আব্দুল করীম - ঢাকা
প্রশ্ন
১. ক) আমি মেশকাত জামাতে পড়ি, ভবিষ্যতে ফিকহের উপর তাখাসসুস করার ইচ্ছা আছে, তাই আমি এখন থেকে তাখাস্সুসের জন্য কিভাবে প্রস্ত্ততি নিতে পারি?
খ) আমি ‘হিদায়া আওয়ালাইন’ পড়ার সময় ‘ফাতহুল কাদীর’ মুতালাআয় রাখতাম, এখনও হেদায়া ছালিছের সাথে ফাতহুল কাদীর মুতালাআ করি। কিন্তু হিদায়া ৪র্থ খন্ডের জন্য নাতাইজুল আফকার পড়ে তৃপ্তি পাই না। আমার মনে হয় হিদায়ার শরাহ করার চেয়ে বিভিন্ন কিতাবের সমালোচনা করাই এতে প্রাধান্য পেয়েছে। তাই আমি জানতে চাই, হিদায়া ৪র্থ খন্ডের জন্য কোন্ কিতাব পড়া বেশি উপযোগী হবে?
গ) যাদের ইফতা পড়ার ইচ্ছা আছে তাদের শরহে নুখবায় এর সাথে উলূমুল হাদীস-এর কোন্ কোন্ কিতাব পড়া জরুরি?
২. ফিকহের জন্য মুতাকাদ্দিমীনের কিতাবের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? এবং সেগুলো কোথায় পাওয়া যাবে? আমি অনেক কিতাবের নাম পাই কিন্তু তা কোনো মাকতাবায় পাই না।
উত্তর
ক) তাখাসসুসের উদ্দেশ্য, যোগ্যতা ও প্রস্ত্ততি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বিক্ষিপ্ত আকারে শিক্ষার্থীদের পাতায় ইতোপূর্বে লেখা হয়েছে। ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’ বইটিতে নিম্নোক্ত তিনটি প্রবন্ধ দেখতে পারেন।
১. নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনা (পৃ ৬০-৬৯।)
২. ইলমের জন্য চাই পিপাসা, কিছু প্রতিবন্ধক ভুল ধারণা (পৃ. ১৪৪-১৫৩। )
৩. আসাতিযার সঙ্গেই দৃঢ় ও স্থায়ী সম্পর্কের প্রয়োজন. পৃ ৮৪-৮৯।
খ) নাতাইজুল আফকার শরাহটি ইবনুল হুমাম (রহ.) কৃত ফতহুল কাদীর-এর তাকমিলাহ ও পরিশিষ্টরূপে রচিত হলেও এ দুয়ের মাঝে রয়েছে আকাশ পাতাল তফাত। ইবনুল হুমামের মানহাজ অনুসরণ করতে হলে তো আরেকজন ইবনুল হুমামই লাগবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর কোনো বান্দাকে এ কাজ করার দাওফীক দান করুন।
পেরেশানির কারণ নেই, হেদায়া তৃতীয় খন্ড পর্যন্ত কোনো তালিবুল ইলম যদি ‘ফাতহুল কাদীর’আদ্যোপান্ত বা উল্লেখযোগ্য অংশ মোটামুটি বুঝে মুতালাআ করেন, এতে উল্লেখিত দালায়েল ও উজুহে ইস্তেদলালের বয়ান এবং দালায়েলের পারস্পরিক নক্দ ও তাবসিরার মানহাজ ও উসূলের সঙ্গে পরিচিত হন এবং হেদায়ার অবশিষ্টাংশ বোঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয় তাহলে এতেও বেশ ফায়দা হবে।
কিতাবের ইবারত হল করা, এবং দালায়েলের তাখরীজ ও তাফসীলের জন্য তো বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)-এর আল-বিনায়াহ-তেও অনেক তথ্য মজুদ রয়েছে। আর সংক্ষেপে মতলব বোঝার জন্য তো আকমালুদ্দীন বাবরতী রহ. এর ‘আল-ইনায়া’ খুবই উপকারী। পাশাপাশি হেদায়া ৩য় ও ৪র্থ খন্ডের উপর আব্দুল হালীম লাখনবী (রহ.)-এর হাশিয়াটিও মুতালাআয় রাখা যায়। এরপর রাজেহ ও মুফতাবিহী কওল নির্ণয়ের জন্য এবং মাসআলার তাফসীল ও শরহের জন্য পরবর্তী যামানার মুহাক্কিক ফকীহ আলেমদের রচিত নির্ভরযোগ্য শরাহ ও হাশিয়াসমূহের মধ্যে তাবয়ীনুল হাকায়েক, আল বাহরুর রায়েক, রদ্দুল মুহতার ইত্যাদির সাহায্য নেয়া যায়।
