মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী ও মিশকাত এর হাওলায় লেখা আছে— বায়ুর শব্দ বা গন্ধ ছাড়া পুনরায় ওযু আবশ্যক নয়। তাহলে এই অবস্থায় নামায পড়া যাবে কি না? আবার বুখারী শরীফের ১৩৪, ১৭২, ১৯১৪ নম্বর হাদীসে আছে যে, কেউ যেন (বায়ু নির্গত) শব্দ না শুনে বা গন্ধ না পেয়ে নামায না ছাড়ে। মুহতারামের কাছে আমার প্রশ্ন হল— বায়ু নির্গত হল, কিন্তু শব্দ হল না ও গন্ধ পাওয়া গেল না, তাহলে ওযু থাকবে কি না? ঐ অবস্থায় নামায পড়া যাবে কি না?
মূল জবাবের পূর্বে দুটি বিষয় বোঝা দরকার :
১. বায়ু নির্গত হওয়া ওযু ভঙ্গের কারণ।
২. বায়ু নির্গত হওয়ার বিষয়টি যেহেতু দৃশ্যমান নয়, তাই যতক্ষণ তা বের হওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত ওযু নষ্ট হবে না।
বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত এ সংক্রান্ত হাদীসগুলো মিলিয়ে পড়লেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য নিচে এ বিষয়ে কিছুটা বিশদ আলোচনা করা হল।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—
لاَ تُقْبَلُ صَلاَةُ مَنْ أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ، قَالَ رَجُلٌ مِنْ حَضْرَمَوْتَ: مَا الحَدَثُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ؟ قَالَ: فُسَاءٌ أَوْ ضُرَاطٌ.
“যার ‘হদস’ হয়েছে সে (পুনরায়) ওযু না করে নামায পড়লে তার নামায আদায় হয় না।” (আবু হুরায়রা রা.-এর নিকট হাদীসটি শুনে) ‘হাযরামউতে’র অধিবাসী এক ব্যক্তি তাকে বললেন, হে আবু হুরায়রা, ‘হদস, হওয়ার মানে কী?
তিনি বললেন, শব্দহীন অথবা শব্দবিশিষ্ট বায়ু নির্গত হওয়া। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৫)
আলী ইবনে তল্ক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—
إِذَا فَسَا أَحَدُكُمْ فِي الصَّلَاةِ، فَلْيَنْصَرِفْ فَلْيَتَوَضَّأْ وَلْيُعِدِ الصَّلَاةَ.
কারও যদি নামাযের মধ্যে শব্দহীন বায়ু নির্গত হয় তাহলে সে যেন নামায ছেড়ে দেয়। তারপর ওযু করে পুনরায় নামাযটি আদায় করে নেয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২০৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২২৩৬)
প্রশ্নে সহীহ বুখারীর উদ্ধৃতিতে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে তা পূর্ণাঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি; বরং হাদীসের শুধু শেষাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। সহীহ বুখারীর যে অধ্যায়ে হাদীসটি আনা হয়েছে সে অধ্যায়ের শিরোনামসহ পুরো হাদীসটি পড়লেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যেত। কেননা উক্ত বর্ণনায় শব্দ ও গন্ধের কথা বলা হয়েছে বায়ু নির্গত হওয়ার সন্দেহে আক্রান্ত এক ব্যক্তির ব্যাপারে। শব্দ ও গন্ধের কথা তাকে এজন্যই বলা হয়েছে যে, সে যেন বায়ু নির্গত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কেবল সন্দেহের কারণেই ওযু ভেঙ্গে গেছে মনে করে নামায ছেড়ে না দেয়। শিরোনামসহ পুরো হাদীসটি এই—
بَابُ مَنْ لاَ يَتَوَضَّأُ مِنَ الشَّكِّ حَتَّى يَسْتَيْقِنَ
...عَنْ عَبَّادِ بْنِ تَمِيمٍ، عَنْ عَمِّهِ، أَنَّهُ شَكَا إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّجُلُ الَّذِي يُخَيَّلُ إِلَيْهِ أَنَّهُ يَجِدُ الشَّيْءَ فِي الصَّلاَةِ؟ فَقَالَ: لاَ يَنْفَتِلْ — أَوْ لاَ يَنْصَرِفْ — حَتَّى يَسْمَعَ صَوْتًا أَوْ يَجِدَ رِيحًا.
অধ্যায় : (ওযু ভঙ্গের ব্যাপারে) নিশ্চিত না হয়ে শুধু সন্দেহের কারণে নতুন ওযু আবশ্যক না হওয়া
...আব্বাদ ইবনে তামীম রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন— তার মনে হয় যে, নামাযের মধ্যে কিছু (বায়ু নির্গত) হয়ে গেছে। (অর্থাৎ এমনটি মনে হলে তখন তার করণীয় কী?)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘শব্দ বা গন্ধ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে যেন নামায না ছাড়ে’। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৬১)
অতএব সহীহ বুখারী থেকেই পরিষ্কার যে, বায়ু নির্গত হওয়া নিশ্চিত হলেই ওযু ভেঙে যায়। আর সন্দেহে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যম শব্দ ও গন্ধ। এই মাসআলা এবং সহীহ বুখারীর বর্ণনার এই ব্যাখ্যা মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা দ্বারাও প্রমাণিত। ইমাম নববী রাহ. বলেন—
حتى يسمع صوتا أو يجد ريحا، معناه : حتى يعلم وجود أحدهما، ولا يشترط السماع والشم بإجماع المسلمين.
