বাদ সালামে মাসনূন। আমি হাটহাজারী দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার হেদায়া ১ম বর্ষের একজন তালিবে ইলম। হেদায়াতুন নাহব কিতাবটি যখন পড়া শুরু করি, অর্থাৎ আরবী কিতাবাদী পড়া যখন শুরু হল তখন থেকেই কিছু সমস্যার সম্মুখিন হয়ে আসছি।
সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। এমন অবস্থায় আপনার লিখিত এবং মাকতাবাতুল আশরাফ, বাংলাবাজার হতে প্রকাশিত ‘তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়’ নামক কিতাব হাতে পাই। কিতাবে উল্লেখিত ২২৭ নং প্রশ্ন: “ইবারত বুঝি আলোচনা উদ্ধার করতে পারি না”-এ বর্ণিত সমস্যাগুলোই হল আমার সমস্যা। এরপর আমি আপনার পরামর্শটি ভালোভাবে পড়ি এবং বুঝার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু বিষয় আমার নিকট অস্পষ্ট হওয়ার কারণে আমল করতে পারছি না। হযরতের কাছে বিনীত নিবেদন, যেন তিনি এ ব্যাপারে আমাকে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দান করেন। নিম্নে আমি বিষয়গুলো উল্লেখ করছি।
ক) পরামর্শে বলা হয়েছে, “শুধু ইবারাত সহীহ পড়তে পারা যায়Ñ এ পরিমাণ নাহবী জ্ঞান সঠিকভাবে তারকীব বুঝার জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্য নাহবের সঙ্গে আরো মুনাসাবাত প্রয়োজন।” প্রশ্ন হল, এটি কোন্ কিতাব দিয়ে মেহনত করে অর্জন করব। দরসে নেযামীতে যে কিতাবগুলো সাধারণত পড়ানো হয় এবং আমরা পড়েছি সেগুলোর বাইরে যদি হয় তাহলে কীভাবে পড়ব? বিস্তারিত জানতে চাচ্ছি।
খ) “লুগাতের আরবী কিতাবসমূহের সাহায্যে লফয ও তাবীরের উদ্দিষ্ট অর্থ নির্ণয় করার অভ্যাস করারও প্রয়োজন” প্রশ্ন হল, আমি এ পর্যন্ত যা কিতাব পড়েছি তার আলফাযের অর্থ বোঝার জন্য শুধু দু’টি লোগাত ব্যবহার করেছি একটি আল-কামূসুল ওয়াহীদ (আরবী-উর্দূ) আরেকটি আল-কামূসুল ওয়াফী (আরবী-বাংলা) এ অবস্থায় আমার জন্য তাবীর এবং আলফাযের উদ্দিষ্ট অর্থ নির্ণয়ের ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে কি না। আরবী লোগাতের মধ্যে সহজবোধ্য এবং নির্ভরযোগ্য কিছু লোগাতের নাম জানতে চাচ্ছি, যা সর্বদা আমরা কিতাব হল করতে কাছে রাখতে পারব এবং কিতাব হল করতে বেশি উপযোগী হবে ।
গ) “আরবী আদব বা আরাবিয়্যাতের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ইবারতের ভাবার্থ বোঝার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক বিষয়।” আমি এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত। অধিকাংশ সময় দেখা যায় আমি তারকীব, লুগাবী অর্থ সব বুঝেছি কিন্তু অর্থ মিলাতে পারছি না। কিন্তু যখন উস্তায বক্তব্যের ধারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন তখন ঠিকই বুঝতে পারছি। প্রশ্ন হল, এটার জন্য কী করতে পরি? সেখানে ‘এসো আরবী শিখি’র ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ কিতাবটি একজন ছাত্র, যে আগে কখনো দরসে পড়েনি, সে কীভাবে পড়বে। মেহনতের পুরো ‘খাকা’ সামনে এসে গেলে খুবই উপকার হত।
ঘ) কিতাবে উল্লেখিত ১৭৭ নং প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, “ভাল হয় যদি উসুলুত তারজামা সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকে।” এটাও আমার বড় এক সমস্যা। অনেক সময় বুঝেতে পারছি যে, এটা হাল, এটা তমীয, কিন্তু মাকাম অনুসারে তরজমা তুলতে পারছি না। এগুলোর তরজমা কতভাবে তোলা যায় তাও জানি না। হরফে জর যখন ইবারতে বেশি হয়ে যায় তখনও সমস্যা হয়ে যায়, তরজমা করতে পারি না। প্রশ্ন হল, এ ফনের কোনো কিতাব আছে কি না? না থাকলে এ ব্যাপারে ধারণা কীভাবে অর্জন করব?
