আমি দীর্ঘদিন যাবত মাছের ব্যবসা করছি। আমি মাছের আড়ৎ এর মালিক। এই ব্যবসার পদ্ধতি হচ্ছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী ও সাগর পাড়ে একদল মাছ ব্যবসায়ী থাকেন, যাদের সাথে ঢাকাসহ জেলার মাছের আড়তদারগণ প্রতি এক বছরের জন্য একটি চুক্তি করে থাকেন যে, আড়তের মালিক পক্ষ ঐ নদীর পাড়ের মাছ ব্যবসায়ী-যাকে আমরা পার্টি/ব্যাপারী বলে থাকি-তাকে নির্দিষ্ট অংকের যেমন, পাঁচ অথবা দশ লক্ষ টাকা দিবে এই কথার উপর যে, ঐ পার্টি এক বছর ঐ আড়তদারকে মাছ দিবে। আর ঐ মাছ বিক্রি করে দেওয়ার জন্য আড়তদার সেই ক্রয়-বিক্রয় থেকে নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবে। কিন্তু এই ক্রয়-বিক্রয়ের লাভ/লোকসানের সম্পূর্ণ মালিক হচ্ছেন ঐ পার্টি। আর ঐ যে পূর্বে ৫/১০ লক্ষ টাকা পার্টিকে দেওয়া হয়েছে সেটা আড়তদার এবং পার্টি অর্থাৎ উভয় পক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে পার্টির কাছ থেকে আড়তদার (মালিক পক্ষ) এক বছরে প্রতিদিন কিছু কিছু করে কেটে রাখবে। এরপর বছর শেষে আবার নতুন করে হিসাব শুরু হবে। দেশের সমস্ত আড়তের কার্যক্রম এভাবেই চলছে। শত শত আড়তদারগণ এই নিয়মেই ব্যবসা করছেন। সম্মানিত মুফতীগণের নিকট আমার জিজ্ঞাসা এই ব্যবসাটি কতটুকু শরীয়তসম্মত? হালাল নাকি হারাম? কুরআন-হাদীসের আলোকে বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
প্রশ্নে বর্ণিত লেনদেনটি জায়েয নয়। এটি মূলত ঋণ প্রদান করে তা থেকে উপকৃত হওয়ার একটি পন্থা। কেননা এক্ষেত্রে আড়তদার মাছের ব্যবসায়ীকে ঋণ না দিলে ঐ ব্যবসায়ী তার কাছে মাছ নিয়ে আসত না এবং সে তা থেকে আড়তদারি কমিশনও পেত না। আর কাউকে ঋণ দিয়ে তার থেকে শর্ত করে উপকৃত হওয়া সুদের অন্তর্ভুক্ত। ফাযালা ইবনে উবাইদ রা. বলেন, প্রত্যেক ঋণ, যা লাভ নিয়ে আসে তা সুদের অন্তর্ভুক্ত। (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৫/৩৫০)
দ্বিতীয়ত এক্ষেত্রে আড়তদার মাছের ব্যবসায়ীকে ঋণ দিচ্ছে এ শর্তে যে, ব্যবসায়ী তার মাছগুলো আড়তদারের কাছে নিয়ে আসবে এবং সে এগুলো বিক্রি করে দিয়ে ব্যবসায়ী থেকে কমিশন নিবে। আর এভাবে এক কারবারের সাথে আরেকটি চুক্তি শর্তযুক্ত করা, বিশেষ করে ঋণ প্রদানের সাথে এভাবে অন্য লেনদেনের শর্ত করা নাজায়েয। হাদীস শরীফে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই কারবারে আরেকটি চুক্তির শর্ত করা থেকে নিষেধ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৭৮৩)
আরেক বর্ণনায় আছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, একই কারবারে আরেকটি চুক্তি শর্তযুক্ত করা সুদের অন্তর্ভুক্ত। (সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ১০৫৩)
আরেক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের সাথে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি শর্তযুক্ত করা অবৈধ বলেছেন। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১২৩৪)
সুতরাং প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিতে লেনদেন করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে বৈধভাবে কারবার করতে চাইলে ব্যবসায়ীর সাথে মাছের আগাম খরিদের চুক্তি করা যেতে পারে। যাকে পরিভাষায় বাইউস সালাম বলা হয়। তখন এক বছরের জন্য মাছের ব্যবসায়ী থেকে নির্ধারিত পরিমাণ মাছ অগ্রিম মূল্যে ক্রয় করে ব্যবসায়ীকে পুরো মূল্য নগদে পরিশোধ করে দিবে। এক্ষেত্রে মাছের প্রকার, সাইজ, মান ও পরিমাণ সবকিছু চুক্তির সময়ই ভালোভাবে ঠিক করে লিখে নিতে হবে।
এভাবে মাছের আগাম খরিদ চুক্তি করার পর মাছের ব্যবসায়ী যখন আড়তদারকে মাছ এনে দিবে তখন আড়তদার এগুলোর মালিক হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে মাছ বিক্রির পর লাভ-ক্ষতি সব আড়তদারের হবে। যা লাভ হবে সে-ই পুরোটার মালিক হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে মাছের ব্যবসায়ী যদি আগাম খরিদ চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত আরো মাছ নিয়ে আসে তবে আড়তদার তা বিক্রি করে দিতে পারবে এবং এর বিনিময়ে কমিশনও নিতে পারবে। কিন্তু বাইউস সালামের সাথে এমন কোনো শর্ত করা যাবে না।