মুহাররম ১৪৪৩ || আগস্ট ২০২১

হাসান মাহমুদ - সদর, নোয়াখালী

৫৪৭০. প্রশ্ন

ফরএভার বিজনেস পদ্ধতি কতটুকু শরীয়তসম্মত? এর ব্যবসায়িক পদ্ধতি হল-

(ক) আমি ফরএভারের পণ্য ক্রয় করতে হলে প্রথমে কোম্পানির একজন রেজিস্টার্ড কাস্টমার হতে হবে। কাস্টমার না হয়েও পণ্য ক্রয় করা যাবে। রেজিস্টার্ড কাস্টমারদের জন্য সকল পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৫% ছাড় দেওয়া হয়।

(খ) এরপর আমি কাস্টমার থেকে কোম্পানির একজন স্বাধীন ডিস্ট্রিবিউটর হতে চাইলে আমি আমার আইডি থেকে ২ সিসি পরিমাণ পণ্য ক্রয় করতে হবে। ২ সিসি পরিমাণ মানে ২০০০ পয়েন্ট। ১ পয়েন্ট ১৮.৫০ টাকা। ২০০০ পয়েন্টের পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৭০০০ টাকা। ৫% কাস্টমার ডিসকাউন্ট অনুযায়ী, যা ৩৫০০০ টাকা প্রদান করতে হয়। ৩৫০০০ টাকা দিয়ে ২০০০ পয়েন্টের পণ্য ক্রয়ের পরে আমি কোম্পানির একজন স্বাধীন ডিস্ট্রিবিউটর অথবা কোম্পানির একজন বিজনেস পার্টনার হিসেবে বিবেচিত হব।

(গ) ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার কারণে কোম্পানি আমাকে ৩০% ছাড়ে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ দিচ্ছে। যার ফলে আমার স্পন্সরকৃত কাস্টমারকে ৫% ছাড়ে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ দিচ্ছে। বাকি ২৫% আমাকে দিচ্ছে।

(ঘ) আমার কাস্টমার যখন অমার ন্যায় ডিস্ট্রিবিউটর হবেন তখন আমার এবং আমার ডিস্ট্রিবিউটরের কমিশন সমান। সেক্ষেত্রে আমি আর আমার ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে কোনো লভ্যাংশ পাব না।

(ঙ) আমার আইডিতে আমার অধীনের সকলের সিসি মিলিয়ে ২৫ সিসি সম্পূর্ণ হওয়ার পর আমার স্তর পরিবর্তন হবে। আমি সুপারভাইজার হিসাবে বিবেচিত হব। সেক্ষেত্রে আমার পূর্বের কমিশন বেড়ে ৩৫%-এ রূপান্তরিত হবে।

(চ) ঠিক একইভাবে অমার টোটাল টিমের সিসি মিলিয়ে যখন অমার অইডিতে ৭৫ সিসি পরিমাণ হবে তখন কোম্পানি আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসাবে বিবেচিত করবে। এবং ১৫০ সিসি পরিমাণ হলে ম্যানেজার বিবেচিত হব।

(ছ) Assistant Manager ৪৩% কমিশনManager ৪৮% কমিশন।

এইগুলো মূলত আমার প্রমোশন হবার কারণে অমাকে যোগ্যতা অনুযায়ী কোম্পানি দিয়েছে।

সারকথা, ফরএভার বিজনেস পদ্ধতি এভাবেই যে, ফরএভার কোম্পানির কারখানা যেহেতু একটা সেহেতু তাদের ব্যবসার সিস্টেম হল, সরাসরি কারখানা থেকে পণ্য ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে আসে। এবং ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছায়।

কোম্পানি তার একটি পণ্যের খুচরা মূল্যের ৫২% নিয়ে বাকি ৪৮% তার পণ্যের ক্রেতা, সুপারভাইজার, ম্যানেজার-এর মধ্যে বণ্টন করে দিচ্ছে।

অতএব, এখন আমার জানার বিষয়, উক্ত সুরতে ব্যবসা করা বৈধ হবে কি না? কোনো পদ্ধতি শরীয়তসম্মত না হলে সেটার শুদ্ধ পদ্ধতি জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর

