আমাদের এলাকায় কয়েকটি লেনদেন খুবই প্রচলিত। কিন্তু বৈধ কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে। নিম্নে এগুলোর বিবরণ উল্লেখ করছি।
১ম পদ্ধতি : সমিতির কাছে ঋণের আবেদন করলে সমিতি কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীকে সরাসরি নগদ অর্থ না দিয়ে এক কৌশল অবলম্বন করে। প্রথমে সমিতির নির্ধারিত ফরম পূরণ করত: আবেদনকারীকে নিয়ে সমিতি কর্তৃক নির্ধারিত দোকানে চলে যায়। দোকানের কোন নির্দিষ্ট মালের স্ত্তপের দিকে ইঙ্গিত করে বলে যে, মালগুলি আমি (উদাহরণত) ১,০০,০০০/- (এক লক্ষ) টাকায় খরিদ করলাম। অতপর ১,০০,০০০/- (এক লক্ষ) টাকা ব্যবসায়ীর হাতে দিয়ে আবেদনকারীকে বলে এ মালগুলি সমিতি আপনার কাছে ছয়মাস মিয়াদে ১,৪০,০০০/- (এক লক্ষ চল্লিশ) হাজার টাকায় বাকিতে বিক্রি করছে। আপনি মালগুলি দোকানীর কাছে বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়া যেতে পারেন অথবা দোকানী নিজেই ৯৯,৫০০/- (নিরানববই হাজার পাঁচশত) টাকা আবেদনকারীকে দিয়ে বলে এই মালগুলি আমি আপনার কাছ থেকে ক্রয় করলাম।
২য় পদ্ধতি : সমিতির অফিস দ্বিতীয় তলায় এবং অফিসে বিক্রয়যোগ্য কিছু মালামাল আছে। নিচ তলায় মার্কেট এবং মার্কেটে সমিতির নির্ধারিত দোকান আছে। দোকানের কাজ হল বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মাল ক্রয় করে সমিতির অফিসে পৌঁছিয়ে দেওয়া। এ সমিতির বিনিয়োগ পদ্ধতি হল সমিতির কাছে ঋণ চাইলে সমিতি তাকে নগদ অর্থ না দিয়ে তার কাছে অফিসের রক্ষিত মাল বাকির উপর অধিক মূল্যে বিক্রি করে। অতপর ঋণপ্রার্থী উক্ত মাল নিজ আয়ত্তে নিয়ে নিচ তলার মার্কেটে সমিতির নির্ধারিত দোকানে নগদ অর্থে কম মূল্যে বিক্রি করে। এতে করে সমিতির সম্পদ সমিতির কাছেই ফিরে যায়। এবং এই বাকি ও নগদ ক্রয়ের আড়ালে সমিতির মোটা অংকের মুনাফা অর্জন হয়। আবেদনকারীর প্রয়োজনও মিটে যায়।
৩য় পদ্ধতি : ঋণ প্রার্থী একজন ব্যবসায়ী। তার ঠান্ডা পানিয় এর ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এক লোকের নিকট ২০,০০০/- (বিশ হাজার) টাকা ঋণ চাইলেন। কিন্তু তিনি বিনা লাভে ঋণ দিতে প্রস্ত্তত নন। তাই তিনি এই পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যে ঋণপ্রার্থীর দোকানের একটি ফ্রিজ ২০,০০০/- (বিশ হাজার) টাকা মূল্যে ক্রয় করলেন এবং (মালিকানা বোঝানোর জন্য) ফ্রিজে হাত রেখে ঋণপ্রার্থীর নিকট ছয় মাসের জন্য প্রতি মাসে ১২০০ (এক হাজার দুইশত) টাকা দরে ভাড়া দিলেন। এবং শর্ত করে যে, ছয় মাস পর ঋণপ্রার্থী ঐ ফ্রিজটি পুনরায় ২০,০০০/- টাকা মূল্যে ক্রয় করে নিবেন। এতে করে বিনিয়োগ দাতা ফ্রিজের ভাড়ার নামে ছয় মাসে মুনাফা পেল ৭২০০/- (সাত হাজার দুইশত) টাকা এবং ছয় মাস পর ফ্রিজের মূল্য ফেরত বাবদ পেল ২০,০০০/- (বিশ হাজার) টাকা।
৪র্থ পদ্ধতি : এই বিনিয়োগের তরিকা হল, এক ব্যক্তি ফাল্গুন-চৈত্র মাসে প্রতি হাজারে ৩/৪ মণ ধান দরে লগ্নী করেন যা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পরিশোধ যোগ্য। সমস্যা দেখা দেয় পরিশোধের সময় গরিব বেচারা এত ধান পাবে কোথায়। অথবা যারা ১/২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করেছেন তারা এত ধান পাবে কোথায়। সমাধান কল্পে ঐ ব্যক্তি ঋণ গ্রহীতাকে নিয়ে চলে যায় তার পূর্ব নির্ধারিত ধানের আরতে বা ধান বোঝাই নৌকায়। অতপর ঋণগ্রহীতা বাজার দর হিসাব করে ধানের যা মূল্য আসে (মনে করেন হাজারে ৩ মণ ধরে এক লক্ষ টাকার লগ্নী ধান তিন শত মণ ৫০০ (পাঁচ শত) টাকা দরে