একটি ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা এবং একটি বুযুর্গ খান্দান
Ishaq Ubaydi
ইংরেজ বেনিয়ারা এ দেশ দখল করার পূর্বে শুধু বঙ্গদেশেই আশি হাজার কওমী মাদরাসা ছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ঐ সমস- মাদরাসার ব্যয়ভার বহন করার জন্য স'ায়ী বন্দোবস- দেওয়া জায়গীরগুলো ইংরেজরা এক ফরমান বলে রহিত করে দিলে ধীরে ধীরে সব মাদরাসা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশের আলেম-ওলামা ও মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতায় অনেক দিন পর্যন- তারা তটস' ছিল, কিন' ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে তা বিস্ফোরিত হতে গেলে ইংরেজরা তাদের কূট-কৌশল ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এমতাবস'ায় আমাদের পূর্বসূরী আকাবিরগণ সম্মুখ যুদ্ধ পরিহার করে মুসলমানদের দ্বীন-ঈমান বাকি রাখার স্বার্থে ১৮৬৬ সালে ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আর ঐ দেওবন্দ মাদরাসার অনুকরণে উপমহাদেশ জুড়ে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পূর্ববঙ্গেও বেশ কিছু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের হাটহাজারি দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা (বর্তমান অবস'ানে) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০১ সনে। আর ওই সময়েই ১৩২২ হিজরী সনে নোয়াখালির মান্দারী এলাকায় বটতলী গ্রামেও আশরাফুল মাদারিস নামে আরেকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা এখনো দ্বীনের আলো বিতরণ করে যাচ্ছে। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুজাদ্দেদে মিল্লাত হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর অন্যতম ভক্ত-মুরীদ হযরত মাওলানা আবদুল আযীয রাহ.। যিনি ‘জনাবওয়ালা’ নামেই বেশি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এই বুযুর্গ উলা বা মেশকাত পর্যন- একাই পড়াতেন। তাঁর কাছে পড়ালেখা করে এবং তাঁর সোহবত-সান্নিধ্যে থেকে অনেকে অনেক বড় আলেম ও জগতবিখ্যাত বুযুর্গ তৈরি হয়েছেন।
যেমন আরবী সাহিত্যে ‘সাবআ মুয়াল্লাকা’র অনুসরণে সাত মুয়াল্লাকা বিশিষ্ট কিতাব ‘আহমদুল আরব’ ও বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম সাহিত্যের মোকাবেলাকারী কবিতার বই ‘কেনান কুসুম’-এর রচয়িতা জগতবিখ্যাত বুযুর্গ আলেম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ কোববাদ রাহ. তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র ছিলেন। কথিত আছে যে, একদিন জনাবওয়ালা কোথাও দাওয়াতে যেতে চাইলেন। পথিমধ্যে সামান্য পানির কারণে তা পার হতে পারছিলেন না। এই অবস'া দেখে তাঁর এই ছাত্র পানিতে শুয়ে যান এবং বলেন যে, উস-াদজী, আমার গায়ের ওপর পা রেখে পার হয়ে যান। উস-াদের প্রতি ভক্তি ও অনুরাগ থাকা তো অবশ্যই দরকার। কিন' এমন ফিদায়ী ছাত্রের নজীর কি খুব বেশি পাওয়া যাবে?