আর হেদায়ার চতুর্থ খন্ডে ফিকহের যেসব অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যথা মুয়ামালাতের কিছু অংশ, কাযা ও আদালত, দন্ডবিধি, কুরবানী ও পশু যবেহ এবং বিভিন্ন বিষয়ের হালাল-হারাম সংক্রান্ত মাসায়েল। এসব পরিচ্ছেদের মাসায়েলগুলো সুষ্পষ্টভাবে বোঝার জন্য এসব মাসায়েল ও মাবাহেসের ওপর লিখিত স্বতন্ত্র ও মানসম্পন্ন রচনাবলী অনুসন্ধান করে বিভিন্ন সুযোগে পড়ে নেয়া উচিত। হেদায়া সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে। আপনি সেগুলো দেখতে পারেন।
গ) আপনার এ প্রশ্নটির উত্তর ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’ বইটিতে শরহে নুখবা, উলূমুল হাদীস এবং দাওরায়ে হাদীস সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো পড়লে পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
২. কোনো ফনের মাসায়েলের তফসীল, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অসম্পূর্ণ বিষয়াবলি সম্পূর্ণ করা এবং যামানার নতুন চাহিদা ও মেযাজ অনুসারে মাসায়েল উপস্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুহাক্কিক, মুতকিন মুতাআখখিরীন আহলে ফনের খেদমত ও অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ‘ফন’-এর রাসেখ ও সুদৃঢ় ইলম এবং তাফাক্কুহ ও গভীরতা অর্জনের ক্ষেত্রে মুতাকাদ্দিমীন আহলে ফনের কিতাবসমূহের প্রভাব ও কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। এছাড়া ফনের মাসাদিরে আসলিয়্যাহ ও মাসাদিরে কাদীমার শরণাপন্ন হওয়া তো তাহকীক ও তানকীহের একটি প্রধান সোপান। সলফ ও মুতাকাদ্দিমীনের ফযীলত ও অগ্রগণ্যতা সম্পর্কে ইমাম শাতেবী রহ. (মৃত্যু ৭৯০ হি.) এর ‘আল-মুয়াফাকাত’ গ্রন্থের (দ্বাদশ মুকাদ্দিমা ১/৮৬-৮৮) আলোচনা এবং হাফেজ ইবনু রজব রহ.-এর
فضل علم السلف على علم الخلف
রিসালাটি মুতালাআ করতে পারেন।
মুতাকাদ্দিমীনের রচনাবলির বিশাল অংশ মুদ্রিত বা অমুদ্রিত পান্ডুলিপি রূপে বিদ্যমান রয়েছে। ওইসব কিতাবের কোন্টি মুদ্রিত আর কোন্টি অমুদ্রিত এবং তা কোন্ কুতুবখানায় পাওয়া
যাবে এসব ব্যাপারে ‘মাখতূতাত’ ও ‘মাতবূআত’ সমূহের (অমূদ্রিত পান্ডুলিপি ও মূদ্রিত কিতাব) পরিচয় সম্বলিত ফাহারিস ও গ্রন্থপঞ্জিসমূহ বিভিন্ন গ্রন্থাগারের ক্যাটালগ এবং বাণিজ্যিক কুতুবখানা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সমূহের মজুত তালিকার সহায়তা নিতে পারেন। নতুন আঙ্গিকে তাহকীকসহ ফিকহের যেসব কিতাব মুদ্রিত হয়েছে সেগুলোর ‘ফিহরিসিল মাসাদির’ মুতালাআ করলেও এ সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারবেন।
প্রশ্ন : ৩. ক) শুনেছি,তাখাস্সুস নাকি শুধু এক বিষয়েই করতে হয়। এর কারণ কী? অথচ আমাদের আকাবিরের অনেকের জীবনীতে দেখা যায় যে, তিনি সকল বিষয়ে দক্ষ ছিলেন, তাহলে আমাদের একাধিক বিষয়ে তাখাস্সুস করতে বাধা কোথায়?
