উ ম্মা হ : মিসরের মুখে কার ছবি
এত বড় ও বর্বর রক্তপাত! নিরস্ত্র জনতার উপর ওই দেশেরই সেনাবাহিনীর। এ যেন কল্পনাকেও হার মানায়। ট্যাংক-কামান, ব্রাশফায়ার, বন্দুকের গুলি একসঙ্গে। হাজার হাজার মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা। একদিন, দুদিন, তিনদিন। গত ১৪ আগস্ট থেকে পর পর কয়েক দিন। বেপরোয়া রক্তের পিপাসা। এরপর আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে দেওয়া। আহত আশ্রয়ীদের দমন করতে ঐতিহাসিক কয়েকটি মসজিদ জ্বালিয়ে ছারখার করে দেওয়া। দু’সপ্তাহ আগের মিসরের চিত্রটি এরকমই ছিল। এখনও ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে। এখনও থেমে থেমে হত্যা ও ধরপাকড় চলছে।
দীর্ঘকাল স্বৈর শাসনের পর প্রথম বারের মতো নির্বাচিত সরকার প্রধানকে গত ৩ জুলাই বন্দি করে নিয়ে যায় মিসরের সেনাবাহিনী। সেনা প্রধান আব্দুল ফাত্তাহ সিসি একটি গোঁজামিলের নতুন সরকার গঠন করেন। সে সরকার স্থগিত করে দেয় খসড়া সংবিধানের ইসলামী শরীয়াহ বিষয়ক ধারা। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমীনের কর্মী-সমর্থকরা। রাজপথে অবস্থানরত প্রতিবাদী জনতাকে প্রায় ৪১ দিন পর নজিরবিহীন গণহত্যার মধ্য দিয়েই দমন করা হয়। গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনেই সব ঘটানো হয়। কিন্তু বাধা দেওয়ার মতো কোনো ধ্বনি কোথাও উচ্চারিত হয় না। দেশে দেশে ক্ষমতাসীন মুসলিম উম্মাহর দরদী ভাই-বোনেরা এ ঘটনায় অশ্রু মুছেন উদ্বেগে-কষ্টে। তবে শাসকরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন কিংবা কেউ কেউ সমর্থনও দিয়ে যান হত্যা ও বর্বরতায়।
সাম্প্রতিককালে এ জাতীয় ঘটনার নজির পাওয়া যাবে কেবল চাপিয়ে দেওয়া কয়েকটি যুদ্ধের ক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ সংকটে এ জাতীয় গণহত্যার নজির খুবই কম। মিসরের সেনাবাহিনী সে নজির বীরত্বের সাথেই স্থাপন করল। নিজ দেশের ভাইদের হত্যা করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল যে সেনাবাহিনী, তারা গত ৫০ বছরে আগ্রাসী প্রতিবেশী ইহুদী ইসরাইলের সৈনিকদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি। বড় বেদনার সঙ্গে পৃথিবীর মুসলমানরা এ দৃশ্যটা দেখল। যাদের করবার মতো কিছুই নেই সেই শাসন-ক্ষমতাহীন মুসলিম জনগণ পুরো ঘটনায় বিমর্ষ হলেন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর খেদমত ও নেতৃত্বের ঠিকাদার কয়েকজন শাসক উল্টো সিসি নেতৃত্বের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। এভাবে মুসলিম দেশে দেশে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী জনগণের সঙ্গে তাদের বর্তমান শাসকদের এক অদ্ভুত দূরত্বের উদাহরণ হয়ে গেল মিসর।
মিসরে গণহত্যার শিকার হাজারো মানুষ ছিলেন ইসলামী শাসনের সমর্থক নির্বাচিত বৈধ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিদার। আর যারা তাদের হত্যা করেছে তারা মুসলিম দেশে সেকুলার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা। প্রশ্ন উঠেছে, কেবল এ জন্যই কি এই সেকুলার বর্বরতা নিয়ে পশ্চিমা মোড়লরা নিশ্চুপ? এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কি মুসলিম দেশগুলোতে সেকুলার ও ইসলাম-উচ্ছেদকামী শক্তির হাতে নির্বিচার হত্যা ও বর্বরতা চালানোর আন্তর্জাতিক সম্মতিপত্র দিয়ে দেওয়া হলো? এ ঘটনার অন্তর্গত চরিত্রটিকে কি কেবল মিসরের মাঝে সীমাবদ্ধ মনে করার কোনো যুক্তি আছে? বিশ্লেষকরা বলেছেন, মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী অনুশাসন প্রত্যাশী নিরস্ত্র জনগণের আওয়াজ বন্ধ করার এ এক নতুন অনুশীলিত ফর্মুলা। মিসর এখন মুসলিম দেশগুলোর ছবি। মিসরের দিকে চোখ রাখলে সব মুসলিম দেশের ইসলামপ্রেমী জনতা ও সেকুলার শাসক গোষ্ঠীর চেহারা ভেসে উঠবে। সেকুলার রাজনীতিক, প্রশাসক, আমলা ও বাহিনীর হাতে নির্বিচার গণহত্যার ‘সম্মতি-সমর্থন’ পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে যেন অবধারিত। নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মানবতা ও ন্যুনতম চক্ষুলজ্জার সেখানে কোনোই স্থান থাকবে না। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? কত দেশে চলতে পারবে?
