আমাদের এলাকায় অনেক দিন যাবৎ সিন্দুকের মতো করে কবর খনন করে কবরের নিচের অংশ একেবারে সমান করে দেয়া হয়। তার উপর লাশ চিত করে শোয়ানোর পর শুধু মাথা কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর কবরের একেবারে উপরের অংশে বাঁশ দিয়ে তার উপর মাটি দেয়া হয়। যার কারণে লাশ এবং বাঁশের মাঝে অনেক দূরত্ব থাকে, ফলে হিংস্র প্রাণী কতৃর্ক লাশ নষ্ট করার বা বর্ষাকালে অল্প দিনে কবর নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
এ বিষয়ে এলাকাবাসীর সাথে কথা বললে তারা বলে, আমরা পূর্ব থেকে এমন করে আসছি এবং দেখে আসছি।
উল্লেখ্য, আমাদের এলাকায় অনেক বড় বড় আলেম রয়েছে, তারা এটা নিষেধ করলে এলাকাবাসী তাদের সাথে ফিতনা সৃষ্টি করে।
এখন আমাদের জানার বিষয় কয়েকটি—
১. কবর খনন করার শরয়ী পদ্ধতি কয়টি এবং কী কী?
২. লাশ কবরে শোয়ানো এবং মাটি দেয়ার উল্লেখিত পদ্ধতি শরীয়তসম্মত কি না? যদি না হয় তাহলে তার শরয়ী পদ্ধতি কি?
৩. শরীয়তসম্মত পদ্ধতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের করণীয় কী?
১. কবর খনন করার শরয়ী পদ্ধতি দুইটি—
এক. لحد (লাহ্দ)। কোনো কোনো এলাকায় একে বুগলী কবরও বলা হয়। এর পদ্ধতি হল, প্রথমে চার কোণা বিশিষ্ট একটি গর্ত খনন করবে। যা লম্বায় মায়্যিতের উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি হবে এবং চওড়া হবে লম্বার অর্ধেক পরিমাণ। আর গভীরতার ক্ষেত্রে মায়্যিতের দেহ যতটুকু লম্বা ততটুকু গভীর হওয়া উত্তম। তবে সর্বনিম্ন তার অর্ধেক পরিমাণ গভীর হলেও চলবে। এরপর কিবলার দিকে করে মায়্যিতকে শোয়ানোর জন্য ঐ গর্তের ভেতরে ডান দিকে আরেকটি ছোট গর্ত খনন করবে। এই ছোট গর্তটির গভীরতা মায়্যিতের দেহের প্রশস্ততার চেয়ে একটু বেশি হবে এবং জমিনের অংশ এতটা ঢাল হবে যে, মায়্যিতকে শোয়ালেই তার সিনা কিবলামুখী হয়ে যায়। অতঃপর উক্ত গর্তের ভেতর মায়্যিতকে রেখে গর্তের মুখে বাঁশ ইত্যাদি খাড়া করে দিয়ে ছোট গর্তটি বন্ধ করে দেবে।
দুই. কবর খননের দ্বিতীয় পদ্ধতিকে বলা হয় : شق (শাক্ক)। যাকে অনেকে সিন্দুক কবরও বলে। এর পদ্ধতি হল, প্রথমে মায়্যিতের কোমর বা সিনা সমপরিমাণ একটি গর্ত খনন করবে। এরপর তার মাঝ বরাবর আরেকটি ছোট গর্ত খনন করবে। এই গর্তের প্রশস্ততা মায়্যিতকে কিবলামুখী করে শোয়াতে যতটুকু প্রশস্ততার প্রয়োজন হয় ততটুকু রাখবে এবং গভীরতা মায়্যিতের দুই কাঁধের প্রশস্ততার চেয়ে একটু বেশি রাখবে। এরপর উক্ত ছোট গর্তের উপর বাঁশ ইত্যাদি বিছিয়ে উপরের পুরো অংশ মাটি দিয়ে ভরে দেবে।
যেসব জায়গার মাটি শক্ত ও মজবুত সেখানে লাহ্দ তথা বুগলী কবর খনন করাই সুন্নত। তবে যেসব জায়গার মাটি নরম সেখানে সিন্দুক কবর খনন করবে। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৬৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩২০০; আলমাবসূত, সারাখসী ২/৬১; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৯০; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২২৬; হালবাতুল মুজাল্লী ২/৬২২; রদ্দুল মুহতার ২/২৩৪
২. প্রশ্নে কবর খনন ও মায়্যিতকে কবরে রাখার যে পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। কেননা সেখানে একটিই গর্ত করা হয় এবং বাঁশ ইত্যাদি কবরের একেবারে উপরে দেওয়া হয়। ফলে মাঝে অনেক ফাঁকা থেকে যায়। যার কারণে অল্পদিনে বা সামান্য বর্ষণে কবর ভেঙ্গে যাওয়ার এবং হিং¯্র প্রাণী কর্তৃক লাশ নষ্ট করার আশংকা তৈরি হয়। সে আশংকা প্রশ্নেও উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিতে নিচের জমিন একেবারে সমতল রাখা হয় এবং মায়্যিতকে চিত করে শোয়ানো হয়। অথচ মায়্যিতকে ডান কাতে কিবলামুখী করে শোয়ানো সুন্নত। আর কবর দেওয়ার শরয়ী ও নিরাপদ পদ্ধতি হল, যা উপরে প্রথম প্রশ্নের উত্তরে লেখা হয়েছে। —মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১১৭৭৯, ১১৭৮৩; বাদায়েউস সানায়ে ২/৬৩; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৬৬; শরহুল মুনইয়া, পৃ. ৫৯৫; হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাল মারাকী, পৃ. ৩৩৩; আদ্দুররুল মুখতার ২/২৩৬
৩. শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে কবর বানানোর প্রচলন করার জন্য এলাকার বিজ্ঞ আলেমগণ চেষ্টা চালাবেন এবং মানুষকে হিকমতের সাথে বোঝাবেন। তাদের সহযোগিতায় এক-দুটি কবর খনন করে নমুনাস্বরূপ দেখাবেন। এর উপকারিতাগুলো মানুষকে বলতে থাকবেন। এভাবেই ধীরে ধীরে শরীয়তসম্মত কবর খনন শুরু হবে ইনশাআল্লাহ। কোনো এলাকার দীর্ঘদিনের প্রচলন এক-দুদিনের কথায় বা কঠোরতা করে পরিবর্তন করা যায় না; বরং হিকমতের সাথে বুঝিয়ে করতে হয়।