মুহাম্মদ ইবরাহীম খলীল - মাদানী নগর
প্রশ্ন
মুহতারাম! আমি আপনাকে আল্লাহর জন্য মুহাববত করি। বিভিন্ন সমস্যায় আপনার কাছে লিখতে ইচ্ছে হলেও সুযোগ হয় না। আজ বিকেলে সুযোগ পেয়ে লিখছি। আমি কাফিয়া জামাতে পড়ি। এ জামাতে আমাদের পাঠ্য কিতাবগুলো হচ্ছে, তরজমাতুল কুরআন (১১-২০ পারা), কুদূরী, উসূলুশ শাশী, দুরুসুল বালাগাহ, কাফিয়া ও মিরকাত। এগুলোর মধ্যে কাফিয়ার লম্বা তাকরীর মুখস্থ করতে ভালো লাগে না। তেমনি মিরকাত কিতাবটিও সবকের সময় ছাড়া অন্য সময় পড়তে ইচ্ছে হয় না। কারণ এগুলোর পিছনে সময় দিলে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের শরাহ মুতালাআ করা যায় না। এখন আমার করণীয় কী?
উত্তর
আপনি যে মাদরাসায় পড়াশোনা করেন সেখানকার নেসাব-নেযামের অনুগত থাকা আপনার কর্তব্য। মাদরাসার সবকিছুকে সম্মান ও গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করুন। তবে একথা সত্য যে, কাফিয়ার শরাহসমূহের অপ্রয়োজনীয় ও দূর সম্পর্কীয় ‘কিলা-কুলনা’র পেছনে সময় ব্যয় করা উচিত নয়। এ বিষয়ে উস্তাযে মুহতারাম হযরত তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম ও দেওবন্দের শায়খ সাঈদ আহমদ পালনপুরী দামাত বারাকাতুহুমের পরামর্শ অনুসরণ করতে পারেন।
তাঁদের পরামর্শ যদিও পাঠদান-পদ্ধতির সাথে সম্পর্কিত, তবে একজন বুদ্ধিমান তালিবে ইলম তা থেকে নিজের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারেন।
তাঁদের উভয়ের আলোচনার সারমর্ম হল, কাফিয়া ইলমে নাহবের একটি মশহূর মতন। এর ইবারত সহজ। ফনের জরুরি সব মাসআলা এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। এর দ্বারা প্রয়োজন পূর্ণ হয়ে যায়।
ফিকহের ক্ষেত্রে মুখতাসারুল কুদূরী যেমন নাহবের ক্ষেত্রে কাফিয়া তেমনই। অর্থাৎ এতে শুধু নাহবের মাসআলা বয়ান করা হয়েছে। বিস্তারিত দলিলের জন্য রয়েছে শরহে জামী, যেমন ফিকহের ক্ষেত্রে আছে হিদায়া। কিন্তু মূল কাফিয়ার মাসআলার পিছনে সময় ব্যয় না করে কায়েদার দলিল ও নুকতা এবং যুক্তি ও রহস্য বর্ণনার পেছনে প্রচুর সময় ব্যয় করা হয়। এই ধারার প্রচলন করেছেন খোরাসানী ও আফগানী কিছু আলিম। এভাবে প্রশ্নোত্তর, হাকীকত-মারিফত এবং ‘নুকতা দর নুকতা’র সিলসিলা শুরু হয়ে গেল আর ধীরে ধীরে মূল মাসআলাগুলোই গুরুত্বহীন হয়ে যেতে থাকল।
অতএব কাফিয়ার তালিবে ইলমের প্রথম দায়িত্ব হল, মূল মাসআলা খুব ভালোভাবে বুঝা ও তা আত্মস্থ করে নেওয়া। কারণ এই কিতাবের মাকসাদই হল, প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্ঞানলাভের পর নাহবের বিস্তারিত মাসআলাগুলোর মাধ্যমে ফনের সাথে তালিবে ইলমের মুনাসাবাত তৈরি করা এবং বিভিন্ন উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত দ্বারা নাহবের মাসআলা ইস্তেম্বাত করার যোগ্যতা পয়দা করা।
তবে বুঝার স্তর ‘হিদায়াতুন নাহু’ থেকে এটুকু উঁচু হতে পারে যে, ইবারতের ফাওয়ায়েদ-কুয়ূদ ও শব্দ-বাক্যের প্রেক্ষাপট স্পষ্ট হয়ে যায় এবং গ্রন্থকার যে সকল আলোচনা অতি সংক্ষেপে করেছেন তা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায়।
