অনেক আরব আলিমকে দেখা যায়, মুখে দাড়ি নেই কিংবা খাটো দাড়ি। অথচ দাড়ি লম্বা করা ‘সুনানে হুদা’র অন্তর্ভুক্ত এবং এক মুষ্ঠির চেয়ে খাটো না করা ওয়াজিব। শুনেছি, আপনি আরব আলেমদের কাছেও পড়েছেন। তারাও কি এমন ছিলেন? আরও শুনেছি যে, আপনার একজন বিশেষ উস্তাদ, যিনি অনেক কিতাবপত্র লিখেছেন, তারও অবস্থা নাকি এমন ছিল। আপনারই এক ছাত্রের সূত্রে একজন আমাকে বলেছে যে, আপনি নিজেই নাকি তাকে এই তথ্য দিয়েছেন। সে একথাও বলেছে যে, আপনি তাকে বলেছেন, ‘তাঁর কিতাব পড়লে ইলম পাবে, তাহকীক পাবে, কিন্তু আমল-আখলাক কিছুই নেই!’
আরবে যদিও অনেক আলিমের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়েছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে আমার উস্তাদ শুধু দু’জন : ১. শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.। ২.তাঁর শাগরিদ শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দামাত বারাকাতুম।
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রাহ.কে দেখেছেন এমন হাজার-হাজার মানুষ আরবে-আজমে রয়েছেন। সবাই জানেন যে, শায়খ রাহ.-এর চেহারা ছিল পূর্ণ মাসনূন শ্মশ্রুশোভিত। দাড়ি তো সুন্নতে ওয়াজিবা, সাধারণ সুন্নত ও আদাবেরও যে গুরুত্ব শায়খের মাঝে ছিল তা জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাঁর কিতাবাদি থেকেই অনুমান করতে পারেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল : ‘মিন আদাবিল ইসলাম’, আসসুন্নাতুন নাবাবিয়্যাহ ওয়া মাদলূলুহাশ শরয়ী’, মুকাদিমায়ে তুহফাতুল আখয়ার বি ইহইয়াই সুন্নাতি সাইয়িদিল আবরার’ ইত্যাদি। আর যারা শায়খ রাহ.কে সরাসরি দেখেছেন তাদের তো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই রয়েছে।
উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম লিখেছেন, ‘আমি তাঁর (হযরত শায়খ আবদুল ফাত্তাহ) নাম প্রথম শুনি ১৯৫৬ সালে। আমার ওয়ালিদ হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. ‘মু’তামারে আলমে ইসলামী’র সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ফিলিস্তিন সফর করেছিলেন। দামেস্ক থেকে হযরত ওয়ালিদ ছাহেবের যে চিঠি আসে তাতে সিরিয়ার উলামা-মাশাইখের আলোচনা ছিল। ওই চিঠিতে তিনি বিশেষভাবে হযরত শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর কথা লিখেছিলেন। ফিরে আসার পরও হযরত ওয়ালিদ ছাহেব তাঁর কথা বলতেন অত্যন্ত মুহববতের সঙ্গে। অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলতেন যে,‘ইলম ও তাহকীকের অঙ্গনে যোগ্য ব্যক্তি এখনও আরবে অনেক আছেন, কিন্তু এমন ব্যক্তিত্ব খুবই কম, যারা একই সঙ্গে গভীর ইলম ও ইত্তেবায়ে সুন্নতের অধিকারী এবং যাদের আচার-আচরণে সালাফে সালেহীনের স্মৃতি জেগে ওঠে। হযরত শায়খ আবদুল ফাত্তাহ ওই দুর্লভ ব্যক্তিদেরই অন্যতম। ...’
‘পৃথিবীতে এই নিয়মই কার্যকর যে, যারা আসার তারা আসছে আর যারা বিদায় নেওয়ার তারা বিদায় নিচ্ছে, কিন্তু এমন ব্যক্তিত্ব বিরল, যাঁদের বিদায়ে পূর্ব-পশ্চিমের সকল মানুষের হৃদয় কাঁদে। অনাত্মীয়রাও তার তিরোধানে স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করে। নিঃসন্দেহে হযরত শায়খ রাহ. এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। একে তো এখন জ্ঞান ও পান্ডিত্যের অবনতিও দৃশ্যমান। কিন্তু তবুও কিছু ব্যক্তি এ অঙ্গনে তৈরি হচ্ছেন কিন্তু ইলম যাদের কথা ও কাজে বিকশিত, যাদের জীবন ও আচরণ ইত্তেবায়ে সুন্নত ও সালাফে সালেহীনের অনুসরণে প্রদীপ্ত, বিনয় ও খোদাভীতি এবং ভদ্রতা ও সহনশীলতায় প্রজ্জ্বোল, এমন ব্যক্তিত্বের দেখা পাওয়া তো এখন কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। এঁদের কেউ যখন বিদায় নেন তখন তো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাদের শূন্যতা পূর্ণ হয় না। (নুকূশে রফতেগাঁ, পৃ. ৩৮৯, ৩৯৩)
আমার খুব কষ্ট হয়েছে! একজন আলমী শায়খ ও মুরববী এবং মুতাওয়াতিরুল আদালাহ ওয়াস সালাহ ব্যক্তিত্বের ‘নির্দোষিতা’ সম্পর্কে লিখতে হল!
শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দামাত বারাকাতুহুম, আলহামদুলিল্লাহ, এখনও বা-হায়াত আছেন এবং ইলমে দ্বীনের খিদমতে মগ্ন আছেন।
এখন তাঁর বয়স তিয়াত্তর বছর। গভীর ইলম, উত্তম আখলাক এবং ইত্তেবায়ে সুন্নতের বৈশিষ্ট্যে তিনি শায়খ রাহ.-এর নমূনা। বাংলাদেশ থেকে যেসব আলিম-উলামা হজ্ব ও যিয়ারতের জন্য যান এবং আরবের উলামা-মাশাইখের সঙ্গে মুলাকাত করেন তাঁদের কাছ থেকেও জানা যেতে পারে যে, শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহর মুখমন্ডল মাসনূন দাড়িতে শোভিত। দীর্ঘ সময় পরে (যখন তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ফোনে এবং চিঠিপত্রের মাধ্যমে) গত দুই সফরে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ মুলাকাত হয়েছে এবং নতুন করে শায়খ রাহ.-এর স্মৃতি জাগ্রত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে হায়াতে তাইয়েবা দান করুন। আমীন।
মোমেনশাহীর একজন বড় আলিম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর মদীনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা মুকাররমায় আমাকে ফোন করে বলেছিলেন যে, ‘আমার অন্তর সাক্ষ্য দিয়েছে যে, ইনি একজন বুযুর্গ ব্যক্তি।’ আরেকজন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। তাঁর মাসনূন শ্মশ্রুশোভিত নূরানী চেহারা দেখে তিনি নির্বাক হয়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত শুধু কাঁদতেই থাকেন। শেষে বহু কষ্টে কান্না থামিয়ে সালাম দেন।
তো এঁদের সম্পর্কে যে মিথ্যা কথার প্রসঙ্গে আপনি আমার উদ্ধৃতি দিয়েছে এটা পরিষ্কার ‘বুহতান।’আপনার তো এটা শুনেই বলা উচিত ছিল, ‘সুবহানাকা হাযা বুহতানুন আযীম।’
এর কারণ হল কখনও কখনও ইলম শেখার জন্য কিছু ‘জাহেল’ লোকও আসে এবং তালীম-তরবিয়ত গ্রহণ না করে ‘জাহেল’ই বের হয়ে যায়। এ ধরনের লোকদের পক্ষে তো এমন কথা তৈরি করা অসম্ভব নয়।
আপনি আরেকটি বিষয় চিন্তা করুন। শুধু দাড়ি না থাকার বা ছোট থাকার উপর ভিত্তি করে কীভাবে একজনকে ‘বেআমল’ ও ‘বেআখলাক’ বলে দেওয়া হল? কারো সম্পর্কে এই কথা সঠিক হলেও তো এ কারণে তাকে ‘দাড়িহীন’ বলা যায় কিংবা বলা যায়, ‘দাড়ির মতো একটি সুন্নতে ওয়াজিবার তরককারী’। কিন্তু একেবারে আমল-আখলাক কিছুই নেই এটা কীভাবে বলা যায়? তারা যেন অনুগ্রহ করে উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর সহীহ বুখারীর দরসী তকরীর ‘ইন‘আমুল বারী’ প্রথম খন্ডে ‘বাব আদ্দীনু ইউসরুন’ পড়ে নেন। ইনশাআল্লাহ এর দ্বারা ‘গুলূ’ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এবং চিন্তা-ভাবনায় ভারসাম্য আসবে।
সেখানে হযরত একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। চেচনিয়ায় রূশবাহিনীর আক্রমণ চলছিল। সেখানকার মজলুম মুসলমানদের জন্য সাহায্যের বিভিন্ন প্রচেষ্টা চলছে। এ সময় হযরতের একজন পুরানো দোস্ত, অত্যন্ত দ্বীনদার, সাক্ষাতের জন্য আসেন। আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত তাকে বললেন,‘চেচেনিয়ার মুসলমানদের জন্য কিছু সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, ইচ্ছে হলে তুমিও এতে শামিল হতে পার।’ ওই দোস্ত বললেন, এই চেচেনিয়ার লোকেরা তো দ্বীনদার নয়! না মুখমন্ডলে দাড়ি আছে, না তাকওয়া-পরহেযগারীর কোনো চিহ্ন, কিছুই নেই!