প্রশ্নের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে, ‘ফরএভার লিভিং প্রোডাক্টস বাংলাদেশ লিমিটেড’ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতি অনুসৃত একটি কোম্পানি। আর এমএলএম পদ্ধতি বহু কারণে শরীয়তসম্মত নয়। দেশের বিজ্ঞ মুফতীগণের সমন্বয়ে গঠিত বেফাকুল মাদারিস মুফতী বোর্ড ঢাকা দীর্ঘ গবেষণা ও পর্যালোচনার পর উক্ত পদ্ধতির কারবারকে বহু আগেই সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী ও নাজায়েয ফতোয়া প্রদান করেছে। দেশে ইতিপূর্বে এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর সরকার কারো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ‘ডেসটিনি ২০০০’-এর কথা অনেকেরই জানা রয়েছে। এর আগেই বন্ধ হয়েছে টংচেং, ‘জিজিয়ান’সহ অনেক প্রতিষ্ঠান।

এ পদ্ধতির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত এক এলাকায় এক নামে অনেকদিন ব্যবসা করে না। আসলে করতে পারেও না। সাধারণ ব্যবসায়িক নীতিতেও এ ধারণা ভ্রান্ত ও লোকঠকানো। ব্যবসা বিষয়ক বহু গবেষক এমনই বলেছেন। একটি উদাহরণই দেখা যাক, প্রশ্নোক্ত কোম্পানি যে মধ্যস্বত্বভোগীদের না দিয়ে তাদের একেকজন এজেন্টকে সর্বোচ্চ ৪৮% পর্যন্ত বিক্রয় মূল্যের অংশ দিয়ে নিজেদের কৃতিত্বের কথা প্রকাশ করছে, আসলেই কি তাতে ভোক্তার কোনো লাভ হচ্ছে? বরং এক্ষেত্রে তো দেখা যাচ্ছে, সে চাইলে যে পণ্যটি ৬০ টাকায় বিক্রি করতে পারত, তা সে ১০০ টাকায় বিক্রি করছে তার কর্মী বা এজেন্টদের কমিশন দেয়ার জন্য, যার বোঝা বইছে সাধারণ ভোক্তা। এজেন্টকে না দিয়ে সে যদি সরাসরি মার্কেটিং করত তাহলে তার খরচাদি বাদ দিয়ে লাভ রেখে বিক্রি করলেও ভোক্তা পণ্যটি অন্তত ৪০% কম মূল্যে পেত। অথচ তারা এটিকেই তাদের ব্যবসার ভালো দিক বলে প্রচার করে থাকে।

যেহেতু প্রশ্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে তাই বিষয়টি খোলাসা করে দেয়া হল। এভাবে সাধারণ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে এ কারবারে আরো অনেক ত্রুটি রয়েছে। আমরা শুধু কারবারটির শরয়ী ত্রুটিগুলোর কয়েকটি উল্লেখ করছি-

এক. ফরএভার লিভিং প্রোডাক্টসের ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে কাজ করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্টার্ড কাস্টমার হয়ে নির্ধারিত মূল্যের পণ্য ক্রয় করার শর্ত করা হয়েছে। এভাবে ডিস্ট্রিবিউটরের মান উন্নত করতে হলে তার নিজের কিংবা তার অধীনস্থ নেটের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় করে নির্ধারিত সিসি (পয়েন্ট) অর্জন করার শর্ত করা হয়েছে। শরীয়তে এভাবে একটি কারবারের চুক্তির জন্য আরেকটি চুক্তির শর্ত করা জায়েয নয়। হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-

نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن صفقتين في صفقة واحدة.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম এক কাজের চুক্তির সাথে অন্য চুক্তি করতে নিষেধ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৭৮৩)

দুই. ডিস্ট্রিবিউটরের অধীনে বা টিমের লোকদের সিসি বৃদ্ধির কারণে তার নিজের স্তর পরিবর্তন ও পদোন্নতি করা হচ্ছে এবং অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া হচ্ছে। তাদের সিসি বৃদ্ধির পিছনে মূল ডিস্ট্রিবিউটরের কোনো পরিশ্রম নেই। এটি শরীয়তে الأجر بلا عمل তথা শ্রমবিহীন পারিশ্রমিক গ্রহণ ও বাতিল পন্থায় অন্যের সম্পদ ভোগ করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ.