এর বাইরে নাহবের সাথে সম্পর্কহীন আকলী মুনাকাশা ও শাব্দিক মারপ্যাঁচ সম্পূর্ণ পরিহার করা উচিত।
২. কাফিয়ার সর্বোত্তম শরহ হল শরহে রযী। এছাড়া শরহে জামী ও হাশিয়ায়ে ঈসামেও এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা কিতাব বোঝার জন্য জরুরি কিংবা ইলমে নাহবের সাথে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ‘তাহরীরে সম্বট’ জাতীয় যে সকল শরহে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা রয়েছে কোনো অবস্থাতেই তালিবে ইলমদেরকে এই সব শরহ দেখার অনুমতি দেওয়া যায় না।
উদাহরণস্বরূপ,
لكلمة لفظ وضع لمعنى مفرد
এর পিছনে যেভাবে দিনের পর দিন ব্যয় করা হয়, এর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং এই বাক্যের মূল অর্থের বাইরে শুধু আলিফ-লামের প্রকারভেদ, মুফরাদের অর্থ এবং এর ইবারতগত ও অর্থগত পার্থক্যগুলো বুঝে নেওয়াই যথেষ্ট। তবে আলিফ-লামের প্রকারাদির জন্য এই পরিমাণ উদাহরণ বের করা চাই, যাতে প্রত্যেক প্রকারের পূর্ণ পরিচয় যেহেনে বসে যায়।
৩. অনর্থক আলোচনা পরিহার করার ফলে যে সময় পাওয়া যাবে তা নাহবের প্রায়োগিক যোগ্যতা তৈরির পিছনে ব্যয় করা উচিত। কিতাবে বর্ণিত মাসআলাগুলোর মিছাল ছাড়াও আরো মিছাল, কুরআন-হাদীস ও আরবী সাহিত্য থেকে দৃষ্টান্ত বের করা, এই ধরনের আরো নতুন নতুন বাক্য তৈরি করা; যাতে পঠিত কায়দার উপর ভালোভাবে তামরীন হয়ে যায়।
এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কাফিয়ার তালিবে ইলম ‘আননাহবুল ওয়াফী’ মুতালাআয় রাখতে পারে। এই কিতাবে কাফিয়া স্তরের উপযোগী মাসআলা কুরআন-হাদীস ও আরবী সাহিত্যের বিভিন্ন উদাহরণসহকারে পেশ করা হয়েছে। এর বাইরে এই কিতাবে আলাদা তামরীন অংশও রয়েছে। এতে করে একদিকে কাফিয়ার মাসায়েলের ইজরা হবে, অন্যদিকে ধীরে ধীরে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের রুচি তৈরি হবে।
এক্ষেত্রেও মূল কথা হল, কাফিয়ার তালিবে ইলমদের উচিত, সাহিত্য-রুচি ও নাহবী যওক আছে এমন উস্তাদদের সহযোগিতা নেওয়া। আর প্রত্যেক
উস্তাযেরও কর্তব্য, আদবী যওক উন্নত করার চেষ্টা করা এবং নাহব ও আরবী সাহিত্যের মৌলিক ও মানোত্তীর্ণ গ্রন্থসমূহ নিজেদের সাধারণ মুতালাআয় রাখা। (পালনপুরী দা.বা. কৃত হা-দিয়া শরহে কাফিয়া, দরসে নিযামী কি কিতাবে ক্যায়সে পড়হেঁ আওর পড়হায়েঁ ২৬-২৯)
আর মিরকাত পর্যন্ত মানতিক তো খুব বেশি নয়। তাই মিরকাত বা এই জাতীয় কোনো সহজ কিতাব থেকে মানতিকের ইস্তিলাহগুলো মোটামুটিভাবে আত্মস্থ করে নেওয়াই ভালো।
তাছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফনের যে কিতাবগুলো নেসাবে আছে, সে ক্ষেত্রে নিয়ম হল, প্রথমে মূল মতন ভালোভাবে হল করতে চেষ্টা করুন। সাথে সাথে এসব কিতাবের আরবী শরহ-হাশিয়াগুলোর সাথে পরিচিত হোন। মাঝে মাঝে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বহস কিংবা কোনো ইবারত জটিল মনে হলে এসব আরবী শরহের সহযোগিতা নিন। নেযামুল আওকাতে তারপরও সময় থাকলে নির্দিষ্ট কোনো শরহ নিয়মিত মুতালাআ করতে পারলে তো নূরুন আলা নূর। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমলের তাওফীক দান করুন। আমীন।