আমাতুল আজীজ - ময়মনসিংহ
৪৭৮৬. প্রশ্ন
আমার প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণ আছে। ২/৩ ভরি সাধারণত ব্যবহার করি। বাকি স্বর্ণ কেবল বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহার করি। এক বোন বললেন, ‘যে স্বর্ণ নিয়মিত ব্যবহার করা হয় তার যাকাত দিতে হয় না।’ এব্যাপারে আমাদের সমাজে বহু বিভ্রান্তি ছাড়ানো হয়।
মুফতী সাহেবের কাছে আমার জানার বিষয় হল, ঐ বোনের কথাটি কি ঠিক? এ বিষয়ে ইসলামী শরীয়াহর বিধান বিস্তারিত দলীলসহ জানালে বাধিত হব।
উত্তর
আপনার বোনের কথা ঠিক নয়। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার যাকাত দিতে হয়। নিম্নে কিছু বর্ণনা উল্লেখ করা হল :
সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, এক মহিলা তার মেয়েকে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন। মেয়েটির হাতে দুটি স্বর্ণের চুড়ি ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এ অলংকারের যাকাত আদায় কর? মহিলা বললেন, না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَيَسُرّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللهُ بِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ؟
তুমি কি পছন্দ কর যে, এ দুটি চুড়ির বদলে তোমাকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন আগুনের দুটো চুড়ি পরাবেন? (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৬৩, হাদীসটিকে ইবনুল কাত্তান, মুনযিরি, যাইলায়ী প্রমুখ হাদীস বিশারদগণ সহীহ বলেছেন। নাসবুর রায়াহ ২/৩৭০; বায়ানুল ওয়াহামি ওয়াল ঈহাম ৫/৩৬৬)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন-
دَخَلَ عَلَيّ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَرَأَى فِي يَدَيّ فَتَخَاتٍ مِنْ وَرِقٍ، فَقَالَ: مَا هَذَا يَا عَائِشَةُ؟ فَقُلْتُ: صَنَعْتُهُنّ أَتَزَيّنُ لَكَ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: أَتُؤَدِّينَ زَكَاتَهُنّ؟، قُلْتُ: لَا، أَوْ مَا شَاءَ اللهُ،
قَالَ: هُوَ حَسْبُكِ مِنَ النَّارِ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম আমার কাছে আসলেন, তখন আমার হাতে রূপার দুটো চুড়ি ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা কী আয়েশা? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যেন আপনার সামনে সেজেগুজে থাকতে পারি এজন্য এগুলো বানিয়েছি। তিনি বললেন, তুমি কি এগুলোর যাকাত আদায় কর? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, এগুলোই তোমাকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৬৫; হাকেম, ইবনু দাকীকিল ঈদ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৪৭৭; নাসবুর রায়াহ ২/৩৭১)
উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি স্বর্ণের এক প্রকার অলংকার ব্যবহার করতাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, এটা কি কানযের অন্তর্ভুক্ত? (কুরআনুল কারীমে যার জন্য শাস্তির কথা এসেছে) তিনি বললেন-
مَا بَلَغَ أَنْ تُؤَدّى زَكَاتُهُ، فَزُكِّيَ فَلَيْسَ بِكَنْزٍ.
যাকাতের নেসাব পরিমাণ হলে যদি তার যাকাত আদায় করা হয় তাহলে তা কানযের অন্তর্ভুক্ত থাকে না। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৬৪; ইমাম হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইমাম নববী বলেন, হাদীসটি হাসান। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৪৭৮; আল মাজমু ৫/৫১৭)
এজাতীয় বর্ণনাকে সামনে রেখে বড় বড় ফকীহ সাহাবী ও তাবেয়ীগণ স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার যাকাত দেওয়ার ফাতোয়া দিয়েছেন।
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাতে বর্ণিত আছে, উমর রা. আবু মূসা আশআরী রা.-এর নামে এ মর্মে চিঠি লেখেন যে-
مُرْ مَنْ قِبَلَك مِنْ نِسَاءِ الْمُسْلِمِينَ أَنْ يُصَدِّقْنَ حُلِيّهنّ.
আপনি আপনার আশপাশের মুসলিম মহিলাদেরকে তাদের অলংকারের যাকাত আদায় করার আদেশ দিন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদীস ১০২৫৭, ইমাম বুখারী বর্ণনাটিকে মুরসাল বলেছেন। -আত-তারীখুল কাবীর ৪/২১৭)
আরেক হাদীসে এসেছে, এক মহিলা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে নিজ অলংকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বললেন, এগুলোর কি যাকাত দিতে হবে? তিনি বলেন-
إِذَا بَلَغَ مِائَتَيْ دِرْهَمٍ فَزَكِّيهِ.
যদি দুইশত দিরহাম (অর্থাৎ যাকাতের নেসাব) পরিমাণ হয় তাহলে এর যাকাত আদায় কর। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা ৭০৫৫, আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৯৫৯৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৪৩৫৮)
এছাড়াও উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা., আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখ সাহাবী এবং ইবনে সীরীন, ইবনুল মুসায়্যিব, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আতা, মুজাহিদ, যুহরী, আলকামা, আসওয়াদ ও উমর ইবনে আবদুল আযীয প্রমুখ তাবেয়ী অনুরূপ ফতোয়া দিতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৭০৫৪, ৭০৫৯, ৭০৬০, ৭০৬৫, ৭০৫৭)
একারণেই প্রখ্যাত তাবেয়ী আতা, যুহরী ও মাকহুল বলেন-
قَالُوا: فِي الْحُلِيِّ زَكَاةٌ. وَقَالُوا : مَضَتِ السّنّةُ أَنّ فِي الْحُلِيِّ الذّهَبِ وَالْفِضّةِ زَكَاةً.
স্বর্ণ ও রূপার অলংকারে যাকাত দিতে হয়। এটি পূর্ব থেকে চলে আসা সুন্নত। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১০২৬৭)
মোটকথা, উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বর্ণ বা রূপার অলংকার ব্যবহৃত হলেও তার যাকাত দিতে হয়।
ব্যবহৃত অলংকারের যাকাত দিতে হয় না- এ মর্মে সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েতটি সনদের দিক থেকে সহীহ নয়। দেখুন, আলখিলাফিয়্যাত, বাইহাকী ৪/৩৭৪; তানকীহুত তাহকীক, ইবনু আব্দিল হাদী ২/২১০; নাসবুর রায়াহ ২/৩৭৪
এক্ষেত্রে যারা বলেন, অলংকারের যাকাত দিতে হবে না, তারা দলীল হিসাবে কিছু আছার উল্লেখ করেন। তবে অলংকারের যাকাত ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টি যেহেতু বিভিন্ন হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তাই এ মতটিই দলীলের বিচারে অধিক শক্তিশালী।
-কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনাহ ১/২৮৩; শরহু মুখতাসারিত তাহাবী ২/৩১৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/১০১; ফাতহুল কাদীর ২/১৬২; আলবাহরুর রায়েক ২/২২৬