নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক - বাইতুল উলূম ঢালকানগর মাদরাসা
প্রশ্ন
আসবাবুল ইলম যথা কিতাব, কাগজ, কলম, টেবিল, দরসগাহ ইত্যাদির এহতেমাম করার সাথে ইলমের সম্পর্ক কতটুকু এবং বড় আলেম হওয়ার জন্য আসবাবুল ইলমের সম্মান করার প্রয়োজন কতটুকু। আমাদের সম্মুখে বহু যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্র রয়েছে যারা কিতাব খুব ভালো বুঝে এবং পরীক্ষায়ও সিরিয়ালে যায় কিন্তু তারা আসবাবুল ইলমের বিলকুল সম্মান করে না। যথা সাধারণত সব সময়ই কুরআন ও হাদীসের দরসে ওযু ব্যতিত বসে এবং কুরআন তরজমা ওযু ব্যতিত কুরআন শরিফ স্পর্শ করে এবং হাদীস, উসূলে ফিকহের মত কিতাবসমূহের উপর পা উঠিয়ে দেয়। এমনকি এ সকল কিতাবের উপর দিয়ে অতিক্রম করতেও দেখা গেছে। এখন আমার মত গবীদের কী করণীয়? এ ব্যাপারে হুজুরের বিশেষ দিক নির্দেশনার প্রতি এ বান্দা মোহতাজ।
(খ) আমাদের আকাবীরগন তাদের নিকট আসবাবুল ইলম একেবারেই কম ছিল, পড়ালেখার সুন্দর সুবিধা ছিল না এবং অর্থ সম্পদের অবস্থা ও ছিল নগন্য। কিন্তু তাঁরা এত ইলম অর্জন করছেন এবং দ্বীনের এতা বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন যা আমাদের তাছাউর করতেও ভয় হয়। পক্ষান্তরে বর্তমানে পর্যাপ্ত পরিমানের থেকেও অধিক আসবাবুল ইলম, সর্বপ্রকার সুবিধা ও ওয়াসাআত থাকা সত্ত্বেও আকাবীরদের মত বড় মুহাক্কীক ও মুত্তাকী আলেম তৈরি হচ্ছে না এবং দ্বীনের অতটা উন্নতি হচ্ছে না এর কারণ কী? বর্তমান জামানায় আকাবিরদের মত আলেম হওয়া ও তাদের মত দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দেওয়া কি সম্ভব? এ ব্যাপারে জানার জন্য হুজুরের নিকট বিশেষ বিনীত নিবেদন রইল।
(গ) হযরত আমি একজন ‘গবিউল আগবিয়া’ ছাত্র। এক পড়া শতবার পড়লেও মনে থাকে না। কিতাব বুঝিনা তথাপিও আমার অন্তরে বড় আশা আকাবীরদের মত হওয়ার এবং তাদের ন্যয় দ্বীনের বড় খেদমত করার। আর এ জন্য আমি যাবতীয় কষ্ট ও মেহনত করতে তৈরি আছি। এমনকি এজন্য যদি আমার জীবনও বিলীন করতে হয় তথাপি আমি প্রস্ত্তত।
সুতরাং হুজুরের নিকট আমার জানার বিষয় হল আমার এ নাজুক ও করুন অবস্থায় আমার এ বিশাল ও আশাতিত আশা করা কি সম্ভব? যদি সম্ভব হয় তাহলে আমার এখন এ জন্য কী করণীয়?
উত্তর
ইসলামী শরীয়তে আদবের মর্যাদা অনেক এবং তার গুরুত্বও ইসলামে অনেক বেশি। শুধু আসবাবুল ইলম কেন, মানব জীবনের কোন দিকটা এমন আছে যেখানে মানুষের জীবন সফলকাম, সুখ-স্বাচ্ছন্দময় ও সুচারু হওয়ার জন্য আদবের প্রয়োজন নেই? এজন্যই হাদীসের কিতাবগুলোতে যেখানে আল-আদব নামে দীর্ঘ কলেবরের একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় আছে সেখানে ইলম অধ্যায়ে ইলম সংক্রান্ত আদব এবং অধ্যায়গুলোতে সংশ্লিষ্ট আদবের শিক্ষা বিদ্যমান রয়েছে। এভাবে আম আদাব সম্পর্কে অনেক স্বতন্ত্র কিতাব রচিত হয়েছে। তেমনি খাস আদাবুল ইলম সম্পর্কেও স্বতন্ত্র অনেক কিতাব ও রিসালা রচিত হয়েছে। আদাবুল ইলম বিষয়ক কিতাবগুলোতে আসবাবুল ইলমের আদাব গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত হয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নোক্ত কিতাবগুলো দেখা যেতে পারে। ১। আল জামে’ লি আখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামি, হাফেজ আবু বকর খতীব আলবাগদাদী (৪৬৩ হি.) ২। জামেউ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহী ওয়া মা-ইয়ামবাগী ফী রিওয়াতিহি ওয়া হামলিহি, ইমাম ইবনু আব্দিল বার (৪৬৩ হি.) ৩। তাযকিরাতুস সামে ওয়াল মুতাকাল্লিম ফী আদাবিল আলিমি ওয়াল মুতাআল্লিম’ ইমাম বদরুদ্দীন আল-জামায়া’ (৭৩৩ হি.)
