আমার জানামতে আমাদের সমাজে কিছু মানুষ যে কোনো ফরয নামায (বিশেষ করে ফজরের ফরয নামায)-এর জামাতে অনুপস্থিত থাকে। কারণ হিসাবে তারা বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবসময় নামায আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করতেন এবং আবু দাউদ শরীফের একটি হাদীসে আছে, ‘যখন তোমাদের ইমামগণ নামায আদায়ে বিলম্ব করবে তখন তোমরা নিজেরা উক্ত নামায ঘরে আদায় করবে। পরে তাদের সাথে মিলিত হলে পুনরায় জামাতে শরীক হবে। তা তোমাদের জন্য নফল।’
তাদের এ বক্তব্য কতটুকু সঠিক এবং উক্ত কারণে জামাতে অনুপস্থিত থাকার গুনাহ হবে কি না?
প্রশ্নোল্লেখিত ব্যক্তিদের মসজিদের জামাত থেকে অনুপস্থিত থাকা এবং এর স্বপক্ষে উক্ত দলীল পেশ করা সহীহ নয়। আর সুনানে আবু দাউদের উক্ত হাদীসটি এক্ষেত্রে দলীল নয়। তাছাড়া মাগরিব ছাড়া প্রত্যেক নামাযেরই একটি মুস্তাহাব সময় রয়েছে। যা আওয়াল ওয়াক্ত থেকে কিছুটা পরে। যেমন, ফজরের নামায সম্পর্কে হযরত রাফে বিন খাদিজ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
أَسْفِرُوا بِالفَجْرِ، فَإِنّهُ أَعْظَمُ لِلأَجْرِ.
তোমরা ফজরের নামায চারদিক আলোকিত হয়ে যাওয়ার পর পড়বে। কেননা তাতে অধিক সওয়াব রয়েছে। (জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫৪)
যোহরের নামায সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
إِذَا اشْتَدّ الحَرّ فَأَبْرِدُوا بِالصّلاَةِ.
রোদের তাপ বেশি হলে তাপমাত্রা কমে আসার পর যোহরের নামায পড়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৬)
আসরের নামায সম্পর্কে হযরত জাবের রা. বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يُصَلِّي الظّهْرَ بِالْهَاجِرَةِ، وَالْعَصْرَ وَالشّمْسُ بَيْضَاءُ نَقِيّةٌ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের নামায আদায় করতেন দ্বিপ্রহরে। আর আসর নামায আদায় করতেন সূর্য শুভ্র ও উজ্জ্বল থাকতেই। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫২৭)
ইশার নামায সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
مَكَثْنَا ذَاتَ لَيْلَةٍ نَنْتَظِرُ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لِصَلَاةِ الْعِشَاءِ الْآخِرَةِ، فَخَرَجَ إِلَيْنَا حِينَ ذَهَبَ ثُلُثُ اللّيْلِ، أَوْ بَعْدَهُ، فَلَا نَدْرِي أَشَيْءٌ شَغَلَهُ فِي أَهْلِهِ، أَوْ غَيْرُ ذَلِكَ، فَقَالَ حِينَ خَرَجَ: إِنّكُمْ لَتَنْتَظِرُونَ صَلَاةً مَا يَنْتَظِرُهَا أَهْلُ دِينٍ غَيْرُكُمْ، وَلَوْلَا أَنْ يَثْقُلَ عَلَى أُمّتِي لَصَلّيْتُ بِهِمْ هَذِهِ السّاعَةَ، ثُمّ أَمَرَ الْمُؤَذِّنَ فَأَقَامَ الصّلَاةَ، وَصَلّى.
অর্থাৎ রাতের এক তৃতীতয়াংশ বা আরো বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ইশার নামায পড়িয়ে বললেন, আমার উম্মতের জন্য কঠিন না হলে এ নামায আমি এ সময়েই পড়তাম। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৩৯)
এসব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাগরিব ছাড়া অন্যান্য নামাযের মুস্তাহাব সময় আওয়াল ওয়াক্তে নয়; বরং ওয়াক্ত শুরু হওয়ার কিছুটা পরে।
আর আবু দাউদের হাদীসে এক শ্রেণির আমীর-উমারা কর্তৃক নামাযের সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর অথবা একেবারে ওয়াক্তের শেষ প্রান্তে এসে নামায পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করে সে সময়ের করণীয় নির্দেশ করা হয়েছে যে, সেক্ষেত্রে তোমরা একাকী নামায পড়ে নেবে এবং পরে তাদের সাথে জামাতে শরীক হবে। সুনানে আবু দাউদের পূর্ণ হাদীসটি এই-
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: إِنّهَا سَتَكُونُ عَلَيْكُمْ بَعْدِي أُمَرَاءُ تَشْغَلُهُمْ أَشْيَاءُ عَنِ الصّلَاةِ لِوَقْتِهَا حَتّى يَذْهَبَ وَقْتُهَا فَصَلّوا الصّلَاةَ لِوَقْتِهَا، فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ أُصَلِّي مَعَهُمْ؟، قَالَ: نَعَمْ، إِنْ شِئْتَ.