উত্তর : ক) ‘তাখাসসুস’-এর উদ্দেশ্য হলো, ফন্নী ইখতেসাস-শাস্ত্রীয় বুৎপত্তি ও বিশেষজ্ঞতা অর্জন। অর্থাৎ বিশেষভাবে কোনো ফনের উসূল ও ফুরু’ সম্পর্কে ব্যাপক, বিস্তৃত, গভীর ও পোখতা ইলম অর্জন করা। এ স্তরের জ্ঞানের মাধ্যমেই ফনের তাহকীক-তানকীহ ও গবেষণা করা যায় এবং ফনের সুরক্ষা তথা সকল হ্রাস-বৃদ্ধি, অপব্যখ্যা ও অন্যায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা যায়। এই ফন্নী ইখতেসাস দু-তিন বছরের কোনো কোর্স সম্পন্ন করার নাম নয়। বরং এর জন্য প্রয়োজন, পূর্ণ অভিনিবেশ, নিরন্তর চর্চা ও সাধনা এবং আহলে ফন ও আহলে ফিকহ এর বিশেষ ও দীর্ঘ সোহবত। এজন্য ইলম ও জ্ঞান সাধনায় নিযুক্ত বিশেষজ্ঞগণ নিজ বিষয়ে গভীরতা ও প্রাজ্ঞতা লাভের প্রয়োজনে এবং নিজ ফনের বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক খেদমত যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার প্রয়োজনে সাধনার মূল ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করে থাকেন। কারণ, এক ব্যক্তির পক্ষে একাধিক বিষয়ে ইখতেসাস পর্যায়ের ইলম অর্জন করা যদিও অসম্ভব নয়, কিন্তু দুঃসাধ্য বটে। এরপর একাধিক বিষয়ে ইখতেসাস অর্জিত হলেও সব বিষয়ের ইখতেসাস মানে ও পরিমাণে সমান হয় না বা বাস্তবক্ষেত্রে তিনি একাধিক ফনের খেদমত সমান্তরালভাবে করার ফুরসত পান না। আমি এ পর্যায়ে সালাফের কয়েকজন ব্যক্তির দিকে কেবল
ইঙ্গিত করছি।
ইমাম শাফেয়ী রহ. তাঁর কোনো শাগরিদকে লক্ষ করে বলেছিলেন
أتريد أن تجمع بين الفقه والحديث، هيهات
হাফেয আবু বকর খতীবে বাগদাদী রহ. ইলমে হাদীস সম্পর্কে বলেছেন
إنه علم لا يعلق إلا من قصر نفسه عليه ولم يضم غيره من الفنون إليه
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফেয আব্দুর রহমান সাখাবী রহ. আত্মজীবনীতে নিজের সম্পর্কে এবং তার শায়েখ হাফেজ ইবনে হাজার রহ. সম্পর্কে যে কথা বলেছেন তা তাঁর কিতাব ‘আয্যওউল লামি’(৮/৫-৬)-তে দেখতে পারেন। এ ছাড়াও দেখা যেতে পারে। বাসায়ের ওয়াইবার, ২/৫৭৪-৫৭৯, মাওলানা ইউসুফ বান্নুরী রহ.।
এ জন্য আমাদের পূর্ববর্তী আকাবির ও আসলাফের যুগেও সমান্তরালভাবে একাধিক বিষয়ের ফন্নী ইখতিসাসের অধিকারী মণীষীর সংখ্যা খুবই কম। ফকীহ, মুহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন, উদাবা প্রমূখ আহলে ইলমের ভিন্ন ভিন্ন তবাকা ও শ্রেণী তো কোনো অস্পষ্ট বিষয় নয়। আর আমাদের এই (কহতুর রিজাল)-এর যামানায় একাধিক বিষয় তো দূরের কথা এক বিষয়ের আহলে ইখতেসাসের দৃষ্টান্ত ও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনো ফনের ইখতেসাস লাভের উদ্দেশ্যে সে ফনের অনুশীলন চর্চায় ফারেগ ও অভিনিবিষ্ট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি স্বতন্ত্র প্রয়োজনীয়তা এবং ইলম ও ফনের শাখাসমূহের পারষ্পরিক নির্ভরতার কারণে অন্যান্য জরুরী উলূম ও মাআরিফ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমসম্প্রসারণের আবশ্যকতাও অস্বীকার করা যায় না।
তাফাক্কুহ ফিদ্দীন, রুসূখ ফিল ইলম বা দ্বীন ও শরীয়তের গভীর ও পরিপক্ক জ্ঞান এবং মুফাক্কির ও দাঈ পর্যায়ের যোগ্যতা লাভের জন্য তো শুধু ইলমী তাখাসসুস যথেষ্ট নয়, বরং শরয়ী ইলম ও ফনের সকল গুরুত্বপূর্ণ শাখা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উলূম ও মাআরিফ সম্পর্কে ইলম অর্জন করতে হবে। এবং সজাগ সচেতন আহলে ফিকহ এর সাহচর্যের মাধ্যমে সচেতনতা , প্রাজ্ঞতা, চিন্তা ও কর্মে ভারসাম্য, আদাবুল মুআশারার জ্ঞান ও অনুশীলন ইত্যাদি অর্জন করতে হবে। সর্বোপরি আহলে দিলের সোহবত গ্রহণ করে তাকওয়া ও অন্তরের পরিচ্ছন্নতা অর্জন করাও অপরিহার্য।
সর্বশেষ কথা হল, শুধুমাত্র তাখাসসুস বা ভিন্ন কোনো নামের দু-তিন বছরের প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স সম্পন্ন করা কোনো ফনের ইখতেসাস বা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মাহারাত অর্জন তো দূরের কথা বুনিয়াদী ও জরুরী ইলম অর্জনেরও নিশ্চয়তা দেয় না। সব তালিবে ইলমের হালত ও সুযোগ এক রকম হয় না এবং সবার জন্য সব পদ্ধতী উপযোগীও নয়। সুতরাং কোনো ফনের তাখাসসুসের পাশাপাশি অন্যান্য উলূম ও মাআরিফের মাহারাত লাভের পদ্ধতি কী হবে তা তালেবে ইলম তার তালীমী মুরুববী এবং মাহির ও মুশফিক উস্তাজের নির্দেশনা অনুসারে নির্ধারণ করবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ইলমের মনযিলে মকসুদ তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও রুসূখ ফিল ইলম নসীব করুন। আমীন।