জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৮ || জুলাই ২০০৭

উমর ফারুক (জয়পুরী) - জামাতে জালালাইন, মতিঝিল মাদরাসা, ঢাকা

প্রশ্ন

আমি জামাতে জালালাইনের ছাত্র। হিদায়া কিতাব অধ্যয়নকালে তার হাশিয়া, বিশেষভাবে তাখরীজে আহাদীস-এর দিকে নজর দিলে হানাফী মাযহাবের অনেক মাসআলাই দুর্বল মনে হয়। যেমন রাফয়ে ইয়াদাইন, কিরাআত খালফাল ইমাম মহিলাদের ইমামত ও জামাত সম্পর্কিত মাসআলার হাদীসগুলি কোনোটি জয়ীফ, কোনোটি মাজহুল আবার কোনোটি মাতরুক। পক্ষান্তরে শাফেয়ী মাযহাবের দলীলগুলি খুব মজবুত মনে হয়। ফলে হানাফী মাযহাব সম্পর্কে আমার মনে অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এখন হুজুরের নিকট আমার আরজ এই যে, উপরোক্ত সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য আমি কী করতে পারি। সুপরামর্শ দেওয়ার আবেদন রইল।

উত্তর

এখানে দুটি বিষয় রয়েছে-এক. ওই মাসআলাগুলোর দালীলিক অবস্থা যা হিদায়া-গ্রন্থকার উল্লেখ করেছেন। দুই. হিদায়ার পেশকৃত দলীলসমূহে মান। যদি হিদায়া গ্রন্থকারের পেশকৃত কোনো আকলী বা নকলী দলীলে কোনো ত্রুটি বা দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয় তবে বিশেষ ওই দলীলটি দুর্বল সাব্যস্ত হতে পারে; কিন্তু মূল মাসআলার দালীলিক অবস্থান দুর্বল হতে পারে না। কেননা অন্যান্য কিতাবে এই মাসআলার আরও অনেক দলীল বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় এই যে, কোনো সাধারণ পাঠক যখন হিদায়ার কোনো দলীলে কোনো ধরনের ত্রুটি বা দুর্বলতার সন্ধান পায় তখন সম্পূর্ণ বিষয়টির তাহকীক করা ছাড়াই খুব দ্রুত দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। প্রথম সিদ্ধান্ত এই যে, হিদায়া গ্রন্থকার মুহাদ্দিস ছিলেন না। তিনি হাদীস জানতেন না। তাই এ ধরনের ভিত্তিহীন রিওয়ায়াত দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত এই যে, হানাফী মাযহাব দলীলের দিক দিয়ে খুব দুর্বল; বরং একটি ভিত্তিহীন মাযহাব! এই মাযহাবের কাজই হল সহীহ হাদীস ছেড়ে জয়ীফ হাদীস অবলম্বন করা। নাউযুবিল্লাহ।

উপরের দুই ধারণাই ভুল। দ্বিতীয় ধারণার ভ্রান্তি তো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। এ বিষয়ে এখন আলোচনা করছি না। এখানে যেহেতু হিদায়ায় উল্লেখিত হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে তাই আমি এ মুহূর্তে শুধু এ প্রসঙ্গেই আলোচনা করছি।

ইলমে হাদীসে ছাহিবে হিদায়ার মাকাম এ বিষয়ে প্রচুর তথ্য ও আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু যেহেতু আমাদের তালিবে ইলম ভাইয়েরা দরসিয়াত সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিও সাধারণত মুতালাআ করেন না। তাই ছাহিবে হিদায়া সম্পর্কে তাদের মনে কিছু ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়।

উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.) এ বিষয়ে ইবনে মাজা আগুন ইলমে হাদীস পৃ. ১৯৪-১৯৮, মা তামাসসু ইলাইহিল হাজাহ ... (সুনানে ইবনে মাজায় ভূমিকা) পৃ. ১৫, এবং আততাকীবাত আলাদ দিরাসাত পৃ. ৪০৮-৪১৩ এ অত্যন্ত দালীলিক ও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রাহ.ও (১৩১০-১৩৯৪ হি) এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরদার আলোচনা আলইমাম আবু হানীফা ওয়া আসহাবুহুমুল মুহাদ্দিসূন (ইলাউস সুনান-এর ভূমিকায়) করেছেন এবং শায়খ মুহাম্মাদ আউয়ামাহ দিরাসাতুন হাদীসিয়্যাতুন মুকারানাহ লি নাসবির রায়াহ ওয়া ফাতহিল ক্বাদীর ওয়া মুনয়াতিল আলমায়ী কিতাবে অত্যন্ত বিস্তারিত ও হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেছেন। তাঁর পুরো কিতাবটিই পড়ার মতো। নাসবুর রায়াহ-এর দারুল কিবলা জিদ্দা থেকে প্রকাশিত ছয় খণ্ডের এডিশনের প্রথম খণ্ড হল এই কিতাবটি। আমাদের এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী তার পিতা হযরত মাওলানা আবুল হাসান চাটগামী রাহ.-এর কিতাব তানযীমুদ দিরায়াহ-এর আলোচনায় সারাংশ কিছু সংযুক্তিসহ উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে আকাবিরের কিছু কথা আমিও আলমাদখাল ইলা উলূমিল হাদীস শরীফ পৃ. ১০৩-১০৫ এ উল্লেখ করেছি। এ কিতাবের দ্বিতীয় এডিশন প্রকাশিত হয়েছে।

উপরোক্ত কিতাবগুলোর মধ্যে যে কিতাবটিই আপনি সংগ্রহ করতে পারেন সংগ্রহ করুন এবং সেখানে ইলমে হাদীসে ছাহিবে হিদায়ার মাকাম বিষয়ক আলোচনা মনোযোগের সঙ্গে পড়ুন। ইনশাআল্লাহ আপনার সামনে তাহকীক-এর নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

আপনার সুবিধার জন্য মাওলানা নুমানী রাহ.-এর কিছু কথা এখানেও উল্লেখ করছি।

ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর অনেক রচনা এখানে বিদ্যমান রয়েছে এবং বেশ কিছু রচনা মুদ্রিত আকারেও রয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.-এর রচনাবলির মধ্যে ‘‘কিতাবুল খারাজ’’, ‘‘কিতাবুল আছার’’ (যা তিনি ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে বর্ণনা করেন) ‘‘ইখতিলাফু আবী হানাফী ওয়াবনি আবী লাইলা’’, ‘‘আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ী’’ প্রকাশিত হয়েছে। মিসর থেকে ‘‘কিতাবুল খারাজ’’ একাধিক বার প্রকাশিত হয়েছে এবং অন্য তিন কিতাব হয়দরাবাদের মজলিসে ইহইয়াউল মাআরিফিন নুমানিয়্যাহ, মাওলানা আবুল ওয়াফা আফগানী রাহ.-এর তাসহীহ ও তালীকসহ মিসর থেকে প্রকাশ করেছে।

ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর রচনাবলির মধ্যে কিতাবুল হুজাজ অনেকদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে এবং মুয়াত্তা কিতাবুল আছারও অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে।

