জনৈক তালিবে ইলম - ঢাকা
প্রশ্ন
প্রশ্ন : আমাদের উপমহাদেশে বুযুর্গদের নামে যে শাজারা প্রচলিত আছে তাতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি যে, কোনো বুযুর্গ ব্যক্তি তার মুরশিদের সান্নিধ্যে থেকে ফয়েয-বরকতে ধন্য হয়েছেন এবং তার থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাই সেসব বুযুর্গদের খেলাফতের ধারাবাহিকতা জানার জন্য এই শাজারা তৈরি করা হয়েছে। কিন্ত এই শাজারার ব্যাপারে কিছু জায়গায় কোনো কোনো উলামায়ে কেরাম আপত্তি করে বলে থাকেন- যেমন, হাসান বসরী রাহ. হযরত আলী রা. থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত এবং আলী রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ কথাটি ভিত্তিহীন। বিশেষ করে হাসান বসরী রাহ. সম্পর্কে বলে থাকেন যে, তিনি ২২ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বয়স যখন ১৩ বছর তখন ৩৫ হিজরীতে আলী রা. খলীফা নিযুক্ত হন এবং খিলাফতের কেন্দ্র মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত করেন। এরপর আলী রা.-এর সাথে তার আর সাক্ষাৎ হয়নি। তাহলে হাসান বসরী রাহ. আলী রা. থেকে কীভাবে খেলাফত পেলেন? এখন জানার বিষয় হলো, উল্লেখিত আলোচনায় কোন্টি সঠিক- জানালে কৃতজ্ঞ হবো।
উত্তর
দেখুন হাসান বসরী রাহ. প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ইমাম। তিনি অনেক সাহাবীর সোহবত ও তরবিয়াত লাভে ধন্য হয়েছেন। তিনি যে হযরত আলী ইবনু আবী তালিব রা.-এরও দর্শন ও সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং তাঁর সোহবত ও সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন -এ বিষয়টি অবশ্যই প্রমাণিত। এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ তিনি জন্মগ্রহণ করেন মদীনায় ২১ হিজরী সনে, যখন হযরত উমর রা.-এর খেলাফত কালের দু বছর বাকি ছিল। হাসান বসরী রাহ.-এর মাতা ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালামা রা.-এর বাদী। তাই হাসান বসরী রাহ. শৈশবে উম্মে সালামাহ রা.-এর কোলে লালিত পালিত হয়েছেন। বর্ণিত হয়েছে, মায়ের অনুপস্থিতিতে তিনি কাঁদলে উম্মুল মু’মিনীন তাকে দুধ পান করিয়েছিলেন এবং তিনি তালীম তারবিয়াতের জন্য তাকে সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে পাঠাতেন। তিনি তো উসমান রা.-কেও দেখেছেন। ৩৫ হিজরী সনের যুলহজ্জ মাসে যখন উসমান রা.-কে শহীদ করা হয় তখন তিনি মদীনায় ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল চোদ্দ-পনের বছর। এ সময় পর্যন্ত হযরত আলী রা.-ও মাদীনায় অবস্থান করছিলেন। উসমান রা.-এর শাহাদাতের পর আলী রা. খলীফা মনোনীত হন এবং মদীনায় খেলাফতের বায়আত গ্রহণ করেন। এ সময় হাসান বসরী রাহ. তো মদীনার অধিবাসী ছিলেন। ৩৬ হিজরী সনের জুমাদাল আখিরাহ মাসে জামাল যুদ্ধের পর আলী রা. কুফায় স্থানান্তরিত হন। সুতরাং আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে, হাসান বসরী রাহ. মদীনায় থাকাকালীন তার চৌদ্দ পনের বছর বয়স পর্যন্ত আলী রা. মদীনায় অবস্থান করেছেন। এই সময়ের মধ্যে এটাই স্বাভাবিক যে, হাসান বসরী রাহ. আলী রা.-কে দেখেছেন, তাঁর মজলিসে বসেছেন এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন। এ শুধু সম্ভাবনার কথা নয়, বরং একাধিক রেওয়ায়েত থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝে আসে। হযরত আলী রা.-কে হাসান বসরী রাহ. দেখেছেন- এ কথা অনেক মুহাদ্দিসই বলেছেন। তবে তিনি হযরত আলী রা থেকে সরাসরি শুনে কোনো হাদীস বয়ান করেছেন কি না- সে বিষয়ে অনেক মুহাদ্দিসের দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকজন মুহাদ্দিস এ কথাকেই সহীহ ও অগ্রগণ্য বলেছেন যে, হাসান বসরী রাহ. আলী রা. থেকে সরাসরি হাদীস শুনেছেন। দ্রষ্টব্য : তাহযীবুল কামাল, মিয্যি ৪/২৯৭; তাহযীবুত তাহযিব ২/২৬৩; ইকমালু তাহযিবিল কামাল, মুগলাতাঈ ৪/৭৮; ইতহাফুল ফিরকাহ বিরাফওইল খিরক্বাহ, সুয়ূতী (আলহাবী লিল ফাতাওয়া-এর অন্তর্ভুক্ত) ২/২৬৮-২৭১; আলী ইবনু আবী তালিব ইমামুল আরিফীন, আহমদ আলগুমারী ২০০-২২৫; আত তাবিউনাস সিকাত আলমুতাকাল্লাম ফী সামাইহিম মিনাস্ সাহাবাহ, মুবারাক বিন সাইফ পৃ. ৩০০; তারিখুল ইসলাম, হাফেয যাহাবী ৩/২৫ কিন্তু এর পাশাপাশি এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাসাওউফের শাজারা থেকে এ কথা বুঝাও সম্পূর্ণ ভুল ধারণা যে, হযরত আলী রা. হাসান বসরী রাহ.