তোমরা নিজেদের মাঝে একে-অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। [সূরা বাকারা (২) : ১৮৮, সূরা নিসা (৪) : ২৯]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

أنه يأكله بغير عوض.

বিনিময়হীন উপার্জন হল বাতিল পন্থায় উপার্জন। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৭২)

হযরত হাসান বসরী রাহ.-সহ আরো অনেক তাফসিরবিদ এই আয়াতের একই ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন। (দেখুন, রুহুল মাআনী ৫/১৫)

উক্ত কোম্পানিতে ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য যেহেতু পণ্য কেনা শর্ত, তাই উক্ত ক্রেতা কোম্পানিকে তার নির্ধারিত টাকাগুলো দিচ্ছে দুটি জিনিসের বিনিময়ে। ১. নির্ধারিত পণ্যের জন্য। ২. ডিস্ট্রিবিউটর হিসাবে কমিশন প্রাপ্তির জন্য। এখানে উক্ত বিনিময়ের প্রথমটি (নির্ধারিত পণ্য) জানা থাকলেও দ্বিতীয়টির পরিণাম ও পরিমাণ অজানা। কেননা, কমিশন পাওয়ার জন্য নিজে পণ্য ক্রয় করে বা কাস্টমার জোগাড় করে টিম গঠন করার মাধ্যমে নির্ধারিত সিসি পূর্ণ করা শর্ত। অথচ সে আদৌ কাস্টমার জোগাড় করতে পারবে কি না বা পারলে কতজন পারবে, টিমের লোকদের নির্ধারিত সিসি পূর্ণ হবে কি না- ইত্যাদি বিষয়াদি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। সিসি সংগ্রহ করতে না পারলে সে কোনো কমিশন পাবে না। সুতরাং শুরুতে সে উক্ত কোম্পানীতে ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে কমিশন ভোগ করার নিয়তে যে অর্থ বিনিয়োগ করেছে তার প্রাপ্তি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। এটি শরীয়তে নিষিদ্ধ الغرر (আলগারার)-এর অন্তর্ভুক্ত।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন-

نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن بيع الغرر.

অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল লেনদেনে الغرر (গারার)-কে নিষেধ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫১৩, জামে তিরমিযী, হাদীস ১২৩০)

الغرر -এর ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট হানাফী ফকীহ শামসুল আইম্মাহ সারাখসী রাহ. বলেন-

الغرر مايكون مستور العاقبة.

অর্থাৎ, যার পরিণাম অস্পষ্ট তাই গারার। (মাবসূত ১২/১৯৪)

ইমাম ইবনুল আছীর জাযারী রাহ. বলেন-

الغرر ما له ظاهر تؤثره و باطن تكرهه، فظاهره يغر المشتري و باطنه مجهول.

গারার হল, যে কারবারে একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে, যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু এতে অভ্যন্তরীণ এমন ত্রুটি রয়েছে, যা জানলে মানুষ এ থেকে বিরত থাকবে। ফলে এর প্রকাশ্য রূপ ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে দেয় আর অভ্যন্তরীণ রূপ অজানা থেকে যায়। (জামিউল উসূল ১/৪৩২)

তিন. বেচাকেনার ক্ষেত্রে শরীয়তের আরেকটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হল, বিনা কারণে বিক্রেতা ও ভোক্তার মাঝে অযাচিত মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। কিন্তু উক্ত পদ্ধতিতে শরীয়তের এই মৌলিক বিষয়টিরও লঙ্ঘন হচ্ছে। অধিকন্তু  ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে কমিশন ভোগের প্রলোভন দেখিয়ে পণ্য ক্রয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বরং শর্ত করার কারণে না চাইলেও পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এভাবে চাপে ফেলে কোনো বস্তু বিক্রি করাও বৈধ নয়।

এসকল শরয়ী নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর কারণে প্রশ্নোক্ত পদ্ধতির ব্যবসা সম্পূর্ণ নাজায়েয। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের জন্য উক্ত পদ্ধতির ব্যবসা করে আয় করা বা অন্যদের জন্য এদের সাথে যুক্ত হয়ে উপার্জন করা সবই নাজায়েয।

-আহকামুল কুরআন, জাসসাস ২/১৭১-১৭২; মাজমাউল আনহুর ৩/৫৪৪

এই সংখ্যার অন্যান্য প্রশ্ন-উত্তর পড়ুন