উবাদাহ ইবনে সামিত রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার পর এমন কিছু শাসক আসবে যারা নির্ধারিত সময় থেকে নামাযকে বিলম্ব করবে এমনকি নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে। সে সময় তোমরা নামায যথা সময়ে আদায় করে নিবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি (অতপর) তাদের সাথে নামায পড়ে নিব? তিনি বললেন, হাঁ, তুমি চাইলে তা করতে পার। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৩)
এ হাদীসের পাঠ থেকেই একথা স্পষ্ট যে, ফাসেক আমীরগণ ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর নামায পড়বে। আওয়াল ওয়াক্ত থেকে বিলম্ব করার কোনো কথা এখানে বলা হয়নি। অতএব মুস্তাহাব ওয়াক্তে আদায়ের জন্য আওয়াল ওয়াক্ত থেকে কিছুটা বিলম্ব করার ক্ষেত্রে ঐ হাদীস কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়।
আর আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে সাধারণত ফজরসহ অন্যান্য নামাযের জামাতের সময় মুস্তাহাব ওয়াক্তকে কেন্দ্র করেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। সুতরাং শরীয়তসম্মত ওজর ব্যতীত শুধু ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে জামাত অনুষ্ঠিত না হওয়ার অজুহাতে মসজিদের জামাতে অনুপস্থিত থাকা অন্যায়।
মুসলিমদের জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়ে হাদীসে কঠোর ধমকি এসেছে। এক হাদীসে আছে, হযরত আবু দারদা রা.-কে লক্ষ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
عَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّمَا يَأْكُلُ الذِّئْبُ الْقَاصِيَةَ.
তুমি (মুসলিমদের) জামাআতকে নিজের উপর আবশ্যকীয় করে নাও। কেননা দলছুট বকরীকে নেকড়ে খেয়ে ফেলে। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২১০১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৪৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৭১০
আর মসজিদে নামাযের জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন-
مَنْ سَرّهُ أَنْ يَلْقَى اللهَ غَدًا مُسْلِمًا، فَلْيُحَافِظْ عَلَى هَؤُلَاءِ الصّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنّ، فَإِنّ اللهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ سُنَنَ الْهُدَى، وَإِنّهُنّ منْ سُنَن الْهُدَى، وَلَوْ أَنّكُمْ صَلّيْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّي هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِي بَيْتِهِ، لَتَرَكْتُمْ سُنّةَ نَبِيِّكُمْ، وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ... وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلّفُ عَنْهَا إِلّا مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ، وَلَقَدْ كَانَ الرّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرّجُلَيْنِ حَتّى يُقَامَ فِي الصّفِّ.
যে ব্যক্তি আশা রাখে যে, সে কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে মুসলিম অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে, তার উচিত, সে যেন ঐ জায়গায় এই নামাযসমূহ আদায়ের প্রতি যত্নবান হয়; যেখানে আযান দেওয়া হয় (অর্থাৎ মসজিদে)। কেননা, মহান আল্লাহ তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য এমন সুন্নাহ নির্ধারণ করেছেন, যা হেদায়েত। আর নিশ্চয় এই নামাযসমূহ (মসজিদে আদায় করা) হেদায়েতের সুন্নাহ। যদি তোমরা (ফরয) নামায নিজেদের ঘরেই পড়, যেমন এই পিছিয়ে থাকা লোক নিজ ঘরে নামায পড়ে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর তরীকা পরিহার করলে। আর (মনে রেখো,) যদি তোমরা তোমাদের নবীর তরীকা পরিহার কর, তাহলে নিঃসন্দেহে পথহারা হয়ে যাবে। একটা সময় ছিল যখন আমরা মুসলিমদের দেখেছি যে, (তারা জামাত থেকে পিছনে থাকত না) শুধু দেখেছি যে, নামায (জামাতসহ পড়া) থেকে কেবল প্রকাশ্য মুনাফিকই পিছিয়ে থাকত। আরো দেখেছি যে, অসুস্থ ব্যক্তি দু’জনের উপর ভর করে মসজিদে আসত এবং তাকেও (নামাযের) সারিতে দাঁড় করানো হত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৪)