মুহাম্মাদ আলী আকবর - জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা, ছোটবন গ্রাম, রাজশাহী
প্রশ্ন
মুহতারাম! আপনি কেমন আছেন? আমার বিশ্বাস আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহে নিশ্চয়ই ভালো আছেন। কারণ যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা তালিবানে ইলমের মুজাদ্দিদানা খেদমত নিচ্ছেন তাকে কি তিনি অশান্তিতে রাখতে পারেন। আমার খুব ইচ্ছা, আপনার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা নিব। তাই নিবেদন করছি।
ক) হুজুর, আমি জামাতে শরহে বেকায়াতে পড়ি। আমাদের নেসাবে আছে যথাক্রমে : কুরআন তরজমা (১-১৫), শরহে বেকায়া, মুয়াত্তা, মুখতাসারুল মাআনী, নূরুল আনওয়ার (কিতাবুল্লাহ), সিরাজী, মাকামাতে হারীরী ও আত তরীক ইলাল ইনশা (১-৩)। এ কিতাবগুলো কোন সময় ও কীভাবে মুতালাআ করলে ভালো হবে এবং সহায়ক হিসেবে কী কী শরাহ মুতালাআ করা যায় জানতে চাই।
খ) আমি আরবী শরাহ মুতালাআ করতে ইচ্ছুক। উল্লেখিত কিতাবগুলোর কী কী আরবী শরাহ মুতালাআ করা যেতে পারে। জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
উত্তর
اللهم ما أمسى بي من نعمة أو بأحد من خلقك فمنك وحدك لا شريك لك فلك الحمد ولك الشكر جزاك الله تعالى خيرا.
আল্লাহ তাআলা আপনার সুধারণা কবুল করুন।
আপনার প্রথম প্রশ্ন ছিল, নেসাবের কিতাবগুলো কীভাবে ও কোন সময় পড়বেন। এটা তো আসলে মাদরাসার নিয়মের বিষয়। মাদরাসার নেযামুল আওকাত অনুযায়ী মুতালাআ ও তাকরার করবেন।
যদি প্রশ্ন হয় নাশাত ও উদ্যমের সময় কোন কিতাব পড়া চাই, তাহলে মূলনীতি এই যে, সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ কিতাব ঐ সময় পড়া চাই, যখন মন-মস্তিষ্ক প্রফুল্ল থাকে এবং উদ্যম ও আগ্রহ পরিপূর্ণ থাকে। যেমন প্রথমে তারজামাতু মাআনিল কুরআনিল কারীম, এরপর মুখতাসারুল মাআনী, এরপর শরহে বিকায়া ...।
আর ‘কীভাবে মুতালাআ করব’-এটা একটা অস্পষ্ট প্রশ্ন। তবে বেশ প্রচলিত। প্রশ্ন অস্পষ্ট হলে উত্তরও তো অস্পষ্টই হবে। যাই হোক, এ বিষয়ে সাধারণ কিছু কথা আরজ করছি।
১. যা কিছু পড়ুন, বুঝে পড়ুন। অন্তত বুঝে পড়ার চেষ্টা করুন। যে কিতাবে অনুশীলন জরুরি, তাতে গুরুত্বের সাথে অনুশীলন করুন। যেমন ‘আততরীক ইলাল ইনশা’ কিতাবটি অনুশীলন ছাড়া পড়লে কি কোনো ফায়েদা হবে, তা যত বারই পড়া হোক? ইনশার জন্য এখন নতুন নতুন কিতাব এসেছে। সেগুলোর সহযোগিতা নিতেও কোনো বাধা নেই।
২. নিজের সাথে বা কোনো সহপাঠীর সাথে আলোচনা করুন যে, ইবারতের যে তরজমা করলেন তা কীভাবে করলেন। তরজমাটি কি ইবারতের সাথে মিলাতে পারেন, না শুধু অনুমান করে তরজমা করেছেন?