যদিও তাঁদের অনেক রচনা কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীরও অনেক ইমামের রচনা এখন একেবারেই দুষ্প্রাপ্য পরবর্তী ইমামদের যে রচনাগুলো সেগুলোর সারসংক্ষেপ উল্লেখিত হয়েছে তা আলহামদুলিল্লাহ এখনও বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ শামসুল আইম্মা সারাখসী রাহ. (মৃত্যু : ৪৯০ হি.)-এর ‘‘মাবসূত’’, মালিকুল উলামা কাসানী (মৃত্যু : ৫৮৭ হি.)-এর ‘‘বাদায়েউস সানায়ে’’ এবং শাইখুল ইসলাম বুরহানুদ্দীন মারগীনানী রাহ. (মৃত্যু : ৫৯৩ হি.)-এর ‘‘হিদায়া’’ এই তিনটি গ্রন্থ উল্লেখ করা যায়। কেননা এই তিন কিতাবে যে হাদীস ও আছার উল্লেখিত হয়েছে তা পূর্ববর্তী হানাফী ইমামদের রচনাবলি থেকে গৃহিত। ওই ইমামগণের উপর আস্থাশীল হয়ে তারা এই হাদীস ও আছরের সনদ ও উদ্ধৃতি উল্লেখ করেননি। হাফেয কাসিম ইবনে কুতলূবুগা রাহ. ‘‘মুনইয়াতুল আলমায়ী ফী মা ফাতা মিন তাখরীজি আহাদীসিল হিদায়া লিযযাহাবীর ভূমিকায় লেখেন, আমাদের পূর্ববর্তী ইমামগণ, আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, ফিকহী মাসাইল এবং সেগুলোর দলীল হিসেবে হাদীস শরীফ সনদসহ লেখাতেন। ইমাম আবু ইউসুফের ‘‘কিতাবুস সিয়ার’’ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তদ্রূপ ইমাম ত্বহাবী, খাসাফ, আবু বকর রাযী, কারখী প্রমুখের রীতিও তা-ই ছিল। তবে ‘‘মুখতাসারা’’ শ্রেণীর রচনাবলি এর ব্যতিক্রম। পরবর্তী যুগের ব্যক্তিবর্গ পূর্ববর্তীদের রচনাবলির উপর নির্ভর করে সেই হাদীসগুলোকে সনদ ও উদ্ধৃতি ছাড়াই নিজেদের রচনায় উল্লেখ করেছেন। পরে মানুষ এই সংক্ষিপ্ত রচনাগুলোকেই গ্রহণ করেছে।

আমাদের ফকীহগণ পূর্ববর্তী ইমামগণের প্রতি এরূপ আস্থাশীল ছিলেন যেমন ইমাম বাগাভী ও শাহ ওয়ালি উল্লাহ সিহাহ সিত্তার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন এবং যেভাবে ইমাম বাগাভী মাসাবীহুস সুন্নাহ গ্রন্থে এবং শাহ ওয়ালি উল্লাহ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় ওইসব কিতাবের হাদীস সনদ ও উদ্ধৃতি ছাড়া উল্লেখ করেছেন তদ্রূপ হানাফী ফকীহগণও তাঁদের ইমামগণের বর্ণনাসমূহ নিজেদের রচনায় এভাবেই স্থান দিয়েছিলেন। পরে যখন তাতারীদের আক্রমণে মুসলিম জাহান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল এবং আজমী অঞ্চলসমূহ থেকে আরম্ভ করে দারুল খিলাফা বাগদাদ পর্যন্ত মুসলিম জাহানের সকল কেন্দ্র একে একে বরবাদ হল তখন পূর্ববর্তীদের রচনাবলির এক বিরাট অংশ বিনষ্ট হয়ে যায়। অনেক গ্রন্থ যা এই ফিৎনার আগে একদম সহজলভ্য ছিল ফিৎনার পরে তা একদম হারিয়ে গেল। এজন্যই পরবর্তী হাফেযে হাদীসগণের মধ্যে যারা হিদায়া বা এ ধরনের গ্রন্থগুলোর হাদীসের তাখরীজের (সূত্র-নির্দেশ) কাজ করেছেন তাদেরকে বিভিন্ন বর্ণনা সম্পর্কে বলতে হয়েছে যে এই বর্ণনাটি হুবহু এই শব্দে আমরা পেলাম না। কেননা তারা ওই হাদীসগুলি হানাফী ইমামগণের রচনায় তালাশ করার স্থলে পরবর্তী হাদীসবিদগণের ওইসব গ্রন্থে তালাশ করেছেন, যা তাদের যুগে প্রসিদ্ধ ও সহজলভ্য ছিল। এখান থেকে হিদায়া গ্রন্থকার সম্পর্কে কারো কারো এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, হাদীসের বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি সংকীর্ণ ছিল তদ্রূপ ওই হাদীসগুলো সম্পর্কেও এই ধারণা করেছেন যে, এগুলো বোধ হয় দুর্বল হাদীস। অথচ ইলমে হাদীসের সঙ্গে ছাহিবে হিদায়ার সম্পর্কেও কম ছিল না এবং তিনি যে হাদীসগুলি বর্ণনা করেছেন তা-ও জয়ীফ নয়। ছাহিবে হিদায়া নিজেও অনেক বড় মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন, আর তিনি যে হাদীসগুলো উল্লেখ করেছেন তা পূর্ববর্তী ইমামগণের গ্রন্থাবলি থেকেই গ্রহণ করেছেন। আমরাও কিছু হাদীসের ক্ষেত্রে দেখেছি যে, হাফেয যাইলায়ী ও হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী প্রমুখ হিদায়ার তাখরীজকারগণ স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, হাদীসটি আমরা পাইনি, কিন্তু হাদীসগুলো কিতাবুল আছার মাবসূতে ইমাম মুহাম্মাদ ইত্যাদি গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। শুধু হিদায়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন তা নয়, সহীহ বুখারীর অনেক তালীক সম্পর্কে হাফেয ইবনে হাজার অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। যার মূল কারণ হল, ইমামগণের গ্রন্থাদি দুর্বল হয়ে যাওয়া। অন্যথায় ইমাম বুখারী, ছাহিবে হিদায়া প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে এই সন্দেহ করাও বাতুলতা যে, তারা কোনো ভিত্তিহীন বর্ণনা রেওয়ায়েত করবেন।’’-ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস

হিদায়ার হাদীস সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

এ পর্যন্ত একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার অন্য বিষয়টি একটি ঘটনা থেকে বুঝে নিন। ঐতিহাসিক মীর খুর্দ সিয়ারুল আউলিয়া কিতাবে লিখেছেন যে, ‘‘মাওলানা ফখরুদ্দীন যারাদী (৭৪৮ হি.) একবার হিদায়ার দরস দিচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর দোস্ত মাওলানা কামালুদ্দীন সামানী সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত হলেন। যিনি ফিকহ বিষয়ে ভিন্ন মাসলাকের অনুসারী ছিলেন। তাঁকে দেখে মাওলানা ফখরুদ্দীন রাহ. হিদায়া কিতাবে উল্লেখিত হাদীসগুলোর পরিবর্তে ওই মাসআলাগুলোতেই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীস পেশ করতে শুরু করেন।’’

মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী রাহ. হিন্দুস্তান মে মুসলমানোঁ কা নেযামে তালীম ও তারবিয়ত কিতাবে (খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১৫৬-১৫৭) উপরোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করার পর লিখেছেন-

হিদায়ার যে হাদীসগুলোর নিচে টীকাকারগণ ‘‘গরীব’’ শব্দ সংযুক্ত করেছেন এটা সাধারণত হাদীসের শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যথায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই অর্থ ও মর্ম সিহাহ-এর হাদীস থেকেও প্রমাণ করা যায়।

হাশিয়ায়ে হিদায়া তাখরীজে হিদায়া

হিদায়ার যে হাশিয়া আপনার সামনে রয়েছে তা মাওলানা আবদুল হাই লাখনোভী এবং তাঁর পিতা মাওলানা আবদুল হালীম লাখনোভী কৃত। আওয়ালাইন-এর হাশিয়া পুত্রের এবং আখিরাইন-এর হাশিয়া পিতার। এই হাশিয়ার পরিবর্তে আপনি যদি লাখনোভী রাহ.-এর সমসাময়িক মাওলানা মুহাম্মাদ হাসান সম্ভলী (মৃত্যু : ১৩০৫ হি.)-এর হাশিয়া মুতালাআ করতেন, তদ্রূপ তাখরীজে হিদায়া বিষয়ে শুধু আদদিরায়া কিতাবে সীমাবদ্ধ না থেকে হিদায়ার অন্যান্য তাখরীজও অধ্যয়ন করতেন তাহলে আপনার মনে ওই ভুল ধারণা সৃষ্টি হত না। হাদীসের কিতাবসমূহে আল্লামা লাখনোভী রাহ.-এর প্রশস্ত দৃষ্টি ছিল কিন্তু শায়খ যাহিদ কাওছারী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী ইলালুল জারহ ওয়াত তাদীলের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টি এতটা সূক্ষ্ম নয়। (ফিকহু আহলিল ইরাক ও হাদীসুহুম)