মিসরে প্রতিবাদী হাজারো মুরসিসমর্থক হত্যার পর সরকারী ভাষ্যে বলা হচ্ছে, সন্ত্রাস দমনের জন্য এটা করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের এ প্রক্রিয়া চলবে। সেকুলার গণমাধ্যমগুলোতেও একই সুর ধ্বনিত হচ্ছে। হত্যার পর লাশ ও রক্তের সমুদ্রে আগুন ধরিয়ে দিয়েও তারা ‘সন্ত্রাস দমনের’ কথা বলছে। গণহত্যা নিয়ে মিন মিন করে কিছু কথা বললেও পশ্চিমা মোড়ল দেশগুলো ‘সন্ত্রাস দমনে’ সিসিকে অব্যাহত সমর্থন জুগিয়েই যাচ্ছে। আর গণবিচ্ছিন্ন ও পাশ্চাত্যনির্ভর আরব শাসকরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হাতে নিয়ে মিসরের সেকুলার সেনাশাসককে বাহবা দিয়ে যাচ্ছে। মিসের দিকে তাকালে বিবেক ও বিচারের চোখ এখন অন্ধ হয়ে যায়। মিসরের মুসলমানদের এই দুঃসময়ে একজন মাত্র মুসলিম নেতা মানুষের মতো শব্দ করে অশ্রু ঝরিয়েছেন। তিনি তুরষ্কের প্রধানমন্ত্রী তাইয়েব এরদোগান। তার পাশে আর কেউ নেই। এরদোগানের চোখের পানি দুনিয়াজুড়ে কোটি কোটি মানুষের গাল ভিজিয়েছে।
কাছাকাছি সময়ে কাছাকাছি ঘটনা। রাজপথে ইসলামের পক্ষের প্রতিবাদী নিরস্ত্র মুসলিমদের ওপর সশস্ত্র হামলা। নিজ দেশের শান্তিরক্ষীদের ‘হাতে হত্যা, রক্ত ও লাশের অবমাননা। দুটিই মুসলিম দেশের রাজধানী। হামলাকারী শাসক শক্তির একই চরিত্র। হামলার পর একই ভাষা, একই সুর, একই অমানবিকতা। হত্যার পরিমাণ, সংখ্যা ও অবস্থান-মেয়াদে কিছু ভিন্নতা থাকলেও হামলাকারীদের চেতনা ছিল অভিন্ন। উভয় দেশেই তারা সেকুলার। উভয় দেশেই তারা ইসলামের পক্ষের মানুষদের শত্রু। উভয় দেশেই তারা বিপথগামী গণমাধ্যমের বিকৃত সমর্থনধন্য। উভয় দেশেই তারা পশ্চিমা মোড়লদের নীরব সম্মতিপ্রাপ্ত।
পর্যবেক্ষকরা এখন বেদনার সঙ্গেই বলেন, সামনের পৃথিবীতে বর্বর, নৃশংস সেকুলার ও ঈমানবিদ্বেষী গোষ্ঠীকে হিসাবে নিয়েই মুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানদের বাঁচতে হবে। মুসলমানরা যত শান্ত-নির্বিরোধ জীবনই যাপন করুক, অপর পক্ষের হাতে থাকবে মারণাস্ত্র। সুবোধ গৃহস্থের পাশেই থাকবে সশস্ত্র ডাকাতের বাস। অসতর্ক উদারতার ঘোর তৈরি হলেই ডাকাতেরা কামান-বন্দুক নিয়ে হামলে পড়বে। এ এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় হিসাব। এ এক অবধারিত অংক। ঈমান নিয়ে বাঁচতে চাইলে এ অংক এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ এখন আর কোনো মুসলিম দেশেই থাকবে না।
দুঃখী পর্যবেক্ষকদের এসব ঠান্ডা অংকের কথা আমাদের মাথায় ঢুকতে চায় না। নিশ্চিন্ত ঘুমের মধ্যেই সামনের দিনগুলো পার করে দিতে চাই। কিন্তু না চাইলেও সেই ঘুম বার বার ভেঙ্গে যায়।