-কে এবং শাজারায় উল্লিখিত প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তিকে পারিভাষিক অর্থে ইজাযত ও খেলাফত প্রদান করেছেন। কেননা সালাফের যামানায় তাসাওউফের ক্ষেত্রে বর্তমানের পারিভাষিক ইজাযত ও খেলাফত প্রদানের রীতি ছিল না। সালাফের যুগে তো ইসলাহ ও তাযকিয়ার জন্যে আল্লাহওয়ালাদের সংশ্রব ও সাহচর্য, তাঁদের মুহাব্বত এবং অনুসরণ-অনুকরণের পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল। এটাই হল তাসাওউফের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এর জন্য প্রচলিত বাইআত এবং ইজাযত ও খেলাফত প্রদান শর্ত নয়। সুফিয়ায়ে কেরামের মাঝে পরবর্তী যুগে যখন নির্দিষ্ট কোনো শায়েখের হাতে বাইআত হওয়া এবং তাসাওউফের আনুষ্ঠানিক ইজাযত ও খেলাফত প্রদানের ব্যাপক প্রচলন ঘটে তখনো সুন্নাতের অনুসারী হক্কানী সুফিয়ায়ে কেরামের কাছে এগুলো তাসাওউফ তথা ইসলাহ ও তাযকিয়ার অপরিহার্য শর্ত ও প্রতিপাদ্যরূপে পরিগণিত হয়নি। দেখুন, আওয়ারিফুল মাআরিফ, উমর ইবনু মুহাম্মদ সুহরাওয়ার্দী (মৃত্যু : ৬৩২) ১/১৫৯; আলী ইবনু আবী তালিব ইমামুল আরেফীন পৃ. ১১১-১১৯; ইলাউস সুনান ১৮/৪৪৯-৪৫০; ইমদাদুল আহকাম ১/৩০৮; রিসালাতুল মুসতারশিদীন ৭২-৭৩ এবং ১০২-১০৮; তাসাওউফ : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ,পৃ. ৭৫-৭৮ যাহোক সালাফে সালিহীনের যুগে তাযকিয়া ও ইসলাহের জন্য আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণের পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল এবং সে যুগে সোহবতের তাছীর ও প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর ও শক্তিশালী। এর সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন সাহাবায়ে কেরাম রাযিআল্লাহু আনহুম। কেননা তাঁরা ঈমান ও মুহাব্বতের সাথে রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। ঈমানের সাথে অল্প সময়ের সোহবত এমনকি একবারের দর্শনের দ্বারাও তাঁরা সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম সুবকী রাহ. লিখেছেন- و ذلك لشرف الصحبة و عظم رؤية النبي صلى الله عليه وسلم، وذلك أن رؤية الصالحين لها أثر عظيم، فكيف رؤية سيد الصالحين؟! فإذا رآه مسلم و لو لحظة، انطبع قلبه على الاستقامة، لأنه بإسلامه متهيء للقبول، فإذا قابل ذلك النور العظيم أشرق عليه وظهر أثره في قلبه وعلى جوارحه . দ্রষ্টব্য : আল ইবহাজ ফী শরহিল মিনহাজ ১/৯, আরো দ্রষ্টব্য : লামাহাত মিন তারিখিস সুন্নাহ ওয়া উলূমিল হাদীস, শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ পৃ. ৪৯-৫১ এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- طوبى لمن رآني وآمن بي، وطوبى لمن رأى من رآني، ولمن رأى من رآني وآمن بي (رواه الحاكم في المستدرك ৪/৯৬ و الضياء المقدسي في الأحاديث المختارة ৯/৯৯ وهو حديث ثابت وله طرق كثيرة) সালীহীন ও নেককারদের সোহবতের তাছীর ও ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে- خير جلساءكم من يذكركم الله رؤيته، وزاد في علمكم منطقه، وذكركم الآخرة عمله. অর্থাৎ তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী সে, যাকে দেখলে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ হয়, যার কথায় ইলম বৃদ্ধি পায়, যার কাজ তোমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। -মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমাইদ, হাদীস নং ৬৩১; মুসনাদে আবী ইয়ালা, ২১৯৯ তো বহু সাহাবীর সোহবত ও তারবিয়াত লাভে ধন্য হাসান বসরী রাহ.-এর মত ব্যক্তিত্ব শৈশবে ও কৈশরে আলী রা.-এর মত ইমামুল আরেফীনের অল্প সময়ের সোহবত ও দর্শন লাভের বরকতে তাযকিয়া ও ইসলাহের উচ্চ মার্গে উন্নীত হন- তবে তো তা খুব স্বাভাবিক বিষয়। খোদ হাসান বসরী রাহ. সম্পর্কে তাঁর জীবনীতে হাফেজ ইবনে কাছীর রাহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিতাবে ইউনুস ইবনে উবাইদের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করেছেন- كان الرجل إذا نظر إلى الحسن انتفع به، وإن لم يسمع من كلامه ولم ير عمله. সার কথা তাসাওউফের শাজারাটি মূলত সোহবত এবং তালীম-তারবিয়তের সিলসিলাহ। তবে পরবর্তী যে যুগে পারিভাষিক ইজাযত ও খেলাফত প্রদানের রীতি প্রচলিত হয়েছে, সে যুগের মাশায়েখদের মাঝে সোহবত ও তারবিয়তের পাশাপাশি পারিভাষিক ইজাযত ও খেলাফতও ছিল। অন্যথায় শাজারাটি মূলত কেবল সোহবত লাভের বিবরণী। এ কারণে শাজারার সিলসিলায় যদি হাসান বসরী রাহ.-এর উপরে অন্য কোনো সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হত যার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও সোহবত প্রমাণিত, তবে তাতেও কোনো সমস্যা ছিল না।