মৃ ত্যু - চি ন্তা : গায়ের জোরে সব হয় না
চুপেচাপে দুর্নীতি করার গল্প পুরোনো হয়ে গেছে। এখন দুর্নীতি হয় বুক ফুলিয়ে। পুকুর চুরির জায়গায় চলে দিনদুপুরে নদীডাকাতি। বড় বড় কর্তা পর্যায়ের লোকেরা এসব করেন। আর সাধারণ মানুষ তা দেখেশুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। কী আর করা! সয়ে যাওয়া ছাড়া পথ তো নেই। কিন্তু এসব দুর্নীতি আর চুরির গল্পও এবার ফিকে হতে চলেছে। দখল আর জোরজবরদস্তির হাত পড়ছে এখন অদ্ভুত সব ক্ষেত্রে। গত ২২ আগস্ট ঢাকার একটি ট্যাবলয়েড দৈনিকের খবর সে কথাই বলছে। ময়মনসিংহ ফুলবাড়িয়ার এক সংসদসদস্যের বাড়ি তোলা হয়েছে গোরস্থান দখল করে। সাথে নাকি একটি মন্দিরের কিছু জায়গাও রয়েছে। ওই এমপি সাহেব সরকারদলীয় হওয়ায় এ দখলি কর্মকান্ডে আবার পুলিশি পাহারাদারিও কাজে লাগানো হয়েছে। দখল, পুলিশি পাহারা আর বাড়ি বানানো চলেছে মাসের পর মাস। চুরি নয়, সিনাজুরির সাথেই চলেছে দখলপর্ব। কেউ কোনো শব্দ করতে পারেনি। সরকারদলীয় এমপি বলে কথা।
দখলের ওই নমুনাটিও একদম নতুন নয়। নদী-নালা, পার্ক-গোরস্থান দখল করে বাড়িঘর বানানোর অনুশীলনটির সঙ্গে দেশের মানুষ কমবেশি পরিচিত। কিন্তু আরও অভিনব একটি দখলের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এর ক’দিন আগে। এটি একদমই নতুন ঘটনা। এমনটি আগে কখনো শোনা যায়নি। সে এক অদ্ভুত দখলি কান্ড! হ্যাঁ, এটিও ঘটিয়েছেন সরকারদলীয় এক সাবেক সংসদসদস্য। দখল আর ত্রাস সৃষ্টিতে তার ‘সুনাম’ সর্বজনবিদিত। বছর খানেক আগে সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। বহু হাকডাক করেও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেননি। এতে অবশ্য তিনি দমে যাননি। ক্ষমতার দাপট জাহিরে তার কৃতিত্ব তিনি অবিরত দেখিয়েই চলেছেন। গত ১৮ আগস্টের একটি দৈনিক পত্রিকায় তার দখল-খবর ছাপা হয়। শেষ পাতায়, সচিত্র সে খবরের মূল অংশটি ওই পত্রিকা থেকেই তুলে দেওয়া হলো।
‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে দুটি কবরের জায়গা দখল করে সীমানা প্রাচীর দিয়েছেন আওয়ামীলীগের সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে প্রাচীর নির্মাণ তত্ত্বাবধান করেন। কবরের জমি কিনতে আবেদন করার নিয়ম থাকলেও তিনি তা মানেননি। জানা যায়, তার বাবার ২৯ তম মুত্যৃবার্ষিকী ছিল গত ২০ ফেব্রুয়ারি। এর তিন দিন আগে ওই কবরস্থানে গিয়ে বাবার পাকা কবরের পাশে দুটি স্থান নির্ধারণ করেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কবরস্থান রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি করপোরেশনের কর্মী ও ভাড়াটে শ্রমিকদের দিয়ে ওই স্থান দুটির সীমানা নির্মাণ করান। শামীম ওসমান সিটি করপোরেশনের কর্মীদের বলেন, তাঁর নির্দেশ ছাড়া ওই দুটি স্থানে যেন কোনো লাশ দাফন করা না হয়। পরে ১২ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার কবর আমার বাবার কবরের পাশে নির্ধারণ করে রেখেছি।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশনের কবরস্থানের জমি কিনতে হলে আবেদন করতে হয়। কিন্তু তারপর কোনো আবেদন না করেই দুটি কবরের জায়গা দখল করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেছেন। সেখানে কাউকে দাফন করতেও তিনি বারণ করেছেন।’