আল্লাহ তাআলার পানাহ, আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আজকাল আদব বিষয়টাই অত্যন্ত অবহেলার শিকার। অথচ সলফে সালেহীনের অবস্থা ছিল, তাঁরা ইলমের আগে আদব শিখতেন ও শিখাতেন। এ বিষয়ে সালফের হেদায়াত ও ঘটনাবলীর তালিকা অনেক দীর্ঘ। শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দামাত বারাকাতুহুম ‘আদাবুল ইখতিলাফ ফী মাসায়িলিল ইলমি ওয়াদ্দীন’ কিতাবে এর কিছু নমুনা পেশ করেছেন। যা সকলের জন্যই পড়ে নেওয়ার মতো।
মনে রাখতে হবে, শুধু ইমতেহানে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া অথবা মোটামুটি কিতাব বুঝার ইস্তেদাদ থাকা ‘ভালো ছাত্র’ হওয়ার মাপকাঠি নয়। ভালো ছাত্র হওয়ার জন্য আদব রক্ষা করা এবং আখলাক ভালো হওয়া অপরিহার্য। সুস্থ রুচি ও উন্নত চিন্তা শক্তির প্রয়োজন।
মনে রাখবেন ইলমে নাফে বা উপকারী হওয়ার জন্য মৌলিক কিছু শর্ত রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তাফাক্কুহ ফিদ্দীন তথা ইলমের গভীরতা, রুসূখ ফিল ইলম তথা ইলমের দৃঢ়তা অর্জন এবং তাকওয়া-তাহারাত সহনশীলতা, আকলে সালীম ও আদব অবলম্বন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করতেন-
اللهم إني أسألك علما نافعا ورزقا طيبا وعملا متقبلا.
(খ) ও (গ) আমাদের মাদরাসগুলোতে ইলমের অধঃপতনের অনেক কারণ রয়েছে। যেমন, ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির প্রবণতা, ইলমের জন্য বিলীন হওয়ার মানসিকতা লোপ পাওয়া, তালিবে ইলমের প্রতি উস্তাযের মুহাববাত এবং উস্তাযের সঙ্গে তালিবে ইলমের দৃঢ় ও স্থায়ী সম্পর্কের অভাব। তাকওয়া-তাহারাত ও আদাবের ব্যাপারে যত্নবান না হওযা। আহলে ফন-শাস্ত্র ব্যক্তিদের সোহবত গ্রহণ না করা। আহলে বুযুর্গদের সোহবত গ্রহণ না করা এবং আরো অন্যান্য বিষয়।
এসব বিষয়ের প্রতিকার ও আমাদের করণীয় কী তা বুঝার জন্য পুর্বোক্ত কিতাবগুরোর পাশাপাশি নিম্নোক্ত কিতাবগুলি আমলের নিয়তে বারবার মুতালাআ করা উচিত।
১। মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহ.-এর বক্তৃতা ‘আপ কোন হ্যায় আওর কিয়া হ্যায় আপ কী মানযিল কেয়া হ্যায়’ বা এর অনুবাদ ‘তালেবানে ইলমের রাহে মনযিল’
২। মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর ‘পাজা সুরাগে যিন্দেগী’ বা অনুবাদ ‘জীবন পথের পাথেয়’
৩। মায়ালিমু ইরশাদিয়্যাহ লিসিনায়াতি তালিবিল ইলম, শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ
বলাবাহুল্য, ইলমী, আমলী, ফিকরী এবং ঈমানী তারাক্কী ও উৎকর্ষের জন্য পার্থিব আসবাবের আধিক্য যথেষ্ট নয়। বরং এর জন্য প্রয়োজন আওসাফ ও গুনাবলী অর্জন করা। সালাফের উলামায়ে কেরামের জীবন চরিতের মুতালাআ এ ক্ষেত্রে অনেক ফলপ্রসূ হবে ইনশাআল্লাহ।