সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি জন্মসূত্রে এই এলাকার একজন স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের এই গ্রামে (দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ৯নং ভিয়াইল ইউনিয়নের জয়পুর গ্রাম) একটি ফাজিল মাদরাসা ও মাদরাসা মাঠের সাথেই এলাকার কবরস্থান অবস্থিত। এই কবরস্থানের সাথেই একটি মাজার ও তাঁর কয়েক হাত সামনেই একটি বিশেষ পুকুর অবস্থিত।
মাদরাসা মাঠেই প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ১ম সপ্তাহে (নির্র্ধারিত) দিনব্যাপি ওয়াজ-মাহফিল ও ঈসালে সাওয়াব হয়। উল্লিখিত দুই দিন মাজার ও পুকুরের আসল কার্যক্রম চলে। আর সারা বছরই মানুষের আসা-যাওয়ার মাধ্যমে তা অব্যাহত থাকে।
মাজারের দানবক্সে মানুষ দান করে এবং পুকুরের পানি পান করে এবং বোতলে করে নিয়ে যায়। মানুষের ধারণা, এই মাজারে দান করলে ও পুকুরের পানি পান করলে তাঁদের সমস্যা সমাধান, অসুস্থতা দূর হবে এবং সন্তান লাভ হবে ইত্যাদি। এখানে প্রচুর মুরগি, ছাগল, চাল ও টাকা মানুষ দান ও মান্নত করে। এই মাজার ও পুকুরে নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, মুসলিম-অমুসলিম সকলেই আসে। হিন্দুরা তাঁদের নিয়ম অনুযায়ী হাত নমস্কার করে, দান করে ও পানি নিয়ে যায়। আর মুসলিমরা হাত তুলে দুআ করে ও শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ইত্যাদি।
এই মাজারের উপরে একটা বিশাল গাছ আছে ও তাঁর পাশেই আরেকটা বিশাল গাছ আছে। এই গাছ দুটির ব্যাপারেও মানুষের মাঝে ভয় কাজ করে। বৃদ্ধ লোকেরা এই মাজার ও পুকুরের আশ্চর্য ঘটনাবলি বর্ণনা করে। এখানে বর্তমানেও কোনো স্বাভাবিক কাজে বিঘœতা ঘটলে এই মাজারের কারামত বলে মনে করে ও ভয় করে।
এখন আমার বিশেষ জানার বিষয় হল,
১. যে কোনো প্রয়োজনে মাজারে দান, দুআ ও মান্নত করার হুকুম কী?
২. নিয়ত অনুযায়ী পুকুরের পানি পান করলে উপকার হয় বা সমস্যা দূর হয়- এরকম বিশ্বাসের হুকুম কী?
এবং তা যদি কেউ আল্লাহ্র ওয়াস্তেই করে। (আমাদের এলাকার লোকজন বিশ্বাস করে আল্লাহ্র ওয়াস্তে করলে সমস্যা নেই)
আমাদের এলাকার লোকজন ইসলাম প্রিয় ও আলেম-উলামাদের ভালোবাসে তবে এই বিষয়টি সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা আপনাদের দলীলভিত্তিক জবাব পেলে বিষয়টি এলাকার লোকজন ও কমিটি অবশ্যই মানবে।
অতএব এই কার্যক্রমের উপর বিবেচনা করে শরীয়তের দৃষ্টিতে এর হুকুম ও আমাদের করণীয় বলবেন কি।
১. যে কোনো মাজারওয়ালা বা কবরবাসী, এমনকি ওলী-বুযুর্গ হয়ে থাকলেও তার কাছে কিছু চাওয়া শিরক। কেননা, দুআ ও সাহায্য প্রার্থনা শুধু আল্লাহ তাআলার কাছেই করা যায়। দুআ একটি ইবাদত। আর সমস্ত ইবাদত আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত। সূরা ফাতিহায় আছে-
اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ.
আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই কাছে সাহায্য চাই। [সূরা ফাতেহা (১) : ৪]
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
اَمَرَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ.
আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন, তোমরা একমাত্র তারই ইবাদত করবে। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৪০
সূরা রা‘দে (আয়াত : ১৪) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
لَهٗ دَعْوَةُ الْحَقِّ وَ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖ لَا یَسْتَجِیْبُوْنَ لَهُمْ بِشَیْءٍ اِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّیْهِ اِلَی الْمَآءِ لِیَبْلُغَ فَاهُ وَ مَا هُوَ بِبَالِغِهٖ وَ مَا دُعَآءُ الْكٰفِرِیْنَ اِلَّا فِیْ ضَلٰلٍ.