(ক) নাহবের সঙ্গে মুনাসাবাত কম হওয়া এবং নাহবী তারকীব অসম্পূর্ণ বোঝার একাধিক কারণ রয়েছে। যথা: ১. নাহবের আমলী ইজরা তথা প্রায়োগিক জ্ঞান পর্যাপ্ত না থাকা। নাহবের কাওয়ায়েদ ও মাসায়েল কেবল তাত্তি¡কভাবে বুঝে নেয়া যথেষ্ঠ নয়। বরং শুরু থেকেই নাহবের আমলী ইজরা ও বাস্তব প্রয়োগের ব্যাপারে যত্মবান হতে হবে। এজন্য কিতাবে যখনই কোনো নাহবী কায়েদা ও মাসাইল পড়া হয় তখনই তার একাধিক মিছাল ও উদাহরণ চিন্তা ভাবনা করে খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ কালামে-আরব ও কথা-বার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং কুরআন-হাদীসের ইবারত থেকে বেশি উদাহরণ বের করার মশ্ক করবে। নাহবের প্রায়োগিক জ্ঞানকে পরিপক্ক করার জন্য উস্তাযের নেগরানীতে নাহবী কাওয়েদ ও মাসায়েলের মৌখিক ও লিখিত অনুশীলন করা প্রয়োজন। এ জন্য‘আননাহবুল ওয়াযিহ’ বা ‘আতত্বরীক ইলান নাহব’ তামরীনসহ পড়া যেতে পারে। কিতাবে যেভাবে তামরীন করতে বলা হয়েছে সেভাবে করতে থাকতে হবে যেন তা এমনভাবে আত্মস্থ হয়ে যায় যে,কিতাবের বাইরের মিছালসমূহেও তা প্রয়োগ করা যায়।
২. আরবী ইবারতের নাহবী তারকীব ও ইরাবের বিশ্লেষণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকা। এ বিষয়ে পরিপক্ক জ্ঞান লাভের জন্য নাহবী রুচির অধিকারী উস্তাযের তত্ত্বাবধানে নাহবী তারকীবের মশক করা প্রয়োজন। এছাড়া ইরাবুল কুরআন, ইরাবুল হাদীসের কোনো কিতাবের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুম রচিত ‘আততরীক ইলাল কুরআনিল কারীম’কিতাবে বয়ানুল ইরাব অংশের নাহবী তারকীবের নমুনা দেখা যেতে পারে।
৩. নাহবের তাফসীলী মাসায়েলের জ্ঞান অসম্পূর্ণ থাকা। নাহবে মীর ও হেদায়াতুন নাহব কিতাব দুটি পড়ার পর কাফিয়া কিতাবটি পাঠদানের বড় মাকসাদ হচ্ছে, নাহবের বুনিয়াদী মাসায়েলসমূহ আত্মস্থ করার পর তাফসীলী মাসায়েলের জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নাহবের সঙ্গে অধিক মুনাসাবাত তৈরি করা। কিন্তু আজকাল অনেক ক্ষেত্রে এ মাকসাদটি হাসিল হয় না। এ জন্য জরুরি হল, অপ্রাসঙ্গিক ইতেরায ও জওয়াব এবং অপ্রয়োজনীয় চুল-চেরা বিশ্লেষণ পরিহার করে কিতাবের মূল মাসআলাগুলো সঠিকভাবে বোঝার উপর গুরুত্ব দেয়া। ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়গুলো যথাযথভাবে বুঝে নেয়া এবং কাবেলে ইযাফা বিষয়সমূহ জেনে নেয়া। কাফিয়ার সংক্ষিপ্ত হাশিয়াগুলোর মধ্যে আমার মতে ‘যীনী যাদাহ’ উপকারী হবে। তবে রফীউদ্দীন ইস্তারাবাদী কৃত শরাহটি, যা ‘শরহুর রযী’ নামে পরিচিত কাফিয়ার ফন্নী শরাহ, যা বিস্তারিত ও প্রামাণিক আলোচনা সমৃদ্ধ। আসাতিযায়ে কেরাম নাহবী মালুমাত বৃদ্ধি ও ফনের পরিপক্কতার জন্য শরহুর রযী এবং কাফিয়ার মূল সূত্রÑ আল মুফাসসাল ও তার শুরুহ অধ্যয়ন করতে পারেন। এছাড়া প্রচীন উৎসগ্রন্থগুলোর সারনির্যাস রূপে রচিত, কুরআন-হাদীস ও কালামে আরবের প্রচীন ও সমকালীন শাওয়াহিদ ও উদাহরণ সম্বলিত এবং অনুশীলন ভিত্তিক বিশদগ্রন্থ‘আননাহবুল ওয়াফী’ কিতাবটি বেশ উপকারী। কাফিয়া কিতাবের উস্তাযগণ এই কিতাবটি নিয়মিত মুতালাআয় রাখতে পারেন।
(খ) লফজ ও ইবারতের উদ্দিষ্ট অর্থ বোঝার জন্য যেমন লুগাতের কিতাবের সহযোগিতা নিতে হয়, তেমনি বাক্যের পূর্বাপর অবস্থা খেয়াল করতে হয়। কারণ এতে এমন কিছু ‘কারাইন’ বা আলামত ও অনুষঙ্গ পাওয়া যায় যা বাক্যস্থ শব্দের উদ্দিষ্ট অর্থ প্রমাণ করে। লুগাতের কিতাবে দেখতে হবে, শব্দটি কীভাবে ব্যবহার হয়, শব্দটির মূল অর্থ কী, শব্দটির ব্যবহারক্ষেত্র কী এবং অনুষঙ্গ ও ক্ষেত্রভেদে তার অর্থভেদ কীভাবে ঘটে। আর এ উদ্দেশ্যে তালিবে ইলমদের জন্য জরুরি হল সরাসরি আরবী-আরবী কোনো নির্ভরযোগ্য লোগাত দেখার অভ্যাস গড়ে তোলা। ভিন্ন ভাষায় অনুদিত লোগাতের উপর নির্ভরশীল হলে আরাবিয়্যাতের যওক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে আরবী লোগাতের সাহায্যে উদ্দিষ্ট অর্থ নির্ণয় করার পর ভিন্ন ভাষায় তার সমার্থক শব্দ ও তাবীর কী তা জানার জন্য ভিন্ন ভাষায় অনূদিত কোনো নির্ভরযোগ্য অভিধান দেখা যেতে পারে। সংক্ষিপ্ত ও সহজ আরবী লোগাতসমূহের মধ্যে আল-মুজামুল ওয়াসিত নিয়মিত মুরাজাআত করা যেতে পারে। যা সমকালীন বিজ্ঞ আরবী ভাষাবিদ দ্বারা সংকলিত। আর বিশেষ প্রয়োজনে কখনো কখনো বিশদ বিস্তারিত কোনো আরবী অভিধান দেখা যেতে পারে। যেমন লিসানুল আরব, তাজুল আরুস ইত্যাদি, যেগুলোতে লুগাতের উৎসগ্রন্থসমূহের এবং আইয়াম্মায়ে লুগাতের উদ্ধৃতি সংকলিত হয়েছে।
(গ) ‘এসো আরবী শিখি’ কিতাবটি কোনো উস্তাযের কাছে তামরীনসহ পড়ুন। অর্থাৎ কিতাবে যেভাবে তামরীন করতে বলা হয়েছে সেভাবে করতে থাকুন যেন তা আত্মস্থ হয়ে যায়। এর সাথে ‘আত-তামরীনুল কিতাবী’ও রাখুন।
(ঘ) তরজমা ও অনুবাদ শেখার জন্য এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কোনো উস্তাযের কাছে অনুশীলন করা বেশি প্রয়োজন। শুধু কিছু তাত্তি¡ক নিয়মকানুন জেনে নেয়া যথেষ্ঠ নয়।