হযরত জনাবওয়ালা ১৯০১ ইং থেকে ১৯৬০ ইং পর্যন- একটানা দীর্ঘ ৬০ বছর যাবত প্রথম জামাত থেকে ১০ম জামাত উলা বা মেশকাত শরীফ পর্যন- একাই তা’লীম-তরবিয়তের কাজ আঞ্জাম দেন। তাঁর ইনে-কালের পর হযরতের বড় ছাহেবযাদা হযরত মাওলানা আবদুুল হাফীয সাহেব ১৯৬১ থেকে ১৯৭২ পর্যন- ১২ বছর এই খেদমতে নিয়োজিত থাকেন। হযরত মাওলানা কোববাদ সাহেব সম্পর্কে নাকি হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেছিলেন, তোমরা সাহাবাদের নমুনা দেখতে চাইলে তাকে দেখ। সাহাবাদের পেছনে পড়ে যাওয়া এই কোববাদকে আমাদের যামানায় আমাদেরকে তাঁদের নমুনা দেখানোর উদ্দেশ্যেই হয়তো আল্লাহ তাআলা এত বিলম্বে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নোয়াখালী ছাড়াও কুমিল্লা-চট্টগ্রামের অনেক বড় বড় আলেমই জনাব ওয়ালার হাতে গড়া আলেম ছিলেন।
১৯৬১ সালে আমি ১২ বছরের কিশোর। চট্টগ্রামে পড়া-লেখা করার কারণে ছোট মানুষ বলে জনাবওয়ালা সম্পর্কে জানার ও তাঁর সাথে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ আমার তখন হয়নি। তবে তাঁর বড় ছাহেবযাদা হযরত মাওলানা আবদুল হাফীয সাহেবের সাথে কয়েকবার সাক্ষাত ও তাঁর কিঞ্চিত সোহবত-সান্নিধ্য আমার নসীব হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তিনিও পিতার মতো বড় মাপের আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জন্মের পর জনাবওয়ালা হযরত থানভী রাহ.-এর কাছে একটি সুন্দর নাম রাখার আরজ করলে হযরত থানভী রাহ. সাতটি ছেলের নাম ও তিনটি মেয়ের নাম লিখে দেন। সেই অনুপাতে প্রথম ছেলের নাম আবদুল হাফীয রাখা হয়। এখানে একটি বিষয় অত্যন- তাৎপর্যের ব্যাপার যে, হযরত জনাবওয়ালার সর্বমোট সন-ান জন্মেছিল ১৩ জন। ৯ পুত্র ও ৪ কন্যা। তবে হযরত থানভীর নির্বাচিত নামানুসারে যাদের নাম রাখা হয়েছিল তারা সবাই জীবিত ছিলেন, বাদ বাকি ৩ সন-ান শৈশবেই মৃত্যু বরণ করেন। এটা হযরত থানভী রাহ.-এর একটি যিন্দা কারামতই বটে। নামগুলো যথাক্রমে আবদুল হাফীয, আবদুল মুয়ীয, আবদুল হাফেয, আবদুল জলীল, আবদুল কবীর, আবদুল আযীম, আবদুল কাদীর, খাদীজা, রোকেয়া, ফাতেমা।
ভাইদের মধ্যে মোটামুটি সবাই আলেম ছিলেন। তবে বড়, মেঝো এবং পঞ্চম ভাই দেশের নামকরা আলেম ছিলেন। জনাবওয়ালার মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছাহেবযাদা বাবার মাদরাসার হাল ধরেন এবং তিনিও পিতার অনুকরণে একাই মেশকাত পর্যন- দশ জামাতের সবক পড়াতেন। তাঁর অনেক কারামতের কথা ছাত্রজীবনেই আমি শুনতে পেয়েছিলাম। তদুপরি একা কীভাবে দশটি জামাতের কিতাব পড়ান তা স্বচক্ষে দেখার জন্য দু আনা দিয়ে একটি মিসওয়াক খরিদ করে হযরতের জন্য হাদিয়া স্বরূপ আমি নিয়ে যাই। মাসটি ছিল রমযান মাস। হযরত কাচারি ঘরে একটি চেয়ারে বসা ছিলেন। আমি মোলাকাত করে হালপুরসী করলে বললেন, রমযানের আগে যেহেতু একা একা দশটি জামাতের দরস দান করেছি তাই পরিশ্রম তো অবশ্যই হয়েছিল কিন' এখন রমযানের ছুটির কারণে দরসের কাজ বন্ধ থাকায় শ্রম কিছুটা কমে যাওয়ায় হাই প্রেসার দেখা দিয়েছে এবং সেদিন পড়ে গিয়ে মাথায় জখম পেয়েছেন বলেও আমাকে দেখালেন। আমি সুযোগ পেয়ে হযরতের ছাত্রজীবনের একটি কারামতের কথা তাঁর নিজ মুখে শোনার জন্য বললাম, হযরত যখন দেওবন্দে মেশকাত শরীফ অধ্যয়ন করছিলেন তখনও তো একবার মারাত্মক অসুখ হয়েছিল। হযরত তখন ভোলা ভোলা শব্দে পুরা ঘটনাই আমাকে নিজ মুখে বলে দিলেন। এই মুবারক ও অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি আমার কাশকুলে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। হযরত বললেন, আব্বাজানের পীর ভাই হিসাবে দেওবন্দের মুহতামিম হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব আমাকে প্রতি মাসে ৫/- টাকা করে এজন্য বেশি দিতেন যে, আমি যেন হযরত থানভীর দরবারে যাই। কিন' হযরত থানভীকে তখন ভালো বুযুর্গ মনে করতাম না বলে আমার আর থানভীর দরবারে যাওয়া হত না। ইত্যবসরে আমার একটা মারাত্মক রোগ দেখা দিল, যে রোগে হাকীম ও ডাক্তাররা আমাকে মৃত বলে ঘোষণা দিলেন। আমাকে উত্তর মাথা করে কাপড় দিয়ে ঢেকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল এবং কারী তৈয়ব সাহেব হুজুর নিজ হাতে আমার কাফনের কাপড় কাঁচি দিয়ে কাটছিলেন। এমতাবস'ায় হঠাৎ আমি নড়া-চড়া দিয়ে উঠে যাচ্ছি দেখে হযরত কাফনের কাপড়টা আমার দৃষ্টি গোচর না হওয়ার জন্য খাটের নিচে ফেলে দেন এবং আমার পিঠ হযরতের বুকের সাথে চেপে রেখে হযরতের ওপর ঠেক দিয়ে কোনোমতে আমাকে বসান। ইতিমধ্যে ডাক্তার তলব করা হয়। ডাক্তার আমাকে ঔষুধ খাওয়াতে চাইলে আমি ইশারা করে বললাম যে, আমি ঔষধ খাব না। হযরত মনে করেছিলেন, আমার আত্মা হয়তো ছেকতার মতো কোথাও আটকা পড়ে ছিল এখন একটু নড়া-চড়া করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করব। কিন' না। আমি সম্পূর্ণ সুস' হয়ে গেলাম। এখানে ব্যাপারটা ছিল, আমি যখন অর্ধমৃত অবস'ায় ছিলাম তখন স্বপ্ন দেখছিলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রা. সহ আরেকজন খাদেম সমেত দেওবন্দ মাদরাসার পূর্ব দিক থেকে দেওবন্দের ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে উড়ে যাচ্ছিলেন। সামান্য যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা.কে বললেন, চলো এখানে একজন অসুস' রোগী আছে,আমরা তাকে দেখে আসি। এই বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেছনে ফিরে আমার মাথার পাশে বসে পড়লেন। অন্য পাশে হযরত আবু বকর রা.ও বসলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক গ্লাস পানি নিয়ে নিজে তাতে দম করে হযরত আবু বকর রা.কেও তাতে দম করতে বললেন। তৃতীয় ব্যক্তি যিনি ছিলেন তাকে আমি চিনি না, কিন' সাদা পোশাকে সজ্জিত পাগড়ি পরিহিত অবস'ায় খাদেমের মতো পাশে এক পায়ে দাড়িয়ে ছিলেন। পরে এই স্বপ্নের বৃত্তান- হযরত থানভীর কাছে বর্ণনা করার সময় ঐ খাদেমের আকৃতি বর্ণনার পর হযরত থানভী বললেন, তিনি হলেন হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ.।
যাই হোক, এখন দম করা পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, বাবা! এটা খেয়ে ফেল। আমি বললাম, হুজুর! খেলে কী হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি আরোগ্য লাভ করবে। আমি বললাম, আশা পুরণ না হলে বেঁচে থেকে কী লাভ? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার আশা কী? আমি বললাম, দাওরায়ে হাদীস পড়তে পারা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা হবে। আর কী আশা? আমি বললাম, হজ্ব নসীব হওয়া। তিনি বললেন, তাও হবে। আর কী? আমি বললাম, একজন ভালো পীরের হাতে বাইয়াত হতে পারা। নবীজী বললেন, তাও হবে। আর কী? এভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হস- মুবারকে পানির গ্লাসটি রেখেই ৫টি আশার কথা তাঁকে জানালাম এবং তিনি তা পূরণ হওয়ার ভবিষ্যদ্বানী করলেন। একটি বিষয় কারো কাছে না বলার জন্য হযরত থানভী রাহ. আদেশ করেছেন তাই তিনি তা আমাকেও আর বলেননি। আর একটি বিষয় আমি এখন ভুলে গেছি। হযরত আমাকে আবার বললেন, সব ক’টি আশা পূরণ হবার আশ্বাস পাওয়ার পর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত আবু বকর রা.-এর দম করা পানিটুকু পান করে নিলাম। এরপরই আমি সুস' হয়ে নড়া-চড়া করে উঠে বসি। সেই যে ভালো হলাম, এই পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আমার আর কোনো অসুখ-বিসুখ হয়নি। এবার শুধু হাই প্রেসারের কারণে মেঝেতে পড়ে একটু আঘাত পেয়েছি।