৩. যা বুঝলেন তা মাঝে মাঝে উস্তাদকে শুনিয়ে দেখুন, ঠিক বুঝলেন, না ভুল; পুরা বুঝলেন, না অর্ধেক।
৪. যে ইবারতের অর্থ বুঝে আসেনি,
চিন্তা করুন, কেন বুঝে আসেনি-
ক) কোনো শব্দের অর্থ না জানার কারণে? তাহলে গরীবুল ফিকহ (লোগাতুল ফিকহ)-এর কোনো কিতাব কিংবা কোনো সাধারণ ও নির্ভরযোগ্য লোগাতের কিতাবের সহায়তা নিন।
খ) তারকীব না বোঝার কারণে? তাহলে বার বার চিন্তা করুন। কারো সাথে আলোচনা করুন। কিংবা নাহব-সরফের কিতাবের সহায়তা নিন।
গ) কিতাবের আলোচনা-ভঙ্গির সাথে পরিচিত না হওয়ার কারণে? তাহলে বারবার মুতালাআ করে কিতাবের সাথে ‘উন্স’ ও ভাব পয়দা করুন।
ঘ) বিষয়টি জটিল হওয়ার কারণে? তাহলে নির্ভরযোগ্য কোনো শরাহর সহায়তা নিন এবং সবশেষে উস্তাদের শরণাপন্ন হোন।
ঙ) ফনটি আপনার জন্য নতুন হওয়ার কারণে? তাহলে প্রথমেই চিন্তা করুন, ফনটি যদি জরুরি হয় তাহলে এর সাথে পরিচয় না থাকা কত লজ্জার কথা! সুতরাং তালীমী মুরববীর মশোয়ারা অনুযায়ী ঐ ফনের কোনো সহজ ও আকর্ষণীয় কিতাব পাঠ করুন এবং ফনটির সুফল ও প্রয়োজন চিন্তা করে তার সাথে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করুন।
চ) না বোঝার কারণ কি কিতাবী ইসতিদাদের দুর্বলতা? তাহলে ধীরে ধীরে এই দুর্বলতা দূর করার চেষ্টা করুন। এর জন্য কোনো প্রাজ্ঞ ও স্নেহশীল উস্তাদের তত্ত্বাবধান অপরিহার্য। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী মেহনত করতে হবে এবং মেহনত জারি রাখতে হবে। হিম্মত হারানো যাবে না। মেহনত ও দুআ এবং তাকওয়া ও ইনাবত ইলাল্লাহ জারি থাকলে মাহরূম হওয়ার কারণ নেই।
والذين جهدوا فينا لنهدينهم سبلنا، وان الله لمع المحسنين
প্রথম প্রশ্নের দ্বিতীয় কথা ছিল, ঐ সকল কিতাবের সহায়ক হিসেবে কী কী শরাহ মুতালাআ করা যায়।
তরজমাতু মাআনিল কুরআনিল কারীমের জন্য আততরীক ইলাল কুরআনিল কারীমের তিন হিস্যা মুতালাআ করে বোঝার চেষ্টা করুন। এই দরসে আপনাকে কোন কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি হযরতুল উস্তাযের তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, অনুবাদ : হযরত মাওলানা আবুল বাশার ছাহেব, নিয়মিত মুতালাআয় রাখুন। শরহে বেকায়া ও অন্যান্য কিতাবের জন্য কিতাবের সাথে যুক্ত আরবী হাশিয়াই যথেষ্ট। প্রথমে সরাসরি কিতাব হল করার চেষ্টা করুন। খুব প্রয়োজন হলে হাশিয়ার সহায়তা নিন। কিতাব হল হয়ে যাওয়ার পর যদি সময় থাকে তাহলে আরো জানার জন্য, কোনো গলতির ইসলাহের জন্য, কিংবা কোনো অস্পষ্ট বিষয় পুরাপুরি বোঝার জন্য শুরূহ ও হাওয়াশীর সহায়তা নিন।