তিন শত মণ ধানের মূল্য ১,৫০,০০০/- (এক লক্ষ পঞ্চাশ) হাজার টাকা। উক্ত টাকা ঋণ গ্রহীতা নৌকা বা আড়তের ব্যাপারীকে দিয়ে বলেন যে, আমি আপনার নৌকা বা আড়ত থেকে তিনশত মণ ধান ক্রয় করিলাম। এবং তা (লগ্নীদাতাকে লগ্নী পরিশোধার্তে দিয়ে দিলাম। এবার লগ্নীদাতা যেহেতু তিন শত মণ ধানের মালিক হয়ে গেলে তাই উক্ত ধান পুনরায় নৌকা বা আড়তের ব্যাপারীর কাছে এক হাজার টাকা কমে অর্থাৎ এক লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে আসে। এতে করে ঐ ব্যক্তি মুনাফা ও মূলধন মিলে এক লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার টাকা পাইলেন। নৌকা বা আড়তের ব্যাপারী উক্ত কর্মটি সম্পাদন করে দেওয়ায় এক হাজার টাকা পেলেন। উল্লেখ্য উক্ত ক্রয়বিক্রয়ে কোন মাপ বা ওজন কিছুই করা হয় না। এমনকি উক্ত নৌকা বা আড়তে তিন শত মণ ধান আছে কি না? এ ব্যাপারেও কোন খোঁজ খবর থাকে না।
দলিলসহ পদ্ধতিগুলোর সমাধান দিয়া চির কৃতজ্ঞ করিবেন।
প্রশ্নে বর্ণিত সবকটি লেনদেনই নাজায়েয। এসব পদ্ধতি সুদ গ্রহণের অপকৌশলমাত্র। আর সুদ যেমনিভাবে সরাসরি হারাম তেমনিভাবে তা গ্রহণের জন্য হীলা বাহানা অবলম্বন করাও হারাম।
জেনে রাখা দরকার যে, ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেন বাস্তবমুখী কারবার। যা মালিকানা পরিবর্তন ও পণ্য হস্তান্তরের বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত।
কিন্তু প্রশ্নোক্ত সবকটি পদ্ধতিতেই দেখা যাচ্ছে, পণ্য প্রথমে যার কাছে ছিল তার কাছেই থেকে যাচ্ছে। মাঝে শুধু বিভিন্ন লেনদেনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন প্রথম পদ্ধতি এক মাধ্যম হয়ে
এ পণ্যই আবার দোকানীর কাছে বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
অথচ পণ্য পূর্বে থেকে দোকানীর কাছেই আছে।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতেও গ্রাহক সমিতির এক প্রতিনিধি থেকে পণ্য নিয়ে সমিতিরই আরেক প্রতিনিধির নিকট বিক্রি করে দিচ্ছে। অর্থাৎ সমিতির মাল সমিতির কাছেই থেকে যাচ্ছে।
তেমনি তৃতীয় পদ্ধতিতেও ফ্রিজ যার কাছে ছিল তার কাছেই আছে। মাঝে শুধু ফ্রিজের ক্রয়-বিক্রয় ও ভাড়ার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। একইভাবে চতুর্থ পদ্ধতিতেও ধানের আড়তে বা ধানবোঝাই নৌকায় গিয়ে শুধু ধান ক্রয়-বিক্রয়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ধান
যার কাছে যেভাবে ছিল তার কাছেই থেকে যাচ্ছে।
সুতরাং প্রশ্নোক্ত কোন পদ্ধতিতেই টাকাদাতা ও গ্রহীতা কোন পক্ষেরই বাস্তবিক অর্থে পণ্য লেনদেন করা উদ্দেশ্য নয়। বরং গ্রাহককে ঋণ দিয়ে মেয়াদান্তে তার থেকে অতিরিক্ত নেওয়ার ছুতা হিসেবে এ পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা হয়েছে।
জানা কথা যে, ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত নেওয়া সুদ। যেমনিভাবে সুদ হারাম ও ঘৃণিত তেমনিভাবে তা গ্রহণের জন্য হীলা-বাহানা অবলম্বন করাও হারাম ও ঘৃণিত। মনে রাখা দরকার যে, কোন ছুঁতা বা হীলা-বাহানা অবলম্বন করলেই সুদী লেনদেন বৈধ হয়ে যায় না। কারণ শরীয়তে মুআমালাত তথা লেনদেনের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ও হাকীকতের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কোন সুদী কারবারের শুধু নাম বদলে দিলেই তা বৈধ হয়ে যায় না।
অতএব মুসলমানের কর্তব্য হল, এ ধরনের হীলা-বাহানার মাধ্যমে উপার্জন না করে শরীয়ত স্বীকৃত পন্থায় লেনদেন করা। এবং সামর্থ্য থাকলে করযে হাসানা প্রদান করা।