিরোধী দল-সাম্প্রদায়িক বিজেপি তো রীতিমত দাঙ্গাপীড়িত মুসলমানদের

আরো ভীত-সন্ত্রস্ত করে সংখ্যাগুরুদের উল্লসিত ভোটের পাশাপাশি ব্ল্যাকমেইল করে সংখ্যালঘুদের ভোটও আদায় করে নেওযার কৌশল হাতে নিয়েছে।

মানবিকতার চেয়ে আক্রান্ত মুসলিমদের নিয়ে রাজনীতির

হিসাবটাই এখন বড় হয়ে উঠেছে মুজাফফরনগর ও গোটা উত্তর প্রদেশে। ওই রাজ্যে সরকার চালাচ্ছে সমাজবাদী পার্টি। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদব। গত দেড় দশক ধরে মুসলিম ভোটে ধন্য মুখ্যমন্ত্রী ১৫ সেপ্টেম্বর দাঙ্গাকবলিত এক গ্রামে গেলে তীব্র বিক্ষোভের মুখে পড়েন। নিপীড়িত মুসলমানরা তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাড় করান। ফলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতাকর্মীরা সেখানে সোৎসাহে নেমে পড়েছেন। যাদবের প্রতিদ্বন্দ্বী কেন্দ্রে বিজেপির সমর্থক মায়াবতীর বহুজন সমাজপার্টি উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকার ভেঙ্গে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির দাবি জানিয়েছে। কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরাও এ সুযোগের সদ্ব্যবহারে পিছিয়ে নেই।

মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী ১৬ সেপ্টেম্বর মুজাফফরনগরের কয়েকটি শরণার্থী শিবির

ঘুরে দেখেন। সেখানে গিয়ে তারা অপরাধীদের কঠোর সাজা দেওয়া এবং দুর্গত ব্যক্তিদের দ্রুত ঘরে ফেরানোর আশ্বাসবাণী শোনান। দাঙ্গাপরিস্থিতির পর কংগ্রেসের নেতারা নির্বাচনী হিসাব মিলিয়ে বেশ জোরের সঙ্গেই বলেন, আমরা নিশ্চিত, নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকে যারা রুখতে পারবে উত্তর প্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায় তাদেরই বেছে নেবে।

অপরদিকে দাঙ্গার উসকানি দাতারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বর্তমানে যারা কেন্দ্রে ও উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আছেন, তারা সংখ্যালঘু মুসলমানদের

নিরাপত্তা বিধান করতে পারছেন না। অতএব নিরাপত্তা চাইলে বিরোধী দলকেই (বিজেপি) ক্ষমতায় আনতে হবে। গুজরাটের দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিলেও এবার বিজেপির নেতা মোদিও নতুন চাল দিয়েছেন।

তিনি কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, আমরা তাদের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ পেয়েছি মুজাফফরনগনেন দাঙ্গায়।

এদিকে মুজাফফরনগরের মুসলমান বিনাশী দাঙ্গার পর অন্য একটি হিসাব গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় ভারতীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্রের এক বীভৎস চেহারাই যেন উন্মোচিত হয়ে গেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি থেকে সৌম্য বন্দোপাধ্যায়-এর পাঠারো প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছ: বিজেপি নিশ্চিত,

একদিকে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা, অন্যদিকে সহিংসতা- দুই কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐক্য উত্তর প্রদেশে তাদের ঝুলি ভরিয়ে দেবে। কংগ্রেসের দুশ্চিন্তাও ওটাই।

অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদলকে ছেড়ে জাট সম্প্রদায় বিজেপির দিকে ইতিমধ্যেই ঢলে পড়েছি। এদিকে মনমোহন সিং-সোনিয়া গান্ধী-রাহুল গান্ধীর এক সঙ্গে মুজাফফরনগর সফরকে প্রধান বিরোধীদল-বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ পর্যটন বলে কটাক্ষ করেছে।

জন্মের সময় দেশটির নেতারা বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা হবে তাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ। সংবিধানেও সে নীতির কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ওই দেশের বর্তমান নেতারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা রপ্তানিতে উদগ্রীব থাকে। আর প্রতিবেশী দেশের হীনম্মন্যতাগ্রস্ত কিছু লোক ভক্তি ও মুগ্ধতার সঙ্গে সে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের দিকে তাকিয়েও থাকে। সে দেশেই বার বার সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়। সে রক্তাক্ত আক্রমণ নিয়ে রাজনীতিকদের পক্ষ

থেকে মেলানো হয় নিষ্ঠুর রাজনৈতিক হিসাব। আবার ওই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মানুসারী বিশাল সংখ্যক মানুষ সেসব আক্রমণ নিয়ে উল্লসিত হন। সংখ্যালঘুদের ওপর

আক্রমণকারী ও আক্রমণে উস্কানিদাতাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। গণমাধ্যমে নির্বিকার ভাষায় সে সম্ভাবনার প্রতিবেদনও প্রচার হয়। তার পরও ওই দেশটাকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে আখ্যা দিয়ে অতি পরিচিত একশ্রেণীর বক্রবুদ্ধির জ্ঞানপাপীরা সুখ পায়।

অসহায় চোখে আমরা সে দৃশ্যটা দেখতে বাধ্য হই। 

 

advertisement