শুরূহ ও হাওয়াশীর মুতালাআ সঠিক উদ্দেশ্যে হওয়া চাই। শুধু রসম হিসেবে কিংবা ইসতিদাদের কমতি পুরা করার জন্য না হওয়া চাই। অর্থাৎ যে কিতাব পড়ার জন্য যে পরিমাণ ইসতিদাদ জরুরি তা হাসিল না করেই কিতাব শুরু করা হল এবং ইসতিদাদের কমতি শুরূহ-হাওয়াশী; বরং বাংলা তরজমা ও নোটবই দ্বারা পূরণ করার চেষ্টা করা হল! মনে রাখবেন, এটা একটা ব্যর্থ চেষ্টা। এজন্য প্রত্যেক তালিবে ইলম ভাইয়ের কাছে আমার দরখাস্ত, প্রথম জামাত থেকেই মেহনত করে পড়ুন এবং প্রথম থেকেই নিজের সম্পর্কে দায়িত্বশীল হোন।
আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, নেসাবী কিতাবসমূহের আরবী শরহ মুতালাআ করতে চান। জানতে চাচ্ছেন, কোন কিতাবের মুনাসিব আরবী শরহ কোনটি।
আরবী শরাহর প্রতি আপনার আগ্রহ মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য। একজন তালিবে ইলমের কুতুবখানায় সাধ্য অনুযায়ী শুরূহ ও হাওয়াশী থাকা উচিত। তবে সেসবের মুতালাআ নেযাম অনুযায়ী হতে হবে। যেন ‘তালাবুল কুল্ল ফওতুল কুল্ল’ এর দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হয়। কিংবা ‘আলআহাম ফালআহাম’ নীতির বিপরীত না হয়।
‘তরজমাতু মাআনিল কুরআনিল কারীম’-এর জন্য রাগিব আসফাহানীর ‘মুফরাদাতুল কুরআন’, ‘তাইসীরুল কারীমিল মান্নান’, বা ‘আইসারুত তাফাসীর’, কিংবা ‘তাফসীরে ইবনে কাছীর’ সংগ্রহ করতে পারেন।
শরহে বেকায়া সম্পর্কে ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে।
‘মুখতাসারুল মাআনী’র ক্ষেত্রে কিতাব হল করার মাকসাদ তাজরীদ দ্বারা হাসিল হতে পারে। আর ফন্নী বহসগুলোর জন্য ‘তালখীসূল মিফতাহ’-এর ফন্নী শুরূহ এবং মাআনী-বয়ানের ফন্নী কিতাবসমূহ সংগ্রহ করতে হবে। এর একটি তালিকা আপনি নিজে প্রস্ত্তত করে কোনো সময় দেখিয়ে নিতে পারেন।
নূরুল আনোয়ারের জন্য ‘কাশফুল আসরার’ (আলমানারের উপর খোদ মুসান্নাফের শরহ) সংগ্রহ করুন এবং উসূলে ফিকহের নতুন পুরাতন যত কিতাব পান সংগ্রহ করুন। জাসসাস রাহ.-এর ‘আলফুসূল’, সারাখসী-এর ‘উসূল’ ও আলাউদ্দীন বুখারী রাহ.-এর ‘কাশফুল আসরার শরহ উসূলিল বাযদভী’ ইত্যাদি আগে থেকেই মুদ্রিত আছে। আর এখন তো মাশাআল্লাহ আরো অনেক প্রাচীন কিতাব মুদ্রিত হয়েছে এবং নতুন নতুন অনেক কিতাব ছাপা হয়ে আসছে।
সিরাজীর জন্য আমাদের উস্তাদগণ ‘হাশিয়ায়ে শরীফিয়্যাহ’ পাশে রাখার পরামর্শ দিতেন। এখন নতুন প্রেক্ষাপটে ফিকহুল মাওয়ারীছের নতুন কিতাবাদিও সংগ্রহ করা জরুরি। তাছাড়া আপনার জানা থাকার কথা যে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ফিকহ-ফতোয়ার সকল গ্রন্থেই ফারাইয-অধ্যায় আছে। তাছাড়া তাফসীরের কিতাবসমূহে আছে মীরাছ-সংক্রান্ত আয়াতসমূহের উপর আলোচনা এবং শুরূহে হাদীসে আছে মীরাছ বিষয়ক হাদীসসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
মাকামাত সম্পর্কে সম্ভবত আগেও লিখেছে। জনাব মাওলানা আহমদ মায়মূন দামাত বারাকাতুহুম মাকামাতের যে বাংলা শরহ লিখেছেন তার ভূমিকা পাঠ করুন, ইনশাআল্লাহ জরুরি নির্দেশনা পাবেন।