হুজুর আরো বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন আবার জিজ্ঞাসা করলাম, হুজুর! আমার হয়াত কত? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন ৭০। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, এখন থেকে ৭০ নাকি আমার জন্ম থেকে? তিনি হেসে বললেন, তা বলা যাবে না। হুজুর আমাকে আবার বললেন, মেশকাতের বছর আমার বয়স ২০ বছর। এখন পঞ্চাশ হয়ে সত্তর হয়ে গেছে। জানি না, কখন পরপারের ডাক আসে? আব্বাজানের এই আমানত কাকে সোপর্দ করব জানি না। আমার ভাই মুফতী আবদুল মুয়ীয ও আবদুল কবীর তো বড় আলেম, তারা লালবাগ মাদরাসার বড় মাপের উস-াদ, তারা কি গাঁও-গ্রামে এই আমানত রক্ষা করতে আসবে? কি জানি? হুজুর আমাকে আরো বললেন, ক’দিন আগে একদিন বিকেল বেলায় কাচারির সম্মুখে এভাবে চেয়ার নিয়ে বসে আছি এমন সময় বসিকপুরের এই রাস-া দিয়ে একজন পাগল উত্তর দিকে যেতে যেতে বলছিল, সত্তর তো হয়ে গেছে আর কত? সত্তর তো গেছে আর কত? প্রথমে আমি তার কথার তাৎপর্য সম্পর্কে খেয়াল করিনি, কিন' একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে, কথাগুলো তো সে আমাকেই বলছে। আমার আগের ২০ বছর আর এখনকার পঞ্চাশ বছর মিলিয়ে সত্তর হয়ে গেছে।
পরে হযরত থানভী রাহ.-এর হাতে তিনি বাইয়াতের সম্পর্ক করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ থেকে আমি ঢাকায় চলে যাওয়াতে হযরতের সাথে আর যোগাযোগ রক্ষা করতে পারিনি। এই সাক্ষাতের পূর্বে সম্ভবত আরেকদিন সেখানে আমি জুমার নামায পড়েছিলাম। জুমার খুতবায় দেখলাম, হযরত ‘আসসুলতানু যিল্লুল্লাহি ফিল আরদি’-এর মধ্যে ‘আদেল’ শব্দটি বাড়িয়ে দিয়ে ‘আসসুলতানুল আ’দিলু’ পড়লেন।
হযরত মাওলানা আবদুল হাফীয ছাহেবের অসংখ্য কারামত ছিল, যা পত্রস' করা সম্ভব নয়। তাঁর বড় ছাহেবযাদা মাওলানা আবদুর রহমান সাহেব ছাত্র জীবন থেকেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এবার যিয়ারত করতে গিয়ে শুনতে পেলাম যে, তিনিও পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলা তার এবং তার মুরব্বীদের সকলের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন। হুজুরের ছাহেবযাদা মাওলানা আবদুস শহীদও ছাত্রজীবন থেকেই আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এবার তাঁর সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়।
জনাবওয়ালার মেঝো ছাহেবযাদা হযরত মুফতী আবদুল মুয়ীয ছাহেবও বড় মাপের আলেমে দ্বীন ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি খুব কম কথার লোক ছিলেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ৮১-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অধম লেখক যখন হুজুরের প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম তখন অনেকবার মুফতী সাহেব হুজুরের সাথে লালবাগ মাদরাসার দপ্তরে দেখা-সাক্ষাত হয়েছে। তবে হুজুরের সাথে আমার মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি আছে বলে মনে পড়ছে না। খতীবে বাংলা মরহুম হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেসবাহ ছাহেব একসময় হযরত মুফতী সাহেব হুজুরের জামাতা ছিলেন বলে একবার মেসবাহ সাহেবের সাথে হুজুরের বাড়িতে মেহমান হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। হুজুরের ভাইপো আমার স্নেহাষ্পদ মাওলানা মাহফুযের মাধ্যমে তা হয়। জাতীয় মসজিদ ঢাকার বাইতুল মোকাররম-এর প্রথম খতীব হযরত মুফতী আমীমুল ইহসান ছাহেবের ইনে-কালের পর থেকে আমৃত্যু ঐ মসজিদের খতীবের দায়িত্ব তিনি পালন করেন। আল্লাহ তাঁকেও জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন।
হযরত মাওলানা আবদুল কবীর ছাহেবের সাথেও আমার পরিচয় এবং কিছুটা ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছিল ৮১-এর নির্বাচন থেকেই। আসলে আমার কর্মজীবনের যৌবন কেটেছে বাজে কাজে, অর্থাৎ রেডিও বাংলাদেশের চাকরিতে। তাই ঐ সময় দেশের বহু আলেম-ওলামা ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক গড়ার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হই। হযরত মাওলানা আবদুল কবীর ছাহেব হুজুরের সাথেও ঐ একই কারণে আমার পূর্বে পরিচয় ঘটতে পারেনি বলে আমার এখনও আফসোস হয়। তিনি হজরত হাফেজ্জী হুজুরের অন্যতম খলীফা হওয়ার সুবাদে খেলাফত আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সভা বা পরামর্শ সভায় তাঁর সাথে প্রায় দেখা হত এবং কথাবার্তা হত। আলেম হিসাবে তিনিও বড় মানের ও বুযুর্গ ছিলেন। তবে ৮১-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি ঢাকায় না থাকায় তাঁর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। আমার লালবাগ পড়ার সুযোগ না হলেও বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের অনেকেই ছিলেন লালবাগে হুজুরের ছাত্র। সে সুবাদে আমিও তাঁকে উস-াদের মতোই মনে করতাম। নব উত্থিত খেলাফত আন্দোলন ধ্বংস হওয়ার পেছনে যারা দায়ী ছিল বলে আমরা মনে করি, তাদেরকে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের অন্যতম খলীফা হওয়ার সুবাদে হুজুরকে অনেক সময় ব্যবহার করতে চেষ্টা করতে দেখেছি। সাদা দিল আল্লাহ ওয়ালা লোক বলে তারা একটু আধটু ব্যবহার করে ফেলতো অনেক সময়। হুজুর যখন নোয়াখালী জেলা খেলাফতের আমীর অধম তখন ঢাকায় ছিলাম বলে তাঁর সোহবত-সান্নিধ্য সব সময় আমার নসীব হয়নি। মাঝে মধ্যে জরুরি কোনো পরামর্শের সময় শুধু হুজুরের সাথে দেখা-সাক্ষাত হত। হুজুরের বড় ছাহেবযাদা মাওলানা হারুন ছাহেবের সাথে লালমাটিয়া মাদরাসায় একবার আমার পরিচয় হয়েছিল। আর আশরাফুল মাদারিসের বর্তমান মুহতামিম মাওলানা মামুন সাহেবের সাথেও কয়েকদিন পূর্বে আল আমিন মাদরাসায় মাইজদিতে পরিচয় হয়।
হযরত জনাব ওয়ালার সাত ছেলের সবাই আলেম হলেও এই তিন জনই ছিলেন বড় মাপের আলেম ও দেশ বরেণ্য আলেমে দ্বীন। আমার যা মনে হয়, জনাব ওয়ালার এই মুবারক খান্দানে শ’ খানেক আলেম তো অবশ্যই হবে এখন। এই খান্দানটি যেমন ঐতিহ্যবাহী খান্দান, ঠিক তেমনি আশরাফুল মাদারিসও ঐতিহ্যবাহী একটি পুরাতন দ্বীনী প্রতিষ্ঠান। ইংরেজদের কারণে যখন এই দেশে দ্বীনী ইলমের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তখন হাতে গোনা যে দু’একটি কওমী মাদরাসা সৃষ্টি হয়েছিল আশরাফুল মাদারিস তার অন্যতম।
মহান আল্লাহ তাআলা এই খান্দানকে এবং এই মাদরাসাকে তার দ্বীনের খেদমতের জন্য সব সময় কবুল ও মঞ্জুর করুন। সাথে সাথে আমাদেরকেও। আমীন।