হযরত বলেন, ‘আমার এত বিরক্তি লাগল যে, খোদার বান্দা, মানুষের সম্পর্কে কুধারণারও তো একটা সীমা-পরিসীমা থাকে!
‘ওই মুসলমানরা বছরের পর বছর রাশিয়ার জুলুম-অত্যাচারের শিকার, শুধু এই জন্য যে, তারা কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে, আর তুমি বল, তাদের দাড়ি নেই!
‘আল্লাহকে ভয় কর, একজন কালেমা পাঠকারী শুধু কালেমার কারণে জুলুম-অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, আর তুমি বলছ, দাড়ি নেই, তাই সে সাহায্য পেতে পারে না। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’
এই ঘটনা উল্লেখ করে হযরত রাহ. বলেন, ‘এমন কেন? শরীয়তে (র বিধানাবলিতে) কি কোনো পর্যায়ক্রম নেই? সবচেয়ে বড় জিনিস দাড়ি! এটা থাকলেই চলে! এরপর গীবত করুক, মিথ্যা অপবাদ দিক, লেনদেনে হাজার সমস্যা থাকুক, অন্যের হক মারুক, যা ইচ্ছা করুক, দাড়ি যেহেতু আছে অতএব ‘দ্বীনদার’! ‘দ্বীনদারের’ অর্থ আমরা ধরে নিয়েছি ‘দাড়িওয়ালা’। দ্বীনদার অর্থ দ্বীনের অনুসারী। তো এরা দ্বীনদারির সম্পূর্ণ অর্থ দাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে! যেন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে দ্বীনের কোনোই সম্পর্ক নেই। নাউযুবিল্লাহ!!
‘আমি আরজ করছি যে, ইসলামে দাড়ি সুন্নতে ওয়াজিবা। প্রত্যেকের জন্য এটা ওয়াজিব। কিন্তু ইসলাম এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের মধ্যে একটা প্রবণতা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে যে, আমরা দ্বীনকে বাহ্যিক বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছি। এটা অত্যন্ত জঘন্য ধরনের ‘গুলূ’।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই কথাগুলো স্মরণ রাখা উচিত। আমাদের (মাদরাসার) পরিবেশে আমরা দাড়ি রাখলাম, কুর্তা পরলাম, পাজামা টাখনুর উপরে ওঠালাম তো আমরা দ্বীনদার, আর যারা বাইরে আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, চাকুরি করছে তারা দুনিয়াদার!
কিছুদিন আগে এখান থেকে শিক্ষাসমাপণকারী একজন চিঠি লিখল। তার শব্দ এই ছিল যে, আমি এখন যে মাদরাসায় পড়ানো আরম্ভ করেছি সেখানে আমার মন বসছে না। আমার ভাই বলেন, তুমি কোনো চিন্তা করো না, দ্বীনের কাজ করতে থাক, তোমার সব খরচপত্র আমি বহন করব। কিন্তু আমার ভাই একজন দুনিয়াদার মানুষ। আমি তার কথা মানতে পারি কি?
‘আমি বললাম, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ! তোমার ভাই তোমার দ্বীন রক্ষার জন্য নিজের উপার্জিত অর্থ দ্বারা তোমাকে সহযোগিতা করছেন, তাকে তুমি বলছ দুনিয়াদার! আর নিজে হয়ে গেছ দ্বীনদার!! ...’ (ইনআমুল বারী ১/৫০১-৫০২)
যাই হোক, এই কথাগুলো প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করলাম। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। তাঁর আখলাক সম্পর্কে শুধু একটি মন্তব্য উল্লেখ করে কথা শেষ করছি। সিরিয়ার অবিসংবাদিত বুযুর্গ আল্লামা সাইয়েদ আহমদ ছকর্ একবার বলেছিলেন, ‘‘আখলাককে যদি বলা হয়, ‘মূর্ত হও’ তাহলে দেখা যাবে আবদুল ফাত্তাহ দাড়িয়ে আছেন!’’ (লিসানুল মিযান, প্রকাশকের ভূমিকা ১/৫৮)
আল্লাহ যদি চিন্তাশক্তি দান করেন তো এই এক বাক্য থেকেই অনেক কিছু অনুধাবন করা যাবে।#