গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিজেএমসি নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল লোকসানের কারণে বন্ধ ঘোষণা করেছে। এতে চাকরিরত সকলকে চাকরিশেষে প্রাপ্য গ্রাচুইটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে সরকার সবার প্রাপ্য অর্থের অর্ধেক নগদ চেক/ক্যাশ টাকা প্রদান করবে। বাকি অর্ধেক বাধ্যতামূলকভাবে সঞ্চয়পত্র প্রদান করবে। অন্যান্য সঞ্চয়পত্র সাধারণত যখন ইচ্ছা বিক্রয় করা যায়। কিন্তু এই সঞ্চয়পত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিক্রয় করা যাবে না। তবে যেহেতু পাটকল শ্রমিকগণ বহুদিন বেতন-বোনাস না থাকার কারণে আর্থিক দুরবস্থায় নিপতিত। চাকরি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চাকরিহারা হয়ে আরো বিপদে নিপতিত হচ্ছে। তাই সরকার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ প্রতি মাসে উত্তোলন করার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। আগে থেকেই বেতন-বোনাস বঞ্চিত আর্থিক সংকটে নিপতিত পাটকল কর্মকর্তা কর্মচারী শ্রমিকরা সবগুলো টাকা একসাথে হাতে পেলে কাজে লাগাতে পারত। কিন্তু অর্ধেক বাধ্যতামূলক সঞ্চয়পত্র প্রদানের কারণে মহা আর্থিক বিপদে নিপতিত হতে হচ্ছে। আমরা জানি সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ সুদ যা হারাম। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বিক্রয় অযোগ্য বাধ্যতামূলকভাবে সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশের কী হুকুম হবে? কুরআন ও হাদীসের আলোকে উত্তর জানিয়ে বাধিত করবেন।
সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ গ্রহণ করা জায়েয নেই। কারণ তা সুস্পষ্ট সুদ। যেমনটি আপনিও জানেন। আর কুরআন মাজীদ এবং হাদীস শরীফে সুদ গ্রহণের ভয়াবহতার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ، فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللهِ وَرَسُولِهِ.
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও; যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক। যদি তা না কর (সুদের বকেয়া না ছাড়, সুদের কারবার অব্যাহত রাখ) তাহলে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ হতে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও। [সূরা বাকারা (২) : ২৭৮-২৭৯]
অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَس.
যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। [সূরা বাকারা (২) : ২৭৫]
নিম্নোক্ত কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল-
(এক) হাদীস শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
اجْتَنِبُوا السّبْعَ المُوبِقَاتِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا هُنّ؟ قَالَ: الشّرْكُ بِاللهِ، وَالسّحْرُ، وَقَتْلُ النّفْسِ الّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلّا بِالحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا.
তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাক। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা। জাদু করা। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। সুদ খাওয়া...। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৬৬, ৬৮৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৯)
(দুই) হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
رَأَيْتُ اللَّيْلَةَ رَجُلَيْنِ أَتَيَانِي، فَأَخْرَجَانِي إِلَى أَرْضٍ مُقَدَّسَةٍ، فَانْطَلَقْنَا حَتَّى أَتَيْنَا عَلَى نَهَرٍ مِنْ دَمٍ فِيهِ رَجُلٌ قَائِمٌ وَعَلَى وَسَطِ النَّهَرِ رَجُلٌ بَيْنَ يَدَيْهِ حِجَارَةٌ، فَأَقْبَلَ الرَّجُلُ الَّذِي فِي النَّهَرِ، فَإِذَا أَرَادَ الرَّجُلُ أَنْ يَخْرُجَ رَمَى الرَّجُلُ بِحَجَرٍ فِي فِيهِ، فَرَدَّهُ حَيْثُ كَانَ، فَجَعَلَ كُلَّمَا جَاءَ لِيَخْرُجَ رَمَى فِي فِيهِ بِحَجَرٍ، فَيَرْجِعُ كَمَا كَانَ، فَقُلْتُ مَا هَذَا؟ فَقَالَ: الَّذِي رَأَيْتَهُ فِي النَّهَرِ آكِلُ الرِّبَا.
‘আমি (স্বপ্নে) দেখলাম, আজ রাতে আমার কাছে দু’জন মানুষ এল এবং তারা আমাকে একটি পবিত্র ভূখণ্ডে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্তের নদীর কিনারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, নদীতে একব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। আর নদীর কিনারে অপর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে রয়েছে পাথর। যখন নদীর লোকটি কিনারে উঠতে চায় তখন কিনারে থাকা লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরের আঘাতে লোকটি যেখানে ছিল পুনরায় সেখানে ফিরে যায়। এরপর সে আবারও নদীর কিনারে উঠতে চায়, এভাবে সে যখনই কিনারে উঠতে চায় তখনই তাকে পাথর মেরে যেখানে ছিল সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, একে? বললেন, রক্তের নদীতে অবস্থিত যে লোকটিকে দেখেছেন সে হল সুদ ভক্ষণকারী।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৮৫)
(তিন) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহণকারী এবং সুদ প্রদানকারীর উপর লানত করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৭)
অতএব, আপনাদের জন্য জরুরী হল, সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ সর্বাবস্থায়ই সুদ ও হারাম। ‘নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বিক্রয় অযোগ্য’ এমন শর্ত থাকার কারণে সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশ গ্রহণ করা জায়েয হয়ে যাবে না। কেননা যে সময়টায় তা বিক্রি করা যাবে না ঐ সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশই তো দিচ্ছে। লভ্যাংশ ব্যতীত পৃথক কোন উপঢৌকন তো সরকার দিচ্ছে না। আর এ লভ্যাংশটাই সুদ। তাহলে তা কীভাবে গ্রহণ করা জায়েয হতে পারে! আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সুদ এবং সকল প্রকার হারাম থেকে বিরত থাকার তৌফিক নসীব করুন-আমীন।