এ আয়াতে বলা হয়েছে, সত্য প্রার্থনা সেটিই, যা আল্লাহ তাআলার কাছে চাওয়া হয়। আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য যে কারো কাছেই প্রার্থনা করা হোক তা বৃথা এবং তা কাফেরদেরই কাজ।
হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الدُّعَاءُ هُوَ العِبَادَةُ.
দুআই ইবাদত। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করেন-
وَ قَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِیْۤ اَسْتَجِبْ لَكُمْ اِنَّ الَّذِیْنَ یَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِیْ سَیَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دٰخِرِیْنَ.
তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, তোমরা আমার কাছে দুআ কর, আমি তোমাদের দুআ কবুল করব। যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত হতে বিমুখ হবে তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [সূরা মু’মিন (৪০) : ৬০] -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৬৯
মাজারে গিয়ে দুআ করার ব্যাপারে হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. বলেন-
كل من ذهب إلى بلدة أجمير أو قبر سالار مسعود، أو ما ضاهاها لأجل حاجة يطلبها فإنه آثم إثما أكبر من القتل والزنا، أليس مثله إلا مثل من كان يعبد المصنوعات أو مثل من كان يعبد اللات والعزى.
যারা আজমীর, সালার মাসউদ প্রমুখ বুযুর্গদের মাজারে গিয়ে স্বীয় উদ্দেশ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করে তারা হত্যা ও ব্যভিচারের চাইতে জঘন্য পাপ করে। তাদের উপমা হল ঐ মুশরিকদের ন্যায়, যারা স্বহস্তে বানানো মূর্তির পূজা করে এবং লাত উযযার পূজা করে। -তাফহীমাতে ইলাহিয়্যাহ ২/৪৯
অনুরূপভাবে মান্নতও একমাত্র আল্লাহ তাআলার নামেই করা যায়। আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো নামে মান্নত করা হারাম ও শিরক। প্রসিদ্ধ ফিকহগ্রন্থ আলবাহরুর রায়েকে আছে-
...فهذا النذر باطل بالإجماع لوجوه منها أنه نذر لمخلوق والنذر للمخلوق لا يجوز؛ لأنه عبادة والعبادة لا تكون للمخلوق.
মাজার ও পীরদের নামে মান্নত করা সকলের ঐক্যমতে বাতিল। এর একাধিক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল, এ মান্নত মাখলুকের নামে হচ্ছে। আর কোনো মাখলুকের জন্য মান্নত করা জায়েয নেই। কেননা, মান্নত করা একটি ইবাদত। আর ইবাদত কোনো মাখলুকের জন্য হতে পারে না। -আল বাহরুর রায়েক ২/২৯৮
আর মাজার ও কবর দান-সদকার জায়গা নয়। সেখানে দান-সদকার টাকা দিয়ে বহুবিধ শিরক এবং বিদআত কাজ সংঘঠিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মাজারে দান করার মানে এসকল গুনাহে সহযোগিতা করা। আর দানের উদ্দেশ্য যদি মাজারওয়ালার নৈকট্য অর্জন বা কোন উপকার লাভ করা হয় তবে তো এভাবে দান করাটাই শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তাই মাজারে টাকা পয়সা দেওয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
২. কোনো পুকুরের ক্ষেত্রে প্রশ্নোক্ত বিশ্বাস রাখাও শিরকের শামীল। এটি সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভ্রান্ত ধারণা। মতলবী লোকেরা এসব শিরকী কর্মকাÐ চালু করেছে। তাই এমন বিশ্বাস ও কর্ম থেকে বিরত থাকা ফরয। এমনকি উক্ত বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ্র ওয়াস্তে পানি পান করাও জায়েয হবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা ঐ পুকুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলে দেননি। কুরআন-হাদীসের কোথাও বিশেষ কোনো পুকুরের ব্যাপারে আলাদা বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ নেই। এ ধরনের শিরকী কর্মকাÐের সাথে আল্লাহ্র নাম ব্যবহার করা আরো মারাত্মক গুনাহ। তাই মুসলমানদের এসব কিছু থেকে বিরত থাকা ফরয। -রুহুল মাআনী ১৭/২১২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৩৯; ইমদাদুল আহকাম ১/১২৮