আমরা হব তাঁদের মতো
মুহাম্মাদ আওয়ামা
আবু নাসর হারুন বিন মুসা বিন জানদাল (৪০৬ হি.) নামে নাহুর একজন বিখ্যাত ইমাম ছিলেন।
তিনি একবার বললেন, ‘আমরা আবু আলী কালী বাগদাদী রাহ.-এর কাছে তাঁর রচিত ‘নাওয়াদের’ নামক বিখ্যাত কিতাবটি পড়তে আসতাম। কর্ডোভার ঐতিহ্যবাহী ‘যাহরা’ জামে মসজিদে। তখন ছিল বসন্তকাল। একদিন আমি তাঁর দরসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথে হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টির কবলে পড়ে যাই। তবু আমি পথ চলতে থাকি। শায়খের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার জামা-কাপড় ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেল। শায়খের সামনে বসা কর্ডোভার বিখ্যাত সব মনীষী। ভেজা কাপড়-চোপড় নিয়ে মজলিসে বসতে আমার কেমন যেন লাগল। বুঝতে পেরে শায়খ আবু আলী কালী রাহ. বললেন, হে আবু নাসর! যা হয়েছে, তা নিয়ে দুঃখ করো না। একি কোনো ব্যাপার হল! ব্যস, কাপড় পাল্টে নিলেই হল। অথচ আমি তো এমন জখমের মুখোমুখি হয়েছি, যার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে শরীরে, আর তা নিয়েই যেতে হবে কবরে।
অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি আমার শায়খ কারী ইবনে মুজাহিদ রাহ. (৩২৪ হি.)-এর কাছে পড়তে যেতাম। একবার তাঁর দরসের প্রথম কাতারে বসার জন্য আমি রওনা হয়ে গেলাম খুব গভীর রাতে। গিয়ে দেখি, তার মজলিসে যাওয়ার প্রবেশ-ফটকটি বন্ধ। কোনমতেই তা খুলতে পারি না। আমি মনে মনে বললাম, সুবহানাল্লাহ! এত সকাল সকাল এলাম। এরপরও পেছনে পড়ে থাকবো আর অন্যরা চলে যাবে সামনে! নাহ! তা হতে পারে না। খুঁজতে খুঁজতে বাড়িটির পার্শ্বদেশে একটি ঢালু সুড়ঙ্গ পথ দেখতে পেলাম। আমি আগ-পিছ না ভেবে সরু ও সংকীর্ণ ঐ পথে ঢুকে পড়ি। হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে যেতে থাকি খুব কষ্ট করে। মধ্যপথে গিয়ে আটকে পড়ি। সামনের দিকে পথ এতটাই সরু যে, না পারি ঢুকতে; না পারি বের হতে। তবু দমবার পাত্র নই আমি। পা আর হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি জোর করেই শরীরটাকে ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। কাপড় তো ছিড়ে যাচ্ছে-ই; মনে হচ্ছে, গোশতও খসে যাচ্ছে। তবু আমি সামনে চললাম। এক সময় আমি ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হই, দেখ্তে পাই শায়খের মজলিস। যন্ত্রণায় কুঁকড়াতে কুঁকড়াতে শরীরের দিকে একবার তাকালাম। দেখলাম, গোশত পুরোটা খসে পড়ে হাড্ডিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! অতএব হে আবু নাসর! আমার তুলনায় তোমার তো কিছুই হয়নি। (কবিতা) ‘মর্যাদা ও মহত্ত্বের জন্যে তুমি হামাগুড়ি দিয়েছ অথচ যাত্রীরা পৌঁছেছে সেথায়, বিরামহীন কষ্টে আর আরাম-আয়েশ ছুড়ে ফেলে/ক্লান্ত হয়ে পড়েছে প্রায়ই, কিন্তু অনেকে চালিয়েছে লড়াই/ মর্যাদার দেখা পেয়েছে সেই, যে তার হক্ক পূর্ণ করেছে আর করেছে সবর/ভেবোনা মর্যাদাকে একটি খেজুরসম; শুধু গিলে নিলেই হল, তিক্ততার আস্বাদন বিনে পারবে না কভু মর্যাদার আসনে আসীন হতে।
আবু নাসর নাহবী বলেন, ‘নাওয়াদের’-এ কবিতার এই ছন্দগুলি আসার আগেই আমরা লিখে নিলাম। ভুলে গেলাম বৃষ্টিতে ভেজার দুঃখ। শায়খের মৃত্যু অবধি আমি আর তাঁর সঙ্গ ছাড়িনি।
সূত্র : আস্-সিলা, ইবনে বাশকুয়াল ২/৬৫৬, ১৪৪১ অনুবাদ : ইবনে দানিশ