মূল খবরটি শেষ। নিজের জন্য কবরের জায়গা দখল। ঘোষণা দিয়ে, আয়োজন করে। এ রকম ঘটনা আগে ঘটেছে বলে জানা যায়নি। জোর ও জবর-দখলের ব্যাপারগুলো সাধারণত ঘটে থাকে দুনিয়ার জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য। দখলকারীর মাথায় মৃত্যু ও পরকাল চিন্তা তখন সক্রিয় থাকে না। ভোগপ্রবণ পার্থিবতাই থাকে মুখ্য। সেই মানুষের মাঝেই যদি মৃত্যুচিন্তা জেগে ওঠে দেখা যায় তার এক নির্বিরোধ শান্ত রূপ। কোনো ফাসাদ-ঝগড়ায় যেতে চায় না সে। কিন্তু এখানে অদ্ভুত এক মৃত্যুচিন্তার নমুনা পাওয়া গেল। মৃত্যুর পর দাফনের জায়গাটা যেন পূর্ব থেকেই ‘নিশ্চিত বরাদ্দ’ থাকে- সেজন্য চালানো হলো দখল। দখলের প্রবণতা কি তাহলে মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও তারা ছড়িয়ে দিতে চান? গায়ের জোরে ভালো কবর আর ভালো দাফনের প্রস্ত্ততি নেওয়ার মাঝে কী সাফল্য থাকতে পারে? মৃত্যুপরবর্তী পরিণতির পরিবর্তে কেবল কবরের জায়গা নিয়ে এই অভিনব মনোযোগের পেছনে কোন্ জাহেলিয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে- আল্লাহ জানেন।
কোনো বিশ্বাসী মুসলমানের মৃত্যুচিন্তা তো তাকে মৃত্যুপরবর্তী জবাবদিহির জন্য সংযমী করে তোলার কথা। সেটাই স্বাভাবিক এবং সেটাই কাঙ্খিত। এ কারণেই মৃত্যুচিন্তা প্রশংসনীয় ও উৎসাহযোগ্য। কিন্তু মৃত্যুচিন্তা স্বাভাবিক পথে না গিয়ে মৃত্যুপরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রেও যদি জবর-দখলের মানসিকতা সক্রিয় করে তোলে তবে তো সর্বনাশের শেষ থাকবে না। দেখা যাবে, জীবনে যার ঈমান-আকীদা, দ্বীন-ধর্মের বালাই থাকছে না মৃত্যুর পর তার জানাযাতে যেন লোক সমাগম বেশি হয়- সে জন্য মহল্লার লোকদের শাসাতে সশস্ত্র অনুচর লাগিয়ে রাখবে কোনো কোনো মৃত্যু-পথযাত্রী ক্ষমতাদর্পী। সব রকম পাপ কাজে আকণ্ঠ ডুবে থেকেও কেউ কেউ তার মৃত্যুর পর সাড়ম্বর দুআ আর মাগফিরাত প্রার্থনার আয়োজনের জন্য মাস্তান নিয়োজিত করে যাবে। ক্ষমতা দিয়ে ‘পরকাল দখলের’ এই গর্হিত চেষ্টায় সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। আর এতে ওই মৃত ব্যক্তিরও ক্ষতি ছাড়া কোনো কল্যাণ হবে না। তাই মৃত্যুচিন্তার এই ‘গায়েজোরি’ নমুনা থেকে বেরিয়ে আসাই সবার কর্তব্য। বরং ক্ষমতাদর্পীদের মাঝে যথার্থ উপায়ে মৃত্যুচিন্তার জাগরণ ঘটলে ইহকালীন জীবনের নানা দখলপর্বও সংকুচিত হয়ে আসার পথ উন্মোচিত হবে। আর এতেই বরং কল্যাণ হতে পারে সব পক্ষের, সব মহলের।