এজন্য ইখতিলাফী মাসাইলের দলীল-আদিল্লার তুলনামূলক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যে তাহকীক ও তাদরীক হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.-এর আলোচনায় পাওয়া যায় তা লাখনোবী রাহ.-এর আলোচনায় পাওয়া যায় না। যেসব মাসআলায় লাখনোবী রাহ.-এর আলোচনা থেকে ফিকহে হানাফীর দলীল বা ইস্তেদলাল কমজোর হওয়ার ধারণা সৃষ্টি হয় কিংবা তিনি স্পষ্টভাবেই যেগুলোকে কমজোর বলেছেন-ওই মাসআলাগুলোই ফয়যুল বারী মাআরিফুস সুনান থেকে পড়া হলে বাস্তব অবস্থা সামনে এসে যায়।

আদদিরায়া তে হাফেয ইবনে হাজার রাহ.-এর ওই ইলমী শান কখনো প্রকাশিত হয়নি, যা তাঁর কিতাব ফাতহুল বারী তে প্রকাশিত। এজন্য এই কিতাব তাখরীজে হিদায়া বিষয়ে মৌলিক কিতাব নয়। কিন্তু কিতাবটির কলেবর সংক্ষিপ্ত হওয়ায় প্রকাশকরা একেই হিদায়ার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে।

কোনো কোনো এডিশনে তো এই অত্যাচারও করা হয়েছে যে, আবুল মাকারিম নামক কোনো এক গাইরে মুকাল্লিদের জালিমানা হাশিয়াও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

আপনি উদাহরণস্বরূপ যে তিনটি মাসআলা উল্লেখ করেছেন তার জন্য আর কিছু না হোক অন্তত যহীর আহসান নীমাভী রাহ.-এর আছারুস সুনান এবং মাওলানা যফর আহমাদ উসমানী রাহ.-এর ইলাউস সুনানই পড়ে দেখুন। ইনশাআল্লাহ আপনার সকল সংশয় দূর হয়ে যাবে। আশা করি, আপনার মাদরাসায় এ দুটি কিতাব অবশ্যই থাকবে। বরং শুনুন, রাফয়ে ইয়াদাইন এবং কিরাআত খালফাল ইমাম এই দুটি মাসআলা তো এমন যে, তরকে রাফ তরকে কিরাআত-এর মাসলাকের অগ্রগণ্যতা হাদীস, আছার ও অন্যান্য দলীলের আলোকে এতই পরিষ্কার যে, এ বিষয়ে কোনোরূপ দ্বিধা ও সংশয় পোষণ করাও আশ্চর্যের বিষয়। এই মাসআলাগুলোতে মুহাদ্দিস আলিমদের রচিত অনেক কিতাব রয়েছে। আপনি যদি এর কোনো একটিও মুতালাআ করতেন!  একটু চিন্তা করুন তো, ফিকহে ইসলামীর কঠিনতম কিতাব হিদায়া পড়ে যে আত্মস্থ করতে পারে সে কি মাআরিফুস সুনান ইত্যাদি থেকে এই বিষয়গুলো পড়তে পারবে না? সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে অন্তত মাওলানা আমীন সফদর রাহ. ও মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী রাহ. (উস্তাদে দারুল উলূম দেওবন্দ)-এর ছোট ছোট রিসালাগুলো অবশ্যই পড়ে নেওয়া উচিত ছিল। তালিবে ইলমদের মুতালাআর পরিধি এখন সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হতে চলেছে। এই দুর্বলতা যে পর্যন্ত দূর করা না হবে সে পর্যন্ত আমাদের ইলমী দুরবস্থাও দূর হবে না।

ইচ্ছা আছে, আলকাউসারে এ ধরনের মাসআলাগুলো সম্পর্কে দালীলিক ও বিস্তারিত প্রবন্ধের একটি ধারাবাহিকতা আরম্ভ করার। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

এই সংখ্যার অন্যান্য শিক্ষা পরামর্শসমূহ পড়ুন