‘শব্দ বা গন্ধ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে (বায়ু নির্গত হওয়ার সন্দেহগ্রস্ত ব্যক্তি) যেন নামায না ছাড়ে, হাদীসের উক্ত কথাটির অর্থ হল, দুটোর কোনো একটি ঘটেছে বলে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারা। শব্দ শোনা বা গন্ধ পাওয়া শর্ত নয়। এটি মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। (আলমিনহাজ শরহে মুসলিম, নববী ৪/৪৯)
ইমাম আবু সুলাইমান খাত্তাবী রাহ. বলেন—
معناه : حتى يتيقن الحدث، ولم يرد به الصوت نفسه ولا الريح نفسها حسب، وقد يكون أطروشاً لا يسمع الصوت، وأخشم لا يجد الريح، ثم تنتقض طهارته إذا تيقن وقوع الحدث منه.
‘শব্দ বা গন্ধ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে যেন নামায না ছাড়ে’ হাদীসের উক্ত কথাটির অর্থ হল, ‘বায়ু নির্গত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে সে যেন নামায না ছাড়ে।’ সরাসরি শব্দ শোনা কিংবা গন্ধ পাওয়া এখানে উদ্দেশ্য নয়। কারণ কোনো ব্যক্তি বধির হয়, যে কোনো শব্দ শুনতে পায় না। আবার কেউ হয় ঘ্রাণশক্তিহীন, যে কোনো গন্ধ পায় না। তা সত্ত্বেও সে যখন বায়ু নির্গত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয় তখন তার ওযু ভেঙ্গে যায়। (মাআলিমুস সুনান, খাত্তাবী ১/৬৪)
ইবনে হাযম রাহ. বলেন—
والريح الخارجة من الدبر — خاصة لا من غيره — بصوت خرجت أم بغير صوت. وهذا أيضا إجماع متيقن، ولا خلاف في أن الوضوء من الفسو والضراط.
শব্দসহ হোক কিংবা শব্দ ছাড়া, পায়ু পথ থেকে বায়ু নির্গত হলেই ওযু ভেঙ্গে যাবে। এটি নিঃসন্দেহে ঐক্যমত্যপূর্ণ বিষয়। শব্দবিশিষ্ট এবং শব্দহীন বায়ু নির্গত হওয়ার কারণে ওযু আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে কোনো মতভিন্নতা নেই। (আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম ১/২১৮; মারাতিবুল ইজমা, পৃ. ৪০)
আল্লামা আইনী রাহ. বলেন—
قال الإسماعيلي : هذا من رسول الله عليه الصلاة والسلام فيمن شك في خروج ريح منه، لا نفي الوضوء إلا من سماع صوت أو وجدان ريح.
ইসমাঈলী রাহ. বলেন, ‘শব্দ বা গন্ধ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে যেন নামায না ছাড়ে’ কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়ু নির্গত হওয়ার বিষয়ে সন্দেহগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যাপারে বলেছেন। কথাটির উদ্দেশ্য এই নয় যে, শব্দ বা গন্ধ পাওয়া ব্যতিরেকে ওযু ভাঙ্গবে না। (উমদাতুল কারী ২/২৫২)
আল্লামা আইনী রাহ. আরও বলেন—
ثم اعلم أن حقيقة المعنى في قوله حتى يسمع صوتا أو يجد ريحا حتى يعلم وجود أحدهما ولا يشترط السماع والشم بالإجماع.
‘শব্দ বা গন্ধ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সে (অর্থাৎ বায়ু নির্গত হওয়ার সন্দেহগ্রস্ত ব্যক্তি) যেন নামায না ছাড়ে’ কথাটির আসল অর্থ হল, ‘দুটোর কোনো একটি হয়েছে বলে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারার আগ পর্যন্ত সে যেন নামায না ছাড়ে।’ শব্দ শোনা বা গন্ধ পাওয়া শর্ত নয়। এটি ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। (উমদাতুল কারী ২/২৫৩)
আরো দেখুন— সহীহ ইবনে খুযায়মা ১/৫৯; শরহুস সুন্নাহ, বাগাবী ১/৩৫৩; শরহু মুখতাসারিত তহাবী, জাসসাস ১/৩৬৭; আরিযাতুল আহওয়াযী, ইবনুল আরাবী ১/১০০; ফাতহুল বারী ১/২৮৭
সুতরাং প্রশ্নোক্ত হাদীস শরীফে শব্দ ও গন্ধের কথা ব্যাপকভাবে বলা হয়নি। বরং বায়ু নির্গত হওয়ার সন্দেহগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু যার নিশ্চিতভাবে বায়ু নির্গত হয়েছে সে শব্দ বা গন্ধ না পেলেও ওযু ভেঙ্গে যাবে।
অতএব নিশ্চিতভাবে বায়ু নির্গত হওয়ার পরও শুধু শব্দ বা গন্ধ না পাওয়ার কারণে ওযু নষ্ট না হওয়ার ধারণা এবং এর স্বপক্ষে উক্ত হাদীসগুলো পেশ করা নিতান্তই ভুল।